তবে পার্থ মায়ারথ করেন স্মরণ।
অগ্নিদত্ত কপিধ্বজ, শ্বেত অশ্বগণ।।
পার্থ চিন্তা করামাত্র আসে সেইক্ষণ।
কনক রচিত বিশ্বকর্ম্মার গঠন।।
উত্তরের রথ হৈতে নামি ধনঞ্জয়।
প্রদক্ষিণ করি তাহে করেন আশ্রয়।।
পূর্ব্বের কুণ্ডল বীর ত্যজিয়া শ্রবণে।
ইন্দ্রদত্ত কুণ্ডল যে দেন দুই কাণে।।
বেণী ঘুচাইয়া শিরে উষ্ণীষ বন্ধন।
ইন্দ্র দ্ত্ত কুণ্ডল যে দেন দুই কাণে।।
বেণী ঘুচাইয়া শিরে উষ্ণীব বন্ধন।
ইন্দ্রদত্ত কিরীটের করে বিভূষণ।।
খড়্গ ছুরি তূণ আদি বাঁধিয়া কাঁকালি।
গাণ্ডীব ধরিয়া গুণ দেন মহাবলী।।
গুণ দিয়া ধনুকেতে দিলেন টঙ্কার।
বজ্রাঘাতে গিরি যেন হইল বিদার।।
দশদিক পূর্ণ হৈল, কম্পিত ধরণী।
বধির হইল কর্ণ, কিছু নাহি শুনি।।
শমী প্রদক্ষিণ করি রথ আরোহিয়া।
চলিল উত্তরে রথে সারথি করিয়া।।
সুগ্রীব পুষ্পক মেঘ আর বলাহক।
শ্রীকৃষ্ণের হয় চারি সুন্দর ঘোটক।।
শ্বেত-বাহনের অশ্ব ইহাদের সম।
চালাল বৈরাটী অশ্ব অতি মনোরম।।
চলিবার কালে তবে পাণ্ডব ফাল্গুনী।
ধনুর্গুণ টঙ্কারিয়া করে শঙ্খধ্বনি।।
গর্জ্জিল রথের চক্র, গর্জ্জে কপিধ্বজ।
মূর্চ্ছা হয়ে পড়ে রথে বিরাট অঙ্গজ।।
প্রলয়ের মেঘ যেন গর্জ্জিল গগন।
শত বজ্র এক কালে যেমত নিঃস্বন।।
স্থাবর জঙ্গম কাঁপে সপ্তসিন্ধু জল।
শব্দ শুনি ভয়াকুল হৈল কুরুবল।।
মূর্চ্ছিত দেখিয়া পার্থ বিরাট কুমারে।
আশ্বাসিয়া সচেতন করেন তাহারে।।
ক্ষত্রপুত্র হয়ে তুমি কেন এইমত।
শব্দমাত্র শুনি কেন হৈলে জ্ঞানহত।।
লক্ষ লক্ষ হবে যবে ধনুক টঙ্কার।
এককালে শঙ্খনাদ হইবে সবার।।
তখন সংগ্রাম স্থলে কি করিবে তুমি।
রথ হতে খসি যদি পড় পাছে ভূমি।।
উত্তর বলিল, মোরে নিন্দ অকারণ।
এ শব্দে পৃথিবী মধ্যে কে আছে চেতন।।
বহু শুনিয়াছি শব্দ, জলদ-গর্জ্জন।
ধনুর্ঘোষ শঙ্খনাদ অনেক বাজন।।
এতাদৃশ শব্দ কভু কর্ণে নাহি শুনি।
রথচক্রে গর্জ্জে হেন ভয়ঙ্কর ধ্বনি।।
রথের গর্জ্জনে হৈল বধির শ্রবণ।
ধনুর্ঘোষ শঙ্খনাদে হৈনু অচেতন।।
শুনিয়া কিরীটী হাসি বলেন বচন।
যুদ্ধে স্থির হবে নাহি, লয় মম মন।।
বামপদে আমি তোমা রাখিব ধরিয়ে।
কেবল থাকিবে রথে অবলম্ব হয়ে।।
এত বলি পুনর্ব্বার করিলেক শব্দ।
সেই শব্দে কুরুকুল হইলেক স্তব্ধ।।
পুনঃ পুনঃ মহাশব্দ শুনিয়া অদ্ভুত।
কহিতে লাগিল তবে ভরদ্বাজ সুত।।
গাণ্ডীব ধনুর মত শুনি যে টঙ্কার।
দেবদত্ত বিনা হেন শব্দ আছে কার।।
এ শব্দে আমার সেনা কেহ নহে স্থির।
নিরখিয়া দেখ সবে আপন শরীর।।
বিষণ্ণ হইল, রোমাঞ্চিত সব তনু।
কর শির কাঁপে দেখ, কাঁপে বক্ষ জানু।।
তোমা সবাকার চিত্তে কি হয়, না জানি।
বধির হইল কর্ণ, হেন শব্দ শুনি।।
অস্ত্রগণ জ্যোতিহীন, অগ্নিহোত্র মন্দ।
সংজ্ঞাহীন দেখি সৈন্য, সবে নিরানন্দ।।
রক্তমাংসাহারী পক্ষী সৈন্যশিরে উড়ে।
ঘোরনাদ করি সবাকার শিরে পড়ে।।
হয় হস্তিগণ দেখ করিছে ক্রন্দন।
পুনঃ পুনঃ মল মূত্র ত্যজে ক্ষণে ক্ষণ।।
সৈন্যমধ্যে প্রবেশিয়া শিবাগণ ডাকে।
রথধ্বজ বেড়িয়াছে দেখ সব কাকে।।
সত্য হৈল অকুশল সাক্ষাতে আমার।
মহাবীর পার্থ বিনা কেহ নহে আর।।
এমন এমন কর্ম্ম কর বীরগণে।
মধ্যেতে রাখহ যত্নে রাজা দুর্য্যোধনে।।
প্রহরীরা সর্ব্বত্রই জাগি বেড়ি রহ।
বাঁটিয়া দু’ভিতে সৈন্য দউ ভাগে লহ।।
অর্দ্ধসৈন্য গবীগণে রহ এবে বেড়ি।
অসাধ্য যদ্যপি হয়, শেষে দিব ছাড়ি।।
গবীগণ তরে ব্যস্ত নাহি হও আর।
রাজারে রাখহ সবে, যত শক্তি যার।।
জয়তি নীলানিদ্রনাথ নীলচক্রধারী।
নীলপদ্ম সম মুখ, দুষ্ট-অন্তকারী।।
নীলাম্বর সহিত লীলায় নীলাচলে।
নীলকণ্ঠ আদি দেব সেবে পদতলে।।
অরুণ-বরণ চক্ষু, অরুণ বসন।
অরুণ অধর শোভা সে কর চরণ।।
মস্তকে অরুণ হেম মুকুট রচিত।
গলে মণি রত্নহার অরুণ উদিত।।
অরুণ-বরুণ চক্ষু পক্ষ্মী বামপাশে।
অরুণ চরণ সদা গায় কাশীদাসে।।
মহাভারতের কথা সুধাসিন্ধুবত।
একমনে সাধুজন পিয়ে অবিরত।।