২৪তম অধ্যায়
গন্ধর্ব্বভীত বিরাটরাজের দ্রৌপদীবিদায়ে নির্ব্বন্ধ-দ্ৰৌপদীর সময়প্রার্থনা
বৈশম্পায়ন কহিলেন, যে সকল লোক সূতপুত্ৰগণকে নিহত হইতে দর্শন করিয়াছিল, তাহারা মৎস্যরাজের সন্নিধানে গমন করিয়া কহিল, “মহারাজ! গন্ধর্ব্বগণ মহাবল-পরাক্রান্ত সূতপুত্রদিগকে সংহার করিয়াছে। যেমন প্ৰকাণ্ড পর্ব্বতশিখর বজ্রপাতে বিদীর্ণ ও ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত হইয়া পড়ে, তদ্রূপ সূতগণও ধরাশয্যায় শয়ান রহিয়াছে। সৈরিন্ধ্রী বন্ধনমুক্ত হইয়া পুনরায় মহারাজের গৃহে আগমন করিতেছে। হে মহারাজ! সৈরিন্ধ্রী যেরূপ রূপবতী, গন্ধৰ্ব্বগণ যেরূপ পরাক্রান্ত এবং কামিনীগণ পুরুষের যেরূপ অভিলষণীয় তাহাতে বোধ হয়, এবার আপনার সমুদয় নগর সংশয়াপন্ন হইবে। অতএব যাহাতে বিরাট-নগরের উচ্ছেদ না হয়, তাদৃশ নীতিবিধান করুন।”
মৎস্যরাজ তাহাদিগের বাক্যশ্রবণানন্তর কহিলেন, “তোমরা সত্বর সূতগণের চরমক্রিয়া সমাধান কর; একমাত্র সুসমিন্ধ হুতাশনে সমুদয় কীচকগণকে সরত্ন ও সচন্দন করিয়া দাহ করিবে।” তৎপরে সাতিশয় সন্ত্রস্ত-চিত্তে সুদেষ্ণাকে কহিলেন, “প্রিয়ে! সৈরিন্ধ্রী আগমন করিবামাত্ৰ তুমি আমার নির্দেশক্রমে তাহাকে কহিবে, হে বরবর্ণিনি!! তোমার কল্যাণ হউক, তুমি যথা ইচ্ছা প্ৰস্থান কর। রাজা গন্ধৰ্ব্বগণের কাৰ্য্যে অত্যন্ত ভীত হইয়াছেন; এমন কি, গন্ধর্ব্বগণও তোমাকে রক্ষা করেন বলিয়া তিনি স্বয়ং তোমাকে এই কথা বলিতে সমর্থ হইবেন না। স্ত্রীলোকে তোমার সহিত কথোপকথন করিলে গন্ধর্ব্বগণের মনে কোন সংশয় হইবে না, এই জন্য আমি তোমাকে কহিতেছি।”
এদিকে দ্রৌপদী ভীমসেনের প্রতাপে সূতপুত্ৰগণের হস্ত হইতে পরিত্রাণ পাইয়া গাত্র ও বসন প্রক্ষালনপূর্ব্বক শার্দ্দুলবিত্ৰাসিত হরিণীর ন্যায় নগরাভিমুখে গমন করিতে লাগিলেন। পুরুষগণ তাঁহাকে নয়নগোচর করিবামাত্র গন্ধৰ্ব্বগণের ভয়ে চতুর্দ্দিকে পলায়ন করিতে আরম্ভ করিল; কেহ কেহ বা নেত্রদ্বয় নির্মীলিত করিয়া রহিল; দ্রৌপদী ক্রমেক্ৰমে মহানসের দ্বারদেশে উপস্থিত হইলেন। তথায় ভীমসেন মত্ত মাতঙ্গের ন্যায় অবস্থান করিতেছেন অবলোকন করিয়া তাহার বিস্ময়োৎপাদনপূর্ব্বক ধীরে ধীরে সঙ্কেতবাক্যে কহিলেন, “যিনি আমাকে বিপদে রক্ষা করিয়াছেন, সেই গন্ধর্ব্বকে নমস্কার করি।” ভীমও সঙ্কেতক্রমে উত্তর করিলেন, “গন্ধর্ব্বগণ যাহার বশীভূত হইয়া পূর্ব্বাবধি এ স্থানে অবস্থান করিতেছেন, এক্ষণে তাঁহার বাক্য শ্রবণ করিয়া ঋণমুক্ত হইলেন।”
তৎপরে দ্রৌপদী শয়নাগারের নিকট দিয়া গমন করিতে লাগিলেন। ঐ সময়ে বিরাটরাজের কন্যাগণ মহাবাহু ধনঞ্জয়ের নিকটে নৃত্যশিক্ষা করিতেছিলেন, তাহারা নিরপরাধিনী সৈরিন্ধ্রীকে আগমন করিতে দেখিয়া হৰ্ষোৎফুল্লচিত্তে অর্জ্জুনসমভিব্যাহারে তথা হইতে নিৰ্গত হইয়া হৃষ্টচিত্তে কহিলেন, “সৈরিন্ধ্রী! তুমি সৌভাগ্যক্রমে সঙ্কট হইতে রক্ষা পাইয়া পুনরায় আগমন করিয়াছ এবং যাহারা তোমাকে ক্লেশ প্রদান করিয়াছিল, তাহারাও নিহত হইয়াছে।”
অর্জ্জুন কহিলেন, “সৈরিন্ধ্রী! তুমি কিরূপে বিপদ হইতে মুক্ত হইয়াছ এবং কি প্রকারে সেই পাপাত্মারা বিনষ্ট হইয়াছে, ইহা শ্রবণ করিবার নিমিত্ত আমার একান্ত বাসনা হইতেছে।”
দ্ৰৌপদী কহিলেন, “কল্যাণি বৃহন্নলে! তুমি অস্তঃপুরে কন্যাগণের সহিত পরমসুখে বাস করিতেছ, বাস কর। সৈরিন্ধ্রীর বৃত্তান্ত শ্রবণ করিয়া তোমার কি লাভ হইবে? সৈরিন্ধ্রী যে যন্ত্রণা ভোগ করিতেছে, তাহা ত’ তোমাকে সহ্য করিতে হইতেছে না; এই নিমিত্তই আমাকে নিতান্ত কাতর দেখিয়া সহাস্যবদনে জিজ্ঞাসা করিতেছ।”
অর্জ্জুন কহিলেন, “সৈরিন্ধ্রী! বৃহন্নলা তোমার দুঃখে যৎপরোনাস্তি দুঃখভোগ করিতেছে; তুমি তাহাকে তিৰ্য্যাগযোনি পশু-পক্ষী বিবেচনা করিও না। যাহারা সতত একত্র বাস করে, তাহাদের অন্যতম দুঃখিত হইলে সকলেই সেই দুঃখ অনুভব করিয়া থাকে; অতএব তুমি দুঃখিত হইলে আমাদের কাহার অন্তঃকরণে দুঃখের উদয় না হয়? কেহ কদাপি কাহারও হৃদগত ভাব বুঝিতে পারে না; এই নিমিত্তই তুমি আমার মনের ভাব অনুভব করিতে অসমর্থ হইতেছ।”
দ্রৌপদী অর্জ্জুনের সহিত এইরূপ কথোপকথন করিয়া কন্যাগণ-সমভিব্যাহারে রাজগৃহে প্রবেশপূর্ব্বক সুদেষ্ণার সন্নিধানে সমুপস্থিত হইলেন। রাজপত্নী তাঁহাকে দেখিবামাত্র বিরাটের আদেশক্রমে কহিলেন, “সৈরিন্ধ্রী! এক্ষণে তোমার যথা ইচ্ছা হয় গমন কর। রাজা গন্ধৰ্ব্বগণের কাৰ্য্যে অত্যন্ত ভীত হইয়াছেন। তুমি অসামান্য রূপবতী যুবতী, পুরুষগণের অন্তঃকরণও নিতান্ত চঞ্চল এবং গন্ধর্ব্বগণও অতি কোপনস্বভাব; অতএব আর তোমার এ স্থানে অবস্থান করা কর্ত্তব্য নহে।”
দ্ৰৌপদী কহিলেন, “দেবি! মহারাজ আর ত্ৰয়োদশ দিবসমাত্র আমাকে ক্ষমা করুন; গন্ধর্ব্বগণ ইতিমধ্যেই কৃতকাৰ্য্য হইবেন, সন্দেহ নাই। তৎপরে তাহারা আমাকে এ স্থান হইতে লইয়া যাইবেন, তাহা হইলে মহারাজ ও আপনি সবান্ধবে শ্রেয়োলাভ করিবেন, সন্দেহ নাই।”
কীচকবধপর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত।