২৪তম অধ্যায়
বিবিধবান্ধবশোকচ্ছলে শকুনি তিরস্কার
“হে মধুসূদন! ঐ দেখ, সোমদত্তের পুত্র ভূরিশ্রবা যুযুধানকর্ত্তৃক নিহত হইয়া রণস্থলে শয়ান রহিয়াছেন। বিহগগণ উঁহাকে ছিন্নভিন্ন করিতেছে। ঐ দেখ, সমরনিহত সোমদত্ত যেন পুত্রশোকে নিতান্ত কাতর হইয়া যুযুধানকে ভৎর্সনা করিতেছেন। ভূরিশ্রবার জননী নিতান্ত দুঃখিত হইয়া ভর্ত্তা সোমদত্তকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিতেছে, ‘মহারাজ! আজ ভাগ্যক্রমে তুমি এই ভয়ঙ্কর কুরুকুলক্ষয় অবলোকন করিতেছ না। আজ ভাগ্যক্রমে তোমাকে যজ্ঞশীল অতি বদান্য মহাবীর পুত্র যূপধ্বজকে নিহত নিরীক্ষণ করিতে হইল না। আজ ভাগ্যক্রমে সাগরমধ্যস্থ সারসীকুলের ন্যায় পুত্রবধূগণের বিলাপ তোমার শ্রুতিগোচর হইতেছে না। হায়! তোমার পুত্রবধূগণ প্রতিপুত্রবিহীন হইয়া একমাত্র বসন ধারণপূর্ব্বক আলুলায়িতকেশে ইতস্ততঃ ধাবমান হইতেছে। মহাবীর ভূরিশ্রবা ও শল নিহত হইয়া সমরাঙ্গনে নিপতিত রহিয়াছে; শ্বাপদগণ উহাদিগকে ভক্ষণ করিতেছে। তোমার পুত্রবধূগণ সকলেই বিধবা হইয়াছে। আজ ভাগ্যক্রমে তোমাকে উহাদের বৈধব্য অবলোকন করিতে হইল না। হায়! বৎস যূপকেতুর কাঞ্চনময় ছত্র রথোপরি নিপতিত রহিয়াছে। হে মধুসূদন! ঐ দেখ, ভূরিশ্রবার প্রিয় মহিষীগণ উহাকে পরিবেষ্টনপূর্ব্বক বিলাপ ও পরিতাপ করিতেছে। উহারা ভর্ত্তৃশোকে একান্ত কাতর হইয়া দীনভাবে তোমারই অভিমুখে ধাবমান হইয়াছে। ধনঞ্জয় অনবহিত ভূরিশ্রবার বাহুচ্ছেদন করিয়া অতিশয় ঘৃণিত কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিয়াছে। বিশেষতঃ সোমদত্ততনয় প্রায়োপবিষ্ট হইলে সাত্যকি তাহার প্রাণসংহার করিয়া অর্জুন অপেক্ষাও গুরুতর পাপে লিপ্ত হইয়াছে, সন্দেহ নাই। ঐ দেখ, ভূরিশ্রবার পত্নীগণ দুইজনে এক ব্যক্তির প্রাণসংহার করিয়াছে বলিয়া বিলাপ করিতেছে। ভূরিশ্রবার প্রিয়মহিষী উহার হস্ত উৎসঙ্গে লইয়া রোদন করিয়া দীনবচনে কহিতেছে, ‘হা! যাহা আমাদিগের রশনা [কাঞ্চীদাম-কোমরের হার] আকর্ষণ, কঠিন স্তনযুগল বিমর্দ্দন, নীবি বিস্রংসন [বিস্রস্ত—খসাইয়া ফেলা] এবং নাভি, ঊরু ও জঘনদেশ স্পর্শ করিত, যাহা শত্রুগণের বধসাধন, মিত্রগণকে অভয়প্রদান ও বিপ্রগণকে অসংখ্য গোদান করিত, এই সেই হস্ত নিপতিত রহিয়াছে। আর্য্যপুত্র! তুমি যখন অন্যের সহিত যুদ্ধে প্রবৃত্ত ও অনবহিত ছিলে, পার্থ সেই সময় বাসুদেবের সমক্ষে তোমার এই হস্ত, ছেদন করিয়াছেন। মধুসূদন সভামধ্যে কিরূপে অর্জুনের এই কার্য্যের প্রশংসা করিবেন এবং স্বয়ং অর্জুনই বা কিরূপে আত্মশ্লাঘায় সমর্থ হইবেন? হে কৃষ্ণ! ভুরিশ্রবার প্রধানমহিষী তোমাকে এইরূপে ভৎর্সনা করিয়া তূষ্ণীম্ভাব অবলম্বন করিয়াছে এবং উহার সপত্নীরা আপনাদিগের পুত্রবধূর ন্যায় উহার নিমিত্ত শোকপ্রকাশ করিতেছে।
“ঐ দেখ, মহাবলপরাক্রান্ত গান্ধাররাজ শকুনি ভাগিনেয় সহদেবকর্ত্তৃক নিহত হইয়াছে। পূর্বে পরিচারকেরা যাহাকে হেমদণ্ডমণ্ডিত [২] ব্যজনদ্বারা বীজন করিত, অদ্য বিহঙ্গমেরা সেই বীরকে পক্ষপুটদ্বারা বীজন করিতেছে। যে ব্যক্তি মায়াবলে অসংখ্য রূপ ধারণ করিত, সহদেবের তেজঃস্বরূপ হুতাশন তাহার সেই মায়া ভস্মসাৎ করিয়াছে। যে শঠতাচরণ ও মায়াবলবিস্তারপূর্ব্বক সভামধ্যে ধর্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে পরাজয় করিয়া তাহার রাজ্য হরণ করিয়াছিল, এক্ষণে মহাবীর সহদেব তাহারই জীবন হরণ করিয়াছে। ঐ নির্বোধ আমার পুত্রগণের বিনাশসাধনের নিমিত্তই শঠতা শিক্ষা করিয়াছিল। ঐ ধূৰ্ত্তই আমার পুত্রগণের স্বপক্ষীয় বীরসমুদয়ের প্রাণনাশের নিমিত্ত পাণ্ডবগণের সহিত এই বৈরানল প্রজ্বালিত করিয়াছিল। এক্ষণে ঐ দুরাত্মা আমার পুত্রগণের ন্যায় নিহত হইয়া দিব্যলোক লাভ করিয়াছে। মধুসূদন! আমার পুত্ররা অতি সরলস্বভাব এবং ঐ মূর্খ নিতান্ত কুটিল; এক্ষণে বোধ হইতেছে, ঐ ধূৰ্ত্ত লোকান্তরে উপস্থিত হইয়াও আমার পুত্রগণমধ্যে পরস্পর বিরোধ উৎপাদন করিয়া দিবে।”