২৫. আচমকা উচ্চস্বরে হেসে

২৫.

পোয়ারো আচমকা উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন। কোনরকমে তিনি আর নিজেকে সংযত রাখতে পারলেন না। তার মাথা পেছনদিকে হেলে পড়েছে। দু-চক্ষু মুদ্রিত ফরাসি দেশসুলভ প্রাণখোলা উচ্চ হাসির দমকে গম গম করে উঠল সমস্ত হলঘরটা। মাফ করবেন, তিনি চোখ মুছতে মুছতে বললেন, কোনো রকমেই হাসির বেগটাকে সামলে রাখতে পারলাম না। মজা কি জানেন, এই ব্যাপারটা নিয়ে আমরা কত তর্ক করলাম, যুক্তি দেখালাম, কত প্রশ্নের অবতারণা হল, মনস্তত্বের দোহাই পাড়লাম, অথচ সব সময়েই এ ব্যাপারে এমন একজন প্রত্যক্ষদর্শী থেকে গেছেন, যার একজনের চোখের সামনেই এই রহস্যমান হত্যাকান্ডটা সংঘটিত হয়েছে। আমার বিনীত অনুরোধ, কি দেখেছেন দয়া করে খুলে বলুন।

তখন বেশ রাত হবে। অ্যানা মেরিডিথ ছিল ডামি। ও উঠে দাঁড়িয়ে পার্টনারের হাতের তাসটা উঁকি মেরে একবার দেখে নিলো। তারপর ঘরের মধ্যে ইতস্তত ঘুরে বেড়াতে লাগল। তাসটা তেমন ঘোরপ্যাঁচের নয়, কি হবে সমস্তই স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। তাই খেলার দিকে আমারও তেমন মন ছিল না। খেলাটা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে এমন সময় মিঃ শ্যাতানা যেদিকে বসেছিলেন হঠাৎ সেদিকে আমার নজর গেল। অ্যানা মেরিডিথ শ্যাতানার চেয়ারের ওপর ঝুঁকে পড়ে কি যেন করছে। তারপর ধীরে ধীরে সোজা ভাবে উঠে দাঁড়ালো। তার হাতটা ভদ্রলোকের বুকের ওপর ন্যস্ত। চোখে মুখে ভীতসন্ত্রস্ত ভাব। চকিত দৃষ্টিতে সে একবার আমাদের দিকে ফিরে তাকালো। সেই মুহূর্তে তার চোখে অপরাধের ছায়া লক্ষ্য করছিলাম। প্রকৃত ব্যাপারটা কি তখন সেটা অনুমান করতে পারিনি। পরে সমস্ত পরিষ্কার হয়ে গেল। সবই বুঝতে পারলাম।

পোয়ারো গম্ভীরভাবে মাথা নাড়লেন। বললেন, কিন্তু আপনি যে দেখে ফেলেছেন সেটা নিশ্চয় ও জানে না? আপনি তখন ওকে লক্ষ্য করেছিলেন তা বোধহয় ওর নজরে পড়েনি?

আহা বেচারি। সমবেদনায় আর্ত হয়ে উঠলেন মিসেস লরিমার। বড়ই ভয় পেয়ে গেছে। কতখানি শঙ্কা বুকে নিয়েই না বেঁচে আছে পৃথিবীতে! কেন আমি সমস্ত কিছু গোপন করেছিলাম সেকথা ভেবে নিশ্চয় আপনি অবাক হয়ে যাচ্ছেন?

না না, আমি মোটেই অবাক হইনি।

 বিশেষত আপনি যখন জানেন যে আমি……আমি…উদাসীন ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বাকিটা শেষ করলেন মিসেস লরিমার। অভিযোগকারী হিসাবে দাঁড়াবার যোগ্যতাও নিশ্চয় আমার নেই। সে দায়িত্ব কেবলই পুলিশের।

তা ঠিক। কিন্তু আপনি তার থেকেও অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছিলেন।

মিসেস লরিমার বিমর্ষভাবে বললেন, আমি এতটা নরম হৃদয় বা সংবেদনশীল ছিলাম না। তবে বয়সের সঙ্গে সঙ্গেই মানুষের মনে এসব অভ্যাস জন্ম নেয়। তা না-হলে দয়া জিনিসটা কোনোদিনই আমাকে এতটা বিচলিত করে তোলেনি।

সংবেদনশীল কথাটা বেশ শ্রুতিমধুর। উচ্চারণও বেশ গালভরা। পোয়ারো মন্তব্য করলেন, তবে ম্যাডাম, এর যথেচ্ছা প্রয়োগ সমাজের আর পাঁচজনের পক্ষে সর্বদা নিরাপদ নয়। অ্যানা মেরিডিথের বয়স খুবই অল্প, চোখে মুখে একটা ভীত চকিত ভাব। দেখলে মনে হয়, একটু কঠোর কথা বললেই এক্ষুণি বুঝি ভেঙে পড়বে।–হ্যাঁ ঠিকই, সমবেদনা পাবার আদর্শ পাত্রী হিসাবে সকলের কাছেই বিবেচ্য হতে পারে। আমি কিন্তু তাদের সঙ্গে একমত নই। সেদিন অ্যানা মেরিডিথ কেন মিঃ শ্যাতানাকে হত্যা করেছিল জানেন? কারণ তিনি জানতেন অতীতে অ্যানা এক বৃদ্ধ বয়সি মহিলাকে খুন করেছিল। সেই মহিলার কাছেই তখন সে কাজ করত। একবার চুরি করতে গিয়ে অ্যানা এই ভদ্রমহিলার কাছে ধরা পড়ে যায়। তার ফলেই অ্যানা তাকে খুন করে। চিরকালের জন্য ভদ্রমহিলার মুখ বন্ধ করে দেওয়াই ছিল তার উদ্দেশ্য।

এসব কি সত্যি পোয়ারো?

এর সত্যতা সম্বন্ধে আমার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। লোকে তাকে দেখে বলবে, কি ভদ্র, কিনম্র মেয়ে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ওই ছোট শান্তশিষ্ঠ অ্যানা মেরিডিথ খুবই সাংঘাতিক, খুবই বিপজ্জনক। যেখানেই তার সুখ বা নিরাপত্তার প্রশ্ন জড়িত থাকবে সেখানেই সে ভয়াবহভাবে হিংস্র বন্য হয়ে উঠবে। উন্মত্তের মতো কল্পিত শত্রুকে ছোবল মারতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করবে না। কারোর ওপরই তখন তার বিশ্বাস নেই। আর ওই দুটো অপরাধই তার জীবনের শেষ অপরাধ নয়। এর ফলে সে ক্রমশ আত্মবিকাশ লাভ করবে। ভাববে খুনটা খুবই অনায়াস সহজসাধ্য।

মিসেস লরিমারের কণ্ঠস্বর তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল। তিনি যে মনে মনে ভয় পেয়েছেন, বুঝতে দেরি হয় না। আপনি তো মারাত্মক সাংঘাতিক সব কথা বলছেন, মঁসিয়ে পোয়ারো। অবিশ্বাস্য…..অকল্পনীয়…।

পোয়ারো উঠে দাঁড়ালেন। তাহলে আমি এখন বিদায় নিচ্ছি, ম্যাডাম। যা বললাম, ভেবে দেখবেন।

মিসেস লরিমারের চোখেমুখে একটা অনিশ্চয়তার ভাব উঁকি দিল। পরে নিজেকে সামলে নিলেন। যদি আমার তেমন মনে হয়, তাহলে মঁসিয়ে পোয়ারো, আমি কিন্তু আজকের এইসব কথাবার্তা একেবারে অস্বীকারও করতে পারি। মনে রাখবেন, আপনার কোনো সাক্ষী নেই। সেই সর্বনাশা সন্ধ্যায় আমি যা দেখেছি বলে এইমাত্র আপনাকে জানালাম তা কিন্তু আপনার আমার ব্যক্তিগত বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে।

পোয়ারো সরল সুরে তাকে আশ্বস্ত করলেন। কোনো ভয় নেই ম্যাডাম, আপনি সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। আপনার অনুমতি না নিয়ে এই বিষয়ে আমি কিছুই বলব না। আমার নিজস্ব একটা কর্মপদ্ধতি আছে তাছাড়া এখন যখন জানি কোন দিকে আমি এগোচ্ছি।

গভীর আন্তরিকতায় তিনি মিসেস লরিমারের দু’হাত চেপে ধরে করমর্দন করলেন। বলতে বাধ্য হচ্ছি আপনি প্রকৃতপক্ষে একজন স্মরণীয় মহিলা। আপনার প্রতি আমার সশ্রদ্ধ স্বীকৃতি রইল। এমন মহিলা হাজারে একটা মেলে কিনা সন্দেহ, কেন না, এক্ষেত্রে হাজারের মধ্যে নশো নিরানব্বই মহিলা যা করতেন আপনি তা করেননি।

সেটা কি?

কেন আপনি আপনার স্বামীকে হত্যা করেছিলেন, এবং সেটা কতখানিই বা যুক্তিপূর্ণ ছিল, সে ইতিবৃত্ত বর্ণনা করবার লোভ অন্য কোনো মহিলার পক্ষে সামলানো শক্ত হত।

মিসেস লরিমার সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। তার কণ্ঠস্বর দৃঢ়তায় কঠোর। মঁসিয়ে পোয়ারো, আমার যুক্তি সম্পূর্ণই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার। তাঁর সশ্রদ্ধ মনোভাব ব্যক্ত করলেন।

ঠান্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। বাড়ির বাইরে পা দিতেই সেটা টের পাওয়া গেল। একটা খালি ট্যাক্সির খোঁজে চারধারে চোখ ফেরালো। কিন্তু সে মুহূর্তে একটা ট্যাক্সিও দৃষ্টিগোচর হল না। অগত্যা কিংসরোড অভিমুখেই হাঁটতে শুরু করলেন তিনি।

তাঁর সমস্ত মন তখন গভীর ভাবনায় আচ্ছন্ন। মাঝে মাঝে মাথা নাড়ছিলেন নিজের খেয়ালমতো।

নিজের বাড়িতে ফিরে এসে দেখলেন ব্যাটেল বিদায় নিয়ে চলে গেছেন। ভদ্রলোক তার জন্য কোনো খবরও রেখে যাননি।

তিনি রিসিভার তুলে সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেলকে ফোন করলেন।

হ্যাল্লো। ব্যাটেলের ভরাট কণ্ঠস্বর ভেসে এলো। কিছু পেলেন?

আমি যা বলছি মশাই শুনুন; মিস মেরিডিথের সঙ্গে অনতিবিলম্বে একবার দেখা করা প্রয়োজন। এবং সেটা খুবই জরুরি।

হ্যাঁ, তার সঙ্গে যোগাযোগের কথা আমিও ইতিমধ্যে চিন্তা করেছি। কিন্তু হঠাৎ সেটা এত জরুরি হয়ে উঠল কি কারণে।

কারণ মঁসিয়ে ব্যাটেল, সে আরও সাংঘাতিক বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। সে সম্ভাবনাটা অবহেলা করে উড়িয়ে দেবেন না।

সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল মিনিটখানেক নির্বাক থেকে পুনরায় কথা শুরু করলেন। আপনার বক্তব্য আমি বুঝতে পারছি। কিন্তু আর তো কেউ নেই…অবশ্য আমাদের সেজন্য হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা উচিত নয়। সত্যি বলতে কি আমি ইতিমধ্যেই তার কাছে সরকারিভাবে চিঠি পাঠিয়েছি। লিখেছি, আগামী কাল তার সঙ্গে উইলিং ফোর্ডে দেখা করব। আমার মনে হয়, আগে থেকে এইভাবে চিঠি পাঠাবার ফলে সে বেশ কিছুটা নার্ভাস হয়ে পড়তে পারে। তাতে তাকে কায়দা করা সহজ হবে।

হ্যাঁ, সম্ভাবনাটা অমূলক নয়। আপত্তি না থাকলে আমিই আপনার সঙ্গে যেতে পারি।

 নিশ্চয় নিশ্চয়। আপত্তি কি মশাই, আপনাকে সঙ্গে পেলে আমি খুবই খুশি হব। নিজেকে অত্যন্ত সম্মানিত বোধ করব।

পোয়ারো চিন্তান্বিত চিত্তে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন। তার মনটা যেন আজ কিছুতেই স্থির থাকতে চাইছে না। সর্বদাই এক জ্বালাময় অস্বস্তি। ঠিক কোথা থেকে যে এর উৎস। একা একা অনেকক্ষণ আগুনের চুল্লিটার পাশে একটা চেয়ার টেনে নিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন। কপালে চিন্তার রেখা ঢেউ খেলে যাচ্ছে। অবশেষে সমূহ ভয় ভাবনা দূরে ঠেলে ঘুমচোখে বিছানার দিকে এগোলেন।

কাল সকালেই দেখা যাবে। মনে মনে বিড়বিড় করলেন তিনি।

কিন্তু আগামী প্রভাত তার সামনে কিরূপে হাজির হবে তার কোনো স্পষ্ট ধারণা করে উঠতে পারলেন না।

.

২৬.

পোয়ারো যখন প্রভাতী কফি আর ভেজিটেবিল রোল সহযোগে ব্রেকফাস্টের জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন, এমন সময় টেলিফোনে শমন এসে হাজির হল। রিসিভার কানে তুলতে না তুলতেই ব্যাটেলের উৎকণ্ঠিত কণ্ঠস্বর, মঁসিয়ে পোয়ারো।

হ্যাঁ কিন্তু আপনার কি খবর? সুপারিনটেনডেন্টের কণ্ঠস্বর কানে বাজবার সঙ্গে সঙ্গেই পোয়ারো বুঝতে পেরেছেন কিছু একটা ঘটেছে। তার বুকের মধ্যে গত সন্ধ্যার হতাশাধূসর ছায়াটা আবার নতুন করে জুড়ে বসল। তিনি ব্যস্তভাবে তাড়া দিলেন, চুপ করে আছেন কেন, বলুন।

মিসেস লরিমার……

কি খবর মিসেস লরিমারের, গতকাল আপনি তাকে কি বলেছিলেন? নাকি তিনিই আপনার কাছে কোনো স্বীকারোক্তি দিয়ে গেছেন?….কিন্তু আপনার কথা শুনে মনে হল মিস মেরিডিথ সম্বন্ধেই যেন আপনি বেশি সজাগ।

ঠাণ্ডা গলায় প্রশ্ন করলেন পোয়ারো, ঘটনাটা কি?

 আত্মহত্যা।

মিসেস লরিমার আত্মহত্যা করেছেন?

হ্যাঁ, তাই। নানা কারণে ভদ্রমহিলা ইদানীং খুব ভেঙে পড়েছিলেন। তাঁর শরীরও বিশেষ ভালো যাচ্ছিল না। চিকিৎসক তাকে অল্পস্বল্প ঘুমের বড়ি ব্যবহারের নির্দেশ দিয়েছিলেন। গতরাত্রে একসঙ্গে অনেকগুলো বড়ি খাওয়ার ফলে তাঁর মৃত্যু হয়।

পোয়ারো গভীর একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। কোনো দুর্ঘটনা বা অন্য কিছু…..?

না না, একেবারে জলের মতো সহজ সরল ব্যাপার। ভদ্রমহিলা তিন-তিনজনের কাছে চিঠি লিখে জানিয়ে গেছেন।

কোন তিনজন?

 বাকি যারা আছেন…ডাক্তার রবার্টস, মেজর ডেসপার্ড আর মিস মেরিডিথ। পরিষ্কার সোজা চিঠি। তার মধ্যে জটিলতার চিহ্নমাত্র নেই। সমস্ত ঝঞ্জাট ঝামেলা চুকিয়ে ফেলবার এই একটিমাত্র পথই প্রশস্থ বলে তিনি মনে করেন। সেটা হল তার আত্মহত্যা। কারণ তিনিই শ্যাতানার হত্যাকারী। এবং এই ঘটনার ফলে অপর তিনজনকে যে নিদারুন দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে তার জন্য তিনি প্রত্যেকের কাছে বিনীতভাবে ক্ষমাপ্রার্থী। নিখুঁত হিসেবি চিঠি। অল্প কথায় সবকিছু পরিষ্কার ব্যাখ্যা করা আছে। ভদ্রমহিলার চরিত্রের সঙ্গে এর ভাষা অদ্ভুত মিলে যায়।

মিনিট দুয়েক পোয়ারো কোনো কথা বললেন না। রিসিভার ধরে স্থির হয়ে বসে রইলেন।

তাহলে এই হল মিসেস লরিমারের অন্তিম সিদ্ধান্ত। অ্যানা মেরিডিথকে বিপদ ও লোকলজ্জার হাত থেকে বাঁচাবার সংকল্পেই তিনি শেষ পর্যন্ত অবিচলিত রইলেন। দীর্ঘায়িত বেদনাতুর মৃত্যুর চাইতে এই মৃত্যুই তার কাছে কাম্য হয়ে উঠল। তবে এই সিদ্ধান্তের পেছনে স্বার্থহীন আত্মোৎসর্গের ছোঁওয়া আছে। অ্যানা মেরিডিথের জন্য ভদ্রমহিলার অন্তরে একটা মমতাময়ী সহমর্মিতার ভাব দেখা দিয়েছিল। সমস্ত ব্যাপারটাই তিনি নিখুঁত পরিকল্পনায় সুচারুভাবে সম্পন্ন করলেন। একটি আত্মহত্যা…..অপর তিনজন সন্দেহভাজন ব্যক্তির কাছে সরল ভাষায় স্বীকারোক্তি প্রেরণ করা, সত্যিই অসাধারণ ভদ্রমহিলা। মিসেস লরিমারের প্রতি পোয়ারোর শ্রদ্ধা আরও নিবিড় হল। তার চরিত্রানুগ কাজই তিনি করেছেন। সংকল্পে অবিচলিত এবং নিজের পরিকল্পনার সার্থক রূপায়ণেও তিনি অতি মাত্রায় দক্ষ।

পোয়ারো ভেবেছিলেন তিনি তাঁকে বোঝাতে পেরেছেন। কিন্তু নিজের প্রত্যয়ে আস্থা রাখাই তিনি পছন্দ করেন। ভদ্রমহিলার মানসিক দৃঢ়তা খুবই প্রবল।

ব্যাটেলের কণ্ঠস্বরে পোয়ারোর ধ্যান ভঙ্গ হল। জিজ্ঞেস করলেন, গত সন্ধ্যায় কি বলেছিলেন ভদ্রমহিলাকে? তাকেই আমরা সন্দেহ করেছি বলেই কি কিছু ইঙ্গিত দিয়েছিলেন? কিন্তু ফোনে যা বললেন তাতে মনে হল মিস মেরিডিথের ওপরেই আপনার নজর।

পোয়ারো সঙ্গে সঙ্গে কোনো উত্তর দিলেন না। পরলোকগতা মিসেস লরিমার তাঁকে। কোণঠাসা করে রেখে গেছেন। সবকিছু গোপন রাখবেন বলে তিনি তার কাছে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। অবশেষে মৃদুকণ্ঠে বিড়বিড় করলেন, তাহলে হয়তো আমারই ধারণায় কোনো ভ্রান্তি ছিল!

এর বেশি কিছু তিনি বলতে পারলেন না। অনভ্যস্ততার জন্যে কণ্ঠে জড়তা ঘনিয়ে এলো। এই ধরনের ভাষা কদাচিৎ ব্যবহার করেছেন জীবনে।

আপনি ভুল করেছিলেন? প্রশ্ন করলেন ব্যাটেল। তাহলে কোনো কথার সূত্রে তিনি হয়ত। ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু এমনভাবে আমাদের হাতের ফাঁকি দিয়ে উড়ে পালাতে দেওয়া ঠিক যুক্তিযুক্ত হল না।

তার বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগও প্রমাণ করবার ক্ষমতা ছিল না আপনার।

তা অবশ্য ছিল না, …. সেইজন্য মনে হয়, এইভাবে পবিসম্পাতই সবচেয়ে ভালো হয়েছে। তবে ব্যাপারটা এই রকমই ঘটুক সেটা কি আপনার কাম্য ছিল না, মঁসিয়ে পোয়ারো?

মুখে কিছু না বললেও সমস্ত ঘটনাটাই যে তাঁর খুব অপচ্ছন্দের সেটা তার হাবভাবেই বোঝা গেল। বললেন, ঠিক কি ঘটেছে পরিষ্কার করে খুলে বলুন তো?

সকাল আটটার ডাকে রবার্টস এই চিঠি পান। তিনি আর কালবিলম্ব না করে তার নিজের গাড়িতে চড়ে মিসেস লরিমারের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা হয়ে পড়েন। তার পরিচারিকাকে আমাদের সঙ্গে যোগাযোগ করার নির্দেশ দিয়ে যান। সে তার কর্তব্য যথাযথ পালন করে। এদিকে রবার্টস মিসেস লরিমারের বাড়ি গিয়ে শোনেন, ভদ্রমহিলা তখনও ঘুম থেকে ওঠেনি। তিনি দ্রুত পায়ে তার শোবার ঘরে গিয়ে হাজির হন। কিন্তু তখন আর করবার কিছু ছিল না। সব শেষ। আমাদের ডিভিশনাল সার্জেনও প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হাজির হয়েছিলেন। তিনিও রবার্টসের কথাতেই সায় দেন।

ঘুমের ট্যাবলেটই এই মৃত্যুর কারণ?

হ্যাঁ, ভদ্রমহিলার মাথার শিয়রেই একটি ভোরোনালের ফাইল পাওয়া গেছে। এক ধরনের ঘুমের ট্যাবলেট। তার প্রায় অর্ধেকটাই খালি।

অন্য দু’জনের কি খবর? তারা কি ইতিমধ্যে আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেননি?

 ডেসপার্ড শহরের বাইরে গেছেন। আজ সকালের ডাক তার হাতে এখনও পৌঁছয়নি।

আর মিস মেরিডিথ?

অল্প আগে তাকে ফোন করেছিলাম। কি খবর?

আমার ফোন পাবার মাত্র দু’মিনিট আগে সে মিসেস লরিমারের চিঠি পেয়েছে। চিঠিটা তার হাতে একটু দেরিতেই পৌঁছেছিল, বোঝা যাচ্ছে।

চিঠি পাবার পর তার ফলাফল কিছু লক্ষ্য করলেন?

আমার সঙ্গে খুব শান্ত স্বরেই কথা বলল। যেন খুব দুঃখ পেয়েছে এমনই একটা ভাব। তবে এই ঘটনার ফলে যে সে খুব স্বস্তিবোধ করছে সেটা তার গলার স্বরেই টের পাওয়া যায়।

আপনি এখন কোথা থেকে ফোন করছেন?

মিসেস লরিমারের বাড়ি থেকে। একটু অপেক্ষা করুন আমি শিগগিরি পৌঁছচ্ছি।

 পোয়ারো যখন অকুস্থলে হাজির হলেন ডাক্তার রবার্টস তখন প্রস্থানের উপক্রম করছেন। তার সদাহাস্যময় মুখ এখন অদৃশ্য হয়ে গেছে। তার বদলে ফুটে উঠেছে নিষ্ক্রিয় নিরাসক্তি। তাকে এখন খুব ম্লান আর বিবর্ণ মনে হচ্ছে।

কি জঘন্য কান্ড, মঁসিয়ে পোয়ারো। ব্যাপারটা ঘটে যাওয়ার ফলে আমি যে খুব স্বস্তি পেলাম ভাববেন না। সত্যি বলতে কি, আমি খুবই মর্মাহত। মিসেস লরিমারই যে শ্যাতানাকে খুন করেছে তা আগে এক মুহূর্তের জন্যও আমার মনে হয়নি। এটাই হল সবচেয়ে বড় বিস্ময়।

আমিও খুব কম অবাক হইনি। শান্ত স্বভাবের সম্ভ্রান্ত ঘরের আত্মনির্ভর মহিলা। তিনি যে এমন একটা বীভৎস কাজ করতে পারেন সে কথা কল্পনা করাও কষ্টসাধ্য। এর উদ্দেশ্য ই বা কি? অবশ্য এখন আর সেটা জানবার কোনো উপায় নেই। কিন্তু বুকের মধ্যে অদম্য কৌতূহল থেকে যাচ্ছে।

তবে এই ঘটনাটা নিঃসন্দেহে আপনার মনের বোঝা অনেকখানি হাল্কা করে দিয়ে গিয়েছে।

হ্যাঁ, তা আমি অস্বীকার করব না। স্বীকার না করাটা ভন্ডামিরই নামান্তর। লোকে আমাকে খুনি বলে সন্দেহ করছে, এমন অবস্থাটা নিশ্চয় খুব সুখবর নয়। তবে হতভাগ্য মিসেস লরিমারের কথা যদি বলেন তাহলে বলব এই ধরনের আত্মহত্যাই তাঁর নিষ্কৃতি লাভের সর্বশ্রেষ্ঠ পথ।

তিনি নিজেও তাই ভেবেছিলেন। রবার্টস মাথা নাড়লেন। তার বিবেকই বোধহয় তাকে একাজে প্ররোচিত করেছে। বিদায় নিয়ে চলে গেলেন ডাক্তার রবার্টস, পোয়ারো সেখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়েই চিন্তা করলেন কিছু সময়। রবার্টস ঘটনাটা সম্যক উপলব্ধি করতে পারেননি। অনুশোচনার জ্বালায় এ পথ বেছে নেননি মিসেস লরিমার।

সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠবার মুখে প্রৌঢ়া পরিচারিকার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। সে তখন এক কোণে দাঁড়িয়ে ফুফিয়ে ফুফিয়ে কাঁদছে। পোয়ারো তাকে কিছু সান্ত্বনার বাণী শোনালেন। তাতে তার মোক যেন আর উথলে উঠল।

কি ভয়ংকর কি বীভৎস ব্যাপার। আমরা সকলেই তাকে খুব শ্রদ্ধা করতাম। গতকাল সন্ধ্যাবেলা আপনি তার সঙ্গে বসে চা খেলেন। কত সুন্দর ভদ্র ব্যবহার করলেন তিনি। আর আজ সকালেই আমাদের সকলকে ছেড়ে চলে, গেলেন এই শোচনীয় ঘটনার কথা আমি জীবনে ভুলব না। ভদ্রলোক ভোরে এসে দরজায় নক করলেন, আমি গিয়ে সদর দরজা খুলে দিতেই তিনি আমাকে উত্তেজিত কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন মিসেস লরিমার কোথায়? তার উত্তেজিত ভাবভঙ্গি দেখে আমি এত অবাক হয়ে পড়েছিলাম যে ঠিকমতো গুছিয়ে উত্তর দিতে পারলাম না। কোনোরকমে জানালাম, তিনি ঘুম থেকে উঠে ঘন্টি না বাজালে আমরা কেউ গিয়ে তাকে বিরক্ত করি না। এটাই তার আদেশ। আমার কথা শুনে ভদ্রলোক আবার প্রশ্ন করলেন, তার শোবার ঘর কোনটা? কথা বলতে বলতেই তিনি সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে ওপরে উঠতে লাগলেন। আমিও তার পেছন পেছন দৌড়ালাম। দূর থেকে তার শয়নকক্ষটা ইঙ্গিতে দেখাতেই তিনি দরজা ঠেলে ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়লেন। তারপরেই চেঁচিয়ে উঠলেন, হায় হায়, বড় দেরি হয়ে গেছে। আমিও ততক্ষণে সেখানে পৌঁছে। গেছি। দেখলাম, তিনি স্থির হয়ে খাটের ওপর পড়ে আছেন। দেহে প্রাণের কোনো চিহ্ন নেই। ডাক্তার ভদ্রলোক তবু তার হৃদস্পন্দন চালু করবার জন্য যথাযথ চেষ্টা করলেন।

আমাকে বললেন গরম জল আর ব্র্যান্ডি নিয়ে আসতে। কিন্তু সমস্ত প্রচেস্টাই বৃথা হল। ইতিমধ্যে পুলিশের গাড়িও এসে পড়েছে। তারপরেই এই অশান্তি আর গন্ডগোল। কিন্তু এটা স্যার ঠিক ভালো কাজ হচ্ছে না। আমার কর্ত্রী এসব খুবই অপছন্দ করতেন। আর যাই হোক, গেরস্ত বাড়িতে পুলিশ ঢুকবে কেন? এ ব্যাপারে তাদের এত মাথা গলাবার কি দরকার? তিনি যদি ভুল করে দু-একটা বড়ি বেশি খেয়ে মারা গিয়ে থাকেন, তাহলেও সেটা দুর্ঘটনা ছাড়া অন্য কিছু নয়?

পোয়ারো একথার কোনো জবাব দিলেন না। প্রশ্ন করলেন, গতকাল রাত্রে মিসেস লরিমার কি অন্যদিনের মতো সম্পূর্ণ স্বভাবিক ছিলেন? তাকে কি কোনো কারণে বিশেষ উদ্বিগ্ন বা চিন্তিত বলে মনে হচ্ছিল?

না, আমার তেমন কিছু নজরে পড়েনি। তবে তাকে খুব ক্লান্ত দেখাচ্ছিল। তাছাড়া মনে হয়, তিনি খুব যন্ত্রণা পাচ্ছিলেন। ইদানীং তার শরীর বিশেষ ভালো যাচ্ছিল না।

হ্যাঁ, সে আমি জানি।

পোয়ারোর কণ্ঠে সমবেদনার স্পর্শ পেয়ে প্রৌঢ়া দাসী আরও মুখর হয়ে উঠল। তিনি কখনো তার অসুখ বিসুখের জন্য কোনো অভিযোগ করতেন না। তা সত্ত্বেও আমি আর রাঁধুনি-ঝি দু’জনেই তার বর্তমান শারীরিক অবস্থার কথা ভেবে খুব চিন্তায় পড়েছিলাম। তিনি আর আগের মতো কর্মক্ষম ছিলেন না। অল্পেই পরিশ্রান্ত বোধ করতেন। গতকাল আপনি বিদায় নেবার পর আর এক অল্পবয়সি মহিলা তার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। মনে হয় সেই কারণেও তিনি কিছুটা উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তে পারেন।

পোয়ারো সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে উঠতে দাঁড়িয়ে পড়লেন। পিছনে ফিরে তাকিয়ে তীক্ষ্ণ কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, তরুণী মহিলা? গত সন্ধ্যায় কেউ কি তোমার কর্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল?

হ্যাঁ স্যার। আপনি চলে যাবার ঠিক পরেই তিনি এলেন নাম বললেন মিস মেরিডিথ।

 কতক্ষণ ছিলেন তিনি?

প্রায় ঘন্টা খানেক।

পোয়ারো ক্ষণকাল নীরব থেকে প্রশ্ন করলেন, তারপর?

তারপর উনি শুতে গেলেন। সন্ধ্যার ডিনারটা শোবার ঘরেই দিয়ে যেতে বললেন। বললেন, এখন খুব পরিশ্রান্ত বোধ করছেন।

পোয়ারো আবার কিছু সময় নীরবে দাঁড়িয়ে রইলেন। গতকাল সন্ধ্যায় তোমার কর্ত্রী কোনো চিঠিপত্র লিখেছিলেন?

শুতে যাবার পর তিনি কোনো চিঠি লিখেছিলেন কিনা জানতে চাইছেন? তবে আমার তা মনে হয় না।

কিন্তু তুমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত নও, এই তো?

বসবার ঘরের টেবিলের ওপর ডাকে পাঠাবার জন্য গোটা কতক চিঠি পড়েছিল। রাত্রে বাইরের গেট বন্ধ করার আগে আমি সেগুলো নিয়ে গিয়ে ডাকে দিয়ে আসি। কিন্তু সে চিঠিগুলো তো অনেক আগে থেকেই টেবিলের ওপর রাখা ছিল।

মোট কতগুলো চিঠি ছিল?

সঠিক বলতে পারব না। দুটো কি তিনটে। তিনটেই হবে হয়তো।

 চিঠি ডাকে দেবার আগে তাদের ঠিকানা কিছু লক্ষ্য করোনি? ভেবেচিন্তে আমার প্রশ্নের জবাব দাও। বিষয়টা খুব জরুরি।

আমি নিজেই চিঠিগুলো গেটের পাশে ডাকবাক্সে ফেলেছিলাম। সেই সময় ওপরের চিঠির ঠিকানাটা আমার নজরে পড়েছিল। সেটা হচ্ছে ফোর্টনম অ্যান্ড ম্যাসন। তবে অন্য গুলোর কথা আমি বলতে পারব না।

তার গলার সুরে মনে হল সে সত্যি কথাই বলছে।

 চিঠি যে তিনটের বেশি ছিল না তাতে কোনো সন্দেহ নেই তো?

হ্যাঁ স্যার, এ বিষয়ে আমি সম্পূর্ণ নিশ্চিত।

পোয়ারো গম্ভীরভাবে বারকয়েক মাথা নাড়লেন। শূন্য দৃষ্টিতে সিঁড়ির দিকে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তোমার কী যে ওষুধ হিসাবে ঘুমের বড়ি ব্যবহার করতেন তা তুমি নিশ্চয় জানো?

হ্যাঁ, ডাঃ লঙ-ই তাঁকে এই বড়ি খাওয়ার জন্য নির্দেশ দিয়েছিলেন। ঘুমের বড়ির শিশিটা কোথায় থাকত।

তাঁর শোবার ঘরের ছোট জাল আলমারির মধ্যে।

পোয়ারো আর কোনো প্রশ্ন না করে সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে গেলেন। তার মুখের ভাব থমথমে গম্ভীর। যেন আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস।

দোতলায় সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল তাকে মাথা নেড়ে স্বাগত জানালেন। ব্যাটেলের মুখে চোখেও চিন্তা আর অস্বস্তির ছাপ। আপনি এসেছেন বলে আমি খুবই আনন্দিত, মঁসিয়ে পোয়ারো। আসুন, আপনার সঙ্গে ডাঃ ডেভিডসনের পরিচয় করিয়ে দিই।

ডিভিসনাল সার্জন হাত বাড়িয়ে পোয়ারোর সঙ্গে করমর্দন করলেন। তিনি বেশ দীর্ঘকায়। মুখে বিষাদমুখর ভাব।

ভাগ্য আমাদের বিরুদ্ধে। হতাশভাবে তিনি বললেন। ঘন্টাখানেক কি ঘন্টা দুয়েক আগে টের পেলে ভদ্রমহিলাকে বাঁচাতে পারতাম।

হুঁ, মাথা নাড়লেন ব্যাটেল। সরকারিভাবে আমি অবশ্য কিছু মন্তব্য করছি না। তবে ব্যক্তিগতভাবে এ ব্যাপারে আমি তেমন দুঃখিত নই।

সত্যিকারের ভদ্রমহিলা বলতে যা বোঝায় তিনি ছিলেন তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। কি জন্য তিনি মিঃ শ্যাতানাকে খুন করেছিলেন তা জানি না, নিশ্চয় কোনো সঙ্গত কারণ ছিল।

তবে….পোয়ারো বললেন, তিনি তার বিচার শেষ হওয়া পর্যন্ত বেঁচে থাকতেন কিনা সন্দেহ। ইদানীং তিনি খুবই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন।

ডিভিশনাল সার্জনও এ কথায় সায় দিলেন। আপনি ঠিকই বলেছেন সিয়ে, ভদ্রমহিলার আয়ু আর বেশিদিন অবশিষ্ট ছিল না। হয়তো এইভাবে শেষ হওয়াটাই তার পক্ষে সবচেয়ে ভালো হল।

তিনি সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামবার উদ্যোগ করলেন।

এক মিনিট ডাক্তার…..পেছন থেকে ডেকে উঠলেন ব্যাটেল।

পোয়ারো মিসেস লরিমারের শয়নকক্ষের দিকে এগিয়ে গেলেন, আমি কি ভেতরে ঢুকে একবার মৃতদেহটা দেখতে পারি?

নিশ্চয় নিশ্চয়। ব্যাটেল মাথা নেড়ে সম্মতি জানালেন। আমাদের পরীক্ষা নীরিক্ষার কাজ সাড়া হয়ে গেছে।

পোয়ারো ভেতরে ঢুকে দরজা ভেজিয়ে দিলেন। মিসেস লরিমারের প্রাণহীন দেহটা বিছানার ওপর স্থির হয়ে পড়ে আছে। তিনি ঝুঁকে পড়ে এক দৃষ্টিতে সেই শান্ত নিথর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।

তার বুকের মধ্যে একটা ঘন জমাট অশান্তি ক্রমশই পুঞ্জীভূত হয়ে উঠতে শুরু করল। সত্যিই কি মিসেস লরিমার একটি তরুণীকে অপমান এবং মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্যই শেষ পর্যন্ত এই পথ বেছে নিলেন? না এর পেছনে অন্য কোনো রহস্যময় অশুভ কারণ নিহিত আছে?

অন্তত কয়েকটি তথ্য….অকস্মাৎ তিনি খাটের ওপর আরও কিছুটা ঝুঁকে পড়লেন। মৃতদেহের বাঁ হাতের মাঝখানে এক ফোঁটা অতি সূক্ষ্ম বিবর্ণ রক্তচিহ্ন।

সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন পোয়ারো। এক ধরনের অদ্ভুত সবুজ আলো তার চোখের মধ্যে চৰ্চ করছে। শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বার পূর্বমুহূর্তে শিকারী বেড়ালের চোখে যে ধরনের আলো জ্বলে ওঠে অনেকটা সেই রকম। পোয়ারোকে যারা গভীরভাবে চেনেন তারা সকলেই তার এ দৃষ্টির সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচিত।

তিনি দ্রুত পায়ে ঘর ত্যাগ করে নীচে এলেন। ব্যাটেল তখন তার এক অধীনস্থ কর্মচারীর সঙ্গে ফোনের পাশে দাঁড়িয়ে আছেন। কর্মচারীটি রিসিভার নামিয়ে রাখতে রাখতে বিনীতভঙ্গিতে মাথা নাড়লেন, না স্যার, তিনি এখনও তার ফ্ল্যাটে ফিরে আসেননি।

পোয়ারোকে লক্ষ্য করে ব্যাটেল বললেন অনেকক্ষণ থেকে ডেসপার্ডকে ফোনে ধরবার চেষ্টা করছি। চেলসি ডাকঘরের ছাপমারা তার নামে একটা চিঠি আছে।

হঠাৎ একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করলেন পোয়ারো। ডাক্তার রবার্টস কি এখানে আসবার আগে ব্রেকফাস্ট সেরে বেরিয়েছিলেন?

ব্যাটেল অবাক চোখে তাকালেন। না, ভদ্রলোক একবার বলছিলেন যে ব্রেকফাস্ট না সেরেই তিনি তাড়াতাড়ি বেড়িয়ে পড়েছেন।

 তাহলে তাকে নিশ্চয় এখন বাড়িতেই পাওয়া যাবে?

কিন্তু কেন…..?

পোয়ারো ততক্ষণে রিসিভার তুলে ডায়াল ঘোরাতে শুরু করেছেন।

একটু পরেই তার গলা শোনা গেল। কে ডাক্তার রবার্টস? সুপ্রভাত। আমি এরকুল পোয়ারো কথা বলছি। একটা কথা জানবার আছে। আপনি কি মিসেস লরিমারের হস্তাক্ষরের সঙ্গে সুবিশেষ পরিচিতি?

মিসেস লরিমারের হস্তাক্ষর? না, আগে কখনো দেখেছি বলে মনে পড়ে না।

ধন্যবাদ, অশেষ ধন্যবাদ। পোয়ারো আর অপেক্ষা না করে রিসিভার নামিয়ে রাখলেন।

বড় বড় চোখ তুলে পোয়ারোর কাজকর্ম লক্ষ্য করছিলেন ব্যাটেল। বিস্ময়ের সুরে বললেন, আপনার মতলবটা কি মঁসিয়ে পোয়ারো?

পোয়ারো ব্যাটেলের দিকে ফিরে তাকালেন, গতকাল সন্ধ্যায় আমি এখান থেকে বিদায় নেবার পর মিস মেরিডিথ হাজির হয়েছিলেন। প্রকৃতপক্ষে আমি তাকে এ বাড়িতে ঢুকতে দেখেছিলাম, কিন্তু সেই যে মিস মেরিডিথ সে বিষয়ে অতটা নিশ্চিত ছিলাম না। মিস মেরিডিথ বিদায় নেবার পর মিসেস লরিমার শুতে যান। সেই সময় এ বাড়ির ঝি তাকে কোনো চিঠিপত্র লিখতে দেখেননি। এবং গত সন্ধ্যায় আমার সঙ্গে আলাপ আলোচনার আগে তিনি যে এই চিঠিগুলো লিখে রেখেছিলেন সেটাও ঠিক বিশ্বাসযোগ্য নয়। কারণ তাহলে আভাসে ইঙ্গিতে এবিষয়ে কিছু না কিছু জানতে পারতাম। তাহলে এই চিঠি নিটে কখন তিনি লিখলেন?

কেন? ঝি-চাকররা শুতে যাওয়ার সময় তিনি হয়তো বাইরে বেড়িয়ে এগুলো ডাকে দিয়ে এসেছিলেন।

হ্যাঁ, তা সম্ভব। মাথা নাড়লেন পোয়ারো। আবার এও হতে পারে যে তিনি আদৌ চিঠিগুলো লেখেননি।

প্রচন্ড বিস্ময়ে ব্যাটেল হতবাক হয়ে গেলেন। হায় ভগবান। আপনি বলতে চান।

ইতিমধ্যে ঝনঝন শব্দ করে টেলিফোনটা বেজে উঠল। কর্তব্যরত কর্মচারীটি এগিয়ে গিয়ে ফোন ধরলেন। তারপর রিসিভার নামিয়ে রেখে ব্যাটেলের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। সার্জেন্ট ওকোনারের ফোন, স্যার মেজর ডেসপার্ডের ফ্ল্যাট থেকে ফোন করছে। ওকোনার জানাচ্ছে যে ডেসপার্ড আজ সকালে উইলিংফোর্ডের দিকে যেতে পারে। সেই রকমই কথা বলছে।

পোয়ারোকে রীতিমতো উত্তেজিত মনে হল। তিনি ব্যাটেলের হাত ধরে মৃদু আকর্ষণ করলেন। আমাদের আর এক মুহূর্তও সময় নষ্ট করা অনুচিত। এখনি উইলিংফোর্ডে যাবার ব্যবস্থা করুন। মনটা কিছুতেই সুস্থির হতে চাইছে না। একটা অমঙ্গলের আশঙ্কায় বুকের ভেতরটা ছটপট করছে। হয়তো এটা শেষ নয়। আমি আপনাকে বিশেষভাবে সাবধান করে দিচ্ছি। সুন্দরী মেরিডিথ বয়সে তরুণী হলেও মেয়ে হিসাবে খুবই বিপজ্জনক ও সাংঘাতিক প্রকৃতির। এই বিষয়ে আমাদের অতিমাত্রায় সচেতন হওয়া প্রয়োজন।

.

২৭.

অ্যানা, ডাকলেন রোডা।

উ, অ্যানার কণ্ঠে অন্যমনস্কতার ছোঁওয়া। তিনি তখন টেবিলের ওপর ঝুঁকে পড়ে একটা ক্ৰশওয়ার্ড পাজলের সমাধানে ব্যস্ত।

রোডা রেগে উঠলেন। ওসব পাজল টাজল রাখ তো। সবতাতেই তোর আলসেমি। এখন যা বলছি, মন দিয়ে শোন।

শুনছি, বাবা শুনছি। অ্যানা দৈনিক পত্রিকাটা ভাজ করে মুড়ে রেখে চেয়ারের ওপর সোজা হয়ে উঠে বসলেন। কি বলছিস বল?

হ্যাঁ, শোন। আমি বলছি–রোডা অল্প ইতস্তত করলেন, ওই ভদ্রলোক তো আবার এখানে আসছেন। কে? সুপারিনটেনডেন্ট-ব্যাটেল?

হ্যাঁ……আমার মনে হয় মিসেস বেনসনের ব্যাপারটা তাকে খুলে বলাই ভালো।

তুই কি পাগল হয়েছিস? শীতলকণ্ঠে জবাব দিলেন অ্যানা। এখন তাকে বলতে যাব কি দুঃখে?

কারণ…..কারণ তিনি মনে করতে পারেন তুই হয়তো এই ঘটনাটা লুকোবার চেষ্টা করছিস। এত ঝঞ্ঝাটে কাজ কি? প্রকৃত যা ঘটেছে ভদ্রলোকের কাছে খুলে বল না কেন?

এখন আর তা বলা যায় না। অ্যানার কণ্ঠ পূর্বের মতোই শীতল।

 হুঁ, প্রথমে বললেই সবচেয়ে ভালো করতিস।

 কিন্তু এতদিন বাদে তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে লাভ নেই।

তা ঠিক। রোডার কণ্ঠে সংশয়ের সুর।

অ্যানা এবার বিরক্ত হয়ে উঠলেন। বললেন,আমি তোর কথার মাথামুন্ড কিছুই বুঝতে পারছি না। সেই ঘটনার সঙ্গে বর্তমান ঘটনার সম্পর্ক কি?

না, তা অবশ্যই নেই…..তাছাড়া আমার স্বভাব চরিত্র সম্বন্ধে খোঁজখবর সংগ্রহ করাই ভদ্রলোকের প্রধান উদ্দেশ্য। আমি সেখানে ছিলাম মাত্র দু-মাস। দু-মাসে তারা আমার কতটুকু পরিচয়ই বা পাবে?

তোর যুক্তি খুবই খাঁটি, আমিই হয়তো বোকার মতো কথা বলছি। তবুও কেমন যেন একটা অস্বস্তি থেকে যাচ্ছে। সবকিছু খুলে বলাই তোর উচিত। কেন না, পরে যদি তিনি কোনোদিন এই ঘটনার কথা জানতে পারেন তাহলে ভেবে বসবেন তুই ইচ্ছে করেই ব্যাপারটা তার কাছে গোপন করতে চেয়েছিস। অযথা সন্দেহ বাড়িয়ে লাভ কি?

একটা জিনিস কিছুতেই আমার বোধগম্য হচ্ছেনা একথা বাইরে প্রকাশ পাবে কেমনভাবে? কেবল তুই আর আমি ছাড়া আর তো কেউ জানে না।

না, তা যদিও জানে না….রোডা তোতলাতে শুরু করলেন।

অ্যানা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে রোডার দিকে তাকালেন। রোডার কণ্ঠে ঈষৎ সংশয়ের সুর তার কানকে ফাঁকি দিতে পারেনি। কেন, আর কে জানে বলে তুই মনে করিস?

কয়েক মুহূর্ত নীরব থেকে রোডা উত্তর দিলেন। অনেকেই জানে। কোম্বীকারের বাসিন্দারা নিশ্চয় ঘটনাটা অত সহজে ভুলে যাবে না?

ওঃ তাই বল। অ্যানা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। সেখানকার কোনো লোকের সঙ্গে সুপারিনটেনডেন্টের দেখা হবে কিনা সন্দেহ। ব্যাপারটা খুবই অসম্ভব।

কিন্তু অসম্ভব ব্যাপারও পৃথিবীতে অনেক ঘটে থাকে।

রোডা, তুই কিন্তু এই সামান্য ব্যাপারটা নিয়ে বড় বাড়াবাড়ি আরম্ভ করেছিস। কেবল ফ্যাচ ফ্যাচ ফ্যাচ।

সত্যিই খুব দুঃখিত, অ্যানা। তবে কথাটা যদি একবার পুলিশের কানে যায় তবে তারা অন্য কোনো সন্দেহ করে বসতে পারে। মনে করবে তুই হয়তো কিছু লুকোচ্ছিস।

তারা জানতেই পারবে না। কেইবা তাদের বলবে? তুই আর আমি ছাড়া আর তো কেউ জানে না। এই নিয়ে দ্বিতীয়বার কথাটা উচ্চারণ করলেন অ্যানা। কিন্তু এবারে তার গলার স্বর কেমন পাল্টে গেছে। উচ্চারণের ভঙ্গিটা বেশ অদ্ভুত। কানের মধ্যে যেন একটা শিরশির শিহরণ বয়ে আনে।

রোডা ব্যাজার মুখে বললেন, তাহলেও তোর বলা উচিত।

অ্যানার দিকে এক ধরনের অপরাধী দৃষ্টি নিয়ে ফিরে তাকালেন রোডা। কিন্তু সেদিকে কোনো নজর নেই অ্যানার। তিনি তখন নিজের চিন্তায় বিভোর। তার দীর্ঘ ভ্রুজোড়ায় অস্থির কুঞ্জন। যেন তিনি মনে মনে গভীরভাবে হিসেব করছেন কোনো কিছুর।

মেজর ডেসপার্ডও আজ আসছেন। বেশ মজাই হল দেখছি। রোডার কণ্ঠে এবার উৎসাহের সুর ধ্বনিত হল।

কি?…ও হ্যাঁ….

ভদ্রলোক কিন্তু খুবই সুদর্শন।….তুই যদি, একান্তই তাকে না চাস তো আমাকেই না। হয় দিয়ে দে।

পাগলের মতো বকিস না রোডা। আমার জন্য তাঁর কোনোই মাথাব্যথা নেই।

তাই নাকি। তাহলে কেন তিনি বার বার এখানে ঘোরাফেরা করছেন, তিনি নিশ্চয় তোকে ভালোবাসেন। তুই হচ্ছিস যেন একজন ভাগ্যহতা সুন্দরী তরুণী, যাকে উদ্ধার করবার সুযোগ পেলে ভদ্রলোকের পৌরুষ উদ্বেল হয়ে উঠবে।

তোর মধ্যে পরভৃত্তিকা লতার মতো এমন একটা সুন্দর অসহায় ভাব আছে যা প্রত্যেক পুরুষকেই আকর্ষণ করে।

কেন তিনি তো আমাদের দু’জনকে একই দৃষ্টিতে দেখেন। দু’জনের সঙ্গেই সমানভাবে হাসিমুখে কথা বলেন।

সেটা কেবল তার ভদ্রতা। তবে তুই যদি বাস্তবিকই তাঁকে না চাস তো আমি তখন সমবেদনায় বিগলিত বন্ধুর ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারি। তার ভগ্নহৃদয়ে স্বান্তনার সিন্ধ বাণী ছড়িয়ে নতুন করে আবার তাকে ভরিয়ে তুলতে চেষ্টা করব। কে বলতে পারে হয়তো প্রেম নিবেদনই করে বসব শেষ কালে।

অ্যানা হেসে উঠলেন।

নিশ্চয় নিশ্চয়, তিনি তোকে স্বাগত জানাবেন ওতে কোনো সন্দেহ নেই।

ভদ্রলোক দেখতে এত সুন্দর। দীর্ঘশ্বাস ফেললেন রোন্ডা, কি সুঠাম আর সাবলীল

তুই কি সত্যিই তাকে ভালোবাসিস, অ্যানা?

 হ্যাঁ, নিশ্চয়।

কিন্তু তুই বড় বেশি শান্ত নিরুত্তাপ, ভদ্রলোক আমাকেও কিছুটা পছন্দ করেন তবে তোর মতো এতটা নয়,খুবই যৎসামান্য না রে, ভদ্রলোক তোকেও খুব পছন্দ করেন।

অ্যানার কণ্ঠে আবার সেই আগের সুর ধ্বনিত হল। কেমন একটা শিরশিরে হিমশীতল ভাব। রোডা সেদিকে মন দিলেন না। তিনি প্রশ্ন করলেন, গোয়েন্দা-প্রবর ব্যাটেল কখন এখানে পায়ের ধুলো দিচ্ছেন।

বেলা বারোটায়। উত্তর দিলেন অ্যানা। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আবার মুখ খুললেন, এখন তো সবে সাড়ে দশটা। চল নদী থেকে স্নান করে আসি।

কিন্তু…কিন্তু মেজর ডেসপার্ডও তো এগারোটা নাগাদ এসে পৌঁছোবেন বলে চিঠিতে জানিয়েছেন। তাই না?

আমরা সেজন্য বসে থাকতে যাব কেন? মিসেস অষ্টওয়েলের কাছে একটা চিরকুট লিখে রেখে গেলেই চলবে। তার তেমন জরুরি প্রয়োজন থাকলে তিনি নদীর ধারেই আমাদের সঙ্গে দেখা করতে পারেন।

সেই ভালো, প্রেমিকদের কাছে কখনো নিজেকে খেলো করতে নেই। মায়েরা বরাবর মেয়েদের এই উপদেশেই দিয়ে গেছেন। রোডা মৃদু হাসলেন। তাহলে চল, নদী থেকে ঘুরে আসি। ঠান্ডা হাওয়ায় প্রাণটা জুড়োতে পারে।

বাগানের মাঝখানে দিয়ে পায়ে চলা সরু মেঠো পথ ধরে নদীর দিকে পা বাড়ালেন রোডা, অ্যানা তার পেছন পেছন অনুসরণ করলেন।

দশ মিনিট বাদেই মেজর ডেসপার্ড হাজির হলেন। ভদ্রলোক তার নির্দিষ্ট সময়ের অনেক আগেই এসে পৌঁছেছেন। তাই দু’জনেই বেরিয়ে গেছে শুনে, বেশ কিছুটা অবাক হয়ে গেলেন। মেঠো পথ ধরে নদীর অভিমুখেই হাঁটতে শুরু করলেন তিনি।

মিসেস অস্টওয়েল পেছন থেকে বেশ কিছুক্ষণ মেজর ডেসপার্ডের চলমান মূর্তির দিকে তাকিয়ে রইল। দু’জনের কোনো একজনকে নিশ্চয় উনি ভালোবাসেন, মনে মনে বিড়বিড় করল সে। তবে সেটি কোন জন, মুখ দেখে বোঝবার উপায় নেই। দু’জনের সঙ্গেও একই রকম ব্যবহার করেন। মেয়ে দুটো প্রত্যেকেই যে ভদ্রলোককে ভালোবাসে, সে সম্বন্ধে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা অসম্ভব। যদি সত্যিই তেমনটা ঘটে থাকে, তবে ওদের এই গভীর বন্ধুত্ব আর বেশিদিন অটুট থাকবে না। শিগগির ফাটল দেখা দেবে। দু’জন অল্পবয়স্কা তরুণীর মাঝখানে একজন যুবক এসে দাঁড়ালে কত গন্ডগোলই যে ঘটতে শুরু করে।

বুকের মধ্যে প্রচুর উত্তেজনার খোরাক নিয়েই অস্টওয়েল আবার রান্নাঘরে ফিরে গেল। নিষ্কর্মার মতো দাঁড়িয়ে থাকলে চলবে না। এখনও তার অনেক কাজ বাকি। ব্রেকফাস্টের কাপ ডিশগুলো ধুতে হবে। তারপর ঘরদোর পরিষ্কার করা আরও অনেক রকমের টুকিটাকি হাতের কাজ। ইতিমধ্যে কলিং বেলটা আবার শব্দ করে বেজে উঠল।

কে আবার দিন দুপুরে জ্বালা করতে এলো? খুবই বিরক্ত হল অস্টওয়েল। ওরা যেন ইচ্ছে করেই এই সময়টা বেছে নেয়। নিশ্চয় কোনো পার্শেল। টেলিগ্রাম হওয়াও বিচিত্র নয়।

ব্যাজার মুখে গজ গজ করতে করতে দরজা খুলে দিল সে।

দু’জন ভদ্রলোক বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন। একজন ছোট খাটো চেহারার বিদেশী। অপরজন দীর্ঘকায় বলিষ্ঠ আকৃতির ইংরেজ।

শেষের এই ভদ্রলোকটিকে সে যেন ইতিপূর্বে কোথায় দেখেছে।

মিস মেরিডিথ কি বাড়িতে আছেন? দীর্ঘকায় ভদ্রলোক এগিয়ে এসে প্রশ্ন করলেন।

অষ্টওয়েল মাথা নাড়লেন। একটু আগে বেড়িয়ে গেছেন।

 তাই নাকি! কোন দিকে গেছেন?

আসবার সময় তো পথে দেখা হল না।

মিসেস অস্টওয়েল আড়চোখে বিদেশী ভদ্রলোকের মজাদার গোঁফ জোড়াটা নিরীক্ষণ করছিল। এরা যে মেয়ে দুটির বন্ধুস্থানীয় নয় সেটা স্পষ্টই বোঝা যায়। তাই নিশ্চিন্ত মনে উত্তর দিল, নদীতে স্নান করতে গেছেন।

বিদেশী ভদ্রলোক প্রশ্ন করলেন, আর মিস দোয়াস–?

দু’জনেই একসঙ্গে আছেন।

ধন্যবাদ, ব্যাটেল বললেন, নদীর ঘাটে যাবার রাস্তা কোনটা?

প্রথমে বাঁ দিকের পথ ধরে সোজা এগিয়ে যাবেন তাড়াতাড়ি জবাব দিল অস্টওয়েল, কিছুদূর যাবর পর দেখবেন রাস্তাটা দু’ভাগ হয়ে দু’দিকে বেঁকে গেছে। ডান দিকের রাস্তাটা ধরে অল্প হাঁটলেই নদীর ধারে গিয়ে পড়বেন। মাত্র মিনিট পনেরো আগে ওরা বেড়িয়েছেন। নদীর ঘাটেই নিশ্চয় দেখা হবে।

খুবই অবাক ব্যাপার। অস্টওয়েলের মনে আবার নতুন কৌতূহল উঁকিঝুঁকি মারল। তোমাদের তো ঠিক চিনতে পারলাম না বাপু। তোমরা যে কে তা অনুমান করাও দুঃসাধ্য।

মিসেস অস্টয়েল যখন রান্নাঘরে বসে বসে এইসব সাত পাঁচ ভাবছেন পোয়ারো আর ব্যাটেল তখন বাঁ হাতি পথ ধরে অনেক এগিয়ে গেছেন। পোয়ারোকে উত্তেজিত ভঙ্গিতে দ্রুত পায়ে হাঁটতে দেখে ব্যাটেল কৌতূহলী কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন। অত তাড়া কিসের মঁসিয়ে পোয়ারো? মনে হচ্ছে আপনি যেন খুব ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন?

তা ঠিক; কেন জানি না, আমি নিজে খুব অস্বস্তি বোধ করছি।

কিসের আশঙ্কা করছেন?

পোয়ারো মাথা নাড়লেন। নির্দিষ্ট করে কিছু বলা যায় না; নেহাতই একটা সম্ভাবনা মাত্র। তাহলেও কে বলতে পারে…কিছু একটা নিশ্চয় আপনার মাথায় আছে। তা না হলে সকাল বেলা এক মুহূর্তে সময় নষ্ট না করে এখানে চলে এলেন কেন? এবং আপনার কথাতেই আমি কনস্টেবল টার্নারকে নির্দেশ দিয়ে পাঠালাম, এ অঞ্চলের গ্যাস সরবরাহ যেন কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ রাখা হয়। মেয়েটা কি সাংঘাতিক কিছু একটা করে বসতে পারে বলে আপনি সন্দেহ করছেন?

পোয়ারো কোনো উত্তর দিলেন না।

কি আশঙ্কা করছেন আপনি? আবার প্রশ্ন করলেন ব্যাটেল।

এই পরিস্থিতিতে অন্য কি আশঙ্কা করব বলুন?

 ব্যাটেল মাথা নাড়লেন। তা ঠিক..আমি ভাবছি

ব্যাটেল মৃদু স্বরে বললেন, ভাবছি মেরিডিথ কি জানে যে তার বন্ধু মিসেস অলিভারের কাছে একটা গোপন তথ্য ফাঁস করে দিয়েছে?

তারিফ করবার ভঙ্গিতে মাথা ঝাঁকালেন পোয়ারো। সেই জন্যই বলছি তাড়াতাড়ি চলুন। এক মুহূর্ত সময়ও এখন অনেক মূল্যবান।

দু’জনে দ্রুত পায়ে হেঁটে চললেন। নদীতে নৌকা বা স্টীমারের কোনো চিহ্ন নেই। কিন্তু বাঁ দিকে বাঁক নিয়েই পোয়ারো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। ইতিমধ্যে ব্যাটেলেরও সেদিকে নজর পড়েছে।

তাদের থেকে শ-দুয়েক গজ দূরে মেজর ডেসপার্ড। ভদ্রলোক নদীর দিকে এগোচ্ছেন।

আরও কিছু দূরে নদীর মাঝ বরাবর একটা ডিজ্ঞি ওপর রোডা আর অ্যানা বসে আছেন। রোডা দাঁড় টানছে, আর সামনে বসে হেসে হেসে গল্প করছে অ্যানা। দুজনেই কেউই তাঁদের এই লোকগুলোকে লক্ষ্য করেননি। তাদের দৃষ্টি অন্য দিকে নিবদ্ধ।

ঠিক সেই মুহূর্তে সকলের চোখের সামনে অভাবনীয় একটা ব্যাপার ঘটল। অ্যানা দু’হাত বাড়িয়ে সজোরে ধাক্কা মারলেন রোডাকে। রোডা পড়ে যেতে যেতে অ্যানার জামার প্রান্ত ধরে টাল সামলাবার চেষ্টা করলেন। ঝকানিতে উল্টে গেল ছোট ডিঙি নৌকা। দু’জনে জড়াজড়ি করে জলের মধ্যে গিয়ে পড়ল।

দেখুন দেখুন। দৌড়তে দৌড়তে চেঁচিয়ে উঠলেন ব্যাটেল। মিস মেরিডিথ ইচ্ছে করে ধাক্কা মেরে তার বন্ধুকে জলে ফেলে দিল। হায় ভগবান এটা নিশ্চয় তার চতুর্থ হত্যাকান্ড।

তারা দুজনেই খুব দ্রুত দৌড়তে শুরু করলেন। কিন্তু মেজর ডেসপার্ড ছিলেন তাদের অনেক আগে। মেয়ে দুইটির একটিও যে সাঁতার জানে না সেটা তাদের রকম দেখেই বোঝা যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ডেসপার্ড নদীর তীরে পৌঁছে গেছেন। তিনি জলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন।

ব্যাপারটা তো বেশ চিত্তাকর্ষক! বিড় বিড় করলেন পোয়ারো। কার দিকে তিনি প্রথম এগোবেন।

মেয়ে দুটি যখন আর এক জায়গায় নেই। স্রোতের টানে তারা পরস্পরের কাছ থেকে বারো চোদ্দ হাত তফাতে সরে গেছেন।

মেজর ডেসপার্ড দ্রুত সাঁতার কেটে তাদের দিকে এগোলেন। তাঁর গতির মধ্যে কোন বিরতির লক্ষণ ফুটে উঠল না। তিনি সোজা রোডার দিকেই এগিয়ে গেলেন।

ব্যাটেলেও ইতিমধ্যে জলে ঝাঁপিয়ে পড়েছেন।

ডেসপার্ড ততক্ষণে রোডাকে উদ্ধার করে তীরে নিয়ে এসে একটা পরিষ্কার জায়গা দেখে শুইয়ে দিলেন। তিনি আবার ফিরে গিয়ে জলে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। এবার তার নজর সেই দিকে যেখানে অল্প আগেও অ্যানাকে হাঁক পাঁক করতে দেখা গিয়েছিল। কিন্তু এখন আর তার কোনো চিহ্ন পাওয়া যাচ্ছে না।

সাবধান! চেঁচিয়ে উঠলেন ব্যাটেল। ওখানে অনেক বুনো আগাছা আছে। পায়ে জড়িয়ে গেলে বিপদ হতে পারে।

তারা দুজনে প্রায় একইসঙ্গে জায়গাটার কাছে গিয়ে পৌঁছলেন কিন্তু তার আগেই অ্যানা অসহায়ভাবে জলের তলায় তলিয়ে গেছেন।

অবশেষে অনেক পরে ব্যাটেল আর ডেসপার্ডের সমবেত প্রচেষ্টায় অ্যানাকে খুঁজে পাওয়া গেল।

তাঁরা দুজনে ধরাধরি করে তাকে তীরে নিয়ে এলেন।

পোয়োরোর সেবা সুশ্রুষায় ইতিমধ্যে জ্ঞান ফিরে এসেছে রোডার। তিনি এখন দু’হাতে ভর দিয়ে উঠে বসেছেন ধীরে ধীরে। শ্বাস প্রশ্বাসও প্রবাহিত হচ্ছে স্বাভাবিক ভাবে।

রোডার থেকে হাত তিনেক তফাতে অ্যানাকে শোয়ানো হল।

কৃত্রিম প্রক্রিয়ায় শ্বাস প্রশ্বাস ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করা ছাড়া এখন আর অন্য কোনো উপায় দেখছি না। হাঁপাতে হাঁফাতে বললেন ব্যাটেল। তবে আমার মনে হয় সে চেষ্টা বৃথা হবে। সম্ভবত ইতিমধ্যেই মেয়েটির মৃত্যু ঘটেছে।

ব্যাটেল যথেষ্ট তৎপরতার সঙ্গে কৃত্রিম উপায়ে শ্বাস প্রশ্বাস চালু করবার প্রচেষ্টায় ব্রতী হলেন। তাকে প্রয়োজনে সাহায্য করবার জন্য প্রস্তুত হয়ে পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন পোয়ারো।

মেজর ডেসপার্ড রোডার পাশে সরে এসে উদ্বেগ আকুল কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন, এখন কিছুটা সুস্থ বোধ করছেন তো?

রোডা স্বপ্নাচ্ছন্ন কণ্ঠে উত্তর দিলেন, আপনি…আপনি আমায় বাঁচিয়েছেন। তারপর আকুল দু’হাত বাড়িয়ে দিলেন ডেসপার্ডের দিকে। ডেসপার্ড পরম আগ্রহে–তার সুঠাম কোমল হাত দুটো নিজের হাতের মধ্যে টেনে নিতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন রোডা। ডেসপার্ড ডাকলেন, রোডা…..ডোডা আরও জোরে আঁকড়ে ধরলেন তাঁর হাতদুটো।

ডেসপার্ডের চোখের সামনে একটা অলৌকিক ছায়াছবি ভেসে উঠল। লতাগুল্ম সমাচ্ছন্ন আফ্রিকার ঘন সবুজ প্রান্তর; আর চঞ্চল উদ্দাম কলহাস্যে মুখর রোডা ঠিক পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন।

.

২৮.

আপনি কি বলতে চান–সংশয়ের সুরে প্রশ্ন করলেন রোডা–যে অ্যানা আমায় ধাক্কা মেরে জলে ফেলে দিয়েছিল? অবশ্য ব্যাপারটা আমারও সেই রকম মনে হল এবং ও জানত যে আমি সাঁতার জানি না, কিন্তু…সত্যিই কি এটা ইচ্ছাকৃত?

হ্যাঁ এটা সম্পূর্ণ ইচ্ছাকৃত এবং পূর্ব পরিকল্পিত। পোয়ারোর কণ্ঠস্বর গম্ভীর। তারা তখন লন্ডনের সীমান্ত দিয়ে গাড়ি ছুটিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু…কিন্তু কেন?

পোয়ারো মিনিট দুয়েক কোনো উত্তর দিলেন না। অ্যানাকে এই অপকর্মে প্ররোচিত করার পেছনে মেজর ডেসপার্ডও যে নিজের অজান্তে একটা মস্ত বড় উদ্দেশ্য হয়ে দাঁড়িয়েছেন তা তিনি জানিয়েছেন।

সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল অল্প কেশে গলা পরিষ্কার করলেন, বললেন আপনাকে মানসিকভাবে প্রস্তুত হয়ে নিতে হবে মিস দোয়াস। কারণ এবারে যা বলব তাতে আপনি মনে নিদারুণ আঘাত পাবেন। আপনার বন্ধু যে মিসেস বেনসনের বাড়ি কাজ করতেন তিনি দুর্ঘটনায় মারা যাননি। তাকে সুপরিকল্পিতভাবে হত্যা করা হয়েছিল। অন্তত আমাদের তাই ধারণা। এবং এই ধারণা গড়ে ওঠবার পেছনে যুক্তিও ছিল যথেষ্ট। অ্যানা মেরিডিথই তাঁকে হত্যা করেছিলেন।

এসব আপনি কি বলছেন?

আমাদের বিশ্বাস পোয়ারো বললেন, অ্যানাই বোতল দুটো রেখেছিল।

না না,…….কি সাংঘাতিক, এ অসম্ভব। অ্যানা একাজ করতেই পারে না। কেনই বা সে খুন করতে যাবে?

তাঁর পেছনেও যুক্তি ছিল।

এবার সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল কথা শুরু করলেন। সে যাই হোক, অ্যানার ধারণা একমাত্র আপনিই আমাদের কাছে এই ঘটনার হদিশ দিতে পারেন। ইতিমধ্যে শ্রীমতি অলিভারের কাছে যে আপনি এই বিষয় নিয়ে গল্প করেছেন সে কথা নিশ্চয় আপনার বন্ধুকে জানাননি?

না, মৃদু সুরে জবাব দিলেন রোড, আমি ভেবেছিলাম তাতে ও আমার ওপর বিরক্ত হবে।

তা হত, খুবই বিরক্ত হত; গম্ভীর কণ্ঠে মন্তব্য করলেন ব্যাটেল। তবে ও ভেবেছিল একমাত্র আপনার দিক থেকেই বিপদ আসবার সম্ভাবনা আর সেইজন্যই আপনাকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিতে চাইছিল।

সরিয়ে দিতে? আমাকে? কি অমানুষিক কান্ড। আমার কিন্তু এখনও যেন ঠিক বিশ্বাস হচ্ছে না। যাক, সে যখন মারা গেছে তখন আর এ বিষয়ে বেশি আলোচনা না করাই উচিত। কিন্তু মিস দোয়াস, বন্ধু হিসাবে মিস মেরিডিথ যে খুব ভালো ছিল না তাতে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।

গাড়িটা একটা বাড়ির দোর গোড়ায় এসে থামলো।

এটা হচ্ছে মঁসিয়ে পোয়ারোর বাড়ি। চলুন, আমরা সকলে এখানে বসেই সমস্ত বিষয়টা সম্পর্কে কিছু আলাপ আলোচনা করব।

পোয়ারোর ড্রয়িংরুমে ঢুকতে না ঢুকতেই শ্রীমতী অলিভার তাদের স্বাগত জানালেন। ইতিপূর্বে ডাক্তার রবার্টসও সেখানে হাজির হয়েছেন। তারা দু’জনে এতক্ষণ সোফায় বসে শেরী পান করছিলেন। শ্রীমতী অলিভারের মাথায় নতুন ফ্যাশানের হালকা সোলার টুপি। পরিধানে জমকালো ভেলভেটের জামা। জামার বুকের কাছে একটা পকেটের মধ্যে লাল রঙের বড় একটা আপেল উঁকিঝুঁকি মারছে।

আসুন আসুন; শ্রীমতী অলিভার এমন অমায়েক সাবলীল ভঙ্গিমায় সকলকে আহ্বান জানালেন যাতে মনে হয় এটা যেন তারই নিজের বাড়ি, পোয়ারোর নয়। আপনার টেলিফোন পাওয়া মাত্রই আমি ডাক্তার রবার্টসের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তারপর দুজনে একসঙ্গে এখানে এসে হাজির হই, রবাটর্সের পেশেন্টরা নিশ্চয় খুব ব্যস্ত হয়ে উঠেছেন, তবে এই মুহূর্তে সে বিষয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। এই ঘটনার আগাগোড়া সমস্তটা শোনবার জন্যেই আমরা উদগ্রীব হয়ে বসে আছি।

হ্যাঁ, নিশ্চয়। ডাক্তার রবার্টসও এ-কথায় সায় দিলেন, আমার কাছে তো সমস্ত ব্যাপারটাই এখনও অস্পষ্ট ধোঁয়াটে হয়ে আছে।

ঈশ্বরকে বিশেষ ধন্যবাদ। পোয়ারো মৃদু স্বরে বললেন, এই রহস্যময় মামলাটার পরিসমাপ্তি ঘটেছে। অবশেষে আমরা মিঃ শ্যাতানার হত্যাকারীকে আবিষ্কার করতে পেরেছি।

মিসেস অলিভারও আমাকে সেকথা জানালেন। সুন্দরী মেরিডিথই যে এই অপকীর্তির মূল সেটা কল্পনা করাও দুঃসাধ্য। তাকে তো খুনি বলে আমি কোনোদিন ভাবতেই পারিনি।

সে যে একজন খুনি, তাতে কোনো ভুল নেই। ব্যাটেল মন্তব্য করলেন, ইতিপূর্বে তিন-তিনটে খুনের সাহায্যে সে নিজের হাত কলঙ্কিত করেছে। চতুর্থটির বেলায় সে যে সফলকাম হতে পারেনি তার জন্যে তাকে খুব দোষ দেওয়া যায় না।

অবিশ্বাস্য! বিড়বিড় করলেন রবার্টস।

তা মোটেই নয়, শ্ৰীমতী অলিভার এবার আলোচনায় যোগ দিলেন, এ তত সহজ অঙ্কের হিসেব। খুনি হিসেবে সন্দেহটা তার ওপরই সবচেয়ে কম হবার কথা। অতএব সেই প্রকৃত খুনী। গোয়েন্দা গল্পের বেলায় যে রকম ঘটে থাকে, দেখা যাচ্ছে বাস্তব ক্ষেত্রেও সেই একই সূত্র প্রযোজ্য।

আজকের দিনটা আমার ডায়েরিতে একটা স্মরণীয় দিন হয়ে থাকবে। রবার্টস বললেন। প্রথমে মিসেস লরিমারের পত্র। সেটি নিশ্চয় জাল চিঠি, তাই না?

নিঃসন্দেহে, তিনটে চিঠিই জাল।

মিস মেরিডিথ কি নিজের নামেও একটা চিঠি পাঠিয়েছিলেন?

সেটা খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। নকলটাও যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে করা হয়েছিল। অবশ্য বিশেষজ্ঞরা নিশ্চয় এই ভাওতায় ভুলতেন না, কিন্তু এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞের সাহায্য নেবারও কোনো প্রশ্ন উঠত না। মিসেস লরিমার যে আত্মহত্যা করেছেন, পারিপার্শ্বিক সমগ্র ঘটনা আমাদের সেই দিকেই ইঙ্গিত দিচ্ছে।

আমার অযাচিত কৌতূহল মাফ করবেন, মঁসিয়ে পোয়ারো। মিসেস লরিমারের মৃত্যুটা যে আত্মহত্যা নয় সুপরিকল্পিত হত্যাকান্ড সে কথা আপনি প্রথম সন্দেহ করলেন কিভাবে?

চেইন লেনে তাঁর বাড়ির প্রৌঢ়া দাসীর সঙ্গে কথা বলে।

অ্যানা মেরিডিথ যে আগের দিন সন্ধ্যায় মিসেস লরিমারের সঙ্গে দেখা করতে আসেন এ-খবর বোধহয় তার কাছ থেকেই প্রথম জানতে পারেন?

হ্যাঁ, অন্যান্য খবরের সঙ্গে এ তথ্যটাও সে সরবরাহ করেছিল। আর তাছাড়া প্রকৃত অপরাধী কে সে সম্বন্ধেও আমি মনে মনে স্থির সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিলাম। অর্থাৎ মিঃ শ্যাতানার হত্যাকারী কে তা আমি জানতাম। এবং সে ব্যক্তি লরিমার নন।

মিস মেরিডিথের ওপর আপনার সন্দেহ জাগল কি জন্য?

পোয়ারো হাত তুলে ডাক্তার রবার্টসকে বাধা দিলেন। অল্প ধৈর্য ধরুন, ক্রমে ক্রমে সমস্ত কিছুই আমি খুলে বলছি, তবে নিজস্ব পদ্ধতিতে বক্তব্য রাখাই আমার বরাবরের অভ্যাস। সেটা হচ্ছে এক এক করে বাছাই করা। মিসেস লরিমার শ্যাতানার হত্যাকারী নন, মেজর ডেসপার্ডও তাকে খুন করেননি এবং শুনলে অবাক হবেন এই হত্যাকান্ডটার পেছনে মিস মেরিডিথেরও কোনো হাত ছিল না।

সামনের দিকে কিছুটা ঝুঁকে পড়লেন তিনি। তাঁর মৃদু কোমল কণ্ঠস্বরে শিকারী বেড়ালের আমেজ। তাহলে বুঝতেই পারছেন, ডাক্তার রবার্টস একমাত্র আপনিই অবশিষ্ট থাকেন। আপনিই মিঃ শ্যাতানাকে হত্যা করেছেন এবং মিসেস লরিমারকেও।

কম করেও মিনিট তিনেক কারো মুখে কোনো কথা ফুটল না, ঘরের মধ্যে একটা অস্বস্তিকর থমথমে নীরবতা। অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করে ডাক্তার রবার্টস বীভৎস ভঙ্গিতে হো হো করে হেসে উঠলেন। আপনি কি পুরোদস্তুর পাগল, মঁসিয়ে পোয়ারো? বলা বাহুল্য, মিঃ শ্যাতানাকে আমি খুন করিনি। মিসেস লরিমারকে খুন করাও আমার পক্ষে অসম্ভব। মিঃ ব্যাটেল তিনি সুপারিনটেনডেন্টের দিকে ঘুরে দাঁড়ালেন। আপনি কি এই সব আজগুবি প্রলাপ শোনাবার জন্যে আমাকে ডেকে এনেছেন?

সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল শান্তভাবে বললেন, স্থির হয়ে মঁসিয়ে পোয়ারোর সম্পূর্ণ বক্তব্যটা শুনলেই বোধহয় আপনি ভালো করবেন।

পোয়ারো বললেন, যদিও কিছু দিন আগেই আমি উপলব্ধি করতে পেরেছিলাম যে আপনি একমাত্র আপনার পক্ষেই মিঃ শ্যাতানাকে হত্যা করা সম্ভব কিন্তু তা সত্ত্বেও আমার হাতে কোনো সুনির্দিষ্ট প্রমাণ ছিল না। তবে মিসেস লরিমারের ব্যাপারটা সম্পূর্ণ আলাদা। তিনি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ডাক্তার রবার্টসের দিকে ফিরে তাকালেন। এখানে আমার উপলব্ধির কোনো প্রশ্ন ওঠে না। এটা তার চেয়েও আরও সহজ, এই ঘটনার একজন প্রত্যক্ষদর্শী থেকে গেছে সে আদালতে দাঁড়িয়ে আপনার অপকীর্তির সাক্ষী দিতে পারবে।

রবার্টের হাবভাব ক্রমশ স্থির শান্ত হয়ে এলো। চোখের দৃষ্টিতে একটা উজ্জ্বল চঞ্চকে আভা। তিনি দৃঢ়কণ্ঠে পোয়ারোর কথার প্রতিবাদ জানালেন, আপনি বড়ো আবোল তাবোল বকছেন মঁসিয়ে পোয়ারো।

না না, মোটেই তা নয়। একবর্ণও ভুল বকছি না আমি। আজ ভোরের ঘটনা। ভালো করে সকাল হয়নি তখনও। আপনি ঝিয়ের কাছে বাজে ভাঁওতা দিয়ে মিসেস লরিমারের শোবার ঘরে প্রবেশ করলেন। গত রাত্রে কড়া ভোজের ঘুমের ওষুধ খাওয়ার ফলে তিনি তখন গভীর নিদ্রায় অচেন। আপনি আবার প্রৌঢ়া ঝিকে বাজে ভাওতা দিলেন। বললেন, তার কর্ত্রী মিসেস লরিমার খুব সম্ভবত মারা গেছেন। তবু একবার শেষ চেষ্টা করে দেখবার জন্যে তাকে ব্র্যান্ডি আর গরম জল আনতে পাঠান। সেই সময় ঘরের মধ্যে তৃতীয় কোনো প্রাণী উপস্থিত ছিল না। হতচকিতা প্রৌঢ়া ঝি একবার মাত্র উঁকি দিয়ে তার কীর দিকে তাকিয়ে দেখেছিল। তাই তিনি জীবিত কি মৃত সেটা তার পক্ষে সঠিক ভাবে বুঝে ওঠা সম্ভব হয়নি। আর তারপর কি ঘটল?…..

আপনি হয়তো জানেন না যে ডাক্তার রবার্টস জানালায় জমে থাকা বরফ পরিষ্কার করবার জন্যে যে সমস্ত কোম্পানি আছে তাদের কেউ কেউ খুব ভোরেই কর্মচারীদের কাজে পাঠিয়ে দেয়। আপনি যখন মিসেস লরিমারের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করেন সেই সময় একজন কর্মচারীও তার মই নিয়ে হাজির হয়েছিল। ঘটনাচক্রে মিসেস লরিমারের শয়ন কক্ষের জানালাটাই সে প্রথম বেছে নেয়। তার ফলেই একটা দুর্লভ দৃশ্য তার নজরে পড়ে। তাকে এখানে ডেকে আনা হয়েছে। তার নিজের মুখ থেকেই সমস্ত ঘটনাটা শোনা যাক।

পোয়ারো মৃদু পায়ে দরজার দিকে এগিয়ে গিয়ে ডাকলেন, স্টীফেন্স ভেতরে এসো।

অনতিবিলম্বে দশাশই চেহারার শ্রমিকশ্রেণির একজন তোক ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। তার মাথার চুল লাল। ডান হাতে ধরা একটা ক্যাম্বিসের টুপি। টুপির গায়ে গোল করে লেখা-চেলসি উইন্ডো ক্লীনার্স অ্যাসোসিয়েশন।

পোয়ারো প্রশ্ন করলেন, ঘরের মধ্যে যাঁরা বসে আছেন, তুমি কি তাদের কাউকে চিনতে পারছ?

লোকটি চোখ তুলে একবার সকলকে পর্যবেক্ষণ করে নিলো। তারপর অপ্রতিভ ভঙ্গিতে ডাক্তার রবার্টের দিকে ইঙ্গিত করল। এই ভদ্রলোককে চিনতে পারছি।

শেষ কখন তুমি ভদ্রলোককে দেখেছ? এবং উনি তখন কি করছিলেন?

আজ ভোরবেলার ঘটনা স্যার। তখন আটটাও বাজেনি, আমি চেইন লেনে এক ভদ্রমহিলার ঘরের জানালায় জমে থাকা বরফ সাফ করছিলাম। ভদ্রমহিলা বিছানায় শুয়েছিলেন, তাঁকে খুব অসুস্থ দেখাচ্ছিল, তিনি ঘুমের ঘোরেই একবার চোখ মেলে তাকালেন, এই ভদ্রলোককেও আমি তখন তার বিছানার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেছিলাম। আমি তাকে, একজন ডাক্তার বলেই মনে করি। তার হাতে একটা ইঞ্জেকশানের সিরিঞ্জ ছিল। তিনি খুব দ্রুত ভদ্রমহিলার হাতের ওপর ইঞ্জেকশান ছুঁড়ে দিলেন, ভদ্রমহিলা আবার ঘুমিয়ে পড়লেন চোখ বুজে। আমি সেখানে আর বেশিক্ষণ অপেক্ষা না করে নিঃশব্দে অন্য জানালার দিকে এগোলাম…মনে হয়, আমি নিশ্চয় কোনো অন্যায় করিনি?

না না, অন্যায় নয়, পোয়ারো কথার মাঝখানে বাধা দিলেন। সাধারণ শক্তিবর্ধক।…এন মিথাইল সাইক্লো হেক্সানিল-মিথাইল-ম্যালেনিল ইউরিয়া। কেটে কেটে প্রতিটি শব্দ স্পষ্টভাবে উচ্চারণ করলেন তিনি, সাধারণ ভাষায় একে এভিপ্যান বলা হয়। ছোটখাটো অপারেশনের সময় সেই জায়গাটা অসাড় করে দেবার জন্যে এর প্রয়োজন লাগে। শিরার মধ্যে বেশি পরিমাণ এভিপ্যান ইনজেক্ট করে দিলে সে সঙ্গে সঙ্গে অজ্ঞান হয়ে পড়তে বাধ্য। ভেরোনাল বা ওই জাতীয় ঘুমের ওষুধ ব্যবহারের পর এই এভিপ্যানের প্রয়োগ খুবই বিপজ্জনক। মিসেস লরিমারের বাহুর ওপর আমি একটা ইঞ্জেকশানের চিহ্ন লক্ষ্য করেছিলাম। পুলিশ সার্জেনকে ঘটনাটা জানাবার পর তারা ব্যাপারটা পরীক্ষা করে দেখেন। এবং পুলিশ সার্জেন চার্লস ইস্কেরিই আমাকে এই তথ্য সরবরাহ করেছেন।

এতেই আপাতত আমাদের কাজ চলে যাবে বলে মনে হয়। সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল মুখ খুললেন, শ্যাতানার হত্যার ব্যাপারে অত মাথা ঘামাবার প্রয়োজন হবে না। অবশ্য দরকার পড়লে মিঃ ক্র্যাডককে হত্যার দায়েও আমরা আপনাকে অভিযুক্ত করতে পারি। খুব সম্ভবত তাঁর স্ত্রীকেও আপনি হত্যা করেছেন।

মিঃ এবং মিসেস ক্র্যাডকের নামোল্লেখ মাত্রই হতাশভাবে মুষড়ে পড়লেন ডাক্তার রবার্টস। তার মুখে আর কোনো প্রতিবাদের ভাষা জোগাল না। অবশ হয়ে হেলে পড়লেন চেয়ারের ওপর।

ঠিক আছে, আমি-আমি হাত বাড়িয়ে দিচ্ছি; ক্লান্ত কণ্ঠে তিনি বললেন, আর কোনো বাধা দেব না, আমায় গ্রেপ্তার করুন। মনে হয়, শয়তান শ্যাতানাই এবিষয়ে আপনাদের কিছু ইঙ্গিত দিয়েছেন। আমারও সেই রকম সন্দেহ হয়েছিল। ভেবেছিলাম খুব সুন্দর ভাবেই চিরকালের জন্য শ্যাতানার মুখ বন্ধ করতে পেরেছি। কিন্তু

না, শ্যাতানার নয়; ধীর কণ্ঠে ব্যক্ত করলেন ব্যাটেল। সমস্ত কৃতিত্ব মঁসিয়ে পোয়ারোর। তিনি দরজার দিকে এগিয়ে যেতেই ইউনিফর্ম পরা দুজন পুলিশ ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। তিনি তাদের শান্ত গম্ভীর কণ্ঠে ডাক্তার রবার্টসকে গ্রেপ্তার করবার আদেশ দিলেন।

রবার্টসকে নিয়ে কর্মচারী দু’জন ঘর ছেড়ে চলে যাবার পর শ্রীমতী অলিভার খুশি খুশি চোখ তুলে পোয়ারোর দিকে ফিরে তাকালেন। বললেন, আমি তখনই বলেছিলাম এটা ওরই কীর্তি। তবে তাঁর কণ্ঠস্বরে কিছুটা সংশয়ের সুরও মিশেছিল।

.

২৯.

আজকের দিনটা যেন বিশেষভাবে পোয়ারোর ব্যক্তিগত। তিনি গম্ভীরভাবে নিজের আরামকেদারায় হেলান দিয়ে বসে আছেন। সকলের উদগ্রীব চোখের দৃষ্টি ব্যাকুল প্রতীক্ষায় তার মুখের ওপর নিবদ্ধ।

আপনারা প্রত্যেকেই নম্র, অতি ভদ্র। মৃদু হাসলেন তিনি। আপনারা জানেন বক্তৃতা দেবার সুযোগ পেলে আমি মনে মনে খুবই আত্মপ্রসাদ লাভ করি। এটা আমার একরকমের অহংকারও বলতে পারেন। তবু বৃদ্ধের এই ক্লান্তিকর বক্তৃতা শোনবার জন্যে আপনারা যথেষ্ট সৌজন্য সহকারে প্রতীক্ষা করে আছেন। এর জন্যে আমি আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ।

আমি জীবনভোর যতগুলো রহস্যময় মামলার সম্মুখীন হয়েছি তার মধ্যে এই মামলাটাই সবচেয়ে জটিল এবং অত্যধিক চমকপ্রদ। কেন না, এগিয়ে যাবার মতো সামান্যতম কোনো সূত্রের চিহ্ন এখানে নেই। চারজন মাত্র লোক, এবং তাদের মধ্যেই একজন এই অপকীর্তির নায়ক। কিন্তু সে কোন জন, কোনো সূত্র ধরে কি আমরা তাকে চিহ্নিত করতে পারি? বস্তকেন্দ্রিক বিচারে বলতে হয়না, তা পারি না। ধরা ছোঁওয়া যায় এমন কোনো সূত্র নেই। না পাওয়া গেছে কোনো আঙুলের ছাপ। অভিযোগমূলক কোনো কাগজপত্র বা দলিলেরও হদিশ এখানে পাওয়া যায়নি। সন্দেহভাজন চারজন ব্যক্তিই কেবল আমাদের সামনে উপস্থিত আছেন, আর বস্তুগত সূত্র বলতে একটি মাত্র যা পাওয়া যাচ্ছে–সেটা হল ব্রিজ খেলার চারটে স্কোরশীট।

আপনাদের হয়তো স্মরণ আছে, এই মামলার একেবারে প্রথম থেকেই আমি এই স্কোরশীটগুলোর ওপর বিশেষভাবে নজর দিয়েছিলাম। কারণ এর মধ্যেই ওই চারজন নরনারীর মানসিক গতিপ্রকৃতির কিছুটা ইঙ্গিত নিহিত আছে। ঈশ্বরকে ধন্যবাদ সেগুলো আমার আশার অতিরিক্ত সাহায্য করেছিল। বিশেষভাবে একটা মহামূল্যবান সংবাদ এর মধ্যে থেকে আমি খুঁজে পাই। দেখলাম তৃতীয় রাবারের স্কোরশীটে এক দিকের কলমে ১৫০০ সংখ্যাটি লেখা আছে। এই সংখ্যাটি দেখে সিদ্ধান্তে আসতে দেরি লাগে না যে খেলাটি গ্রান্ডস্ল্যামের। এখন সেদিন সন্ধ্যায় ব্রিজ টেবিলের সেই পরিবেশের কথা চিন্তা করুন। সেই অস্বাভাবিক পরিবেশের মধ্যেই কোনো একজন মিঃ শ্যাতানাকে হত্যা করার মতলব আঁটছে। নিশ্চয় তাকে অন্তত দুটো অতি মারাত্মক ঝুঁকির সম্মুখীন হতে হবে। প্রথমত, মারা যাবার আগে ভদ্রলোক চেঁচিয়ে উঠতে পারেন। আর দ্বিতীয়টি হল, তিনি যদি চেঁচিয়ে নাও ওঠেন তাহলেও সেই চরম মুহূর্তে ঘরের অন্য কেউ তাকে দেখে ফেলতে পারেন।

চিন্তা করে দেখুন প্রথম ঝুঁকিটা সম্বন্ধে আপনার কিছু করণীয় নেই। এটাকে জুয়ার মতো সম্পূর্ণ ভাগ্যের হাতে ছেড়ে দিতে হবে। কিন্তু দ্বিতীয়টার সম্বন্ধে সে কথা প্রযোজ্য নয়। চেষ্টা করলে এর কিছুটা প্রতিকারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সাধারণ সাদামাটা তাস পড়লে ব্রিজ খেলোয়াড়রা তেমন মনোযোগ দিয়ে খেলেন না। তারা নিজেদের এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখেন। নিজেদের মধ্যে সহজ হাল্কা সুরে কথাবার্তা বলেন। কিন্তু কোনো জটিল তাস বা বেশি ডাকের খেলা হলে তখন সকলেই রীতিমতো উত্তেজিত হয়ে ওঠেন। সমস্ত মনটা একাগ্রভাবে তাসের দিকেই নিবদ্ধ থাকে। এখন গ্র্যান্ডস্ল্যামের খেলা স্বাভাবিকভাবেই খুব উত্তেজনাপূর্ণ এবং রাবার ব্রিজের প্রায় প্রতিক্ষেত্রের প্রতিপক্ষ এই ডাকে ডবল দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে জিন খেলোয়াড় গভীর মনোযোগ দিয়ে তাস খেলছে। একজনের চিন্তা, কিভাবে তেরোটা পিট-ই ঘরে তোলা যায়। বিরুদ্ধপক্ষ আপ্রাণ চেষ্টা করছে কোনো সুযোগে একটা পিট অন্তত তাদের ছিনিয়ে নিতে হবে। তাদের তাস ফেলার মধ্যে যেন কোনো ভুল না হয় পার্টনার কোন রঙে উৎসাহ দেখাচ্ছে কোন রঙে দেখাচ্ছে না, তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নজর রাখতে হয় সবকিছুর। ভেবে দেখলাম, সেই পরিবেশে কাউকে যদি খুন করতে হয় তবে ডামির পক্ষে হচ্ছে এই সুবর্ণ সুযোগ। খোঁজ নিয়ে জানলাম সেই বিশেষ ডিলটায় ডামি ছিলেন ডাক্তার রবার্টস।

একথা মনে রেখেই মনস্তাত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে নতুনভাবে মামলাটার দিকে অগ্রসর হলাম। সন্দেহভাজন চারজনের মানসিক গঠন বিচার বিশ্লেষণ করে আমার মনে হল এর মধ্যে একমাত্র মিসেস লরিমারই নিখুঁতভাবে কোনো হত্যার পরিকল্পনা করতে পারেন, এবং তাকে সাফল্যমন্ডিত করে তোলার ক্ষমতাও তার আছে। কিন্তু মুহূর্তের উত্তেজনায় তিনি কোনো খুন করে বসবেন এ কথা বিশ্বাস করতে আমি আদৌ প্রস্তুত নই। অপরপক্ষে মিঃ শ্যাতানা যেদিন নিহত হন সেদিন মিসেস লরিমারের হাবভাব বা কথাবার্তা আমার মনে গভীর সন্দেহের উদ্রেক করে। হয় তিনিই মিঃ শ্যাতানাকে খুন করেছেন অথবা কে হত্যাকারী তা তিনি জানেন। মিস মেরিডিথ, মেজর ডেসপার্ড এবং ডাক্তার রবার্টস। এদের পক্ষেও শ্যাতানাকে খুন করা সম্ভব। তবে আগেই বলেছি, এদের প্রত্যেকের মানসিক গঠন ভিন্ন ভিন্ন ধরনের। তাই এরা কাউকে খুন করতে গেলে তার মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন মনোভাব সক্রিয় হয়ে উঠবে।

এরপর আমি দ্বিতীয় পরীক্ষা করলাম। প্রত্যেকের সঙ্গে আলাদা আলাদা দেখা করে প্রশ্ন করলাম সেই ঘরের মধ্যে কি কি জিনিস তাদের নজরে পড়েছে। বিশেষ ভাবে ডাক্তার রবার্টসের ইছুরিটা চোখে পড়বার কথা। কেননা, তিনি হচ্ছেন সেই প্রকৃতির যাঁরা তুচ্ছাতিতুচ্ছ সব কিছুই নজর দিয়ে দেখে থাকেন। ভালো ডাক্তারের এই গুণটি সহজাত। কিন্তু সেদিনের ব্রিজ খেলায় তাসের সম্বন্ধে ভদ্রলোক প্রায় কোনো কথাই বলতে পারলেন না। আমি অবশ্য তার কাছ থেকে খুব বেশি কিছু আশা করিনি সত্যি, তবে তাঁর এতটা বিস্মৃতির কারণ কি ঘটতে পারে। নিশ্চয় তখন তার মনটা অন্য কোনো চিন্তায় মগ্ন ছিল এদিক থেকেও সন্দেহটাও ডাক্তার রবার্টসেরই দিকে ইঙ্গিত করছে।

তাসের ব্যাপারে মিসেস লরিমারের স্মৃতিশক্তি কিন্তু আশ্চর্যভাবে তীক্ষ্ণ। এবং তিনি যে গভীর মনোনিবেশ সহকারে তাস খেলেন তাতে তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে একজন অন্য কাউকে খুন করলেও ভদ্রমহিলা চোখ তুলে দেখবেন বলে মনে হয় না। তার কাছ থেকে আমি আর একটি মহামূল্য সংবাদ পাই। ডাক্তার রবার্টস গ্র্যান্ডস্ল্যামের ডাক দিয়েছিলেন, বলা বাহুল্য খুবই অযৌক্তিকভাবে। এবং তিনি তার পার্টনার মিসেস লরিমারের রঙেই ডাক দেন যার ফলে ভদ্রমহিলাকেই তাসটা খেলতে হয়।

তৃতীয় পরীক্ষা, যে বিষয়ে সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেল এবং আমি দু’জনে মিলে গভীরভাবে আলাপ আলোচনা করেছিলাম, সেটা হচ্ছে ওই চারজনের পূর্ব জীবনের কৃত অপরাধ সম্পর্কে সম্যকরূপে অবগত হওয়া। কোন পরিস্থিতিতে কি উপায়েই বা তাঁরা তাঁদের হত্যাকান্ড সম্পন্ন করেছিলেন, বর্তমান ক্ষেত্রেও সেই পদ্ধতির প্রয়োগ ঘটেছে কিনা, সেটা লক্ষ্য করাই ছিল আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য। তাদের পূর্বজীবনের ইতিহাস উদ্ধারের যা কিছু কৃতিত্ব তা সবই সুপারিনটেনডেন্ট ব্যাটেলের প্রশ্ন কিন্তু বর্তমান রহস্যের কোনো হদিশ খুঁজে পেলেন না। তাঁর ধারণা পূর্ববতী খুনগুলোর বেলায় যে সমস্ত পদ্ধতি অবলম্বন করা হয়েছিল তাদের কোনোটার সঙ্গেই বর্তমান খুনের কোনো সামঞ্জস্য নেই। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তা সত্য নয়। ডাক্তার রবার্টস আগে যে দুটো খুন করেছে বলে আমরা জানি তার সঙ্গে বর্তমান খুনটার কোনো বাহ্যিক সাদৃশ্য হয়তো নেই, কিন্তু মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে বুঝতে পারা যায় এদের মধ্যে চারিত্রিক মিল কত সুদৃঢ়। তিনি যেন বুক ফুলিয়ে সকলের চোখের ওপর দিয়েই অনায়াস ভঙ্গিতে খুন করতে গেছেন। রুগিকে পরীক্ষা করে দেখার পর বাথরুমে গিয়ে সাবান দিয়ে হাত ধুয়ে আসা ডাক্তারদের চিরাচরিত বিধি। সেই অবসরে একজনের শেভিং ব্রাসে অ্যানথ্রক্স রোগের দূষিত জীবাণু মাখিয়ে রেখে আসা কত সহজ। মিসেস ক্র্যাডককে খুন করা হল টাইফায়েড রোগের প্রতিষেধক ইঞ্জেকশান দেবার অছিলায়। কোনো লুকোচুরির ব্যাপার নেই। সকলের সামনেই হাসতে হাসতে ঘটে গেল ব্যাপারটা। এবার শ্যাতানাকে খুনের কথাটা চিন্তা করুন। ডাক্তার রবার্টস হঠাই চিন্তা করলেন, তিনি গভীর জালে জড়িয়ে পড়েছেন। তার হাতে সময়ও নেই। অতি অল্প সময়ের মধ্যে চিরকালের জন্য শ্যাতানার মুখ বন্ধ করে দিতে না পারলে তার সমস্ত অপকীর্তির কথা বাইরে প্রকাশ হয়ে পড়বে। সঙ্গে সঙ্গে তিনি মনস্থির করে ফেললেন। তাকে একটা প্রচন্ড ঝুঁকি নিতে হবে। অবশ্য ব্রিজ টেবিলে ঝুঁকি নেবার অভ্যাস তার আছে। এবং সেখানে যেমন নিপুণ। পারদর্শিতায় তিনি তার তাস খেলে থাকেন এখানেও সেই একই দক্ষ হাতে তিনি তার কাজ সম্পন্ন করতে পেরেছেন। অদ্ভুত সূক্ষ্ম হিসাব করে ঠিক সময়টিতেই চরম আঘাত হেনেছিলেন।

যখন আমি মনে মনে প্রায় নিশ্চিত হয়ে উঠছিলাম যে ডাক্তার রবার্টসই প্রকৃত অপরাধী ঠিক সেই সময়ই মিসেস লরিমার আমাকে ডেকে পাঠালেন এবং আমাকে বিস্মিত করে দিয়ে স্পষ্ট ভাষায় জানালেন, এই খুনটা তিনিই করেছেন। আমি আর একটু হলেই তার কথা বিশ্বাস করে বসেছিলাম যে, এই খুনটা তিনি-ই করেছেন। কিন্তু পরক্ষণেই আমার মাথার ধূসর কোষগুলো পুনরায় সতেজ হয়ে উঠল। না–এটা কখনো সত্য হতে পারে না। তাই এটা সত্যি নয়।

কিন্তু এরপর তিনি যা বললেন তা আরও জটিল। বললেন যে অ্যানা মেরিডিথকে তিনি স্বচক্ষে এই খুনটা করতে দেখেছেন।

পরের দিন সকালে বিছানায় শায়িত মিসেস লরিমারের মৃতদেহের দিকে তাকিয়ে আমি এই ঘটনার নিগুঢ় তাৎপর্য সর্বপ্রথম উপলব্ধি করতে পারলাম। বাস্তবিক পক্ষে তিনি যা বলেছেন তাও যেমন সত্যি, আমার সিদ্ধান্তও ঠিক তেমনই অভ্রান্ত।

আসলে যা ঘটেছিল তা এই। একবার আমি থাকাকালীন মিস মেরিডিথ ঘুরতে ঘুরতে ফায়ার প্লেসের সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। সেই সময় মিঃ শ্যাতানার দিকে তার নজর পড়ে এবং ভদ্রলোক যে মারা গেছেন সে কথাটাও বুঝতে তার দেরি লাগে না। মেরিডিথ তখন শ্যাতানার আরও কাছে এগিয়ে যায়। সেই মুহূর্তে তার হাতদুটোও মৃত শ্যাতানার কোটের বুক পকেটের কাছে উজ্জ্বল চকচকে বস্তুটার জন্য প্রলুব্ধ হয়ে ওঠে। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে বস্তুটিও যে কি সেটা সে উপলব্ধি করতে পারে।

এই ঘটনায় হতচকিত হয়ে মেরিডিথ চেঁচিয়ে উঠতে গিয়েছিল, কোনো রকমে সেটা সামলে নেয়। কারণ কিছু আগে ডিনার টেবিলে ভদ্রলোক যে মন্তব্য করেছিলেন সেটা তার স্মরণ আছে। তিনি হয়তো কাগজপত্রেও এই ঘটনা সম্বন্ধে কোনো তথ্য রেখে যেতে পারেন। তাতে প্রমাণিত হবে, শ্যাতানাকে হত্যার পেছনে অ্যানা মেরিডিথেরও কোনো উদ্দেশ্য ছিল। সকলে মনে করবে যে সে নিজেই শ্যাতানাকে খুন করেছে। ভয়ে এবং আশঙ্কায় কাঁপতে কাঁপতে সে তখন আবার ব্রিজ টেবিলে ফিরে আসে।

সুরাং মিসেস লরিমার সত্যি কথাই বলেছেন, কারণ খুনটা তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন বলে বিশ্বাস করেন। আর আমার সিদ্ধান্তও অভ্রান্ত। কারণ তিনি তা দেখেননি।

ডাক্তার রবার্টস যদি এই খুনটার পর চুপচাপ বসে থাকতেন তাহলে এই ব্যাপারে অভিযুক্ত করা যেত কিনা সে বিষয়ে ঘোরতর সন্দেহ আছে। যদিও নিপুণ ভাওতা ও সুচতুর ফাঁদ এঁটে আমরা তার মুখ থেকে প্রকৃত সত্য স্বীকার করিয়ে নেবার চেষ্টা করতাম। আমি অন্তত এত সহজে হাল ছেড়ে দিতাম না, তা ঠিক।

শ্যাতানাকে হত্যা করার পর ডাক্তার রবার্টসও খুব অস্বস্তির মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন তাতে কোনো দ্বিমত নেই। কারণ তিনি জানতেন ব্যাটেল তার পেছনেও ঘুরে বেড়াচ্ছে। এবং এটা অনির্দিষ্টকাল ধরেই চলবে। এই রহস্যের নিষ্পত্তি না হওয়া পর্যন্ত পুলিশ এই অনুসন্ধানের কাজ চালিয়ে যাবে। তার ফলে তারা হয়তো রবার্টসের প্রকৃত অপরাধের কোনো হদিশ খুঁজে বের করতে পারে। সেইজন্য তিনি একটা চমৎকার মতলব আটলেন। তাঁর অভিজ্ঞ চোখে ধরতে পেরেছিলেন যে মিসেস লরিমার ভেতরে ভেতরে খুবই অসুস্থ। ভদ্রমহিলার আয়ু আর বেশিদিন অবশিষ্ট নেই। এই পরিস্থিতিতে রোগ যন্ত্রণার জ্বালা থেকে মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যে তার পক্ষে আত্মহত্যার পথ বেছে নেওয়া খুবই সাধারণ ঘটনা। এবং আত্মহত্যার পূর্বমুহূর্তে অনুশোচনায় দগ্ধ হয়ে স্বকৃত অপরাধের স্বীকারোক্তি দিয়ে যাওয়াও বিশেষ অস্বাভাবিক নয়। সেইজন্য তিনি কোনো উপায়ে ভদ্রমহিলার হস্তাক্ষর জোগাড় করে সেই লেখার নকলে তিনটি চিঠি লিখলেন। তারপর ভোরবেলা কাক-পক্ষী ওঠার আগে সেই চিঠির ছুতো করে মিসেস লরিমারের বাড়ি ছুটে এলেন। রওনা হওয়ার আগে নিজের পরিচারিকাকে ডেকে পুলিশের কাছে খবর পাঠাতেও ভুললেন না। তার প্রয়োজন শুধু কিছুটা সময়ের এবং সে সময় তিনি কৌশলে তার কাজ হাসিল করে ফেললেন। সমস্ত প্ল্যানটাই খুব নিখুঁতভাবে ছক কেটে প্রস্তুত করা হয়েছিল।

অ্যানা মেরিডিথের ওপর সন্দেহ উদ্রেক করবার তার কোনো বাসনা ছিল না। এমন কি মেয়েটি যে আগের দিন সন্ধ্যায় মহিলার বাড়িতে হাজির হয়েছিল তাও তিনি জানতেন না। মিসেস লরিমারের মৃত্যু এবং নিজের নিরাপত্তা, এইটুকু শুধু তার কাম্য। তাই আমি যখন তাকে জিজ্ঞেস করলাম, মিসেস লরিমারের হাতের লেখার সঙ্গে তিনি পরিচিত কিনা তখন ভদ্রলোক খুব অপ্রস্তুতে পড়েছিলেন। কারণ সত্যিই যদি কোনো সময় এই নকলের ব্যাপারে ধরা পড়ে তখন মিসেস লরিমারের হস্তাক্ষরের সঙ্গে তিনি পরিচিত নন, এই অজুহাতের সাহায্যেই তাঁকে আত্মরক্ষা করতে হবে। ভদ্রলোক যদিও প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আমার প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন কিন্তু ততটা তৎপরতার সঙ্গে দিতে পারেননি।

উইলিংফোর্ড থেকে আমি শ্রীমতি অলিভারকে ফোন করলাম। তিনি অনেক কষ্টে নিজের কৌতূহল ও উত্তেজনা দমন করে ডাক্তার রবার্টসকে নিয়ে আমার বাড়িতে হাজির হলেন। ডাক্তার রবার্টস যখন সব ঝুট ঝামেলা মিটে গেছে ভেবে মনে মনে নিজেকে খুব তারিফ করছেন, অবশ্য তিনি যে রকম পরিকল্পনা করেছিলেন ঠিক সেভাবে ব্যাপারটা গড়ায়নি–ঠিক তখনই আকস্মিকভাবে চরম আঘাত এসে পড়ল। এ যেন বিনা মেঘে বজ্রপাত।

এরকুল পোয়ারো বিদ্যুৎ গতিতে শিকারের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। তার ফলে তিনি আর নতুন কোনো কৌশল প্রদর্শনের সুযোগ পেলেন না। অসহায়ভাবে ধরা দিতে বাধ্য হলেন। সঙ্গে সঙ্গে এই রহস্যময় মামলার পরিসমাপ্তি ঘটল।

কিছুক্ষণ সকলে ভাষা হারিয়ে নির্বাক হয়ে রইলেন। অবশেষে নীরবতা ভঙ্গ করলেন রোডা। ভাগ্যিস জানলার বাইরে দাঁড়িয়ে লোকটা সমস্ত দেখতে পেয়েছিল, তা না হলে ডাক্তার রবার্টসের বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণ করা খুব শক্ত হত।

না, না, সেটা কোনো ভাগ্যের ব্যাপার নয় ম্যাডাম। সমস্তটাই এরকুল পোয়ারোর উর্বর মস্তিষ্কের কৃতিত্ব। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে দরজার দিকে এগিয়ে গেলেন। বললেন, এসো বন্ধু, এসো, আর লুকিয়ে থাকবার প্রয়োজন নেই। তোমার ভূমিকাটুকু তুমি খুব চমৎকার ভাবেই অভিনয় করেছ।

পোয়ারো পূর্ব পরিচিত উইন্ডো ক্লীনারকে সঙ্গে নিয়ে ঘরে প্রবেশ করলেন। এখন সেই ভদ্রলোকটিকে সম্পূর্ণ অন্যরকম মনে হচ্ছে। আমার বন্ধু, মিঃ জেরাল্ড হেমিংওয়ে। একজন সম্ভাবনাপূর্ণ নতুন অভিনেতা।

তাহলে সমস্ত ব্যাপারটাই একটা প্রচন্ড রকমের ভাঁওতা। রোডা বিস্ময়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, রবার্টসকে সত্যিই কেউ তখন দেখেনি।

আমি দেখেছিলাম, পোয়ারোর কণ্ঠস্বরে গভীর আত্মপ্রসাদের সুর। মনের চোখ দিয়ে অনেক কিছুই দেখতে পাওয়া যায় যা ঈশ্বরপ্রদত্ত এই পার্থিব চোখ দুটোয় ধরা পড়ে না। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চোখ বুজে অল্প চিন্তা করলেই…

ডেসপার্ড সকৌতূহলে বললেন, এসো রোডা, আমরা এই বৃদ্ধ ভদ্রলোকটিকে খুন করি। তারপর দেখি এই বৃদ্ধের প্রেতাত্মা প্রকৃত হত্যাকারীকে খুঁজে বার করতে পারে কিনা।