২৫০তম অধ্যায়
ভবনদী পারের উপায়—মোক্ষধর্ম্ম
“শুকদেব কহিলেন, ‘পিতঃ ! ইহলোকে যাহা অপেক্ষা পরম ধৰ্ম্ম আর কিছুই নাই, যে ধৰ্ম্ম সর্বাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, আপনি আমার নিকট সেই ধৰ্ম্ম কীৰ্ত্তন করুন।
“বেদব্যাস কহিলেন, ‘বৎস! আমি ঋষিপ্রণীত সর্ব্বশ্রেষ্ঠ পুরাতন ধর্ম্ম কীৰ্ত্তন করিতেছি, অবহিত হইয়া উহা শ্রবণ কর। মনুষ্য যত্নবান হইয়া স্বীয় শিশুসন্তানদিগের ন্যায় কুমার্গগামী ইন্দ্রিয়দিগকে বুদ্ধিদ্বারা সংযমিত করিয়া একাগ্রচিত্ত হইবে। মন ও ইন্দ্রিয়গণের একাগ্রতাই পরম তপস্যা ও সৰ্ব্বধৰ্ম্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। পণ্ডিতেরা উহাকে পরমধৰ্ম্ম বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন। অতএব মনুষ্য সাংসারিক বিষয়ের চিন্তা পরিত্যাগপূর্ব্বক বুদ্ধিদ্বারা পাঁচ ইন্দ্রিয় ও মনকে বশীভূত করিয়া পরিতৃপ্তচিত্তে অবস্থান করিবে। যখন তোমার ইন্দ্রিয়সমুদয় বাহ্যাভ্যন্তর-বিষয় হইতে নিবৃত্ত হইয়া পরব্রহ্মে অবস্থান করিবে, তখনই তুমি আত্মাতে সেই সনাতন পরব্রহ্মকে দর্শন করিতে সমর্থ হইবে। ব্রহ্মবিদ মহাত্মারাই সেই সৰ্ব্বব্যাপী, বিধূম পাবকের ন্যায় পরব্রহ্মকে দর্শন করিয়া থাকেন। যেমন পুষ্পফলসমন্বিত বহুশাখাসম্পন্ন মহাবৃক্ষ আপনার কোন্ স্থানে পুষ্প ও কোন্ স্থানে ফল বিদ্যমান আছে, তাহা জ্ঞাত হইতে পারে না, তদ্রূপ সোপাধি [উপাধিযুক্ত] জীব “আমি কোথা হইতে আগমন করিয়াছি ও কোথায় গমন করিব” তাহা অবগত হইতে সমর্থ হয় না। কিন্তু অন্তরাত্মা সমুদয়ই দর্শন করিতেছে। মনুষ্য আত্মজ্ঞানরূপ প্রদীপ্ত দীপদ্বারা সেই পরমাত্মাকে দর্শন করিতে পারে। অতএব তুমি আত্মজ্ঞানপ্রভাবে পরব্রহ্মকে দর্শনপূৰ্ব্বক সৰ্ব্বজ্ঞ হইয়া দেহাত্মভাব পরিত্যাগ কর। যে ব্যক্তি নির্ম্মোকনির্ম্মুক্ত সর্পের ন্যায় সমুদয় পাপ হইতে বিমুক্ত হয়েন, তিনিই ইহলোকে উৎকৃষ্ট বুদ্ধি লাভ করিয়া দেহান্তর-সম্বন্ধশূন্য ও জীবন্মুক্ত হইয়া থাকেন।
‘ভবসাগরগামী দুস্তর দেহনদী অব্যক্তরূপে উৎপন্ন হইয়াছে। পাঁচ ইন্দ্রিয় উহার জলজন্তু, মন ও সঙ্কল্প উহার তীর, লোভ ও মোহ উহার তৃণ, কাম ও ক্রোধ উহার সরীসৃপ, সত্য উহার তীর্থ, মিথ্যা উহার চাঞ্চল্য, ক্রোধ উহার পঙ্ক, জিহ্বা উহার আবৰ্ত্ত ও বাসনা উহার দুস্তর পাতালস্বরূপ [অতলস্পর্শ—জলের অসীমতা]। ঐ নদী সৰ্ব্বস্থানে ভীষণ তরঙ্গমালা বিস্তারিত করিয়া লোকসমুদয় প্রবাহিত করিতেছে। অজিতেন্দ্রিয় ব্যক্তিরা উহা কদাচ উত্তীর্ণ-হইতে সমর্থ হয় না; ধৈৰ্য্যশালী জ্ঞানবান্ মনীষিগণই ঐ নদী উত্তীর্ণ হইয়া থাকেন। তুমি জ্ঞানবলে সেই দেহনদী উত্তীর্ণ হও; তাহা হইলেই বিষয়বিমুক্ত, আত্মজ্ঞানসম্পন্ন ও পবিত্র হইয়া উৎকৃষ্ট বুদ্ধি লাভপূর্ব্বক ব্রহ্মস্বরূপ হইতে পারিবে। এক্ষণে তুমি সংসার হইতে মুক্ত হইয়া পর্ব্বতস্থ ব্যক্তির ন্যায় ভূতলস্থ লোকদিগের সহিত নির্লিপ্ত হইয়া তাহাদিগকে অবলোকন কর। হর্ষক্রোধবিহীন ও অনৃশংস হইলেই সৰ্ব্বভূতের উৎপত্তি ও বিনাশের তত্ত্বদর্শনে সমর্থ হইবে। ধাৰ্মিকাগ্রগণ্য তত্ত্বদর্শী পণ্ডিতেরা এই দেহনদীতরণরূপ ধৰ্ম্মকেই সৰ্ব্বধৰ্ম্ম অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া থাকেন।
‘আত্মজ্ঞানসম্পন্ন, নিয়তাত্মা, অনুগত ব্যক্তিদিগকেই এই ধৰ্ম্মের উপদেশ প্রদান করা কর্ত্তব্য। এই আমি তোমার নিকট সর্বোৎকৃষ্ট গূঢ়তম আত্মজ্ঞানের বিষয় কীৰ্ত্তন করিলাম। সুখদুঃখবিহীন ভূতভবিষ্যতের কারণ পরব্রহ্ম পুরুষ, স্ত্রী বা নপুংসক নহেন। কি স্ত্রী, কি পুরুষ, যে উহাকে পরিজ্ঞাত হইতে পারে, তাহাকে পুনৰ্ব্বার সংসারে বদ্ধ হইতে হয় না। এই আমি তোমার নিকট সমস্ত মত বিশেষরূপে কীৰ্ত্তন করিলাম। যাহারা এই সমস্ত মতানুসারে কার্য্যানুষ্ঠান করিতে পারে, তাহাদের সিদ্ধিলাভ হয়, অন্য ব্যক্তি কখনই সিদ্ধিলাভে সমর্থ হয় না। হে বৎস! আমি তোমাকে যেরূপ উপদেশ প্রদান করিলাম, লোকে প্রীতিযুক্ত, দয়াবান্ ও সদ্গুণসম্পন্ন পুত্রকর্ত্তৃক জিজ্ঞাসিত হইয়া, প্রীতমনে তাহাকে এইরূপ সদুপদেশ প্রদান করিবে।’ ”