তারপর এল রাত্রি।
সকলেই যে যার শয্যায় নিদ্রাভিভুত।
কেবল চোখে ঘুম ছিল না সবিতার। ভিতরে ভিতরে একটা অস্থিরতা তাকে যেন কিছুতেই সুস্থির হতে দিচ্ছিল না।
অনেক আশা নিয়ে ঘর বাঁধতে চেয়েছিল সবিতা কিন্তু সব ভেঙে তছনছ হয়ে গেল।
নির্মম ভাগ্যবিধাতা তাকে আঘাতের পর আঘাত হেনেছে বার বার কিন্তু সবিতা ভেঙে পড়েনি।
সমস্ত দুৰ্ভাগ্যকে সে বুক পেতেই গ্রহণ করেছিল। তবু সে শেষ পর্যন্ত জয়ী হতে পারল বা। কেন?
আর একজনও সে রাত্রে জেগে ছিল। কিরীটী রায়।
হঠাৎ মধ্যরাত্রির সুগভীর সুপ্তি পীড়িত হয়ে ওঠে একটা যান্ত্রিক ঠং ঠং শব্দে। উঠে। পড়ল শয্যা হতে সবিতা।
অন্ধকারেই পায়ে পায়ে সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল।
এগিয়ে চলে শব্দটাকে অনুসরণ করে।
ঘরের দরজাটা ভেজানো।
ভেজানো দরজাটা নিঃশব্দে ভিতরে পা দিল সবিতা।
পাগলের মতই একটা ছোট লোহার শাবল নিয়ে অনিল ঘরের মেঝেতে সর্বত্ৰ ঠুকে ঠুকে চলে।
কি করছ?
কে? চকিতে ফিরে দাঁড়াল অনিল। এ কি, সবিতা তুমি!
হ্যাঁ, কিন্তু কি করছে তুমি? সবিতা আবার প্রশ্ন করে শান্ত গলায়।
কিন্তু তুমি এখানে এলে কি করে?
সে প্রশ্নের জবাব পরে দেব। আগে আমার প্রশ্নের জবাব দাও। বলতে বলতে সবিতা দরজার খিলটা তুলে দিয়ে বদ্ধ দরজার গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়াল।
সবিতার দাঁড়াবার ঋজু কঠিন ভঙ্গী, তার মুখের প্রত্যেকটি রেখা, তার কণ্ঠস্বরের অদ্ভুত তীক্ষ্মতা আনিলের দৃষ্টি আকর্ষণ না করে পারে না।
এ যেন তার চেনা-পরিচিত সবিতা নয়। সেই চিরসহিষ্ণু, নির্বক নমনীয় সবিতা নয়।
এ সবিতাকে সে কোনদিন দেখেনি। কোনদিন চেনে না। এ তার বিবাহিত স্ত্রী সবিতা নয়। এ যেন অন্য কোন এক নারী।
কই জবাব দিচ্ছ না কেন? এখানে এত রাত্ৰে তুমি কি করছ?
আকস্মিক বিহ্বলতাটা অনিলের ততক্ষণে কেটে গিয়েছে। দৃপ্ত ভঙ্গীতে ঘুরে দাঁড়িয়ে অনিল বলে, যাই করি না কেন, সে জেনে তোমার কোন প্রয়োজন নেই। তুমি এখান থেকে যাও।
না! তোমার জবাব না নিয়ে আমি যাব না।
সবিতা! চলে যাও বলছি। এখান থেকে।
না। বললাম তো আগে আমার কথার জবাব দাও।
সবিতা!
না, অনেক সহ্য করেছি। তোমার অত্যাচার, অন্যায়। জুলুম মুখ বুজে এতকাল। কিন্তু আর সহ্য করবা না। জেনো সহ্যেরও একটা সীমা আছে।
সবিতা, এখনো চলে যাও বলছি!
ছি, ধিক তোমাকে! একবার ভেবে দেখ তো কোথা থেকে কোথায় তুমি নেমে এসেছ আজ! একদিন কি তুমি ছিলে, আর আজ তুমি কি হয়েছ!
সবিতা, এখনো বলছি চলে যাও এখান থেকে! চিৎকার করে ওঠে অনিল স্থানকাল ভুলে।
চল—এখান থেকে আমরা চলে যাই চল। ওপরে কিরীটীবাবু ওৎ পেতে আছেন তোমাকে ধরবেন বলে। ধরা পড়লে মেয়ের কাছে তুমি মুখ দেখাবে কি করে! কথাগুলো বলতে বলতে এগিয়ে যায় সবিতা স্বামীর দিকে। না, আর অন্যায় আমি তোমায় করতে দেব না।
এখান থেকে যাও সবিতা। আনিল বলে।
বললাম তো আমি যাব না। দৃঢ় শান্ত কণ্ঠে সবিতা বলে।
যাবে না!
না। যদি যাই তো, তোমায় সঙ্গে নিয়েই যাব-একা নয়।
তুমি যাবে না সবিতা?
না।
শাবলটা হাতে সামনে এসে দাঁড়ায় অনিল।
তার চোখের মণি দুটো যেন বাঘের মত জ্বলছে।
সবিতা!
শোন তুমি হয়তো জান না-ওপরে কিরীটীবাবু ওৎ পেতে আছেন। যদি ঘুণাক্ষরেও জানতে পারেন যে তুমি এসেছ—তোমার হাতে হাতকড়ি পড়বে। আমি জানতাম—বুঝতে পেরেছিলাম তুমি আসবেই। তাই না ঘুমিয়ে কান পেতে অপেক্ষা করেছিলাম!
কিরীটী রায় করবে আমার কচুটা!
আচ্ছা তোমার ঘৃণা লজ্জা বলেও কি কিছু নেই? নিজের সন্তানের কাছে আজ তুমি কত ছোট হয়ে গিয়েছ জান?
হিতোপদেশ!
না, হিতোপদেশ নয়—এ শুধু আমার অনুরোধ। এতকাল তো তোমার নিজের মত চলে দেখলে, এবারে না হয় ফেরো—
ফিরব বললেই আজ আর ফেরা যায় না!
যায়—খুব যায়। চল এখান থেকে আমরা পালিয়ে যাই।
পালিয়ে যাব! হ্যাঁ, দুজনে মিলে আমরা রোজগার করব। নতুন জায়গায় গিয়ে ঘর বাঁধব—যেখানে কেউ আমাদের চেনে না।
ও নাটকে আর যে-ই বিশ্বাস করুক আমি করি না, শূন্য হাতে ভাগ্যের সঙ্গে দুনিয়ার সঙ্গে যে যুদ্ধ করা যায় না সে কথাটা আর কেউ না বুঝুক কিন্তু আমি হাড়ে হাড়ে বুঝেছি। সবিতা। শোন, যে কুবেরের ঐশ্বৰ্য আমি প্রায় মুঠোর মধ্যে এনেছি সেটা আমায় মুঠো ভরে নিতেই হবে।
আকস্মাৎ একটা মতলব যেন সবিতার মাথার মধ্যে খেলে যায়। সে বলে, কিন্তু সে তুমি কোনদিনই পাবে না।
পাব-পাব!
না। তার কারণ, তোমার কাছে যে কঙ্কনটা ছিল সেটা আমি সরিয়ে ফেলেছি।
সঙ্গে সঙ্গে তাড়াক করে লাফিয়ে ভাঠে দাঁড়ায় অনিল, সবিতা!
অনিলের চোখের মণি দুটো যেন হিংস্র শ্বাপদের চোখের মণির মত জ্বলছে।
সবিতা!
হ্যাঁ, সে কঙ্কন এখন আমার কাছে। আর শুধু তাই নয়, যে কুবেরের ঐশ্বর্যের জন্যে তুমি ক্ষেপে উঠেছ তাও তোমার আগেই দুটো কঙ্কনের সাহায্যে উদ্ধার হয়েছে।
সে কি! সে কঙ্কন—
পেয়েছি। তোমার ডেরায় বাক্সর মধ্যে পেয়েছি—তুলোর ওপর রাখা ছিল।
সে কঙ্কন তুমি ঐ বামদেবকে দিয়ে দিয়েছ?
হ্যাঁ, তার জিনিস—
সবিতার কথা শেষ হল না, কেন—কোন দিলি সে কঙ্কন হারামজাদী—বলতে বলতে ঝাঁপিয়ে পড়ে লোহার মত শক্ত দু-হাতে সবিতার গলাটা চেপে ধরে অনিল।
বল বল-কেন?
নিষ্ঠুর লৌহকঠিন হাতের সেই পেষণে ক্রমশঃ সবিতার দেহটা শিথিল হয়ে এলিয়ে পড়ে।
চোখের মণি দুটো কোটর থেকে ঠেলে বের হয়ে আসে।
অনিল যেন পেষণ করে চলেছে।
আর উন্মাদের মত বলে চলেছে, বল বল-কেন?
হঠাৎ ঐ ঘরের দরজাটা দড়াম করে খুলে গেল এবং কিরীটী এসে ঘরে প্রবেশ করল।
সবিতার অনুমান মিথ্যা নয়।
সত্যিই কিরীটী বাণীর মুখ থেকে আনুপূর্বিক সব শুনে জঙ্গলের মধ্যে আনিলের ঘরে গিয়ে হানা দেয় এবং সেই ডায়েরী ও কঙ্কন উদ্ধার করে।
এবং সেও বুঝতে পেরেছিল, শেষ চেষ্টা অনিল করবেই এবং অনিল রত্নমঞ্জিলে আসবেই, তাই সে ওৎ পেতে ছিল।
কিরীটী এল বটে, কিন্তু বড় দেরিতে।
তখন যা হবার তা হয়ে গিয়েছে।
সবিতার শ্বাসরোধ হয়ে মৃত্যু ঘটেছে অনিলের নৃশংস নিষ্ঠুর পোষণে।
হাত তলুন আনিলবাবু! রহমৎ সাহেব বললেন। তিনিও কিরীটীর সঙ্গে এসেছেন। রহমৎ সাহেবের হাতে পিস্তল।
অনিলের হাত থেকে সবিতার শিথিল মৃতদেহটা ঝপ করে মাটিতে পায়ের সামনে পড়ে যায়।
এ কি আনিলবাবু-এ কি! কিরীটী চিৎকার করে ওঠে।
অনিলের সম্বিৎও বুঝি তখন ফিরে এসেছে।
সে প্রথমটায় হতবুদ্ধি হয়ে গিয়েছিল।
কিরীটীর দিকে ফিরেও তাকায় না—সে তাকিয়ে থাকে কয়েকটা মুহুর্ত ফ্যাল ফ্যাল করে ভূপতিত তারই পায়ের সামনে সবিতার দিকে।
তারপরই নিষ্প্রাণ দেহটার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে চিৎকার করে ওঠে, সবিতা-সবিতা—না—না—না–
কিরীটী স্থির নিস্পন্দ বোবা-পাথর যেন।
সবিতা-সবিতা-কথা বল সবিতা-সবিতা—আমি-আমি ওকে হত্যা করেছি—আমি আমার স্ত্রীকে গলা টিপে শ্বাসরোধ করে হত্যা করেছি! দারোগীবাবু গ্রেপ্তার করুন আমায়–ফাঁসী দিন।
এ কাহিনীর এখানেই শেষ।
ডাইরীর মধ্যে বর্ণিত সিন্দুকের কোন সন্ধানই কেউ জানতে পারেনি।
রত্নমঞ্জিলের রত্নভাণ্ডার মাটির নীচেই গুপ্ত থেকে গিয়েছে।