অবশিষ্ট
ফরাশি উর্দি-পরা একদল সৈন্য নদীর তীরে এসেছিলো কুচকাওয়াজ করতে। নদীর ওপরে একটা বেলুনের দড়ি ধরে তিনজন শ্বেতাঙ্গকে ভাসতে দেখে তারা দস্তুরমতো হতবাক হয়ে সব লক্ষ করছিলো। এই দুর্গম প্রদেশে একটা বেলুনে চেপে কিনা নদীর ওপার থেকে তিনজন ইয়োরোপীয় লোক উড়ে এলো! এই তাজ্জব ঘটনা দেখে তাদের আর বিস্ময়ের কোনো সীমা ছিলো না। কিন্তু সেই সেনাবাহিনীর অধিনায়ক ইয়োরাপীয় খবর-কাগজে অনেকদিন আগেই ডক্টর স্যামুয়েল ফার্গুসনের দুঃসাহসিক অভিযানের সংবাদ পড়েছিলেন। কাজেই দুই আর দুয়ে যোগ করে এটা চট করে বুঝে নিলেন যে, এঁরা আর কেউ নন, খোদ সেই সুবিখ্যাত অভিযাত্রী এবং তার দুই সঙ্গী।
ধীরে-ধীরে বেলুন চুপসে নেমে আসছে মাটিতে—এই দৃশ্য দেখে সৈন্যরা ভয় পেয়ে গেলো। শেষকালে যদি নিরাপদ স্থানে পৌঁছুবার আগের মুহূর্তেই তাদের মৃত্যু ঘটে! বুঝি-বা সেই দোদুল্যমান অভিযাত্রীরা শেষ পর্যন্ত জীবিত অবস্থায় মাটিতে পৌঁছোন না! বেলুনটা সামান্য বেঁকে প্রবল স্রোতস্বিনীর জলে নেমে আসছে। তাই দেখে আর তারা চুপচাপ নির্বিকার দর্শক হয়ে থাকতে পারলে না। চট করে কয়েকজন ফরাশি সৈন্য দ্রুত জলে নেমে গিয়ে হাত বাড়িয়ে অভিযাত্রীদের ধরে ফেললে, আর চুপসে-যাওয়া ভিক্টরিয়া সেই ভীষণ জলস্রোতে পড়ে দ্রুত ভাসতে-ভাসতে চোখের আড়াল হয়ে গেলো।
দ্রুত পায়ে সেনাপতি এগিয়ে এলেন। ডক্টর ফার্গুসন!
হ্যাঁ, আমারই নাম স্যামুয়েল ফার্গুসন। এঁরা দুজন আমার সঙ্গী, অভিযানের সমস্তটা সময় আমার সঙ্গে-সঙ্গে ছিলেন। শ্রান্ত গলায় ফার্গুসন জানালেন। এই শেষ মুহূর্তে, নিরাপদ এলাকায় পৌঁছে, যেই সব উত্তেজনার সমাপন হলো অমনি এক সারা শরীরভাঙা অবসাদ এসে তার ওপর চেপে বসেছে।
সবাই মিলে ধরাধরি করে তাদের তীরে নিয়ে এলো। কিন্তু তীরে এসেও ফার্গুসন সেই উচ্ছসিত, ফেনিল, পাক-খাওয়া জলধারার দিকে চেয়ে রইলেন; যা তার এতদিনের আশ্রয়, সেই ভিক্টরিয়াকে স্রোতের ওপর ঝুঁটি ধরে অবলীলায় ঘোরাতে-ঘোরাতে দিগন্তের দিকে ভাসিয়ে নিয়ে গেলো জল। ধীরে-ধীরে ঝাঁপসা হয়ে এলো তার চোখ, ছলোছলে করে উঠলো, যেন এখুনি চোখ ফেটে অশ্রু বেরিয়ে আসবে।
যে-বেলুন তার এই দুঃসাধ্য অভিযানকে অনায়াসে সার্থক করে দিয়েছে, আশ্রয় দিয়েছে এই পাঁচ সপ্তাহ, বাঁচিয়েছে তাদের জংলিদের বল্লম, মরুভূমির তৃষ্ণা, বুনো জানোয়ারের দাঁত, কালো বনের আগুন, বেদুইনদের আক্রমণ আর ট্যালিবাস দস্যুদের নিষ্ঠুর বন্দুক থেকে-তার এই চিহ্নবিহীন পরিণতি এক অপরিসীম বিষাদে তাকে ভরে দিলে! এমনকী স্মৃতিচিহ্নটুকু পর্যন্ত রইলো না! বড়ো ক্লান্ত লাগলো নিজেকে। মনেমনে তিনি ফিশ-ফিশ করে বারেবারে আউড়ে নিলেন, তুমি থাকলে না বটে, কোনো স্মারক পর্যন্ত দিয়ে গেলে না, কিন্তু আমি থেকে গেলুম, তোমার কৃতিত্বের জীবিত নিদর্শন! তোমাকে আমি কোনোদিনও ভুলবো না। তারপর জোর করে তিনি ঘুরে দাঁড়ালেন—দিগন্তের কাছে যেখানে নদী বাঁক ঘুরে তার ছলোছলো জল নিয়ে বয়ে যাচ্ছে, সেদিকে আর তাকাতে পারলেন না, তীব্র এক অভাব-বোধে ও বিচ্ছেদ-বেদনায় তাঁর বুকটা টন-টন করে উঠেছে।
সেনেগল প্রদেশ ফরাশিদের একটি উপনিবেশ-সুদানের কাছেই। এই ফরাশি সেনাদল উপনিবেশের রাজ্যপালের আদেশ অনুসারে ঐ এলাকায় একটা জায়গা বেছে নিতে বেরিয়েছিলো, যেখানে সৈন্যদের জন্যে একটি ঘাঁটি স্থাপন করা যাবে। কেননা এ-সব অঞ্চলে দস্যুদের উপদ্রব খুব বেশি—কাজেই সৈন্যদের যত ব্যারাক আর ছাউনি থাকবে, ততই শান্তি ও শৃঙ্খলা রক্ষার জন্যে সুব্যবস্থা করা সম্ভব হবে। সেদিন তারা অমনি এক কুচকাওয়াজে বেরিয়ে নদীর ধারে এসেছিলো, তারপর এই সাক্ষাৎ।
খানিকক্ষণ পরে নিজেকে একটু সামলে নিয়ে ফার্গুসন সেনাপতিকে উদ্দেশ করে বললেন, আমরা যে এখানে বেলুনে করে চব্বিশে মে তারিখে পৌঁছেছি, এই মর্মে একটি সরকারি বিবৃতিতে আপনার স্বাক্ষর প্রয়োজন। আশা করি এইরকম একটা বিবৃতিতে দস্তখৎ করতে আপনার কোন আপত্তি নেই।
নিশ্চয়ই না। আমি এখুনি স্বাক্ষর করছি-আপনার এই অভিযানের সঙ্গে আমার নাম যোগ হলে তো আমারই গৌরব! কিন্তু তার আগে চলুন বিশ্রাম করবেন। আপনাদের দেখে অত্যন্ত ক্লান্ত ও ক্ষুধাত বলে মনে হচ্ছে—কাজেই সব-আগে আপনাদের বিশ্রামেরই প্রয়োজন এখন।
ফরাশি সেনাবাহিনীর সঙ্গে জো আর ডিক কেনেডিকে নিয়ে ক্লান্ত ও অবসন্ন ফার্গুসন বাহিনীর ঘাঁটির দিকে রওনা হয়ে পড়লেন। যেতে-যেতে ভাবলেন, লণ্ডনে পৌঁছুতে আরো কত দিন বাকি! এবারে ফিরে গিয়ে, সত্যি, অন্তত কিছুদিনের জন্যে বিশ্রাম নিতে হবে। না-জেনে সেনাপতি-মশাই একটা মস্ত কথা বলেছেনবিশ্রামেরই প্রয়োজন এখন আমার সর্বাগ্রে। বড্ড ক্লান্ত লাগছে নিজেকে, বড়ো বেশি অবসন্ন।
———-