২৫. আত্মহত্যা নাকি খুন
পোয়ারো কি বলতে চান, তাকে জিজ্ঞাসা করার অবসরটুকুও আমি পেলাম না ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ডের জন্য। তিনি তখন নিচ থেকে হাত নেড়ে ডাকছিলেন, নিচে নেমে আসুন, জরুরী আলোচনা আছে। তাই আমরা দ্রুত নিচে নেমে আসি।
আর এক বিপর্যয়ের কাহিনী শুনুন মঁসিয়ে পোয়ারো তিনি বললেন, –সেই সন্ন্যাসী ফাদার ল্যাভিগনিকে পাওয়া যাচ্ছে না।
সেকি? চমকে উঠলেন পোয়ারো তার কথা শুনে।
হ্যাঁ, মঁসিয়ে পোয়ারো, তাকে তার ঘরে পাওয়া যাচ্ছে না। প্রথমে আমাদের কারোরই খেয়াল হয়নি তার সম্বন্ধে। ভোর হতেই আমাদের মনে হল–কই ফাদার ল্যাভিগনিকে তো দেখা যাচ্ছে না। তিনি কোথায়? তারপর তার ঘরে গিয়ে দেখি।
বাড়ির চাকরদের ডাক পড়ল, তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পর জানা গেল, তারা নাকি ফাদার ল্যাভিগনিকে গতকাল রাত আটটার পর তার রোজকার অভ্যাস মত বাড়ির বাইরে বেড়াতে যান, কিন্তু কেউ তাকে ফিরে আসতে দেখেনি। রাত ন’টার পর প্রধান ফটক বন্ধ হয়ে যায়। আজ সকালে সেই ফটক ঘোলা থাকতে দেখে দু’জন চাকর মনে করে তাদের মধ্যে কেউ একজন নিশ্চয়ই খুলে থাকবে। কিন্তু আসলে তারা কেউই ফটক সেদিন খোলেনি।
তাঁদের আলোচনার মাঝে ডঃ রেলি এসে হাজির হলেন, তার পিছন পিছন এলেন মিঃ মারকাডো।
হ্যালো রেলি, কিছু পেলেন?
হ্যাঁ, ল্যাবরেটরি থেকে অ্যাসিডটা নেওয়া হয়। প্রতিটি অ্যাসিডের বোতল আমি পরীক্ষা করে দেখেছি মিঃ মারকাভোর সঙ্গে। এইচ. সি. এল-র বোতলে এই অ্যাসিডের পরিমাণ একটু কম ছিল। অতএব।
কেন, ল্যাবরেটরিতে চাবি দেওয়া থাকে না?
মারকাডো মাথা নাড়েন। ভয়ে তার মুখটা শুকিয়ে গিয়েছিল। আমতা আমতা করে তিনি বলেন, হ্যাঁ, থাকবে না কেন। তবে কি জানেন, চাবিটা থাকে বসবার ঘরে।
বাঃ, তাহলে তো খুবই মজার ব্যাপার, মেটল্যান্ড মুখ বিকৃতি করে বলে ওঠেন, যে-কেউ যে-কোন ঘরের চাবি নিয়ে যা খুশি করতে পারে। একটু থেমে তিনি আবার বলেন, এখন দেখতে হবে মিস জনসন নিজের হাতে ল্যাবোরেটরি থেকে সেই অ্যাসিড সংগ্রহ করেছিলেন কি না?
না, তিনি নিজে সংগ্রহ করেননি, হঠাৎ আমার মুখ ফসকে কথাটা বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে আমি আমার হাতে মৃদু চাপ অনুভব করলাম। ফিরে তাকাতেই দেখি পোয়ারো আমার পাশ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আছেন। তার চোখে গভীর প্রত্যয়।
প্রসঙ্গটা অবশ্য ধামাচাপা পড়ে গেল হঠাৎ সেখানে একটা গাড়ির আবির্ভাব হতে। গাড়ি থেকে নামলেন একজন ছোট বেঁটে ধরনের লোক। নাম তার ভেরিয়ার। ফরাসী প্রত্নতত্ত্ববিদ। আরবী ভাষা জানেন না। ইটালি যাওয়ার পথে আমাদের বাড়িতে কিছুক্ষণ থেকে যান। ডঃ লিডনার তাকে দুর্ঘটনার কথা বলতে ভদ্রলোক দুঃখ প্রকাশ করে বলেন আপনাদের মাঝে আমি এমন সময় এলাম যখন আপনারা একটার পর একটা বিপর্যয়ের মধ্যে দিয়ে দিন কাটাচ্ছেন।
আমাদের অবস্থা দেখে তিনি পত্রপাঠ ফিরে গেলেন।
আমার ধারণা, করোসিভ অ্যাসিডেই মৃত্যু হয়ে থাকবে মিস জনসনের। ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড নতুন করে আমার কাছ থেকে জানতে চাইলেন, কখন কি অবস্থায় মিস জনসনকে আমি দেখতে পাই। সংক্ষেপে আমি তাকে উল্লেখযোগ্য ঘটনার কথা বললাম।
সব শুনে ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড গম্ভীরভাবে জিজ্ঞাসা করলেন–তাহলে আপনার অভিমত হল, মিস জনসন নিজেই সেই অ্যাসিড খেয়েছিলেন?
না, না, সঙ্গে সঙ্গে আমি প্রতিবাদ করে উঠলাম–ওরকম চিন্তা আমি কখনোই করতে পারি না। না, কখখনও নয়।
জানি না এত বিশ্বাস পেলাম কোথা থেকে? তবে এটুকু বলতে পারি যে, খুন একটা অভ্যাস, পোয়ারোর ওই মন্তব্যটা আমাকে কেমন বিশ্বাস করতে শিখিয়েছিল, মিস জনসন কখখনো আত্মহত্যা করতে পারেন না।
আমি ধরেই নিলাম আপনার অনুমানই ঠিক, ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড একটু চিন্তা করে আবার বললেন–কিন্তু কেউ যদি দুশ্চিন্তায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে এবং হাতের কাছে আত্মহত্যা করার রসদ পেয়ে যায়, সেক্ষেত্রে আপনার কী ধারণা হতে পারে নার্স?
কেন, মিস জনসন কি মানসিক ভারসাম্য সত্যি সত্যি হারিয়ে ফেলেছিলেন? আমার কেমন সন্দেহ হল।
মিসেস মারকাডো তো সেই কথাই বলেছেন। তিনি বলছিলেন, গতকাল নৈশভোজের সময় মিস জনসনকে নাকি অন্যমনস্ক দেখাচ্ছিল, কথা তিনি বলছিলেনই না একরকম। মিস জনসন যে মানসিক রোগে ভুগছিলেন এবং তার হাত থেকে রেহাই পেতে তিনি যে আত্মহত্যা করার পথ বেছে নেন, এব্যাপারে মিসেস মারকাডো নিশ্চিত।
ঠিক আছে আমি সরাসরি অস্বীকার করে বললাম–আমি মোটেও সে কথা বিশ্বাস করি না।
তাহলে আপনি কী মনে করেন?
খুন হয়েছেন তিনি? দ্বিধাহীন আমার উত্তর।
আপনার এই ব্যক্তিগত ধারণার পিছনে কোন যুক্তি আছে?
হ্যাঁ, আছে বৈকি! তারপর আমি তাকে গতকাল অপরাহ্নে মিস জনসনের সঙ্গে আলোচনার কথা সবিস্তারে বললাম।
তিনি কি দেখেছিলেন, সে কথা বলেননি?
না, আরও ভেবে দেখার জন্য সময় নেন তিনি।
তাঁর মনের কথাটা কি আপনি আন্দাজ করতে পারেন না নার্স?
না।
তা আপনি কী ভাবছেন মঁসিয়ে পোয়ারো? এবার পোয়ারোর দিকে ফিরে প্রশ্নটা রাখলেন ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড।
আমার মনে হয়, মোটিভ আপনার হাতের কাছেই রয়েছে।
খুনের?
হ্যাঁ, খুনের! অতঃপর পোয়ারো তার সন্দেহের কারণটা ব্যাখ্যা করে বলতে থাকেন, মৃত্যুর ঠিক পূর্ব মুহূর্তে মিস জনসন ইশারায় তার ঘরের জানালার দিকে ইঙ্গিত করেছিলেন। মনে হয় ওই জানালা পথে আততায়ী–
তা মিস জনসনের ঘরে কতগুলো জানালা আছে বলে মনে হয়?
একটিমাত্র, পোয়ারোর হয়ে উত্তরটা আমিই দিলাম।
ঠিক আছে বলে যান নার্স। ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড এবার আমার দিকে ফিরলেন, তারপর?
ওঁর ঘরের মধ্যে একটা অস্বাভাবিক জিনিস আমার নজরে পড়ে। আমি আমার সন্দেহের কথাটা এই প্রথম প্রকাশ করলাম, মাঝরাত্রে জল খাবার অভ্যাস ছিল মিস জনসনের। তাই তিনি তার বিছানা ঘেঁসে টেবিলের উপরে জলের গ্লাস রাখতেন। কিন্তু ঘরে ঢুকে দেখি সেই জল ভর্তি গ্লাসটা মেঝের উপরে পড়ে আছে।
এমনও তো হতে পারে, গ্লাসটা মিস জনসনের হাত থেকে পড়ে গিয়ে থাকবে।
তাহলে সেটা ভাঙ্গা অবস্থায় দেখতাম। কোন ভূমিকা না করে আমি এবার আসল কথাটা বললাম–মনে হয় আততায়ী সেই গ্লাসটা সরিয়ে টেবিলের উপরে অ্যাসিডের কাপটা রেখে থাকবে এবং মিস জনসন জল মনে করে আধো ঘুমে অ্যাসিডের পাত্রে চুমুক দিয়ে থাকবেন।
হ্যাঁ, ঘুমন্ত অবস্থায় এরকম ভুল সব মানুষই করে থাকে। ডঃ রেলি আমাকে সমর্থন করে বলেন, আমারও তাই ধারণা। মিস জনসন খুন হয়েছেন।
তাহলে এক্ষেত্রে ধরে নেওয়া যায় যে, হয় তিনি আত্মহত্যা –না হয় খুন হয়েছেন কী বলেন ডঃ লিডনার? ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড প্রশ্ন করলেন ডঃ লিডনারের দিকে তাকিয়ে।
আত্মহত্যা করার মত মেয়ে সে ছিল না– ডঃ লিডনার মন্তব্য করেন, অতএব ধরে নেওয়া যায় মিস জনসন খুন হয়েছেন।
হ্যাঁ, ঠিক তাই, ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড তার হাতের প্যাকেটটা খুলতে গিয়ে বললেন, আপনারা কেউই জানেন না নিশ্চয়ই এটা আমি মিস জনসনের বিছানার নিচ থেকে সংগ্রহ করেছি।
ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ডের হাতে কাগজের ওই মোড়কটা আমি প্রথম থেকেই লক্ষ্য করেছিলাম। মোড়কটা খুলে একটা হস্তচালিত যাঁতা কিম্বা গ্রাইন্ডার জাতীয় পাথরের চাকা টেবিলের উপরে রাখলেন ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড।
একটা লোককে খুন করার পক্ষে এ জাতীয় ভারী পাথর যথেষ্ট, ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড ধীরে ধীরে বলেন–আমার বিশ্বাস, এর মধ্যে আর কোন সন্দেহ থাকতে পারে না।
.
২৬.
এরপর আমার পালা
এ এক ভয়ঙ্কর ভয়াবহ ব্যাপার। যে-কোন মুহূর্তে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে পারেন ডঃ লিডনার। আমি নিজেও অসুস্থবোধ করছিলাম।
পেশাদারি কায়দায় ডঃ রেলি সেটা পরীক্ষা করে দেখলেন।
আমার ধারণা, হাতের কোন ছাপ নেই। তদন্তের মাঝে কথাটা বলে এক জোড়া ফরসেড বার করলেন তিনি তার মেডিক্যাল বক্স থেকে অনুসন্ধান কাজটা নিখুঁত করার জন্য।
হু–এক টুকরো চুল, স্বর্ণকেশী। অবশ্য এটা বেসরকারি অনুমান। এরপর আমাকে খুব কঠোর পরীক্ষা চালাতে হবে, পরীক্ষা করে দেখতে হবে ব্লাডগ্রুপ এবং আরও কত কি সব পরীক্ষা চালাতে হবে। এরই মধ্যে একটা আন্দাজ আমি করেছি। মনে হয় মিসেস লিডনারকে প্রথমে খুন করেছে মিস জনসন। তারপর তার মনে অনুশোচনা হয় এবং সেই অনুশোচনাবোধ তাকে আত্মহত্যায় প্ররোচিত করে।
অসহায়ভাবে মাথা নাড়েন ডঃ লিডনার, না আত্মহত্যা সে করতে পারে না।
কিন্তু এখন কথা হচ্ছে, মেটল্যান্ড বলেন, এই ভারী জিনিসটা কোথায় সে লুকিয়ে রাখল?
হঠাৎ একটা সম্ভাবনার কথা আমার মনে হল, কেন সেই কাপবোর্ডের মধ্যে? কিন্তু আমি কিছুই বললাম না।
যেখানেই সেটা থাকুক না কেন, মনে হয় আত্মহত্যা করার আগে মিস জনসন সেটা নিজের ঘরে এনে থাকবে।
এ আমি বিশ্বাস করি না, চিৎকার করে বলে উঠলাম আমি। আমি ভাবতেই পারি না, অমন নিষ্ঠুরভাবে মিসেস লিডনারের মাথায় মিস জনসন কি করে আঘাত করল? এ যেন অবিশ্বাস্য ব্যাপার। আর এই কারণেই বোধহয় বিশ্বাস করা যায় না, অনুশোচনার জন্য তিনি আত্মহত্যা করতে পারেন!
কি যে বিশ্বাস করতে হবে, আমি নিজেই সে কথা জানি না।ক্যাপ্টেন মেটলান্ড ধীরে ধীরে বলতে থাকেন। এরই মাঝে ফাদার ল্যাভিগনির হঠাৎ অদৃশ্য হওয়ার ব্যাপারটাও বড় রহস্যজনক, সেই রহস্যটাও আগে পরিষ্কার হওয়া দরকার। ওঁদের মত তিনিও যদি আমাদের প্রজেক্টের কোথাও মাথায় আঘাত পেয়ে পড়ে থাকেন, সেটা দেখার জন্য আমরা লোক পাঠিয়েছি।
ওহো, এবার আমার মনে পড়েছে আমি বলতে শুরু করি। সবার কৌতূহলী দৃষ্টি আমার দিকে তখন।
ঘটনাটা গতকাল অপরাহ্নের আমি বলি–ফাদার ল্যাভিগনি আমাকে জিজ্ঞাসা করছিলেন, রহস্যময় ট্যারাচোখা যে লোকটা মিসেস লিডনারের ঘরের জানালার সামনে দাঁড়িয়েছিল, কোন্ পথ দিয়ে সে অদৃশ্য হয়ে যায়? তার ধারণা ছিল, অপরাধ বিজ্ঞানের মতে ঘটনাস্থলে একটা না একটা কোন চিহ্ন ঠিক ফেলে রেখে যায় অপরাধী। সেই ক্লু আবিষ্কার করার জন্য তিনি বাইরে একটু ঘুরে আসতে চান।
ওসব অপরাধ-বিজ্ঞানের সূত্র-টুত্র রেখে দাও। ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড বিরক্ত হয়েই বলেন, ফাদার ল্যাভিগনির আসল উদ্দেশ্যটা কি তা আগে জানতে হবে। এক্ষেত্রে আমার অনুমান, মিস জনসন এবং তিনি প্রায় একই সময় একটা ক্লু আবিষ্কার করে থাকবেন। উত্তেজিত হয়ে তিনি বলতে থাকেন, ট্যারাচোখো লোক! ট্যারাচোখো লোক! আমি বুঝতে পারছি না, আমার নোক কেন যে তাকে ধরতে পারছে না!
সম্ভবতঃ সে আদৌ ট্যারাচোখো নয় বলে! শান্তস্বরে পোয়ারো বললেন।
তবে কী আপনি মনে করেন ট্যারাচোখে তাকানোটা তার নকল? আসলে সে আদৌ ট্যারা নয়?
কথা প্রসঙ্গে পোয়ারো বলেন–তাহলে ট্যারাচোখের লোকটা এক্ষেত্রে অতি প্রয়োজনীয় বলে মনে হয়।
লোকটা ট্যারা কি ট্যারা নয়, সেটা মূল প্রশ্ন নয়–এখন সে কোথায়, সেটাই একমাত্র জানার বিষয়!
আমার অনুমান, পোয়ারো বলেন–এতক্ষণ সে বোধহয় সিরিয়ার সীমান্ত অতিক্রম করে গেছে।
সমস্ত সীমান্ত প্রহরীদের টেলিগ্রাম করে আমি সতর্ক করে দিয়েছি, প্রতিটি গাড়ি অনুসন্ধান করে দেখার জন্য। পাসপোর্টে গন্ডগোল থাকলে গাড়ি যেন আটক করা হয়। গাড়ির আরোহী দু’জন। তাই না মঁসিয়ে পোয়ারো?
পোয়ারো মাথা নাড়েন, হ্যাঁ, দু’জনই বটে!
মঁসিয়ে পোয়ারো, প্রথমেই আমার কেমন খটকা লেগেছিল, অনেক কথা আপনি আপনার পেটের মধ্যে রেখে দেন দেখছি।
পোয়ারো মাথা নাড়লেন। না, ঠিক তা নয়। আসলে আজই সকালে সত্য উদঘাটন হতে দেখলাম। আমি তখন সূর্যোদয় দেখছিলাম।
আমার মনে হয় না আপনারা কেউ মিসেস মারকাডোকে চুপিসারে ঘরে চলে যেতে দেখেছেন। অত বড় একটা রক্তপাত ঘটে গেল–আমরা তখন ঘটনার আকস্মিকতায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়, অথচ তিনি তখন তার ঘরে একলা। আর তখন উনি এমন চিৎকার করছেন, যেন শূকর ছানার গলায় ছুরি বসানো হয়েছে।
হায় ঈশ্বর! মিসেস মারকাডো চিৎকার করে উঠলেন–এবার বুঝতে পারছি। এবার আমি বুঝতে পারছি, এসব কাজ ফাদার ল্যাভিগনির। পাগল তিনি ধর্মান্ধ তিনি। তার ধারণা, মেয়েরা পাপী! তিনি তাদের সবাইকে খুন করে ফেলবেন। প্রথমে মিসেস লিডনারকে, তারপর মিস জনসনকে। এবার আমার পালা।
আঁতকে উঠে ছুটে যান তিনি ডঃ রেলির দিকে। আমি আপনাকে বলে রাখছি, আর এক মুহূর্তও এখানে থাকব না। সাংঘাতিক লোক তিনি, নিশ্চয়ই এখানে কোথাও ওঁৎ পেতে বসে আছেন আমার অপেক্ষায়।
ডঃ রেলিকে সাহায্য করার জন্য মিসেস মারকাডোকে শান্ত করিয়ে একটা চেয়ারে বসালাম, কেউ আপনাকে খুন করতে যাচ্ছে না। আমি তাকে আশ্বাস দিয়ে বললাম, আপনি শান্ত হন, আপনার কোন ভয় নেই।
তারপর আর এক বাধা, দরজা ঠেলে শীলা রেলি ঘরে এসে ঢুকলেন। তার মুখটা থমথমে দেখাচ্ছিল। সোজা সে চলে এল পোয়ারোর কাছে। একটু আগে আমি পোষ্ট অফিসে যাই মঁসিয়ে পোয়ারো, যেখান থেকে আপনার একটা টেলিগ্রাম নিয়ে এসেছি।
ধন্যবাদ মাদমোয়াজেল।
ওটা কী আমেরিকা থেকে আসছে? মিসেস মারকাড়ো তার দিকে দৃষ্টি রেখে জিজ্ঞাসা করলেন।
পোয়ারো মাথা নাড়লেন। না ম্যাডাম, এটা আসছে টিউনিস থেকে।
একটু সময় পোয়ারোর দিকে তাকিয়ে থেকে তিনি দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ফাদার ল্যাভিগনি, আমার অনুমান তাহলে ঠিক! সাংঘাতিক লোক তিনি। না, এক মুহূর্তও আমি আর এখানে থাকব না। একটু থেমে তিনি আবার বলতে থাকেন, এ জায়গা আমাকে ছেড়ে যেতেই হবে। এখন আমি আর জোসেফ রেস্ট হাউসে গিয়ে রাতটা কাটিয়ে দিতে চাই।
ধৈর্য ধরুন ম্যাডাম, পোয়ারো ধীরে ধীরে মুখ খুললেন–আমি আপনাদের কাছে সব ব্যাখ্যা করে বলছি।
ক্যাপ্টেন মেটল্যান্ড কৌতূহলী চোখ নিয়ে তাকিয়েছিলেন পোয়ারোর দিকে। ডঃ রেলির দিকে ফিরে পোয়ারো অনুরোধ করলেন, ডঃ রেলি, দয়া করে আপনি যদি সবাইকে খবর দেন এখানে চলে আসার জন্য, তাহলে আমার একটু উপকার হয়।
ডঃ রেলি দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যান।
.
২৭.
যাত্রা শুরু
বিসমিল্লাহি আর রহমান আর রহিম’–আরবি ভাষায় এই প্রবাদটার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে পোয়ারো বলেন, করুণাময়, দয়াময় আল্লার নামে এই প্রবাদটা যে-কোন যাত্রার শুরুতে ব্যবহার করা হয়। আমাদেরও যাত্রা শুরু হল। এ যাত্রা সুদূর অতীতে। এ যাত্রা সেই সব বিচিত্র জায়গায়, যেখানে মানুষের আত্মা ঘোরাফেরা করে থাকে আজও।
সত্যি কথা বলতে কি পোয়ারোর কথায় হঠাৎ আমার প্রাচ্যের সেই মোহিনী মায়ার’ কথা মনে পড়ে গেল। ভেসে উঠল আমার চোখের সামনে সেই সব বিচিত্র দৃশ্য। মনে পড়ল সমরখন্দ এবং ইমপাহানের নাম, সওদাগর, হাঁটুমুড়ে বসে থাকা উটের দল, পিঠে কাপড়ের গাঁটরি নিয়ে নুইয়ে পড়া শ্রমিকদের চলমান স্রোত, মেয়েদের মেহেন্দি রঙে কলপ দেওয়া মাথার চুল, টাট্টু ঘোড়ার চি-চি শব্দ।
এক সময় সম্বিৎ ফিরে পেয়ে ঘরের চারিদিক তাকিয়ে দেখলাম এবং আমার মনে। একটা অদ্ভুত চিন্তার উদয় হল, মিঃ পোয়ারো যা যা বললেন সব কি সত্যি আমরা সবাই সেই নিরুদ্দেশ যাত্রার পথিক, সমবেত হয়েছি এখানে। কিন্তু আমাদের সবার চিন্তা এখন প্রবাহিত ভিন্ন ভিন্ন ধারায়।
এখানে প্রথম আসেন রেইটার এবং এমোট। তারপর বিল কোলম্যান, রিচার্ড ক্যারি এবং সব শেষে মিঃ মারকাভো। প্রথমে আমি তাদের যে চোখে দেখেছিলাম আজও ঠিক সেই চোখে দেখছি; সেই রঙ, সেই ঢঙ, বদলায়নি কিছুই।
কিন্তু তারা যেন কেউ স্বাভাবিক নন। কেমন ভয়ে ভয়ে মিঃ মারকাডো তার হাতের আঙুলগুলো মোচড়াচ্ছিলেন। স্বামীর দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখছিলেন মিসেস মারকাডো। একটা অদ্ভুত কায়দায় ডঃ লিডনারকে কেমন সঙ্কুচিত বলে মনে হল। ওদিকে মিঃ কোলম্যান সরাসরি তাকিয়েছিলেন পোয়ারোর দিকে। তার মুখটা ঈষৎ খোলা, দৃষ্টি প্রসারিত। এই মুহূর্তে তাকে ঠিক সূর্যের মতো দেখাচ্ছিল। মিস রেলি জানালার দিকে তাকিয়ে কি যে ভাবছিলেন জানি না। তবে যে কারণেই হোক মিঃ ক্যারির মুখের ভাব দেখে আমার কেমন একটু করুণা হল। জানি না, পোয়ারো আমাদের সম্বন্ধে এখন কি ভাবছেন।
এ যেন এক বিচিত্র অনুভূতি।
পোয়ারোর কণ্ঠস্বর শান্ত সংযত, ভঙ্গিমা বুদ্ধিদীপ্ত, গভীর নদীর শান্ত ঢেউয়ের মত।
একেবারে গোড়া থেকে আমার মনে হয়েছে, এই কেসের গভীরে পৌঁছতে হলে বাইরে থেকে কোন ক্ল সন্ধানের প্রয়োজন নেই, সত্যিকারের ক্লু হল ভিতর থেকে অনুসন্ধান কাজ চালানো। এ কেসের ব্যাপারে আমি বলতে পারি–কারোর ব্যক্তিগত এবং গোপন হৃদয়ের সংঘাতই হল অমন নিষ্ঠুর পরিণতি। আমার ধারণা, এ কেসের সমাধানের সূত্র খুঁজে বার করার মত রসদ যদিও আমার হাতে ছিল না গোড়ার পর্বে, তবু আমি বলতে পারি যে সম্ভাব্য সমাধানের পথ এখানেই নিহীত আছে।
একটু থেমে তিনি আবার বলতে শুরু করলেন।
এখানে এসে এই কেসের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার সময় থেকে আমার অনুসন্ধানের যাত্রা শুরু। আমার ধারণা প্রতিটি ঘটনার একটা নির্দিষ্ট আকৃতি এবং রূপ আছে। এই ঘটনার ধরন দেখে মনে হয় মিসেস লিডনারের ব্যক্তিত্বের মধ্যে সমাধানের সূত্রটা লুকিয়ে আছে। তাই যতক্ষণ না জানতে পারছি, মিসেস লিডনার ঠিক কি ধরনের মহিলা ছিলেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমার পক্ষে বলা সম্ভব নয়–কেন তিনি খুন হলেন, আর কেই বা তাকে খুন করল? অতএব আমার অনুসন্ধানের প্রথম কাজ হল–মিসেস লিডনারের ব্যক্তিত্ব সম্বন্ধে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল হওয়া।
মনস্তত্বের দিক থেকে আর একটা উল্লেখযোগ্য দিক হল–এক্সপিডিসনের প্রতিটি সদস্যদের মনের মধ্যে সব সময় একটা উদ্বেগ, উত্তেজনা ছড়িয়ে আছে। হয়তো আপাতদৃষ্টিতে বোঝা যাচ্ছে যে, মিসেস লিডনারের উপরে তাদের দুর্বলতার জন্যই বোধহয় এমনি আশঙ্কা। যাইহোক, পরে এক সময় আমি এর সঠিক মূল্যায়ন করব আপনাদের কাছে।
শুরুতেই বলে রাখি, মিসেস লিডনারের ব্যক্তিত্বের উপরে আমি পুরোপুরি মনোযোগ দিয়েছি।
আমার ধারণা, মিসেস লিডনার একটু উগ্র প্রকৃতির হলেও তাঁর মধ্যে একটা শিশুসুলভ রুচিবোধ আছে। তার শয়নকক্ষে বইগুলো দেখে আমার আরও একটা ধারণা হয়েছে তার বুদ্ধি ছিল এবং তিনি ছিলেন অহঙ্কারী।
হ্যাঁ, মিসেস লিডনার সম্বন্ধে আমার আরও একটা ধারণা হয়েছে যে পুরুষদের আকর্ষণ করার প্রবণতা ছিল তার প্রবল। তবে তাই বলে এই নয় যে, তার সেই প্রবণতার দরুণই এমনি এক দুর্ঘটনায় পতিত হন তিনি।
তাঁর সংগৃহীত বইগুলোর মধ্যে সাহিত্য-সংস্কৃতি এবং আধুনিক বিজ্ঞানের প্রভাব ছিল। বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দেয় তার এই রুচিবোধ। উপন্যাসের মধ্যে, লিনডা কনডন এবং ক্রিউ ট্রেন বই দুটি স্মরণ করিয়ে দেয় যে, নারী স্বাধীনতায় মিসেস লিডনারের সহানুভূতি এবং সমর্থন ছিল। এর থেকে বোঝা যায় লেডী হেস্টার স্ট্যানহোপের ব্যক্তিত্ব তাকে দারুণভাবে আকর্ষণ করেছিল। লিনডা কনডন-এ দেখা যায়, ভদ্রমহিলা তার নিজের রূপ এবং সৌন্দর্য সম্বন্ধে বড্ড বেশি সচেতন। এসব পর্যালোচনা করে আমি বেশ বুঝতে পারছি–এই মৃত ভদ্রমহিলা ঠিক কি ধরনের ছিলেন।
ডঃ রেলি এবং অন্যদের সঙ্গে আমি গোপনে আলোচনা করে জেনেছি–মিসেস লিডনার নিজের রূপ এবং সৌন্দর্য সম্বন্ধে দারুণ সচেতন এবং অহঙ্কারী ছিলেন। এই সব মহিলারা ভীষণ বিপজ্জনক হয়ে ওঠে–সময় সময় নিজের ক্ষেত্রে এবং কখনও বা অপরের ক্ষেত্রে। মিসেস লিডনার ছিলেন সেই ধরনের মহিলা। নারী-পুরুষ ভক্তবৃন্দের মধ্যে মক্ষিরানী হয়ে বসে থাকতে ভালবাসতেন তিনি। নার্স লিথেরান, যিনি একজন উদার মনোভাবাপন্ন মহিলা–যাঁর একটা কাব্যিক চেতনাবোধ আছে, তিনিও মিসেস লিডনারের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। মানুষের উপরে প্রভাব বিস্তার করতে আর একটা উপায় জানা ছিল মিসেস লিডনারের, মানুষকে ভয় দেখিয়ে তাদের প্রভাবিত করা।
এখন সব থেকে জরুরী এবং প্রধান সমস্যা হল, সেই রহস্যময় বেনামা চিঠিগুলোর সমাধান করা। কে, কে এই সব চিঠিগুলো লিখল আর কেনই বা? নিজেকে প্রশ্ন করি, তবে কি মিসেস লিডনার নিজেই সেই চিঠিগুলো লিখেছিলেন।
এই প্রশ্নের উত্তর পেতে হলে একেবারে গোড়ায় মানে মিসেস লিডনারের প্রথম বিবাহোত্তর দিনগুলোয় ফিরে যেতে হয়।
যৌবনে মিসেস লিডনার ছিলেন রীতিমতো সুন্দরী এবং স্বাধীনচেতা নারী। তাই বিবাহের বন্ধনে আবদ্ধ থাকতে চাননি বেশি দিন। অথচ তার প্রথম স্বামী ছিলেন দৃঢ়চেতা পুরুষ এবং তার মধ্যে এমন কোন শক্তি ছিল যার জন্য সহজে তাঁর হাত থেকে রেহাই পেতে পারছিলেন না মিসেস লিডনার। তাই তিনি নকল দেশপ্রেমিকের ভূমিকা নিয়ে তার পিতার সাহায্যে ফ্রেডরিক বনসারকে সরিয়ে দিলেন তার জীবন থেকে চিরতরে।
এখন আমরা সেই চিঠিগুলোর প্রসঙ্গে আসি–ইতিমধ্যে আমরা জেনে গেছি তিনি পুরুষের কাছে দারুণ আকর্ষণীয়া ছিলেন। যখনই তিনি একজন পুরুষের প্রেমে পড়েছেন, তখনি তিনি হুমকি দেওয়া একটা চিঠি পেয়েছেন। কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেই সব চিঠিগুলো কে লিখল? ফ্রেডরিক বনসার, নাকি তার ভাই উইলিয়াম কিম্বা মিসেস লিডনার নিজেই?
কিন্তু একটা আশ্চর্য ব্যাপার হল–ডঃ লিডনার তার জীবনে আসার পর থেকেই হুমকি দেওয়া সেই সব চিঠিগুলো আসা বন্ধ হয়ে যায়। মিসেস লিডনার হওয়া পর্যন্ত কোন বাধার সম্মুখীন তাকে হতে হয়নি।
কিন্তু কেন, কেন? একসঙ্গে আমরা সবাই প্রশ্ন করে তাকালাম পোয়ারোর দিকে।
ধরে নিলাম চিঠিগুলো মিসেস লিডনারই লিখেছিলেন। আর এও সত্য যে–ডঃ লিডনারকে তিনি খুব ভালবাসতেন এবং তাই তাকে বিয়ে করেন। কিন্তু কথা হচ্ছে বিয়ের পরেও তিনি কেন আবার চিঠি লিখতে গেলেন? নাটকের পুনরাবৃত্তি কার জন্য?
এবার অন্য আর এক সূত্রে আসা যাক। মনে করা যাক সেই চিঠিগুলো মিসেস লিডনারের প্রথম স্বামীর কাছ থেকেই এসেছিল। তাই যদি হয় কেন সে তাদের বিয়েতে বাধা দিল না? যেমন আগের বিবাহের প্রস্তাবে হুমকি দিয়ে চিঠি লিখেছিল সে? যাইহোক, বিয়ের পর সে আবার হুমকি দিয়ে চিঠি লিখতে শুরু করে? আমার উত্তর সন্তোষজনক নয়। হয়তো সে তখন কোন জেলে বন্দী ছিল কিম্বা চলে যায় বিদেশে কোথাও।
এক্ষেত্রে তিনটে নির্দিষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে : (১) চিঠিগুলো মিসেস লিডনারের নিজেরই লেখা; (২) চিঠিগুলো ফ্রেডরিক বনসার (কিম্বা যুবক উইলিয়াম বনসার) লিখতে পারে; (৩) চিঠিগুলো মিসেস লিডনারের কিম্বা তার প্রথম স্বামী লিখে থাকলেও সেগুলো হয়তো পরবর্তীকালে তৃতীয় ব্যক্তির কাছে প্রকাশ হয়ে পড়ে এবং সেই তৃতীয় ব্যক্তিই তাদের বিয়ের পর চিঠিগুলো আবার লিখতে শুরু করে। কে জানে সেই তৃতীয় ব্যক্তিই এই সব হত্যাকাণ্ডের নায়ক কি না? অতএব আমাকে এখন মিসেস লিডনারের অনুগামী লোকজনদের খুঁটিয়ে বিচার করতে হবে।
তবে এক্ষেত্রে আমি তিনজনকে আমার সন্দেহের তালিকা থেকে বাইরে রাখতে পারি। ডঃ লিডনার, কারণ দুর্ঘটনার সময় তিনি ছাদের উপরে ছিলেন। তারপর মিঃ ক্যারি, কারণ তিনি তখন নদীর ধারে বাঁধ বাঁধার কাজে নিযুক্ত ছিলেন। সব শেষে মিঃ কোলম্যান, তিনি তখন হাসানিয়েয় ছিলেন।
কিন্তু একথাও আবার ঠিক যে, ডঃ লিডনার বাদে (কারণ দুর্ঘটনার সময় তিনি যে ছাদের উপর ছিলেন তাতে কোন সন্দেহ নেই) মিঃ ক্যারি যে বাঁধ বাঁধার কাজে নিযুক্ত ছিলেন কিম্বা মিঃ কোলম্যান প্রকৃতপক্ষে যে হাসানিয়েয় গিয়েছিলেন তার কী প্রমাণ আছে?
বিল কোলম্যানের মুখটা লাল হয়ে উঠল। চোখ-মুখে অস্বস্তির ছোঁয়া। মুখ খুলতে পারলেন না তিনি। ওদিকে মিঃ ক্যারির মুখে কোন ভাবান্তর লক্ষ্য করা গেল না।
তাদের দিক থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়ে পোয়ারো আবার বলতে শুরু করলেন?
আর একজনকে আমার সন্দেহ হয়। মিস রেলির সাহস আছে, বুদ্ধি আছে এবং একটু নির্মমও বটে। নিহত মিসেস লিডনারের প্রসঙ্গ তুলতেই তিনি ক্ষেপে যান। আমি ওঁকে সন্দেহ করি, কথাটা বলতেই উনি সরাসরি জানিয়ে দেন–দুর্ঘটনার সময় তিনি নাকি ক্লাবে টেনিস খেলছিলেন। কিন্তু পরদিন মিস জনসনের সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে কথা প্রসঙ্গে তিনি আমাকে জানান, মিস রেলি নাকি আদৌ সে সময় টেনিস খেলতে যাননি, বাড়ির কাছাকাছি ছিলেন তিনি দুর্ঘটনার সময়। অতএব, মিস রেলি প্রকৃতপক্ষে অপরাধী না হলে মনে হয় উনি আমাকে কিছু প্রয়োজনীয় তথ্য পরিবেশন করতে পারেন। এখানে একটু থেমে শান্তভাবে তিনি বললেন, মিস রেলি, সেদিন অপরাহ্নে আপনি কি দেখেছিলেন বলবেন দয়া করে?
অনেকক্ষণ পরে জানালার দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে মিস রেলি বলেন, মধ্যাহ্ন ভোজের পর ঘোড়ায় চড়ে বাঁধের দিকে বেড়াতে যাই। মাপা কণ্ঠস্বর তাঁর।
মিঃ ব্যারিকে দেখেছিলেন সেখানে?
না।
না!
আশ্চর্য! মিঃ ক্যারির দিকে ফিরে জিজ্ঞাসা করলেন পোয়ারো, আপনার কিছু বলার আছে মিঃ ক্যারি?
আমি তখন বেড়াতে গিয়েছিলাম নদীর ধারে।
বাড়ির দিকে ফেরেননি?
না।
আমার অনুমান মিস রেলি এবার মিঃ ক্যারির দিকে তাকিয়ে বলেন, ক্যারির জন্য আপনি তখন অপেক্ষা করছিলেন কিন্তু সে আসেনি। ক্যারি তার দিকে তাকালেন বটে, কিন্তু জবাব দিলেন না।
তাকে কোন চাপ দিলেন না পোয়ারো। আর একটা প্রশ্ন আপনাকে করব। আর কিছু আপনার চোখে পড়েছিল মাদমোয়াজেল?
হ্যাঁ। সেই সময় হঠাৎ মিঃ কোলম্যানকে এক্সপিডিসন হাউসের দিকে হেঁটে যেতে দেখি। মাথা নিচু করে কি যেন খুঁজছিলেন তিনি।
দেখুন, এখানে আমার বলার আছে। মিঃ কোলম্যান নিরুত্তাপ গলায় কৈফিয়ত দেন, আমার পকেট থেকে একটা সিলিন্ডার সীল পড়ে যায় বাড়ি ফেরার পথে। সেটা খুঁজতেই আমি তাড়াতাড়ি ফিরে আসি হাসানিয়ে থেকে। কিন্তু সেটা না পেয়ে বাড়ি ফিরে আসি বাসে চড়ে। তাই স্বভাবতই ধরে নেয় সবাই আমি ফিরে এসেছি। তবে কোর্টইয়ার্ড দিয়ে আমি আসিনি। তাহলে বাড়ির পরিচারকরা নিশ্চয়ই দেখতে পেত। আর তারা তো স্বীকারই করেছে, কোন আগন্তুককে কোর্টইয়ার্ডে ঢুকতে দেখেনি।
আপনার বক্তব্য ঠিক মেনে নিতে পারছি না, পোয়ারো বলেন–আগন্তুকের কথাই জিজ্ঞাসা করা হয় তাদের, কিন্তু এক্সপিডিসনের সদস্যদের কথা জিজ্ঞাসা করা হয়নি। অতএব এই বলে তিনি এবার রিচার্ড ক্যারির দিকে ফিরলেন।
ক্যারি এতক্ষণ তাকে লক্ষ্য করছিলেন, তার নীল গভীর চোখ উজ্জ্বল হল।
আপনি কী আমাকেও দোষী সাব্যস্ত করতে চাইছেন মঁসিয়ে পোয়ারো?
আমি আমার সন্দেহের কথা বলেছি, কিন্তু এখনও পর্যন্ত নির্দিষ্ট কাউকে আমি চিহ্নিত করতে পারছি না। তবে এ কথা ঠিক যে, এখানকার এক্সপিডিসনের প্রতিটি সদস্যই এখন আমার চোখে সন্দেহজনক ব্যক্তি। এমন কি নার্স লিথেরানও খুনী হতে পারেন।
ওঃ মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করে উঠলাম–আমি এখানে সবে এসেছি। তাছাড়া আমি তো এখানে আগন্তুক মাত্র, এখানকার সদস্য নই।
ভুলে যাবেন না, মিসেস লিডনারের ভয় ছিল কোন আগন্তুক তাকে খুন করতে পারে।
কিন্তু ডঃ রেলি আমাকে এখানে নিয়ে এসেছেন। তিনি আমার সম্বন্ধে ভালই জানেন–
আপনার সম্বন্ধে কতটুকুই বা জানেন তিনি? আপনি নিজের সম্বন্ধে যতটুকু বলেছেন তার বেশি কিছু নয়
বেশ তো সেন্ট ক্রিস্টোফারকে চিঠি লিখে খবর নিতে পারেন আপনি।
আপনি একটু চুপ করবেন? এভাবে তর্ক করলে আমার পক্ষে কাজ চালানো অসম্ভব। পোয়ারো বিরক্ত প্রকাশ করেন–তাছাড়া, আমি তো এখনও পর্যন্ত আপনাকে অপরাধী সাব্যস্ত করিনি। শুধু বলেছি এ, আমার অনুমান। যেমন আমি প্রথমে মনে করি–মিসেস মারকাডোই খুনী। কেন, আপনিই তো বলেছিলেন, মিসেস লিডনারের প্রতি তার একটা প্রচ্ছন্ন আক্রোশ ছিল। কেন বলেননি আপনি মিসেস মারকাডো নেশা করতেন। নেশার ঘোরে যে-কোন লোক তার শত্রুকে খুন করতে পারেন অনায়াসে। তাছাড়া জনশূন্য কোর্টইয়ার্ডে মিঃ এবং মিসেস মারকাভোর পক্ষে মিসেস লিডনারকে দশ মিনিটে খুন করার পক্ষে সেটা যথেষ্ট সময় বৈকি!
সহসা চিৎকার করে উঠলেন মিসেস মারকাডো, না, না এ কথা সত্যি নয়।
আমার পরবর্তী সন্দেহভাজন ব্যক্তি হলেন মিসেস জনসন। খুন করার পক্ষে সত্যি কি তিনি উপযোগী? নিজেকে আমি প্রশ্ন করি বার বার। হ্যাঁ, সম্ভব। স্পষ্টবাদী মেয়ে ছিলেন মিস জনসন। তিনি হয়তো মনে করে থাকবেন মিসেস লিডনার তার স্বামীর প্রতি অবিচার করছেন, অতএব (অবশ্য যদি ডঃ লিডনারের প্রতি তার কোন দুর্বলতা থেকে থাকে) অন্যায়ের প্রতিকার এবং নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য হয়তো মিসেস লিডনারকে তিনি খুন করে থাকলেও থাকতে পারেন।
তারপর আমি তিনজন যুবককে সন্দেহ করতে পারি। তারা তিনজন হলেন–কার্ল রেইটার, উইলিয়াম কোলম্যান এবং মিঃ এমোট। এখন দেখতে হবে এই তিনজনের মধ্যে কার সঙ্গে উইলিয়াম বনসারের সঙ্গে সাদৃশ্য আছে? এদের মধ্যে মিঃ কারি এবং মিঃ উইলিয়াম বনসারের বেশি সাদৃশ্য থাকার কথা। অতএব তিনিও একজন সম্ভাব্য খুনী হতে পারেন। আর মিস রেলির কথা সত্য বলে ধরে নিলে তো উইলিয়াম কোলম্যানকেও একজন সন্দেহভাজন ব্যক্তি হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। নার্স লিথেরানের ভাষায় তার সঙ্গে মিসেস লিডনারের এতটুকু বনিবনা ছিল না। মিসেস লিডনারকে তিনি একটুও সহ্য করতে পারতেন না। অতএব মিসেস লিডনারকে তিনিও খুন করতে পারেন।
এখনও একজন লোক আমার সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ পড়ে আছেন। তিনি হলেন ফাদার ল্যাভিগনি। প্রথম থেকেই তার উপরে আমার সন্দেহ ঘনীভূত হয়। মিসেস লিডনারের ঘরের জানালার সামনে যে লোকটা উঁকি দেয়–ফাদার ল্যাভিগনি নাকি তাকে দেখেছিলেন, সেই আগন্তুক নাকি ট্যারা ছিল। কিন্তু নার্স লিথেরানের আগন্তুকের সম্বন্ধে বিবরণের সঙ্গে ফাদার ল্যাভিগনির কোন মিল নেই। তবে কি ফাদার ল্যাভগনি ইচ্ছাকৃতভাবে আমাদের ভুল পথে চালিত করার জন্য অমন মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন?
আমার কাছে প্রমাণ আছে ফাদার ল্যাভিগনির পরিচয় আসল নয়। তবে কি তিনি ফ্রেডরিক বসনার? তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে আমার এই ধারণা হয়েছে যে একজন ক্যাথলিক প্রিস্টের যে যে গুণ এবং জ্ঞান থাকা প্রয়োজন, তার অভাব ছিল তার মধ্যে। এই সব কারণে আমার মনে সন্দেহ জাগতেই আমি টেলিগ্রাম পাঠাতে শুরু করে দিই নানান জায়গায়।
তারপর নার্স লিথেরান আমাকে একটি অতি মূল্যবান ক্লর সন্ধান দেন। অ্যান্টিক রুমে মূল্যবান অলঙ্কার পরীক্ষা করছিলাম তখন। হঠাৎ তিনি আমাকে দেখালেন–একটি সোনার কাপের উপরে মোমের দাগ লেগে রয়েছে। মোমের দাগ? হঠাৎ, হা হঠাৎই একটা সম্ভাবনার কথা আমার মনে পড়ে গেল। তবে, তবে কি ফাদার ল্যাভগনি–
আমার শেষ টেলিগ্রামের জবাবে উত্তরটা আমি পেয়ে গেলাম আজই, একটু আগে। টিউনিস থেকে আমার খবরদাতা জানিয়েছেন ফরাসী পুলিশের সূত্রে ব্যাপারটা এখন খুব পরিষ্কার হয়ে গেছে, ফাদার ল্যাভিগনি একজন অতি চতুর দাগী চোর–যার কাজ হল মিউজিয়াম থেকে দামী দামী অলঙ্কার আত্মসাৎ করা। তার আসল পরিচয় হল রাউল সেনিয়ার এবং তার দোসর হল প্রথম শ্রেণির স্বর্ণকার আলি ইউসুফ। রাউলের কাজ হল মিউজিয়ামের আসল অলঙ্কারগুলোর ছাঁচ সংগ্রহ করা এবং সেই ছাঁচের আদলে নকল অলঙ্কার তৈরি করা হল আলির কাজ। এইভাবেই ফাদার ল্যাভিগনি যেসব মিউজিয়ামে যান, নকল পরিচয় দিয়ে আসল অলঙ্কার চুরি করার ফঁদ পাতেন।
আজ সকাল পর্যন্ত এই নিয়ে আটটি সম্ভাবনার কথা আমার মনে উদয় হয়েছে, কিন্তু ঠিক জানি না, আসল খুনী কে হতে পারে?
তবে খুন একটা বদ অভ্যাস, খুনী সে নারী কিম্বা পুরুষই হোক না কেন একবার খুন করলে বার বার সে খুন করবেই এক্ষেত্রে দ্বিতীয়বার খুন করে খুনী আমার হাতের মুঠোর মধ্যে এসে গেছে বলে আমার মনে হয়। আমার অনুমান সত্য হলে খুনীর অবস্থা খুব শোচনীয় হয়ে উঠতে বাধ্য।
আমার আশঙ্কা ছিল প্রধানতঃ নার্স লিথেরানের জন্য। তার অত্যাধিক কৌতূহলের জন্য প্রাণনাশের আশঙ্কা ছিল। কিন্তু এক্ষেত্রে আমার আশঙ্কা ফললো মিস জনসনের মৃত্যু দিয়ে। তবে মিস জনসন যে আত্মহত্যা করতে পারেন না–এ ব্যাপারে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত।
প্রথমতঃ দেখা যাক, রবিবার সন্ধ্যায় মিস জনসনকে কাঁদতে দেখেন নার্স লিথেরান। সেই সন্ধ্যাতেই নার্স লিথেরান তাকে তার ঘরে একটি চিঠি পোড়াতে দেখেন, সেই চিঠির হাতের লেখার সঙ্গে বেনামা চিঠিগুলোর হাতের লেখার অদ্ভুত মিল খুঁজে পেয়েছিলেন নার্স লিথেরান।
দ্বিতীয় তথ্য হল, মৃত্যুর দিন সন্ধ্যায় ছাদের উপরে মিস জনসনকে খুব চিন্তিত অবস্থায় দেখতে পান নার্স। জানতে চাইলে মিস জনসন বলেন তিনি নাকি এমন একটা জিনিস দেখেছেন যা প্রকাশ হয়ে পড়লে নতুন তথ্য-আবিষ্কার হাতে পারে। আমি যা দেখেছি, অন্য কেউ দেখেনি তবে একোরে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আমি এ ব্যাপারে মুখ খুলতে পারব না।
এবং তৃতীয় তথ্য, মৃত্যুর শিয়রে দাঁড়িয়ে তার শেষ কথা হল–ওই জানাল, ওই জানালা।
এইগুলো হল আমাদের সূত্র এবং আমরা যেসব সমস্যার মুখোমুখি হয়েছি তা হল- ..
সেই সব চিঠিগুলোর প্রকৃত অর্থ কী? ছাদের উপর থেকে সেদিন সন্ধ্যায় মিস জনসন কি দেখেছিলেন? ওই জানালা, ওই জানালা বলতে তিনি ঠিক কি বোঝাতে চেয়েছিলেন?
প্রথমেই দেখা যাক আমাদের দ্বিতীয় সমস্যার কথা। ছাদের উপর থেকে তিনি কি দেখেছিলেন, কাকে দেখেছিলেন। ফাদার ল্যাভিগনিকে কোর্টইয়ার্ড অতিক্রম করে আসতে তিনি দেখেন। তবে কি তিনি তাঁকেই বোঝাতে চেয়েছিলেন? তবে কি তিনি তার ছদ্মবেশের আড়ালে আসল রূপটা চিনে ফেলেছিলেন? মিসেস লিডনার হয়তো তাকে চিনে ফেলেছিলেন বলেই তাকে সরিয়ে দেওয়া হয় তার মুখ বন্ধ করার জন্য।-এবং মিস জনসন সেই গোপন সত্যটা জেনে ফেলেছিলেন বলে তাকেও সরিয়ে দেওয়া হয়। এ কেসের একটা সঠিক সমাধান পেতে হলে সব কিছু আমাকে ব্যাখ্যা করতে হবে যা এখনও পর্যন্ত অনুল্লেখিত থেকে গেছে।
উল্লেখযোগ্য ঘটনা হল, সেদিন সন্ধ্যায় মিস জনসন ছাদের উপর থেকে কি দেখে অমন চিন্তিত হয়ে ওঠেন? তাঁর কাছ থেকে যে তথ্যটা নার্স লিথেরান সংগ্রহ করতে পারেননি, আজ সকালে ছাদে গিয়ে আমি সেই অজানা তথ্যটা সংগ্রহ করেছি অনেক কষ্টে, নিজের মনকে বিশ্লেষণ করে। ছাদে দাঁড়িয়ে সেই তিনটি বিষয় আমার মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছিল–সেই চিঠিগুলো, সেই ছাদ এবং সেই জানালা। আর ঠিক তখনই আমি দেখতে পাই-মিস-জনসন যা দেখেছিলেন, যা এখন আমি আপনাদের ব্যাখ্যা করতে যাচ্ছি ।
.
২৮.
যবনিকা
ঘরের চারিদিকে একবার তাকিয়ে দেখে নিলেন পোয়ারো। আমাদের প্রত্যেকের চোখ এখন নিবদ্ধ তার উপরে। আমরা সবাই তখন এক অদ্ভুত মানবিকতার শিকার হতে যাচ্ছিলাম। আমাদের সবার মনে তখন কেবল একটাই চিন্তা, একটা সত্য উদ্যাটন হতে যাচ্ছে, সব না হলেও কিছু কিছু অন্তত–
আপনাদের নিশ্চয়ই মনে আছে, আমি আগেই বলেছি অপরাধ সংগঠিত হওয়ার সময় তিনজন লোকের এ্যালিরি ছিল। তার মধ্যে দুজনের এ্যালিবি অযোগ্য বলে আমার প্রথমে মনে হয়েছিল, কিন্তু এখন দেখছি আমি ভুল করেছি। তৃতীয় জনের এ্যালিবিও গ্রহণযোগ্য নয়। আচ্ছা ডঃ লিডনার কি কখনও খুন করতে পারেন? কিন্তু এখন আমি বিস্মিত যে, সেদিন তিনি তার স্ত্রীকে খুন করেন।
তাহলে ডঃ লিড়নারই কী খুনী? একটা অদ্ভুত নীরবতা বিরাজ করছিল সেখানে তখন। ডঃ লিডনারের মুখে কোন কথা নেই। যাইহোক, ডেভিড এয়োটকে একটু অস্থির দেখাচ্ছিল এবং সেই প্রথম মুখ খুলল–আমি ঠিক বুঝতে পারছি না মঁসিয়ে পোয়ারো, আপনি কি বলতে চাইছেন? আমি আপনাকে আগেই বলেছি বেলা পৌনে তিনটের আগে ছাদ ছেড়ে এক মুহূর্তের জন্যও নিচে নেমে আসেননি তিনি। আমি মিথ্যে বলছি না। অতএব তার পক্ষে ছাদ থেকে তার স্ত্রীকে হত্যা করা কি করে সম্ভব?
পোয়ারো মাথা নাড়লেন ধীরে ধীরে।
হ্যাঁ, আমি আপনাকে বিশ্বাস করি বৈকি! আমিও বলছি–ডঃ লিডনার ছাদ থেকে নেমে আসেননি সেদিন সেই সময়। কিন্তু আমি যা দেখেছি যা মিস জনসন দেখেছিলেন সেদিন সন্ধ্যায়, তার থেকে ধারণা করে নেওয়া যায় যে–ডঃ লিডনার ছাদ থেকে না নেমেই তার স্ত্রীকে খুন করতে পারেন।
সঙ্গে সঙ্গে আমরা সবাই তার দিকে অবাক চোখে তাকালাম।
সেই জানালা, পোয়ারো আমাদের স্মরণ করিয়ে দেন–সেই জানালা! মিস জনসনের মতো আমিও এই কথাটা উপলব্ধি করি। মিসেস লিডনারের ঘরের জানালাটা ছিল কোটইয়ার্ডের ঠিক বিপরীত দিকে। ডঃ লিডনারের বড় এ্যালিবি হল–তিনি তখন ছাদের উপর নিজের কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এবং সেই ভারী হস্তচালিত পাথরের যাঁতাটা তার হাতের কাছেই সংগ্রহ করা ছিল। সত্যি কত সহজেই না ছাদের উপর থেকে সুপরিকল্পিতভাবে একটা হত্যাকাণ্ড সবার অলক্ষে ঘটানো যায়! ওঃ কি অপূর্ব এবং অবিশ্বাস্য!
পোয়ারো বলতে থাকেন।
ডঃ লিডনার ছাদে ব্যস্ত তার পটারির কাজে। মিঃ এমোট, মনে আছে তিনি আপনাকে মিনিট দশেক ছাদে আটক করে রাখেন কথার ছলে। ইতিমধ্যে আপনার সহকারী সেই বাচ্চা বয়টি কোটইয়ার্ডের বাইরে চলে যায়। নিচে ফিরে এসে আপনি তার খোঁজে চিৎকার শুরু করে দেন। সেই সুযোগে ডঃ লিডনার তৎপর হয়ে ওঠেন তার পরিকল্পিত কাজের চূড়ান্ত রূপ দেবার জন্য। পকেট থেকে আঠালো মুখোসটা বার করেন, যে মুখোস দিয়ে এর আগে তিনি তার স্ত্রীকে বেশ কয়েকবার ভয় দেখিয়েছিলেন। ছাদের প্যারাপেট থেকে ডঃ লিডনার তার দেহটা ঝুলিয়ে দেন, তার হাতের মুখোসটা মিসেস লিডনারের ঘরের জানালায় আঘাত করতে থাকেন ক্রমাগত। মনে রাখবেন–সেই জানালাটা ছিল কান্ট্রিসাইডের ঠিক বিপরীত দিকে।
ওদিকে তখন মিসেস লিডনার আধোঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন। তখন ভরা দুপুর। ঘুম ভেঙ্গে যেতেই তিনি চিন্তা করেন। প্রকাশ্য দিবালোকে তার জানালায় টোকা মারার মতো দুঃসাহস কে দেখায়? বিছানা থেকে নেমে তিনি জানালার সামনে এসে দাঁড়ান। কৌতুহল মেটাতে জানালা খোলেন তিনি অন্য মেয়েদের মত। তারপর খলা জানালা পথে মুখ বাড়িয়ে উপর দিকে তাকাতে যান। ওদিকে প্যারাপেটের উপর অপেক্ষা করছিলেন ডঃ লিডনার তার হাতের সেই ভারী পাথরের যাতাটা নিয়ে। মুহূর্তে আর বিলম্ব না করে সেই মুহূর্তে তিনি সেটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন তার স্ত্রীর মাথা লক্ষ্য করে
একটা ক্ষীণ আর্তচিৎকার (মিস জনসন যে শব্দটা শুনতে পান) করার পর মিসেস লিডনারের রক্তাক্ত দেহটা জানালার নিচে লুটিয়ে পড়ে।
তিনি যদি তার স্ত্রীকে অত ভালবেসেই থাকবেন, কেন তবে তাকে হত্যা করতে যাকেন? অধৈর্য হয়ে ডঃ রেলি প্রশ্ন করেন-এ খুনের মোটিভ কী? লিডনার আপনি বলতে পারেন? বলে দিন মঁসিয়ে পোয়ারোকে পাগলের প্রলাপ বকছেন তিনি।
ডঃ লিডনার না পারলেন কথা বলতে, না পারলেন একটু নড়ে চড়ে বসতে।
তার হয়ে পোয়ারোই জবাব দিলেন–আমি আপনাদের বলেছি অপরাধটা একটা অভ্যাস। মিসেস লিডনারের প্রথম স্বামীও তো খুব ভালবাসতেন, তবে কেন তিনি তাঁকে হুমকি দিয়ে চিঠি লিখতেন? কারণ তিনি তাকে গভীরভাবে ভালবাসতেন। ফ্রেডরিক বনসারের প্রসঙ্গ উঠতেই দ্বিতীয়বার আমি আবার মিসেস লিডনারের আগের জীবনে ফিরে যাচ্ছি। আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করে থাকবেন–ডঃ লিডনারের তাঁর বিয়ে হওয়ার আগের মুহূর্তে কিম্বা ঠিক পরমুহূর্তে সেই ধরনের কোন বেনামা চিঠি আসেনি তাঁর কাছে। কেন? এই প্রশ্নের মধ্যেই আমি ডঃ লিডনারের পরিচয় উপলব্ধি করতে পেরেছি সত্যি কি সহজ উপলব্ধি আমার–ডঃ লিডনারের আসল পরিচয় হল ফ্রেডরিক বনসার। যৌবনে এই ফ্রেডরিক লুসিকে পাগলের মত ভালোবাসতেন। সেই স্ত্রী তার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেন। পিতার সাহায্যে তাঁর প্রাণদন্ডের ব্যবস্থা করেন। পরে তিনি জেল-হাজত থেকে পালিয়ে যেতে গিয়ে এক ট্রেন দুর্ঘটনায় পতিত হন। সৌভাগ্য যে, প্রাণে বেঁচে যান তিনি। তার সহযাত্রী সুইডিশ প্রত্নতত্ত্ববিদ এরিক লিডনার তার চোখের সামনে সেই দুর্ঘটনায় নিহত হন। ফ্রেডরিকের মাথায় হঠাৎ একটা বুদ্ধি খেলে যায় তখন। এরিক লিডনারের পরিচয় নেন তিনি এবং নিহত এরিক লিডনারকে তার পোষাক এবং পরিচয় ভূষিত করে সরে পড়েন ঘটনাস্থল থেকে। পরবর্তীকালে এরিক লিডনারের মৃতদেহ ফ্রেডরিক বনসারের বলে সমাধিত করা হয়।
তারপরের ঘটনা তো অতি সহজ এবং সরল। নতুন করে এরিক লিডনারের পরিচয় দিয়ে লুসির মন জয় করেন তিনি। ছদ্মবেশের আড়ালে লুসি তাকে চিনতে পারলেন না। বেচারি! ডঃ লিডনার সুযোগ খোঁজেন কিভাবে তাঁর স্ত্রীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া যায়। মাঝে কতকগুলো বেনামা চিঠি পাঠিয়ে তিনি তার এ্যালিবি তৈরি করে রাখেন, ফ্রেডরিক বনসার তখনও জীবিত। শেষ দিকে মিসেস লিডনার বোধহয় তার পরিচয়টা আন্দাজ করতে পেরেছিলেন। যার ফলে তিনি শেষ দিকে রিচার্ড ক্যারির দিকে ঝোঁকেন। এই সুযোগটাই চাইছিলেন ডঃ লিডনার। এবং সেই সুযোগের সদ্ব্যাবহার করেন সেদিন অপরাহ্ন বেলায় সবার অলক্ষ্যে হলেও মিস জনসনের চোখে তিনি ধরা পড়ে যান। তাই তাঁকেও চলে যেতে হল। আমি আবার বলছি–খুন একটা বড় অভ্যাস ডঃ লিডনারের, তাই তিনি রেহাই দিলেন না মিস জনসনকেও! কি–আমি ঠিক বলিনি ডঃ লিডনার?
ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে ছিলেন ডঃ লিডনার। অবশেষে তিনি ভেঙ্গে পড়লেন–হ্যাঁ আমি তাকেও খুন করেছি। বেচারি জনসন। আমি দুঃখিত–এ আমার অজ্ঞতার পরিচয়, এ আমার নিষ্ঠুরতার পরিচয়। মঁসিয়ে পোয়ারো আপনিও একজন দক্ষ প্রত্নতত্ত্ববিদ খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে আমাদের অতীতকে আবিষ্কার করলেন এক নতুন রঙে, এক নতুন ঢঙে। আমার ঘুমন্তু সত্ত্বাকে আপনি জাগিয়ে তুললেন, লুসির ব্যবহারে পৃথিবীর সমস্ত নারীর প্রতি আমার বিতৃষ্ণা জেগে ওঠে। তাই খুন আমার একটা অভ্যাসে দাঁড়িয়ে যায়। মিস জনসন সেই বদ অভ্যাসের শেষতম শিকার!
আর লুসিকে আমি ভালবেসেছিলাম এবং তাকে আমি খুনও করেছি। আপনি যদি লুসিকে বুঝে থাকেন, অহলে আমাকেও উপলব্ধি করতে পারবেন….না, আমার ধারণা আমার সম্বন্ধে আপনার চিন্তাধারা অন্য…..।