২৫৩তম অধ্যায়
দুর্য্যোধনপ্রিয়কামী কর্ণের দিগ্বিজয়
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহাবীর কৰ্ণ সৈন্যমণ্ডলী-পরিবৃত হইয়া রমণীয় দ্রুপদ-নগরী রোধ ও দ্রুপদ রাজাকে পরাজিত করিয়া তাঁহার নিকট করম্বরূপ রজত ও বিবিধ রত্নজাত গ্ৰহণ করিলেন। পরে দ্রুপদরাজের অনুচর রাজগণকে বশংবদ ও করপ্রদ করিয়া উত্তরাভিমুখে প্রস্থান করিলেন। তথায় সমরানল প্রজ্বলিত করিয়া তত্রস্থ সমস্ত নৃপতিকে বশীভূত ও মহারাজ ভগদত্তকে পরাজিত করিলেন। পরে হিমাচলে আরোহণপূর্ব্বক তত্ৰস্থ পার্ব্বত্য রাজাদিগকে পরাজিত ও করপ্রদ করিয়া সত্বর তথা হইতে অবতীর্ণ হইলেন।
অনন্তর পূর্ব্বদিগ্বিভাগে যাত্ৰা করিয়া অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, মণ্ডিক মিথিল, মাগধ কৰ্কখণ্ড, আবশীর যোধ্য ও অহিচ্ছত্র এই কয়েকটি প্রদেশকে আপনার রাজ্যান্তৰ্গত করিলেন। পরে বৎসভূমি অধিকার করিয়া কেবলী, মৃত্তিকাবতী, মোহন, পত্তন, ত্রিপুরা ও
কোশলবাসী ভূপালদিগের নিকট জয়লাভপূ
র্ব্বক কর সংগ্ৰহ করিতে লাগিলেন। অনন্তর দক্ষিণাভিমুখে যাত্ৰা করিয়া তত্ৰত্য রাজাদিগকে পরাজিত করিয়া মহারাজ রুক্মীর সহিত সংগ্রামে প্রবৃত্ত হইলেন। মহাবলপরাক্রান্ত রুক্মী কর্ণের সহিত তুমুল যুদ্ধ করিয়া কহিলেন, “হে রাজন! আপনার বলবিক্রমে পরমপ্রীতি ও প্ৰসন্ন হইয়াছি; অতএব আপনার আর বিঘ্নানুষ্ঠান করিব না। প্রতিজ্ঞা পালন করিলাম, এক্ষণে প্রীতিপূর্ব্বক আপনার ইচ্ছানুরূপ সুবৰ্ণ প্ৰদান করিতেছি, গ্রহণ করুন।” তখন মহাবীর কর্ণ করগ্রহণপূর্ব্বক রুক্মিসমভিব্যাহারে পাণ্ড্য ও শৈলদিগের প্রতি ধাবমান হইলেন। পরে মহীপতি কেরল, নীল, বেণুদারিতনয় এবং অন্যান্য দক্ষিণাত্য রাজাদিগকে পরাজিত ও করপ্ৰদ করিলেন।
অনন্তর মহীপাল শিশুপালের পুত্ৰ-সন্নিধানে গমনপূর্ব্বক তাঁহাকে পরাজয় করিয়া পার্শ্বস্থ ভূপালগণকে পরাজিত করিলেন। পরে সন্ধিসংস্থাপনপূর্ব্বক অবন্তিদেশীয়দিগকে বশীভূত করিলেন এবং বৃষ্ণিবংশীয়দিগের সমভিব্যাহারে পশ্চিমাভিমুখে যাত্ৰা করিয়া যবন, বর্ব্বর প্রভৃতি পাশ্চাত্য রাজাদিগকে বশীভূত করিয়া করগ্রহণ করিলেন। অনন্তর ম্লেচ্ছ, ভদ্র, রোহিতক, আগ্নেয়, মালব, শশক, নগ্নজিৎ প্রভৃতি আটবিক [অরণ্যদেশনিবাসী] ও পার্ব্বত্যগণকে অবলীলাক্রমে পরাজয় করিতে লাগিলেন।
এইরূপে তিনি পর্ব্বত, বন ও সাগর-সমবেত দেশ, পত্তন, নগর, জলপ্রায় প্রদেশ ও দ্বীপসম্পন্ন পৃথিবী অল্পকালমধ্যেই অধিকৃত এবং ভূপালগণকে বশীভূত করিয়া প্রভূত ধন গ্রহণপূর্ব্বক পুনরায় হস্তিনাপুরে উপস্থিত হইলে রাজা দুৰ্য্যোধন ভ্রাতৃবর্গ ও বন্ধুবান্ধব-সমভিব্যাহারে প্রত্যুদগমনপূর্ব্বক তাঁহাকে যথোচিত উপচারে অৰ্চনা করিয়া নগর মধ্যে তাঁহার দিগ্বিজয়ীসংবাদ প্রচারিত করিয়া দিলেন ও প্রীতমনে কহিলেন, “হে কর্ণ তোমার মঙ্গল হউক। বাহ্লিক, ভীষ্ম, দ্রোণ ও কৃপাচাৰ্য্য হইতে যে কাৰ্য্য প্রাপ্ত হই নাই, অদ্য তাহা তোমা হইতেই সম্পূর্ণরূপে লাভ করিলাম। অধিক কি, তুমি আছ বলিয়া আমি সনাথ হইয়াছি। পাণ্ডবেরা বা অন্য উন্নতিশালী রাজগণ তোমার ষোড়শী কলারও উপযুক্ত নহে। যেমন দেবরাজ ইন্দ্ৰ অদিতিকে ভক্তিভাবে নিরীক্ষণ করেন, তেমনি তুমি যশস্বিনী গান্ধারী ও রাজা ধৃতরাষ্ট্রকে দেখিবে।”
অনন্তর হস্তিনা-নগরে মহাকোলাহল ও হাহাকার [কৰ্ণকৃত কাৰ্য্যে পাণ্ডব-বৈর বদ্ধমূল হওয়ার সম্ভাবনা-হেতু হাহাকার রব] শব্দ উত্থিত হইল; কেহ কেহ কর্ণকে প্রশংসা, কেহ কেহ বা নিন্দা করিতে লাগিল; কোন কোন রাজা তুষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিয়া রহিলেন। এদিকে কৰ্ণ মহারাজ ধৃতরাষ্ট্রের সন্নিধানে উপস্থিত হইয়া গান্ধারী ও তাঁহাকে সন্দর্শন এবং তাঁহাদিগের পদবন্দন করিলেন। রাজা ধৃতরাষ্ট্র প্রীতিপূর্ব্বক কৰ্ণকে আলিঙ্গন করিয়া গমনের অনুমতি করিলেন। হে মহারাজ! শকুনি তদবধি মনে মনে ইহা স্থির করিয়াছিল যে, মহাবীর কর্ণ পাণ্ডবগণকে পরাজয় করিয়া রাখিয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই।