বেলা প্রায় নটা নাগাদ জনাদশেক পুলিশ নিয়ে কিরীটী ও রহমৎ সাহেব আরামবাগে এসে উপস্থিত হল।
অতীতের নবাবী ঐশ্বর্যের ভগ্নস্তুপ।
বেদনার্ত হাহাকারে যেন আজও স্মরণ করিয়ে দেয় এক হারিয়ে যাওয়া দিনকে।
দেখছেন তো মিঃ রায়! এই ভগ্নস্তুপের মধ্যে কোন মানুষ কি থাকতে পারে? রহমৎ সাহেব। আবার বলেন।
কিরীটী এবারও তাঁর কথার কোন জবাব দেয় না। এগিয়ে চলে নিঃশব্দে। পুলিশ বাহিনীকে সে অনুসরণ করতে বলে।
ঘরের পর ঘর।
কিন্তু কোন ঘরেই জনমানবের চিহ্ন পর্যন্ত নেই। ধূলিতে আকীর্ণ—বদ্ধ বায়ুতরঙ্গে একটা ধূলো-বালির ভ্যাপসা গন্ধ। সকলে এসে একটা প্রশস্ত হলঘরের মত জায়গায় পৌঁছায়। এবং হঠাৎ ঐ সময় একটা পদশব্দ কানে আসে কিরীটিার। সতর্ক শ্রবণেন্দ্ৰিয় তার উৎকৰ্ণ হয়ে ওঠে সঙ্গে সঙ্গে।
রহমৎ সাহেবের কানেও পদশব্দটা প্রবেশ করেছিল। তিনিও থমকে দাঁড়িয়েছিলেন ইতিমধ্যে।
স্পষ্ট পদশব্দ যেন এদিকেই এগিয়ে আসছে।
চারিদিকে বড় বড় কারুকার্য করা থাম! কিরীটীর চোখের ইঙ্গিতে মুহুর্তে সকলে একএকটা থামের আড়ালে আত্মগোপন করে।
পদশব্দ আরো স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। আরো এগিয়ে আসছে।
জায়গাটার দিনের বেলাতেও পর্যাপ্ত আলো প্রবেশ না করায় আবছা একটা আলোআঁধারি।
কে ঐ এগিয়ে আসছে!
কিরীটীর চিনতে কষ্ট হয় না অস্পষ্ট আলো-আঁধারেও। লোকটা পিয়ারী।
তাহলে তার অনুমান ভুল হয়নি! পিয়ারী এই পড়ো আরামবাগেই এসে আশ্রয় নিয়েছে!
নিশ্চিত মনেই পিয়ারী এগিয়ে আসছে, ওষ্ঠ ধৃত তার একটি জ্বলন্ত সিগারেট।
কোমরের বেল্ট থেকে পিস্তলটিা বের করে কিরীটীর নির্দেশে রহমৎ সাহেব প্রস্তুত থাকেন।
এবং হাত পাঁচেকের ব্যবধান যখন তার পিয়ারী থেকে, আচমকা থামের আড়াল থেকে আত্মপ্রকাশ করে বজ্রকঠিন কণ্ঠে বলে, পিয়ারী, হাত তোল!
ভূত দেখবার মতই
সামলে নিয়ে পিয়ারী বলে, এসবের মানে কি? কে তুমি?
আশ্চর্য, আমাকে তো তোমার চেনা উচিত ছিল পিয়ারী! এর আগেও তো দু-দুবার আমাদের পরস্পরের সাক্ষাৎ হয়েছে। ব্যঙ্গভর কণ্ঠে এবারে কিরীটী বলে।
পিয়ারী চুপ করে থাকে প্রত্যুত্তরে। কারণ ইতিমধ্যে তার চারিপাশে সশস্ত্ৰ এক পুলিস বাহিনী নিঃশব্দে এসে দাঁড়িয়েছে।
বামদেব অধিকারীকে কোথায় রেখেছ বল? কিরীটিই আবার প্রশ্ন করে।
বামদেব অধিকারী!
নামটা চেনো না বলে মনে হচ্ছে নাকি!
না, জীবনে কখনো ও-নাম আমি শুনিনি এর আগে এবং বুঝতে পারছি না, কেনই বা আপনি এভাবে এসে আমাকে ঘিরেছেন?
এমন চমৎকার জায়গাতে ধরা পড়েও বুঝতে পারছ না কেন তোমাকে আমরা ঘিরে দাঁড়িয়েছি!
না। আমি তো এখানে বেড়াতে এসেছি।
বেড়াতেই এসেছ বটে। ব্যঙ্গভরে কথাটা বলে কিরীটী। তারপর রহমৎকে বলে, তাহলে রহমৎ সাহেব, বাকি জায়গাগুলো খোঁজ করে দেখুন—এইখানেই কোথাও বামদেবকে নিশ্চয়ই পাওয়া যাবে।
রহমৎ সাহেব তখন কিরীটীর নির্দেশে দুজন সশস্ত্ৰ পুলিসকে পিয়ারীর পাহারায় রেখে বাকী চারজনকে নিয়ে এগিয়ে গেলেন।
বেশী আর খুঁজতে হল না বামদেব অধিকারীকে। তবে ছট্টুলাল ও গুপীনাথ আগেভাগেই সরে পড়ায় তাদের আর পাত্তা পাওয়া গেল না।
পিয়ারীকে গ্রেপ্তার করে ও বামদেব অধিকারীকে মুক্ত করে সকলে রত্নমঞ্জিলে ফিরে এল।
সেখানে তখন বাণী তার মা’র কাছে গত এক মাসের কাহিনী বলে চলছে আর সকলে গভীর মনোযোগের সঙ্গে শুনছে।
বাণী একসময় ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
পিতার সান্নিধ্য সত্যিই সে আর যেন সহ্য করতে পারছিল না।
অনিল চিৎকার করে ডাকে, কোথায় যাচ্ছিস বাণী?
বাণী কোন জবাব দেয় না বাপের কথায়।
বাণী সোজা জঙ্গলের পথ ধরে রত্নমঞ্জিলের সামনে এসে দাঁড়াল।
স্থিরপ্রতিজ্ঞ তখন সে, বামদেব অধিকারীকে সব কথা খুলে বলবেই।
নিচে কাউকে না দেখতে পেয়ে বাণী সিঁড়ি দিয়ে সোজা একেবারে দোতলায় উঠে যায়। বিনয় ও সুজাতা তাকে চিনতে পারে না, কিন্তু সবিতা ও যোগানন্দ তাকে চিনতে পারে।
সবিতা চিৎকার করে ওঠে, এ কি, বাণী!
বাণী কম আশ্চর্য হয়নি। সে বলে মা!
বাণী ছুটে এসে দু হাতে মাকে জড়িয়ে ধরে।
বামদেবকে নিয়ে কিরীটী ফিরে আসবার পর যেন একটা আনন্দ-কোলাহল পড়ে যায়।
বাণীর মুখে সমস্ত ইতিহাস শুনে তখনি সকলে মিলে জঙ্গলের মধ্যে পড়ো বাড়িতে অনিলের খোঁজে যায়। কিন্তু তার সন্ধান সেখানে ওরা পায় না।
হতাশ হয়েই সকলে ফিরে আসে।
বাণী কিন্তু একসময় তার মাকে আড়ালে ডেকে বলে, মা, বাবা নিশ্চয়ই এখনো আশেপাশে কোথাও আছে। আর আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো রাত্রে বাবা রত্নমঞ্জিলে আসবেই।
মেয়ের কথা শুনে সবিতা কিছু বলে না, চুপ করে থাকে।
দুপুরের ডাকে কিরীটী একখানা চিঠি পেল।
হরিদ্বার থেকে এসেছে চিঠিখানা।