কল্পসূত্রে প্রতিফলিত জীবন ও সমাজ
শৌত, গৃহ্য ও ধর্মসূত্রগুলি সম্মিলিতভাবে অন্তত সাত শতাব্দী-ব্যাপ্ত ভারতীয় সমাজের বিপুল চিত্র আমাদের কাছে তুলে ধরেছে–এর মধ্যে ভারতবর্ষের উত্তর ও দক্ষিণ প্ৰান্তের সমাজ ব্যবস্থা প্ৰতিফলিত হয়েছে। এই বিশাল কালপরিধি-ব্যাপী ও বৃহৎ-ভূখণ্ড-ব্যাপী জীবনধারার পক্ষে সমানভাবে প্রযোজ্য সাধারণ সিদ্ধান্তে উপনীত হওয়া যেমন কঠিন, অনৈতিহাসিক তেমনি অবৈজ্ঞানিকও। তবে আমরা নিরাপদে একথা বলতে পারি, যে সমাজে ক্ষমতা, প্ৰভুত্ব ও সামাজিক সম্মান সমাজের নিম্নবর্গীয় জনসাধারণ থেকে অপ্ৰতিহতভাবে প্রত্যাহার করে সমাজের উচ্চবর্গীয় অস্তিত্বরূপে শ্রেণী ও বর্ণসমূহের স্থবিরত্ব প্রাপ্তিম দৃঢ় প্রবণতা দেখা গিয়েছিল। অবশ্য অর্থনৈতিক উপাদান উৎপাদন-সম্পর্কিত প্রয়োগিক কুশলতা ও উৎপাদন সম্পর্কসমূহ এই পর্যায়ে সংঘটিত অধিকাংশ পরিবর্তনের জন্য দায়ী। তবে প্রাথমিক গতি ও সুস্পষ্ট লক্ষ্য সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর আদর্শগত ভিত্তি নিজস্ব পথে ততক্ষশই অগ্রসর হয় যতক্ষণ পর্যন্ত কোনো সম্পূর্ণরূপে বিরোধী প্রক্রিয়া এই গতিকে রুদ্ধ, ব্যাহত, বা রূপান্তরিত না করে করে। কল্পসূত্রের পর্যায়ে পৌরাণিক সমাজের উদ্ভবের পক্ষে প্রয়োজনীয় সুদৃঢ় ভিত্তি ক্ৰমে নির্মিত হয়েছিল; এই যুগের প্রবণতা শুধুমাত্র পরবর্তী যুগের পূর্বাভাসই দেয় নি, কিছুদূর পর্যন্ত নূতন ধারার সূচনাও করেছিল।
পরিণতির আলোকে বিচার করা বলা যায়, এই যুগে বিভিন্ন বর্ণ ও উপবর্ণের কঠোরভাবে নির্দিষ্ট রূপ সূত্রবদ্ধ হয়েছিল; সমাজে প্রত্যেকের সুনির্দিষ্ট অমোঘ ও অপরিবর্তনীয় অবস্থান ও উপযুক্ত দায়িত্ব ও কর্তব্য বিবৃত হয়েছিল। যদিও বর্ণের তালিকায় অসবর্ণ বিবাহের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে, তবু এধরনের অসবর্ণ-বিবাহজাত সন্তানদের নামকরণে কিছু কিছু নির্দিষ্ট অঞ্চলের ইঙ্গিত রয়েছে। মোট একচল্লিশটি বর্ণনামের পরিচয় পাওয়া যায়। এদের মধ্যে যেমন নিম্নোক্ত বৃত্তিমূলক নাম রয়েছে–কর্মকার, ধীবর, মাহিষ্য, মণিকার, নাবিক, রাজক, রথকার, সূচিক, শূলিক, সুত, উদ্বন্ধক, বেণুক প্রভৃতি–তেমনি নির্দিষ্ট কিছু অঞ্চলের সঙ্গে যুক্ত নােমও পাওয়া যায়, যেমন মাগধ, বৈদেহক প্রভৃতি।
জীবনের তৃতীয় পর্যায়ে অরণ্যে বানপ্ৰস্থ-গ্ৰহণকারী ব্যক্তির জন্য ত্রিশটি ভিন্ন ধরনের জীবনযাপন প্ৰণালী রয়েছে : ধ্যানের জন্য গৃহীত আসনের বৈচিত্র্য অনুযায়ী দশপ্রকার এবং খাদ্যাভ্যাস অনুযায়ী আরো কুড়িটি পদ্ধতি। খাদ্য-পরিহারজনিত কৃচ্ছসাধনও চুড়ান্ত রূপ ধারণ করেছিল, তাই কেউ কেউ শুধু ধুম, কেউ বা শুধু ফেনা পান করে জীবন নির্বাহ করতেন। স্পষ্টত সমাজ তখন সেইসব সমাজ-বহির্ভূত গোষ্ঠীর সঙ্গে আপোসের চেষ্টা করছিল যাঁরা বহু শতাব্দী ধরে কঠোর তপস্যায় নিরত ছিলেন; সিন্ধু উপত্যকার জনসাধারণের প্রাগবৈদিক আগম-ধর্মে এধরনের কঠোর সাধনা প্ৰচলিত ছিল, আমাদের এই বিশ্বাস যদি ঠিক হয়, তাহলে এই সাধনধারার আয়ুষ্কাল ছিল প্রায় এক হাজার বছর। ব্ৰাহ্মণ্যধর্মের বৃত্তে এদের অন্তর্ভুক্ত করার একটি পথ ছিল জীবনের শেষ দুটি আশ্রমে ধ্যান ও আত্মোপলব্ধির প্রামাণ্য পদ্ধতিরূপে তাদের স্বীকৃতিদান। অনুরূপভাবে বহু শতাব্দী ধরে চতুৰ্বর্ণের অন্তর্গত জনসাধারণ মোটামুটি ইচ্ছামত অসবর্ণ বিবাহ করছিল; প্রাচীনতর বৈদিক যুগের চতুর্বর্গকেই শুধু সমাজ যদি স্বীকৃতি দিত তাহলে সমাজের একটি বিপুল অংশ বৃত্তবহির্ভূত হয়ে পড়ার আশঙ্কা ছিল। তাই এইযুগে বহু প্ৰতিবাদী ধর্মীয় গোষ্ঠীর দ্বারা রক্ষণশীল ব্রাহ্মণ্যধর্ম ও তৎসংশ্লিষ্ট বর্ণগত ভেদ ও নিষেধ যখন প্রত্যাহ্বানের সম্মুখীন হল তখন নবোৰ্ত্তত উপবর্ণগুলিকে সামাজিক গভীর অন্তর্ভুক্ত করার প্রয়োজন অনিবাৰ্থ হয়ে উঠল। আগামী বহু শতাব্দীর জন্য ধর্মসূত্রগুলি সামাজিক সংহতি সাধনের এই কর্তব্য সফলভাবে সমাধা করেছিল।
সামাজিক মূল্যবোধ কিভাবে বিবর্তিত ও পরিবর্তিত হয়েছিল তা আমরা পূর্ববর্তী আলোচনায় দেখেছি; তবে সবচেয়ে লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা গেল শূদ্ৰ ও নারীর ক্ষেত্রে, কেননা এই উভয়েই সামাজিক মানদণ্ডে নিম্নস্তরে অবনমিত হয়েছিল। শূদ্ৰদের ক্রমবর্ধমান দারিদ্র্য তাদের অবনমনকে আরো প্ৰকট করে তুলেছিল, এরা খেতমজুর, ধাতুশিল্পী, কুম্ভকার ও গৃহভূত্যরূপে কাজ করত : এদের সামাজিক অধিকার ছিল খুবই নগণ্য; জীবনধারণের জন্য ন্যূনতম প্রয়োজনীয় বৃত্তিই মাত্র এরা পেত এবং নিপীড়ন থেকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা ছিল সামান্যই। শূদ্রের একমাত্র ধর্ম ছিল উচ্চতর তিন বর্ণের সেবা। তার জন্য কোনো অনুষ্ঠান নির্দিষ্ট ছিল না। এবং আনুষ্ঠানিক ও ধর্মগতভাবে শূদ্র আর্য জনগোষ্ঠীর মধ্যে অপরের দয়ার উপর নির্ভরশীল হয়েই বাস করত। এমনকি সাক্ষাতের পর শূদ্রের প্রতি কোনো ধরনের অভিবাদনের বিধান নেই। বণিক ও ব্যবসায়ীদের লালসার স্বাভাবিক পরিণতিরূপে নির্বিচারে শোষণ বর্তমান ছিল এবং কর্মবিমুখ ভূত্য বা দাসের জন্য নিষ্ঠুর ব্যবস্থার মধ্যে গৃহতৃত্য এবং দাস-শ্রেণীর সামাজিক অবস্থান সুস্পষ্ট। এটা খুবই বিস্ময়ের যে, শূদ্রেরা উচ্চতর বর্ণগুলির জন্য রান্না করতে পারত। কিন্তু প্ৰকাশ্যে তা উল্লেখ করতে পারত না কিংবা অন্নগ্ৰহণের জন্য তাদের আহ্বানও করতে পারত না।
পাণিনি জানিয়েছেন যে গৃহভৃত্য, দ্বাররক্ষী, বারিবাহক প্রভৃতি অন্নবস্ত্রর বিনিময়েই নিযুক্ত হত; যদি বা সামান্য মজুরি তারা লাভ করত, তা তাদের শ্রমের পরিমাণ দ্বারা নির্ধারিত না হয়ে জীবনযাত্রার নিম্নমান অনুযায়ী নির্ণীত হত। এভাবে সমাজের দরিদ্রতর ও অধিকতর নিঃসম্বল অংশের শ্রমশক্তির শোষণ ছিল স্বীকৃত সত্য। সমাজের মুষ্টিমেয় ব্যক্তির হাতে সম্পদ কেন্দ্রীভূত হচ্ছিল। যদিও সোমযাগ ছিল সবচেয়ে ব্যয়-বহুল, তবুও এযুগে প্রায়ই তা অনুষ্ঠিত হত; কেননা আত্মিক ও পার্থিব পুণ্যলাভের প্রতিশ্রুতি ছাড়াও সোমযাগ অনুষ্ঠান সামাজিক প্রতিপত্তির প্ৰতীক হয়ে উঠেছিল। সোম অবশ্য ততদিনে দুষ্প্রাপ্য হয়ে পড়েছে; তাই গৌতম ধর্মসূত্রের দ্বিতীয় খণ্ডে সোমের অনেকগুলি বিকল্পের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে–অবশ্য এদের মধ্যে একটিও উত্তেজক পানীয় নয়, ফলে স্বভাবতই সোমযাগ ক্রমশ নিষ্প্রভ হয়ে গেল।
কৃষি-ভিত্তিক সমাজে তিনটি উচ্চতর বর্ণের নারী যেহেতু প্রত্যক্ষভাবে উৎপাদনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাই স্বভাবতই তাদের স্থান গৃহে সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ত–যেখানে তারা কোনো স্বীকৃত অর্থনৈতিক ভূমিকা পালন করতেন না। এছাড়া নারীর সামাজিক অবনমনের অন্যান্য হেতুও ছিল; যেমন, মূলগতভাবে পিতৃতান্ত্রিক ব্ৰাহ্মণ্য সমাজে অনাৰ্যগোষ্ঠীভুক্ত পত্নীরা নির্দিষ্ট কিছু কিছু সামাজিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত হতেন। তাছাড়া পৃথিবীর সর্বত্র সামন্ততান্ত্রিক সমাজভুক্ত নারী সামাজিকভাবে হীনতর বলে বিবেচিত হত। গর্ভবতী নারী যেন পুত্ৰ সন্তানের জননী হবে এই উদ্দেশ্য প্রসূতির সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানে নিহিত থাকার মধ্যে পূর্বোক্ত তথ্য প্রতিফলিত। পুংসবন নামক বিশেষ অনুষ্ঠানে পুত্র-সন্তান-প্ৰাপ্তির আকাঙ্ক্ষা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত হলেও কন্যা সন্তানের জন্য কোনো অনুষ্ঠান পরিকল্পিত হয় নি। কিছু কিছু অনুষ্ঠানে যদিও পুত্রের সঙ্গে কন্যাও উদ্দিষ্ট হয়েছে, তবু কন্যা-সংশ্লিষ্ট অনুষ্ঠানে কোনো মন্ত্রের ব্যবহার না হওয়াটা বিশেষভাবে তাৎপৰ্যপূর্ণ। যজ্ঞে পত্নী যদিও স্বামীর পাশে উপবেশন করতেন, সেখানে তাঁর ভূমিকা সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ও নির্বক পুত্তলিকার মত; কখনো কখনো যজ্ঞকর্মে স্বামীর সহায়তা করলেও মন্ত্র উচ্চারণ করার কোনো অধিকার তার ছিল না। অনিচ্ছুক পত্নীকে তাড়না করার নির্দেশ যেমন লক্ষ্য করা যায়, তেমনি প্রয়োজনবোধে তাকে প্ৰহার করে যৌন সংসর্গে বাধ্য করাও হত। বিশ্বাসঘাতিনী সন্দেহে পত্নীকে বলপ্রয়োগে অপমানিত করে অমানুষিক ও ঘৃণ্য নিষ্ঠুরতার সঙ্গে শান্তি বিধান করা হত। যদিও বলা হয়েছে যে এরূপ নারীকে উপভোগ করার পক্ষে কোনো বাধা নেই। পাণিনি যদিও ভল্ল ও বর্শাধারিণী নারীর উল্লেখ করেছেন তবু সাধারণভাবে নারী সমাজে হীন ছিল ও পুরুষের দ্বারা নিপীড়িত হত। বয়ঃপ্ৰাপ্তির পূর্বেই বিবাহ অনুষ্ঠান ক্রমশ অধিকতর মাত্রায় প্রথারূপে গৃহীত হচ্ছিল। উচ্চতর তিন বর্ণের দরিদ্র পিতা যৌতুকের উপকরণগুলি কোনো শূদ্রের নিকট থেকে জোর করে কেড়ে নিতে পারতেন। এতে প্রমাণিত হচ্ছে যে সামাজিক শ্রেণীবিন্যাসে নারী ধীরে ধীরে অধিকতর অবনমিত হয়ে অস্থাবর সম্পত্তি বা দ্রব্যমাত্রে পরিণত হচ্ছিল। কন্যাপণের পরিবর্তে যৌতুকদান জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল-বধূকে পরিবারের কাছেই সম্প্রদান করা হত। কিছু কিছু নিয়মে অবশ্য মানবিক চিন্তার অভিব্যক্তি লক্ষ্য করা যায় : ‘সমস্ত বর্ণের পুরুষের কর্তব্য–সম্পত্তি অপেক্ষাও অধিক মূল্যবান বিবেচনায় পত্নীকে রক্ষা করা’। (বৌধায়ন ধর্মসূত্র ২ : ৪২); কিন্তু এখানেও নারী পুরুষের সম্পত্তি। আবার অন্যদিকে দেখি বন্ধ্যা বা কন্যা-সন্তানের জননী বা মৃত্যুবৎসা পত্নীকে স্বামী পরিত্যাগ করতে পারত। তাছাড়া শূদ্রের পত্নীকে অন্য তিন বর্ণের পুরুষেরা যথেচ্ছ ভোগ করতে পারত। (আপস্তম্ব ধর্মসূত্র, ২ : ১০ : ২৭ : ১০) পুত্রের উপর শুধু পিতারই অধিকার ছিল, মাতার নয়। অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামগুলিতে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতা ক্রমশ বর্ধিত হওয়ার ফলে জীবনযাত্রার বিশেষ কোনো উন্নতি বা বৈচিত্র্য দেখা যায় নি। পুরোহিতরা সমাজের প্রহরীরূপে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করছিলেন–সামাজিক ও ধর্মীয় আচারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অসংখ্য নিয়মগুলির মধ্যে কোনো গৌণ নিয়মও কোথাও ভঙ্গ হচ্ছে কিনা, যাতে সেই অনুযায়ী যথাযথ প্ৰায়শ্চিত্তমূলক নিয়ম ও অনুষ্ঠানের নির্দেশ দিতে পারেন। স্পষ্টত সামাজিকভাবে সর্বাধিক অসহায় শূদ্র ও নারীরা এই প্রক্রিয়ায় বিধ্বস্ত হতেন। নাবীর আচরণ বিষমানুপাতিকভাবে সমাজপতিদের কঠোর মনোযোগ আকর্ষণ করত ও সামান্যতম যৌন স্খলনেও তাকে নির্মমভাবে শাস্তি প্ৰদান করা হত। প্রাচীন ইহুদীদের মধ্যেও কুমারীত্ব ও সতীত্বের উপর অনুরূপ গুরুত্বদানের প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। ভারতবর্ষে পুরুষের ক্রটিকে খুব সামান্যই কলঙ্করূপে বিবেচনা করা হয়েছে; সাধারণত পুর্বোক্ত দুটি নৈতিক আদর্শের জন্য শুধুমাত্ৰ নারীই নিপীড়িত হয়েছে।
কল্পসূত্রে প্রতিফলিত ধর্ম ব্রাহ্মণ ও উপনিষদে অনুসৃত ধর্ম অপেক্ষা মূলগতভাবে ভিন্ন নয়। দেব-সঙ্ঘে নবাগত দেবতারা পৌরাণিক ধর্মের পূর্বসূরী। প্রেততত্ত্ব এই পর্যায়ে স্পষ্টতরভাবে প্রচারিত হয়েছে কেননা পুনর্জন্ম ও কর্মবাদ ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত তথ্যে পরিণত হয়ে একটি দৃঢ় ও যুক্তিনিষ্ঠ ভিত্তিতে স্থাপিত হয়েছে। অধ্যাত্মবিদ্যায় নানাবিধ ভিন্ন ভিন্ন পূর্বানুমান স্বীকৃতি লাভ করেছে যেহেতু বিচিত্র ধরনের চিন্তাধারা এই পর্যায়ে স্পষ্টভাবে বিকশিত। নিরীশ্বরবাদ এ যুগে বিভ্ৰান্ত ও বিপথচালিত সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর অভিমত বা দর্শনরূপে অভিহিত হয়েছে; এমন কি অগ্নিপরীক্ষার মাধ্যমে বিচারও নাস্তিকের জনা নিষিদ্ধ ছিল। প্রতীক উপাসনা, প্রতিমা ও মন্দিরের অস্তিত্বের নিদর্শন পাওয়া গেছে এবং পিতৃ-উপাসনা ক্রমশ প্রভুত গুরুত্ব লাভ করেছে। সূত্রসাহিত্যের একটি নূতন গ্রন্থ রচিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যজ্ঞানুষ্ঠানের সংখ্যা বহুগুণ বর্ধিত হওয়ার ফলে বিপরীতমুখী প্রতিক্রিয়ায় দেখা দিল আতিশষ্য ও প্রতিরোধ। প্ৰতিমাপুজা যে ইতোমধ্যে প্রচলিত হয়ে পড়েছে, তা পাণিনির একটি নিয়মে প্রতিফলিত; ঐ নিয়মে প্রতিমা নির্মাণ ততক্ষণ পর্যন্ত অনুমোদিত হয়েছে। যতক্ষণ সেটি বিক্রয়ের দ্রব্য হিসাবে বিবেচিত না হচ্ছে। অর্থাৎ ভাস্কর্যজাত বস্তুর মধ্যে প্রতিমাও বাণিজ্যের উপাদান ছিল।
ধর্মসূত্র সাহিত্যের বিষয়বস্তুকে স্থূলভাবে মোট চারটি ভাগে বিভক্ত করা যায় :– (ক) চতুর্বর্ণ ও চতুরাশ্রমের জন্য পালনীয় আচার; (খ) আচারবিধি ভঙ্গ করার প্রায়শ্চিত্ত, (গ) দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনের মামলা (ব্যবহার), (ঘ) রাজধর্ম। সম্মিলিতভাবে এগুলি কোনো ব্যক্তির সামাজিক জীবনের প্রায় অসম্পূর্ণ পবিধিকে স্পর্শ করে; এর পেছনে এই সংস্কারও সক্রিয় যে বৈদিক সাহিত্য বা ‘শ্রুতি’ অর্থাৎ দৈব প্রেরণাজাত সাহিত্যে মানুষের আধ্যাত্মিক জীবন নিয়ন্ত্রণ করে। অবশ্য প্রকৃতপক্ষে কল্পসূত্রের সমাজ, এমন কি, বৈদিক যুগের শেষ পর্যায় থেকেও স্পষ্টত বহু দূরে সরে এসেছে। সামাজিক সংগঠনে অনেক বেশি মাত্রায় জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার ফলে বিচিত্র ধরনের বিধি, উপবিধি, ব্যতিক্রম ও প্ৰায়শ্চিত্তের অদ্ভুত সহাবস্থান দেখা দিল। এটা যেহেতু নিয়ত প্রসারণশীল বিষয়, পরবর্তী স্মৃত্যিযুগে তাই আমরা ধর্মশাস্ত্রের অন্তত কুড়িজন লেখকের নাম জানতে পারি। প্রাচীনতম উপনিষদ ও নবীনতম সূত্রগুলির মধ্যে সময়ের ব্যধান এক সহস্রাব্দ; এই যুগে সাহিত্যিক মানের পীড়াদায়ক অবনমন প্রকট হয়ে উঠেছে। ধর্মও সাহিত্যকে অনুপ্রেরণা দিতে পারে নি, যেহেতু ইতোমধ্যে তা নিতান্ত শূন্যগর্ভ নির্মোকে পরিণত।
কল্পসূত্রে আমরা দুটি পরস্পর বিরোধী শক্তিকে সক্রিয় দেখি–ব্যাপক অর্থে মানবতাবাদ কিছু কিছু সামাজিক বিবিধ মৌলিক বৈশিষ্ট্য, যেগুলির মধ্যে সমন্বয়ী প্রবণতা নিহিত এবং যা সর্বদাই সমাজের দ্বিতীয় মৌল শক্তির সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়; এই দ্বিতীয় মৌল শক্তি হল, সংকীর্ণ সম্প্রদায়কেন্দ্রিক রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি যা। প্রায় সম্পূর্ণভাবে ব্ৰাহ্মণ ও বিত্তবানদের দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, পুরুষতান্ত্রিক ও বর্ণবিভক্ত সমাজ-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। এই দুটি শক্তির আততি ও সংঘর্ষের ফলেই কল্পসূত্রগুলি উদ্ভূত হয়েছিল এবং এই দুটি ধারার স্পষ্ট নিদর্শন সূত্রগুলির মধ্যে নিহিত রয়েছে। অর্বাচীনতর উপনিষদগুলি রচিত হওয়ার সময়ে বিভিন্ন কৌম ও গোষ্ঠীর খণ্ডিত হওয়ার প্রক্রিয়া সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছিল; এরপরেই আমরা অসংখ্য বর্ণ ও উপবর্ণের উদ্ভব লক্ষ্য করি।–প্ৰাগাৰ্য সামাজিক সংগঠন আৰ্যদের দ্বারা জাতিগত, সংস্কৃতিগত, ও বৃত্তিগতভাবে আত্মীকৃত হওয়ার ফলে এটা ঘটেছিল। পরবর্তীকালে অর্থাৎ সূত্ৰ-সাহিত্যের যুগে বর্ণগুলি এতটা পরস্পর বিচ্ছিন্ন ও কঠোর শ্রেণীভেদ অনুযায়ী বিন্যস্ত হয়েছিল যে বৰ্ণভেদ যেকোনো ধরনের সামাজিক প্রগতির পক্ষে প্রতিবন্ধক হয়ে উঠেছিল। বিশেষত অর্বাচীনতর ধর্মসূত্ৰ-সাহিত্য এই নৈরাশ্যজনক চিত্ৰই তুলে ধরেছে।
সূত্রযুগের সমাজ সার্বিক পশ্চাদগতির এক বিষয় চিত্র উপস্থাপিত করেছে, যখন দেশের সীমান্ত-বহির্ভূত অঞ্চলসমূহের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ সম্বন্ধ ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে ছিন্ন হয়ে যাচ্ছিল এবং আত্মসংবৃত ও আত্মসন্তুষ্ট গ্রামীন জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন নগর ও দেশের অবশিষ্ট অংশের বহিঃপৃথিবীর সঙ্গে সর্বপ্রকার সম্বন্ধ সম্পূর্ণ রহিত হয়ে সমাজ ক্রমশ স্থবির হয়ে পড়েছিল। নৌ-বাণিজ্যকে অবজ্ঞার দৃষ্টিতে দেখা হচ্ছিল; যা কিছু অন্তর্বাণিজ্য অবশিষ্ট ছিল তা শুধুমাত্র নগরগুলির উপর তাৎক্ষণিক প্রভাব বিস্তার করছিল। এছাড়া আমরা পদার্থবিজ্ঞানের উন্নতি সম্পর্কেও আগ্রহের অভাব লক্ষ্য করি–যদিও একমাত্র বিজ্ঞানচর্চাই সে যুগের মানসিক অবসাদ দূর করতে পারত। সমালোচকরা লক্ষ করেছেন যে ভারতীয়দের মত গ্রিকরাও নিরীক্ষানির্ভর বিজ্ঞানের উন্নতি সাধনে ব্যর্থ হয়েছিল কেননা তাদের বিশ্বাস অনুযায়ী দার্শনিকরা ভদ্রলোক এবং ভদ্র-ব্যক্তি কখনও কায়িক শ্রম করেন না। যেসব ব্যাপক যুদ্ধবিগ্ৰহ পরোক্ষভাবে বহির্জগতের সঙ্গে গ্রামগুলির সম্পর্কে যে সমাজিক নিষেধ জারি হয়েছিল তার ফলেও গ্রামবাসীরা বহির্জগৎ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এমন একটি সঙ্কীর্ণ গণ্ডীতে আবদ্ধ হয়ে পড়ল যা মনের স্বাভাবিক ও সুস্থ বৃদ্ধির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। ধর্মসূত্রের বিভিন্ন বিধি-নিষেধের মধ্যে এর পরিণতি সবচেয়ে স্পষ্টভাবে অভিব্যক্তি। এই রচনাগুলি বিভিন্ন বর্গ ও আশ্রমের কর্তব্য সম্পর্কিত ক্রমবর্ধমান অনাবশ্যক অনুপুখে পরিপূর্ণ এবং ব্যক্তির আত্মিক উন্নতির প্রতি তা খুবই সামান্য মনোযোগ দিয়েছে। বস্তুত, সমাজে মানুষের তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা সম্পর্কে তীক্ষ্ণ সচেতনতা-বৃদ্ধিতে তা সম্পূর্ণ ব্যর্থ। খাদ্যগ্ৰহণ সম্পর্কে অসংখ্য বিধিনিষেধ এবং আনুষ্ঠানিক পরিচ্ছন্নতা, শুদ্ধতা, অন্ত্যেষ্টি-বিষয়ক অনুষ্ঠান ও প্ৰায়শ্চিত্ত সম্পর্কে অসংখ্য বিধানের উদ্ভাবন দীর্ঘকাল ধরে আধ্যাত্মিক জীবনীশক্তির ক্রমাগত ক্ষয়ই প্ৰতিফলিত করেছে। গুপ্ত সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা এবং তার সমৃদ্ধ ও সক্রিয় পৃষ্ঠপোষকতায় বহুবিধ শিল্প ও বিজ্ঞানেশী মৰ্চার ফলে যদিও সাংস্কৃতিক পরিশীলনের সূত্রপাত হয়েছিল, তবুও তা বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সংকুচিত পরিসরে বন্দী ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন ক্ষুদ্র গ্রামীণ সমাজের নিম্প্রাণ গতানুগতিকতা দূর করার জন্য বিশেষ কোনো ভূমিকা নিতে পারে নি। বস্তুত, তৎকালীন সমাজের বিপুল অংশের পক্ষে বাস্তব পরিস্থিতি ছিল নিতান্ত নির্মম। নগরগুলিতে পরিশীলিত সংস্কৃতির বিকাশ হলেও দেশে অসংখ্য মানসিক কুহেলিকা, সংস্কারসর্বস্বতা, ব্যক্তিত্বহীনতা ও তন্দ্ৰাচ্ছন্নতার অবগুণ্ঠন নেমে আসে; যেখানে একমাত্র বর্ণভেদ ও চতুরাশ্রমই ছিল চুড়ান্ত সত্য।
পৃথক বৈশিষ্ট্যের অভাবে গ্রামগুলির মধ্যে পারস্পরিক সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়; তাদের স্বয়ংসম্পূর্ণ, আত্মসংবৃত বিচ্ছিন্ন অর্থনীতিতে মুদ্রার প্রায় কোনো ভূমিকাই ছিল না। নিষ্ক্রিয়তা ও স্থবিরতা আধ্যাত্মিক নিষ্প্রণতার জন্ম দিয়েছিল–সার্থকভাবে কাল অতিবাহন সম্পর্কে কোনো চেতনাও গড়ে ওঠে নি। এমন কি গ্রামবাসীর মধ্যেও বর্ণগত ভেদের ফলে বিভিন্ন গোষ্ঠীর উদ্ভব হয়েছিল–এরা স্বভাবত এত আত্মতৃপ্তি ছিল যে অসংখ্য প্ৰজন্ম ধরে পারস্পরিক বিচ্ছিন্নতায় জীবনযাপন করতে তাদের পক্ষে কোনো বাধা সৃষ্টি হয় নি। সাহিত্যে প্রকৃত সৃজনশীলতার পক্ষে যেসব বৃদ্ধি, সংঘাত, টানাপোডেন ও আদর্শগত দ্বন্দ্ব আবশ্যক-সেসব সর্বব্যাপী আত্মিক তুচ্ছতার মধ্যে নিঃশেষিত হয়ে গিয়েছিল। ইতোমধ্যে সৃজনশীল শক্তিরূপে বৈদিক ধর্মের প্রেরণা ধীরে ধীরে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। তাই কল্পসূত্রগুলির মধ্যে আমরা একটি বন্ধ্যা, প্রেরণাহীন তুচ্ছ-প্রয়োজন-কেন্দ্রিক ও যুক্তিহীন মতবাদনিষ্ঠ সাহিত্যরূপের সঙ্গে পরিচিত হই।
ধর্মসূত্রগুলির মধ্যে আমরা এমন ধরনের সামাজিক আচার-বিধির পরিচয় পাই যা বহুপূর্বে তার ঐতিহাসিক প্রাসঙ্গিকতা হারিয়ে ফেলে সমাজের উপর জগদ্দল ভারের সৃষ্টি করেছিল। বৌদ্ধধর্ম, জৈনধর্ম ও অন্যান্য প্রতিবাদী সন্ন্যাস-নির্ভর ধর্ম আন্দােলনগুলি বৈদিক ধর্মের ভিত্তিমূলক সপ্রশ্ন প্রত্যাহ্বান জানানাের ফলে ব্রাহ্মণ যজ্ঞধর্মের যান্ত্রিক ধারাবাহিকতা কালধৰ্ম-বিরুদ্ধ ও অবাস্তব হয়ে পড়েছিল। এতে বৈদিক যজ্ঞকেন্দ্রিক প্রাচীন ধর্মীয় উন্মাদনার ধর্মগত জীবনশক্তির পুনরুত্থানের কােনাে ইঙ্গিত আমরা পাই না, বরং এমন একটি আধ্যাত্মিক অবসাদের লক্ষণ দেখি যা পরিবর্তনশীল সামাজিক বাস্তবতার প্রত্যাহ্বান-সমূহের সম্মুখীন হতে অস্বীকারে করেছিল।