চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদ – উজান স্রোত
কুহু বজ্রকে রণসাজ পরাইয়া দিল। বুকে পিঠে লোহার সাঁজোয়া, মাথায় লোহার শিরস্ত্রাণ, কটিতে তরবারি। পরাইতে পরাইতে কুহুর দুই চক্ষু জলে ভাসিয়া যাইতে লাগিল। এতদিনে পাপিষ্ঠা কুহু ভালবাসিয়াছে। শুধু দেহের আসক্তি নয়, এই সরল স্বল্পবাক্ অ-নাগরিক মানুষটি তাহার হৃদয় জয় করিয়া লইয়াছে।
বাষ্পোচ্ছ্বসিত কণ্ঠে কুহু বলিল— ‘চল, পালিয়ে যাই। কাজ নেই যুদ্ধে।’
বজ্র বলিল— ‘আর হয় না। শত্রু আসছে, যুদ্ধ না দিয়ে পালাতে পারি না।’
‘কিন্তু লাভ কি? ওরা সাত হাজার, আমরা মাত্র দুশো জন।’
‘তবু যুদ্ধ করতে হবে। যতক্ষণ একজন সৈনিক যুদ্ধ করতে প্রস্তুত থাকবে ততক্ষণ আমাকে যুদ্ধ করতে হবে। তা ছাড়া কোদণ্ড মিশ্র আছেন। এ আমার যুদ্ধ নয়, কোদণ্ড মিশ্রের যুদ্ধ। তিনি যতক্ষণ আজ্ঞা না দিচ্ছেন ততক্ষণ লড়তে হবে।’
বজ্র তোরণের দিকে চলিল। তোরণদ্বার বন্ধ, তাহার ছায়াতলে পঞ্চাশজন যোদ্ধা প্রস্তুত হইয়া দাঁড়াইয়া ছিল, কিন্তু তাহাদের মুখে চোখে যুদ্ধের উদ্দীপনা ছিল না। বজ্রের সসজ্জ মূর্তি দেখিয়া তাহারা হর্ষধ্বনি করিয়া উঠিল। একজন অধিনায়ক সম্মুখে আসিয়া সসম্ভ্রমে প্রশ্ন করিল— ‘জয়নাগ আক্রমণ করতে আসছে একথা কি সত্য?’
বজ্র বলিল— ‘সত্য। তোমরা তোরণদ্বার বন্ধ রাখো, কিন্তু এমনভাবে বন্ধ রাখো যাতে সহজে খোলা যায়।’
‘যে আজ্ঞা।’
বজ্র তখন প্রাকারের উপর উঠিল। আকৃষ্ট ধনুর ন্যায় অর্ধচক্রাকৃতি প্রাকার, তাহার উপর দেড়শত সৈন্য যথেষ্ট নয়। তথাপি তাহারা প্রসারিত হইয়া সতর্কভাবে অবস্থান করিতেছে, শত্রু বিনা বাধায় প্রাকার উত্তীর্ণ হইতে পারিবে না। বজ্র সমস্ত পরিদর্শন করিয়া বুঝিল, ইহার অধিক আত্মরক্ষার ব্যবস্থা সম্ভব নয়। কিন্তু একটা দিক এখনও অরক্ষিত আছে। রাজপুরীর পশ্চাতে স্নানঘাট অরক্ষিত, শত্রু সেই দিক দিয়া প্রবেশ করিবার চেষ্টা করিতে পারে। যদিও এ আশঙ্কা অমূলক, জয়নাগ এত অল্প সময়ের মধ্যে যথেষ্ট নৌকা সংগ্রহ করিতে পারে নাই; তবু সাবধান থাকা ভাল। বজ্র দশজন সৈনিককে ঘাট রক্ষার জন্য পাঠাইয়া দিল; যদি ওদিক দিয়া আক্রমণ আসে তাহারা গতিরোধ করিতে পারিবে। অন্তত সংবাদ দিতে পারিবে।
তারপর সূর্যাস্ত হইতে যখন আর দুই দণ্ড বাকি আছে তখন দূরে রাজপথের অন্য প্রান্তে জয়নাগের সৈন্যদল দেখা দিল। অগ্রে দুই অশ্বপৃষ্ঠে জয়নাগ ও কোকবর্মা, পিছনে ঘনসন্নিবিষ্ট সৈন্য-সম্বাধ; যেন জাঙ্গাল ভাঙ্গিয়া বন্যার স্রোত আসিতেছে। তাহাদের সঙ্গে ভেরী-তূরী নাই; কিন্তু বিপুল জন-প্রবাহের সঞ্চরণ শব্দ অবরুদ্ধ গর্জনের মত শুনা যাইতেছে।
বজ্র তোরণশীর্ষে প্রাকারের উপর দাঁড়াইয়া ছিল। এই দৃশ্য দেখিয়া তাহার বক্ষে হর্ষোন্মাদনা নৃত্য করিয়া উঠিল। এ দৃশ্য যেন তাহার চিরপরিচিত। অস্তোন্মুখ সূর্যের ছটায় সৈন্যদের পদোদ্ধৃত ধূলা গৈরিকবর্ণ ধারণ করিয়া বিপুল বাহিনীর ঊর্ধ্বে কুণ্ডলিত হইতেছে। তাহার ভিতর দিয়া অস্ত্রের ঝকমকি, বহুবর্ণ কেতন পতাকার আন্দোলন। বজ্র নিজের সমাসন্ন বিপদ ভুলিয়া গেল, ইহারা যে শত্রু তাহা ভুলিয়া গেল। তাহার কর্ণমধ্যে রক্তের দ্রুত প্রবাহ ঝাঁঝর-ঝল্লরীর মত রণিত হইতে লাগিল; তীব্রোজ্জ্বল চক্ষে স্ফুরিত নাসাপুটে সে দাঁড়াইয়া দেখিতে লাগিল।
তোরণ হইতে অনুমান তিনশত হস্ত দূরে আসিয়া জয়নাগ অশ্ব স্থগিত করিলেন : দক্ষিণ হস্ত উত্তোলন করিয়া সৈন্যদের ইঙ্গিত করিলেন। তাহারা দাঁড়াইল।
জয়নাগ কোকবর্মার সহিত কথা বলিতে লাগিলেন। উভয়ের দৃষ্টি দুর্গের উপর; কথা কহিতে কহিতে সৈন্যদের পিছনে রাখিয়া দুই আরোহী সম্মুখে অগ্রসর হইলেন।
বজ্র তোরণশীর্ষ হইতে দেখিতেছিল। অশ্বারূঢ় ব্যক্তিদ্বয় কি কথা কহিতেছে সে শুনিতে পাইল না, কিন্তু কোকবর্মাকে চিনিতে পারিল। অন্য ব্যক্তি নিঃসন্দেহে জয়নাগ। বজ্রের চোখের দৃষ্টি কঠিন হইয়া উঠিল।
তোরণশীর্ষের যোদ্ধারা ধনুতে তীর যোজনা করিয়া অপেক্ষা করিতেছিল; এখনও শত্রু বহুদূরে, তীর নিক্ষেপ করা তীরের অপব্যয় মাত্র। সকলে রুদ্ধশ্বাসে প্রতীক্ষা করিতেছে।
বজ্র একজন নায়ককে কাছে ডাকিল। অশ্বারূঢ় ব্যক্তিদের নির্দেশ করিয়া প্রশ্ন করিল— ‘ওরা এখান থেকে কত দূরে বলতে পার?’
নায়ক বিচার করিয়া বলিল— ‘আড়াইশো হাতের কম হবে না।’
বজ্র বলিল— ‘ভাল। আমাকে একটা ধনু দাও।’
নায়ক বিস্মিত চক্ষু তুলিয়া বলিল— ‘এত দূর থেকে—’
বজ্র বলিল— ‘একটা ভাল ধনু দাও।’
অন্য যোদ্ধারা আসিয়া নিজ নিজ ধনু বজ্রকে দেখাইল। বজ্র একটি শার্ঙ্গ ধনু বাছিয়া লইল; ধনুর্মুষ্টি লৌহের, দুই দিকে শৃঙ্গ। চতুর্হস্ত প্রমাণ ধনু, তাহাতে মৃগতন্তুর ছিলা। বজ্র ধনুর গুণ খুলিয়া আবার টান করিয়া গুণ পরাইল। তারপর অতি যত্নে দুইটি দ্বাদশমুষ্টি পরিমিত কঙ্কপত্রযুক্ত শর নির্বাচন করিয়া লইল।
অশ্বারূঢ় দুইজন ইতিমধ্যে আরও কিছু নিকটে আসিয়াছে; তাহারা গভীরভাবে কোনও বিষয় আলোচনা করিতেছে। কিন্তু তাহারা এখনও দুইশত হস্তের অধিক দূরে আছে; দুর্গ হইতে তীর নিক্ষেপ করিলে তাহাদের নিকট পৌঁছিতে পারে, কিন্তু বিশেষ অনিষ্ট করিতে পরিবে না। বিশেষত জয়নাগ ও কোকবর্মা উভয়ের দেহই লৌহজালিকে আবৃত, তীর গায়ে পড়িলেও বিদ্ধ করিতে পারিবে না।
ঠিক দুইশত হস্ত পর্যন্ত আসিয়া জয়নাগ অশ্ব সংযত করিলেন; যেন অবচেতন মন তাঁহাকে সতর্ক করিয়া দিল ইহার অধিক নিকটে যাওয়া নিরাপদ নয়। দুই অশ্ব পাশাপাশি দাঁড়াইল; দুই আরোহী প্রাসাদের দিকে চক্ষু তুলিলেন।
বজ্র ইন্দ্রকোষের ছিদ্রমুখে দাঁড়াইয়া অপেক্ষা করিতেছিল। সে ধনুতে শরসংযোগ করিল। পাশে দাঁড়াইয়া নায়ক অন্য তীরটি ধরিয়া ছিল, মৃদুস্বরে বলিল— ‘কিন্তু এখনও দুইশত হস্ত দূরে।’
বজ্র শুনিতে পাইল না। শর সন্ধান করিয়া ধীরে ধীরে গুণ আকর্ষণ করিল। কর্ণ পর্যন্ত গুণ আকর্ষণ করিয়া শর ছাড়িয়া দিল। টঙ্কার শব্দ হইল, যেন এক ঝাঁক ভ্রমর একসঙ্গে গুঞ্জন করিয়া উঠিল।
কোকবর্মা হাস্য করিতে করিতে কিছু বলিতেছিল; তাহার মুখের হাসি সহসা মিলাইয়া গেল। সে নিজের প্রতি দৃষ্টি ফিরাইয়া দেখিল একটি তীরের পুঙ্খ তাহার বক্ষ হইতে বাহির হইয়া আছে। বজ্রের তীর তাহার লৌহজালিক ভেদ করিয়া বক্ষে প্রবেশ করিয়াছে, তাহা সে বুঝিতে পারিল না। তাহার কণ্ঠ হইতে একটা শুষ্ক হিক্কার ন্যায় শব্দ বাহির হইল। তারপর সে ঘোড়ার পিঠ হইতে টলিয়া পড়িয়া গেল। নরাধম কোকবর্মা জানিতেও পারিল না যে তাহার লালসা-কলুষিত পঙ্কিল জীবনের অবসান হইয়াছে।
জয়নাগ কিন্তু নিমেষমধ্যে ব্যাপার বুঝিয়াছিলেন, তিনি নিজের ঘোড়ার মুখ ঘুরাইয়া পশ্চাদ্দিকে ঘোড়া ছুটাইয়া দিলেন। বজ্র দ্বিতীয় শর লইয়া ধনুতে যোজনা করিয়াছিল, কিন্তু শরসন্ধান করিবার পূর্বেই জয়নাগ লক্ষ্যের বাহিরে চলিয়া গেলেন।
তোরণশীর্ষে যাহারা বজ্রের এই অদ্ভুত লক্ষ্যবেধ দেখিয়াছিল তাহারা জয়ধ্বনি করিয়া উঠিল। সাধারণ ধানুকী আশী হস্ত পর্যন্ত তীর নিক্ষেপ করিতে পারে, মধ্যম ধানুকী দেড় শত হস্ত পর্যন্ত পারে। কিন্তু অসামান্য শক্তি না থাকিলে দুই শত হস্ত দূরস্থ শত্রুকে লৌহজালিক ভেদ করিয়া বধ করা অসম্ভব। যোদ্ধৃগণের উৎসাহ শত গুণ বর্ধিত হইল, এমন ধনুর্ধরের পক্ষে যুদ্ধ করিয়া গৌরব আছে।
বজ্র ধনু প্রত্যর্পণ করিয়া তোরণশীর্ষ হইতে নামিয়া গেল। সে মনে বিশেষ কোনও উল্লাস অনুভব করিল না, কেবল ভাবিল— ‘রাজা হয়ে অন্তত একটা সৎকার্য করেছি।’
ওদিকে কোকবর্মার তীরবিদ্ধ দেহ পথের উপর পড়িয়া ছিল, তাহার ঘোড়াটা পলায়ন করিয়াছিল। শত হস্ত পশ্চাতে বিস্ময়াহত সেনাদলের সম্মুখে জয়নাগ নিজ অধীনস্থ সেনানীদের সঙ্গে পরামর্শ করিতেছিলেন। প্রাসাদের রক্ষীরা যত অল্পসংখ্যক হোক তাহারা যুদ্ধ করিবে, স্বেচ্ছায় তোরণদ্বার খুলিয়া দিবে না। জয়নাগের সঙ্গে হস্তী নাই, দ্বার ভাঙ্গিয়া ফেলিবার উপযোগী যন্ত্র নাই। এখন কী কর্তব্য?
ক্রমে সূর্য চক্রবালরেখা স্পর্শ করিল; রাত্রির আর বিলম্ব নাই। প্রাসাদের রক্ষিসৈন্যদের মুখেও উদ্বেগের ছায়া পড়িল। তাহারা নিম্নস্বরে নিজেদের মধ্যে জল্পনা করিতে লাগিল; রাত্রি হইলে প্রাসাদ রক্ষা করা কিরূপে সম্ভব হইবে? অন্ধকারে গা ঢাকিয়া শত্রু যদি পাঁচ দিক দিয়া প্রাকার উল্লঙ্ঘনের চেষ্টা করে তবে তাহাদের নিবারণ করার উপায় কি? একবার তাহারা তোরণদ্বার খুলিয়া দিতে পারিলে আর রক্ষা নাই, পুরীর সকলকে মরিতে হইবে।
বজ্র বদ্ধ তোরণদ্বারের সম্মুখে কুঞ্চিত ললাটে পাদচারণা করিতেছিল এমন সময় বাহিরে দূরে বহুজনের কলকোলাহল উত্থিত হইল। কোলাহল ক্রমশ কাছে আসিতেছে। তোরণশীর্ষ হইতে একজন যোদ্ধা ডাকিয়া বলিল— ‘ওরা আক্রমণ করতে আসছে।’
নীচে হইতে একজন নায়ক প্রশ্ন করিল— ‘কতজন?’
‘তিন চারশো। একটা গো-শকট ঠেলে নিয়ে আসছে, বোধহয় তোরণদ্বার ভাঙ্গবার জন্য।’
বজ্র ত্বরিতে প্রাকারে উঠিয়া একবার দেখিয়া আসিল। তারপর নিম্নে দ্বার-রক্ষীদের বলিল— ‘তোমরা প্রস্তুত থাকো। ধনুর্বাণ রাখো, তরবারি নাও। আমি যা আদেশ করব তাই করবে।’
আক্রমণকারীরা কাছে আসিতেছে। তাহারা লক্ষ্যান্তরে আসিলে প্রাকার হইতে নিক্ষিপ্ত শর তাহাদের মধ্যে গিয়া পড়িতে লাগিল; তাহারা বামহস্তে বর্ম তুলিয়া ধরিয়া শর নিবারণ করিতে লাগিল। দুই চারিজন হতাহত হইল, কিন্তু তাহাদের গতি রুদ্ধ হইল না।
তোরণদ্বারের ভিতর দিকে পঞ্চাশজন অসিধারী যোদ্ধা অপেক্ষা করিয়া রহিল। তারপর শত্রুদল গো-শকট ঠেলিয়া সবেগে দ্বারের উপর আঘাত করিল। দ্বার অটুট রহিল বটে কিন্তু বুঝিতে বিলম্ব হইল না যে বারম্বার এইরূপ আঘাত পাইলে দ্বার ভাঙ্গিয়া পড়িবে।
দ্বিতীয় বার গো-শকট দ্বারের উপর সবেগে প্রহত হইল। তারপর বাহির হইতে উচ্চ পুরুষ কণ্ঠস্বর আসিল— ‘শোন সবাই। তোমরা পুরী রক্ষা করতে পারবে না। যদি দ্বার খুলে দাও, যোদ্ধারা সকলে মুক্তি পাবে, জয়নাগ সকলকে নিজ সেনামধ্যে স্থান দেবেন। কিন্তু যদি বাধা দাও, বাতি দিতে কাউকে রাখব না। যদি ইষ্ট চাও দ্বার খুলে দাও।’
কিছুক্ষণ দ্বারের উভয় পক্ষ নীরব, কোনও শব্দ নাই। তারপর বজ্র তরবারি নিষ্ক্রান্ত করিয়া বলিল— ‘দ্বার খুলে দাও।’
বজ্রের পশ্চাতে যে পঞ্চাশজন রক্ষী ছিল তাহারা তাহার অভিপ্রায় বুঝিল। সকলে তরবারি দৃঢ় মুষ্টিতে ধরিয়া দাঁড়াইল।
দ্বার খুলিয়া গেল। এত শীঘ্র দ্বারোন্মোচনের জন্য শত্রু প্রস্তুত ছিল না, তাহারা ক্ষণকাল নিশ্চল হইয়া রহিল। এই অবকাশে বজ্র ও তাহার দল সিংহনাদ করিয়া তাহাদের উপর লাফাইয়া পড়িল।
অতর্কিত আক্রমণে প্রথমেই শত্রুদলের অনেক সৈনিক কাটা পড়িল। তারপর প্রকৃত যুদ্ধ আরম্ভ হইল। বজ্রের পক্ষে পঞ্চাশ, বিপক্ষে তিন শত। কিন্তু বজ্র একা এমন মত্তহস্তীর মত যুদ্ধ করিল যে কেহই তাহার সম্মুখে দাঁড়াইতে পারিল না। তাহার সৈন্যগণও তাহার আদর্শে উদ্দীপ্ত হইয়া সিংহবিক্রমে যুদ্ধ করিল। শত্রুপক্ষ যেন হতবুদ্ধি হইয়াই পলাইতে আরম্ভ করিল। প্রায় অর্ধদণ্ড যুদ্ধ হইবার পর জয়নাগের দল গো-শকট ফেলিয়া মূল সৈন্যদলে ফিরিয়া গেল। বজ্রের রক্ষিদল বিজয়োল্লাসে শকট টানিয়া ভিতরে আনিল এবং আবার তোরণদ্বারে ইন্দ্রকীলক আঁটিয়া দিল।
বজ্র সম্পূর্ণ অক্ষতদেহে ছিল; তাহার পক্ষের কয়েকজন যোদ্ধা অল্পবিস্তর আহত হইয়াছিল, কেহ মরে নাই। সকলে মহোল্লাসে বজ্রকে ঘিরিয়া কলরব করিতে লাগিল।
কিন্তু তাহাদের উল্লাস অধিকক্ষণ স্থায়ী হইল না। সূর্য অস্ত গিয়াছে, সন্ধ্যা ঘনাইয়া আসিতেছে। একজন প্রবীণ যোদ্ধা অগ্রে আসিয়া বজ্রকে সম্বোধন করিয়া বলিল— ‘মহারাজ, আপনার মত বীরের পাশে যুদ্ধ করতে করতে আমরা প্রত্যেকে প্রাণ দিতে পারি। কিন্তু প্রাণ দিয়ে লাভ কি? আপনাকে রক্ষা করতে পারব না। ওরা অসংখ্য, আমরা মাত্র দুই শত। শেষ পর্যন্ত হার মানতেই হবে।’
বজ্র বলিল— ‘তোমাদের ইচ্ছা কি?’
নায়ক বলিল— ‘আমরা আপনার বেতনভুক্, যতক্ষণ আদেশ করবেন ততক্ষণ যুদ্ধ করব। কিন্তু প্রাসাদ রক্ষা করা যাবে না। আমাদের প্রাণ তো যাবেই, আপনারও প্রাণ যাবে। তার চেয়ে আপনি যদি গোপনে প্রাসাদ ত্যাগ করেন তখন আমাদের আর কোনও দায়িত্ব থাকবে না। আমরা যেমন ইচ্ছা করতে পারব।’
বজ্র একটু চিন্তা করিয়া বলিল— ‘আমিও নিরর্থক নরহত্যা চাই না। কিন্তু কোদণ্ড মিশ্র আছেন। তাঁকে জিজ্ঞাসা করা প্রয়োজন। তুমি এস আমার সঙ্গে।’
দুইজনে সভাগৃহের অভিমুখে চলিল। কুহু পিঞ্জরাবদ্ধ পাখির মত প্রাসাদের মধ্যে ছটফট করিয়া বেড়াইতেছিল, সে ছুটিয়া আসিয়া বজ্রের সঙ্গে চলিল।
সভাগৃহ প্রায় অন্ধকার। কোদণ্ড মিশ্র বেদিকার উপর পূর্ববৎ শুইয়া আছেন। বহুক্লান্ত বৃদ্ধ গভীর ঘুমাইয়া পড়িয়াছেন; কিন্তু এখন না জাগাইলে নয়। বজ্র তাঁহার কাছে গিয়া ডাকিল— ‘আর্য কোদণ্ড মিশ্র!’
কোদণ্ড মিশ্র উত্তর দিলেন না। বজ্র আবার ডাকিল, এবারও তিনি নীরব। তখন বজ্র তাঁহার অঙ্গ স্পর্শ করিয়া দেখিল অঙ্গ হিমবৎ শীতল। কোদণ্ড মিশ্র আর জাগিবেন না।
বজ্র কুহুর দিকে ফিরিয়া বলিল— ‘কুহু, যাঁর জন্য যুদ্ধ তিনি নিজেই চলে গেছেন। সুতরাং আমাদের পালাতে আর বাধা নেই।’ সেনানায়ককে বলিল— ‘তোমরা দুর্গের দ্বার খুলে দাও। যুদ্ধ শেষ হয়েছে।’