২৪. থানায় বসে সুশীল নন্দী

থানায় বসে সুশীল নন্দীও ঐ রাত্রেই কিরীটীর লোক মারফৎ প্রেরিত চিঠিটা পড়ছিলেন। চিঠি যত এগিয়ে চলেছে ততই যেন তাকে কি এক আকর্ষণে টেনে নিয়ে চলছে।

বস্তুত কিরীটী যে জোর গলায় বলেছে অনেকবার, মিত্রানীর হত্যাকারী তাদের দলেরই একজন—পরিচিতদেরই একজন—তিনি যেন ঠিক বিশ্বাস করে উঠতে পারেননি, কিন্তু আজ কিরীটীর চিঠিখানা পড়তে পড়তে বিস্ময়ের সঙ্গে যেন বিশ্বাস তার মনের মধ্যে দৃঢ়বদ্ধ হয়ে উঠছে।

 

সুশীল নন্দী পড়তে লাগলেন–

তবে ঐ সঙ্গে এও আমি স্বীকার করব, সেদিনকার ফোরকাস্ট আবহাওয়া সম্পর্কে ঠিকমত সত্য হয়ে যাওয়ায় আপনি যে সুযোগটা পেয়েছিলেন সেটা আপনার নির্দোষিতার পক্ষেই গিয়েছিল। আকাশের চাঁদ হঠাৎ ঢাকা পড়লে অন্ধকার হয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু পরমুহূর্তেই মেঘ অপসারিত হলে যেমন আবার আলো দেখা দেয়—আপনার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। ধুলোর ঘূর্ণিঝড় ওঠা সত্ত্বেও আপনার অপকীর্তি চাপা থাকেনি। আপনার ভুলগুলো—যা মরা পাখীর পালকের মত চারিদিকে ছড়িয়ে ছিল, সেগুলোই আপনার মিত্রানীকে হত্যার সাক্ষী দিয়েছে এবং তাদের মধ্যে প্রত্যক্ষ প্রমাণগুলোর কথা আগেই বলেছি, এবার শেষ কথায় আসছি।

(৭) আমার প্রথম থেকেই ধারণা হয়েছিল এবং আপনাদেরও বলেছি যে আপনাদের মধ্যেই কেউ সেদিন ঐভাবে মিত্রানীকে হত্যা করেছেন কিন্তু কেন—কেন আমার এ ধারণা হলো। প্রথমত আপনারা যে সেদিন গার্ডেনে পিকনিক করতে যাবেন—বাইরের কেউ সে কথা জানত না একমাত্র আপনারা কজন ছাড়া দ্বিতীয়ত সেই চশমাধারী দাড়িওয়ালাকে দিয়ে যে গোলকধাঁধার সৃষ্টি করেছিলেন—সেটা তাহলে একমাত্র ক্ষীণদৃষ্টি সুহাসবাবুরই নজরে পড়তো না এবং সেটা পড়েছিল আপনিই সে কথাটা একসময় সুহাসবাবুকে বলায়—আর আপনি জানতেন সুহাসবাবুর ক্ষীণদৃষ্টির কথা। তৃতীয়ত ঝড় ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আপনি মিত্রানীকে অনুসরণ করেন এবং যেতে যেতে দুজনকে আপনি ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেন সুহাসবাবু ও কাজল বোসকে। চতুর্থত আপনিই মিত্রানীর মৃতদেহটার প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন—যেহেতু আপনিই একমাত্র ব্যাপারটা তখন পর্যন্ত জানতেন। এবং সেটা অবিলম্বে প্রকাশ হওয়ার একান্ত প্রয়োজন ছিল।

(৮) আপনার এটাও নিশ্চয়ই ভুল হবে না—মিত্রানীর মৃত্যুটা যে স্বাভাবিক নয় তখনো সেটা কেউ জানতে পারেনি এবং মৃতদেহ তোলবার সময় আপনিই তার গলায় রুমালের ফাসটা প্রথমে দেখতে পেয়ে অস্ফুট চিৎকার করে ওঠেন সকলের জবানবন্দী মত।

দেখুন কেমন করে আবার অদৃষ্টের পরিহাস আপনাকে দিয়েই আপনার পাপাচারের কথাটা ঘোষিত করালো! একবারও তখন আপনার মনে হয়নি বিদ্যুৎবাবু

ধক করে উঠলো যেন সুশীল নন্দীর এতক্ষণ পরে চিঠির মধ্যে ঐ নামটা পড়ে। বিদ্যুৎ বিদ্যুৎ সরকারই তাহলে?

কয়েকটা মুহূর্ত বিহুল বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে থাকেন সুশীল নন্দী। তারপর আবার পড়তে শুরু করেন

হ্যাঁ একবারও আপনার ঐ মুহূর্তে মনে হয়নি সন্ধ্যার ঘনায়মান অন্ধকারে তার গলায় চেপে বসা রুমালের ফাসটা অত সহজে কারো চোখে পড়ার কথা নয়, তাছাড়া আপনিই মাথার দিকটা ধরেছিলেন তার ইচ্ছা করে—ঐ কথাটা সকলকে জানাবার জন্য—আবার। সেই অদৃষ্টের পরিহাস, আপনি টর্চের আলোয় ব্যাপারটা সকলের দৃষ্টিগোচর করলেন! আপনি একবারও হয়ত ভাবেননি বিদ্যুৎবাবু, হত্যা মানেই পুলিস অনুসন্ধান ও সর্বশেষে আদালতের কাঠগড়া!

যাক—আমার যা বলবার ছিল বললাম। এবার আপনি কি করবেন না করবেন নিজেই ভেবে দেখবেন—তবে জানবেন—ভোর হওয়ার আগেই হয়ত পুলিস আপনার ওখানে হানা দেবে, কারণ আমি তো আগেই বলেছি-আপনাকে লেখা এই চিঠির আরো দুটো কপি একটি সুশীল নন্দীকে ও অন্যটি পুলিস কমিশনারকে একই সঙ্গে পাঠালাম।

আমার কাজ শেষ।

আপনাদের কিরীটী রায়।

 

তখনো ভাল করে প্রথম ভোরের আলো ফুটে ওঠেনি—শেষ রাতের আকাশে তখনও চাঁদের আলোর খানিকটা আভাস লেগে আছে।

পর পর দুখানা পুলিসের জীপ সেই বিরাট বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল।

বাড়ির লোকজনদের জাগিয়ে পুলিস অফিসারদের ভিতরে ঢুকতে কিছুটা সময় লাগলো। বাড়ির লোক সকলে স্তম্ভিত বিমূঢ়।

দোতলার একটা ঘর বাড়ির লোকেরা অফিসারদের দেখিয়ে দিল দরজাটা বন্ধ ছিল—

ধাক্কা দেওয়া সত্ত্বেও যখন ভিতর থেকে কেউ খুললো না—দরজা ভেঙে ফেলল। এবং ঘরে পা দিয়েই ওরা থমকে দাঁড়াল।

মানুষটি বসে আছে চেয়ারে—হাতে ধরা তার কিরীটীর চিঠির শেষ পৃষ্ঠাটা ও বাকী দুটো পায়ের কাছে পড়ে আছে।

বিদ্যুৎবাবু—আমরা থানা থেকে আসছি!

কেমন যেন শূন্য বোবা দৃষ্টিতে বিদ্যুৎ তাকাল অফিসারের মুখের দিকে।