কয়ার ভিকুনার পশমে বোনা থলিতে কী এমন প্রমাণ ছিল যার সামনে সকলের সমস্ত দ্বিধা সংশয় প্রতিবাদই শূন্যে মিলিয়ে গিয়েছে?
কুজকোর মন্দিরপুরী কোরিকাঞ্চার তীর্থযাত্রিণীদের অতিথিশালায় গানাদো শেষ বিদায় নেবার সময় কয়ার হাতে প্রাণপণ সতর্কতায় রক্ষা করবার উপদেশের সঙ্গে অমূল্য অভিজ্ঞান হিসেবে এটি দিয়েছিলেন আমরা জানি।
কয়া নিজেও প্রথমে পশমের থলি থেকে বার করে সে অভিজ্ঞান যে কী তা দেখতে সাহস করেনি।
সংকটতারণ জাদুদণ্ড হিসেবে এ অভিজ্ঞান প্রথম ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছিল কুজকো থেকে সৌসা যাবার সংকীর্ণ গিরিপথে।
রেইমির উৎসবের জন্যে সে পথে দূরদূরান্তর থেকে তখন উৎসুক জনপদবাসীরা কুজকো নগরে আসছে।
কৃষক-দুহিতার বেশে সেই জনতার ভেতর দিয়ে কিছুদূর পর্যন্ত অগ্রসর হতে কয়ার তেমন অসুবিধা হয়নি।
কিন্তু কৃষককন্যার বেশে থাকলেও সমস্ত কুজকোমুখী জনতার মধ্যে বিপরীত পথের একজন যাত্রিণী কতক্ষণ দৃষ্টি এড়িয়ে থাকতে পারে!
রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভমুর গুপ্ত প্রহরীদের একজন তাই সন্দিগ্ধ হয়ে কয়াকে আটক করেছিল। সবাই যখন রেইমি উৎসবের জন্যে কুজকো শহরে চলেছে তখন উলটো পথে সে যাচ্ছে কেন এই ছিল প্রহরীর প্রশ্ন।
এরকম প্রশ্নের জন্যে তৈরি ছিল কয়া। বিশ্বাসযোগ্য একটা উত্তরও দিয়েছিল। বলেছিল, তীর্থযাত্রীদের একদলের মুখে তার মা মরণাপন্ন শুনে সে নিজেদের বসতিতে ফিরে যাচ্ছে। আসবার সময় মাকে সামান্য একটু অসুস্থ দেখে এসেছিল। তাঁর এরকম অবস্থা হতে পারে জানলে সে উৎসবে আসত না। কুজকো শহরে রেইমি উৎসবের আনন্দের চেয়ে মার টান বেশি বলেই সে ফিরে যাচ্ছে।
কৈফিয়তটা ভালই দিয়েছিল। মরণাপন্ন মার জন্যে উদ্বেগের অভিনয়ে কোনও ত্রুটি ছিল না। কিন্তু বিপদ বেধেছিল তারপরই।
কয়ার কথা বিশ্বাস করে সহানুভূতি থেকেই প্রহরী কয়ার গ্রামের নাম জিজ্ঞাসা করেছিল এবার। তাকে সাহায্য করার উদ্দেশ্যই ছিল হয়তো প্রহরীর।
এইবার ধরা পড়েছে কয়া। কাল্পনিক একটা গ্রামের নাম সে কোনওমতে বানিয়ে বলেছিল, কিন্তু তাতে হিতে বিপরীত হয়েছে। সেরকম কোনও গ্রামের অস্তিত্ব নেই জেনে হিংস্র কঠোর হয়ে উঠেছে প্রহরী। কয়াকে তার সঙ্গে সেখানকার কুরাকা অর্থাৎ অঞ্চলপ্রধানের কাছে যেতে হবে এই তার আদেশ।
এ বিপদ কাটাবার শেষ চেষ্টা করেছিল এবার কয়া। কাক্সামালকা শহরের সেই ভয়ংকর প্রলয় রাত্রির পর থেকে গানাদোর সঙ্গে সোনাবরদার সেজে কুজকো এসে পৌঁছোনো পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত অথচ তীব্র প্রগাঢ় যে অভিজ্ঞতা তার এই সময়টুকুর মধ্যে হয়েছে, তারই স্মৃতি সন্ধান করে আর-একটা কৈফিয়ত সাজিয়েছিল।
বলেছিল, গ্রামের নাম হয়তো আমি ভুল বলেছি। আমরা মিতিমায়েস বহু দূরের কুইটোর এলাকা থেকে সবে এ অঞ্চলে আমাদের বসতি বদল করতে হয়েছে। আমাদের বসতির ঠিক নাম তাই আমার মনে থাকে না।
এ কৈফিয়ত সাজানোর মধ্যে কয়ার বুদ্ধি ও কল্পনাশক্তির যথেষ্ট পরিচয় ছিল সন্দেহ নেই। পেরু রাজ্যের সত্যিই একটি প্রথা ছিল, এক জায়গার অধিবাসীদের গ্রামকে গ্রাম জনপদকে জনপদ বহুদূরের আর এক জায়গায় স্থানান্তরিত করার। ইংকারা প্রজাদের বিদ্রোহের সম্ভাবনা রোধ করবার জন্যেই এ ব্যবস্থা করতেন। অসন্তোষের অঙ্কুর কোথাও আছে সন্দেহ করলে এ জনপদের সমস্ত অধিবাসীদের এমন দূর প্রবাসে সরিয়ে দেওয়া হত, যেখানে সে অঙ্কুরের শিকড় মেলবার সুযোগ নেই। রাজাদেশে এরকম বাধ্যতামূলক বসতি বদল যাদের করতে হত, তাদের নাম ছিল মিতিমায়েস। মিতিমায়েসদের একটি মেয়ের পক্ষে নতুন বসতির নাম ভুলে যাওয়া খুব অস্বাভাবিক নয়।
গুপ্ত প্রহরী কিন্তু কয়ার এ কথায় হেসে উঠেছিল নির্মমভাবে। বলেছিল, এ কৈফিয়ত কুরাকার কাছেই দেবে চলো। তিনি শুনে স্বয়ং রাজপুরোহিতের কাছেই তোমায় পাঠাবেন মনে হচ্ছে। এসো আমার সঙ্গে।
হাত বাড়িয়ে কয়াকে ধরতে গিয়ে চমকে উঠেছিল প্রহরী।
না! কোনওদিকে কোনও আশা আর নেই জেনে মরিয়া হয়ে উঠে তীব্ৰস্বরে বলেছিল কয়া, তোমার সঙ্গে আমি যাব না, তোমাকেই আসতে হবে আমার সঙ্গে সৌসায় যাবার গোপন গিরিপথ দেখাতে। এই আমার আদেশ!
কৃষক কন্যাকেশী মেয়েটির এ আশ্চর্য রূপান্তরে প্রথমটা সত্যিই বিমূঢ়-বিচলিত হয়ে গিয়েছিল প্রহরী। তারপর নিজেকে অত্যন্ত অপমানিত বোধ করে ক্রোধে জ্বলে উঠে বলেছে, তোমার এই আদেশ! তোমার আদেশে সৌসার গোপন গিরিপথ দেখিয়ে তোমায় নিয়ে যেতে হবে! কে তুমি?
অযথা প্রশ্ন কোরো না।এবার শান্ত দৃঢ় হয়ে এসেছে কয়ার কণ্ঠ। তবু তার মধ্যে উদ্বেগের ঈষৎ কম্পন বুঝি সম্পূর্ণ প্রচ্ছন্ন থাকেনি।
এক মুহূর্ত থেমে কয়া আবার বলেছিল, আমার পরিচয় তোমার জানবার নয়। কেন আমার আদেশ তোমার অলঙ্ঘনীয় তা-ই শুধু দেখো।
ভিকুনার পশমে বোনা থলিটি এবার খুলে ধরেছিল কয়া। খোলবার সময় নিজের অনিচ্ছাতেই তার হাত যে একটু কেঁপে উঠেছিল, সেটা বোধহয় অস্বাভাবিক নয়।
কী আছে সে রহস্যময় থলির মধ্যে সে তখনও জানে না। যে অভিজ্ঞান সে। দেখাতে যাচ্ছে শত্রুপক্ষের সন্দিগ্ধ প্রহরীর কাছে তার কোনও মূল্য হবে কি না তা সম্পূর্ণ অনিশ্চিত।
রাজপুরোহিতের গুপ্ত প্রহরীর চেয়ে অনেক বেশি উৎকণ্ঠিত কৌতূহল নিয়ে থলিটি থেকে অভিজ্ঞানের নিদর্শনগুলি সে বার করে এনেছিল।
তারপর প্রহরীর চেয়ে অভিভূত হয়ে সেদিক থেকে আর দৃষ্টি ফেরাতে পারেনি।
অভিজ্ঞান হিসেবে এমন কিছু তখন তার হাতে শোভা পাচ্ছে, যা তারও কল্পনাতীত।
এ কল্পনাতীত অভিজ্ঞান নিদর্শন হল কোরাকেঙ্কুর দুটি পালক আর উদয়সূর্যের মতো রক্তিম ইংকা নরেশের শিরোশোভা প্লান্টুর একটি টুকরো।
ইংকা নরেশের প্রত্যক্ষ উপস্থিতির চেয়ে তাঁর অখণ্ড আধিপত্যের এ কটি নিদর্শনের মূল্য কম নয়। কোরাকেঞ্জুর এ পালক পেরুর বিরলতম বস্তু। তাভান্তিন্সুইয়ুর অতিগোপন দুর্গম একটি মরুশুষ্ক সর্বসাধারণের নিষিদ্ধ অঞ্চলে কোরাকেষ্ণু নামে আশ্চর্য একটি পক্ষীজাতি যুগ যুগ ধরে সযত্নে লালিত হয়ে আসছে। পোষা দুরে থাক, সে পাখি চোখে দেখবার অধিকারও পেরুর প্রজাসাধারণের নেই। অভিষেকের সময়ে সেই পাখির দুটি মাত্র পালক প্রত্যেক ইংকাকে শিরোভূষণ হিসেবে দেওয়া হয়। কোরাকেঞ্জুর সেই পালক আর বিশেষ ভিকুনার পশমে বোনা মাথায় জড়াবার রক্তিম বস্ত্র প্লান্টু ইংকা রাজশক্তির সবচেয়ে সম্মানিত প্রতীক। আর যা-কিছুরই হোক, কোরাকেঞ্জুর এ পালকের জাল হওয়া অসম্ভব। স্বয়ং ইংকা নরেশের মতো এ পালক দ্বিতীয়রহিত। রাজশক্তির প্রতীক হিসেবে তাই এ নিদর্শন সমস্ত সন্দেহ সংশয়ের ঊর্ধ্বে।
এ প্রতীক চিহ্ন আতাহুয়ালপার কাছে গোপনে চেয়ে নিয়ে গানাদো আশ্চর্য দূরদৃষ্টির পরিচয় দিয়েছিলেন সন্দেহ নেই। এ প্রতীকচিহ্ন আতাহুয়ালপার কাছে আদায় করা অবশ্য সহজ হয়নি। গানাদোর ওপর আতাহুয়ালপার বিশ্বাস তখন গভীর, তবু এ প্রস্তাব শুনে রীতিমতো স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন আতাহুয়ালপা। তীক্ষ্ণ অবিশ্বাসের সুরে সবিস্ময়ে গানাদোর দিকে চেয়ে বলেছিলেন, কী, বলছ কী তুমি! কোরাকেঙ্কুর পবিত্র পাখির পালক আমি তোমার হাতে তুলে দেব প্রতীক-চিহ্ন হিসেবে চরম সংকটে ব্যবহার করবার জন্যে।
হ্যাঁ, সূর্যসম্ভব। দৃঢ়স্বরে বলেছিলেন গানাদো, আর সবকিছু যেখানে বিফল, সেখানে অসাধ্যসাধনের জাদুদণ্ড হিসেবে এই পালকে যে কাজ হবে, আর কিছুতে তা হবার নয়।
কিন্তু, ক্ষুব্ধ প্রতিবাদ জানিয়ে বলেছিলেন আতাহুয়ালপা, এ তো আমাদের সমস্ত সংস্কার আর ঐতিহ্যের অপমান! ভাতিসুয়ুইর ইতিহাসে এ পবিত্র প্রতীক কোনওদিন কোনও ইংকা নরেশের হাতছাড়া হয়নি।
শান্তকণ্ঠে একটি উত্তর দিয়েই আতাহুয়ালপাকে নীরব করে দিয়েছিলেন গানাদো। বলেছিলেন, তাভানতিসুইয়ুর ইতিহাসে এমন চরম লজ্জার আর দুর্ভাগ্যের দিনও কখনও আসেনি।
পরিকল্পনায় ভুল হয়নি গানাদোর। চরম সংকটে অলৌকিক জাদুদণ্ডের মতোই কাজ করেছে ইংকা নরেশের প্রতীক-চিহ্ন।
রাজপুরোহিত ভিলিয়াক ভমু নতমস্তকে সে প্রতীকচিহ্ন মেনে নিয়ে চলে গেছেন। হুয়াসকার এবার মুক্তি পাবেন।