২৪৫তম অধ্যায়
সন্ন্যাসীর লক্ষণ—উপাসনা-প্রণালী
“শুকদেব কহিলেন, তাত! ব্রহ্মলাভার্থী ব্যক্তি বানপ্রস্থাশ্রমের ন্যায় চতুর্থ আশ্রমে অবস্থান করিয়া সাধ্যানুসারে কিরূপে পরমাত্মার সহিত জীবাত্মার সংযোগ করিবেন?
“ব্যাসদেব কহিলেন, ‘বৎস! গৃহস্থ ও বানপ্রস্থ এই দুই আশ্রমে চিত্তশুদ্ধি লাভ করিয়া অনন্তর যাহা কৰ্ত্তব্য, তাহা কীৰ্ত্তন করিতেছি, অবহিতচিত্তে শ্রবণ কর।
‘ব্রহ্মচৰ্য্যাদি আশ্রমত্রয়ে চিত্তদোষ সংশোধন করিয়া চারি আশ্রমের মধ্যে অতি উৎকৃষ্ট সন্ন্যাসাশ্রমে গমন করিবে। অতএব তুমি চিত্তদোষ সংশোধন করিতে অভ্যাস কর। সন্ন্যাসী সিদ্ধিলাভের নিমিত্ত সহায়শূন্য হইয়া একাকীই ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করিবেন। যিনি আত্মার সহিত সাক্ষাৎকার করিয়া একাকী বিচরণ করেন, ঐরূপ ব্যক্তিকে কখন মোক্ষপদ হইতে পরিভ্রষ্ট হইতে হয় না। নিরগ্নি ও বাসস্থানপরিশূন্য হইয়া অন্নার্থ গ্রামে গ্রামে ভিক্ষাবৃত্তি অবলম্বন, প্রাত্যহিক আহারসঞ্চয়, চিত্তের একাগ্রতাসাধন, অল্পাহার, একাসন, করঙ্গ[ভিক্ষাপাত্র]ধারণ, বৃক্ষমূল আশ্রয়, কাষায়বস্ত্রপরিধান, সহায়পরিত্যাগ এবং সমুদয় জীবের প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করাই সন্ন্যাসীর চিহ্ন। যিনি অন্যের কটুক্তি শ্রবণ করিয়াও তাহার প্রতি কটুক্তি প্রয়োগ না করেন, তাঁহার সন্ন্যাসধৰ্ম্ম গ্রহণ করা উচিত। কখন কাহারও কুৎসিত কাৰ্য্য দর্শন ও কুৎসা শ্রবণ, বিশেষতঃ স্বয়ং ব্রাহ্মণের নিন্দাবাদ করা কদাপি বিধেয় নহে। সৰ্ব্বদা ব্রাহ্মণের প্রতি অনুকূলবাক্য প্রয়োগ করাই কর্ত্তব্য। অন্যের মুখে ব্রাহ্মণের নিন্দাবাদ শ্রবণ করিলে ধৈৰ্য্যাবলম্বন করিয়া তূষ্ণীম্ভাবে অবস্থান করাই উচিত। যিনি আপনাকে সৰ্ব্বব্যাপী এবং জনাকীর্ণ স্থানকে শূন্যময় বলিয়া বোধ করেন, যিনি যথকিঞ্চিৎ [যৎসামান্য।] আহার, যৎসামান্য বস্ত্র পরিধান ও যথাতথা গমন করিয়া থাকেন, যিনি জনসমাজ সর্পের ন্যায়, মিষ্টান্নজনিত তৃপ্তিকে নরকের ন্যায় এবং কামিনীগণকে শরের ন্যায় বিবেচনা করেন, যাঁহার সম্মান হইলে হর্ষ বা অপমান হইলে ক্রোধের লেশমাত্র জন্মে না এবং যিনি সমুদয় জীবকে অভয় প্রদান করিতে পারেন, দেবতারা তাঁহাকেই যথার্থ ব্রহ্মজ্ঞ বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন। জীবনে বা মৃত্যুতে আহ্লাদ প্রকাশ করা সন্ন্যাসীর কৰ্ত্তব্য নহে। ভৃত্য যেমন প্রভুর আজ্ঞার অপেক্ষা করিয়া থাকে, তদ্রূপ কালকে প্রতীক্ষা করিয়া অবস্থান করাই বিধেয়। চিত্ত ও বাক্যের দোষ পরিহার করা এবং স্বয়ং সমুদয় পাপ হইতে বিমুক্ত হওয়া উচিত।
‘যাহার শত্রু নাই, তাহার ভয়ের লেশমাত্র থাকে না। যে ব্যক্তি হইতে কোন প্রাণী ভীত না হয়, কোন প্রাণী হইতেও তাহার কিছুমাত্র ভয় থাকে না। ফলতঃ মোহশূন্য ব্যক্তির কিছুতেই আশঙ্কা নাই। যেমন মাতঙ্গের পদচিহ্ন অন্যান্য সমুদয় পদচারী জীবের পদচিহ্নে বিলীন হইয়া যায়, তদ্রূপ এক অহিংসাধৰ্ম্মে অন্যান্য সমুদয় ধৰ্ম্মই বিলীন রহিয়াছে। যিনি হিংসাধৰ্ম্মে লিপ্ত না হয়েন, তিনি অনায়াসে মৃত্যুভয় অতিক্রম করিয়া অনন্তকাল অবস্থান করিতে সমর্থ হয়েন। যিনি প্রজ্ঞাসম্পন্ন, শান্তগুণাবলম্বী, সত্যবাদী, ধৈৰ্য্যশালী, জিতেন্দ্রিয় ও সৰ্ব্বভূতের রক্ষায় যত্নবান্ হয়েন, তিনি অনায়াসে অতি উৎকৃষ্ট গতিলাভ করিতে পারেন। মৃত্যু কখনই এতাদৃশ জ্ঞানসম্পন্ন, নির্ভীক ও নিস্পৃহ ব্যক্তিকে অতিক্রম করিতে সমর্থ হয় না; প্রত্যুত তিনিই মৃত্যুকে অতিক্রম করিয়া থাকেন। যিনি সমুদয় বিষয়সংসর্গ হইতে বিমুক্ত ও শান্ত হইয়া আকাশের ন্যায় নির্লিপ্ত থাকেন, যাঁহার কেহই আত্মীয় নাই, যিনি একাকী বিচরণ করেন, ধর্ম্মার্থই যাঁহার জীবনধারণ, অন্যের উপকারই যাঁহার ধর্ম্ম, যিনি পুণ্যকাৰ্য্যদ্বারা দিবারাত্র অতিবাহিত করিয়া থাকেন, যাঁহার কিছুমাত্র আকাঙ্ক্ষা বা কোন কাৰ্য্যে উদ্যোগ নাই, যিনি স্তুতি বা নমস্কারজন্য সুখানুভব করেন না এবং সমুদয় বাসনা হইতে বিমুক্ত হইয়া থাকেন, দেবতারা তাঁহাকেই ব্রহ্মজ্ঞ বলিয়া কীৰ্ত্তন করেন। জীবমাত্রেই সুখে সন্তুষ্ট ও দুঃখে একান্ত ভীত হইয়া থাকে; অতএব যাহাতে তাঁহাদিগের দুঃখ জন্মে, এমন কাৰ্য্য কদাপি কৰ্ত্তব্য নহে। জীবগণকে অভয় প্রদান করা সমুদয় দান অপেক্ষা শ্রেষ্ঠ। যিনি প্রথমেই হিংসাধৰ্ম্মকে পরিত্যাগ করিতে পারেন, তিনি প্রাণীগণের নিকট অনন্তকাল অভয় লাভ করিয়া থাকেন।
‘মুখব্যাদান করিয়া পঞ্চগ্রাসরূপ প্রাণাহুতি প্রদান করা সন্ন্যাসীর ধৰ্ম্ম নহে। ত্রিলোকের আত্মস্বরূপ বৈশ্বানর সন্ন্যাসীর সর্ব্বশরীরে অবস্থান করেন। তিনি প্রাদেশপরিমিতি হৃদাকাশস্থিত সেই বৈশ্বানরকে মন ও ইন্দ্রিয়াদিসমুদয় আহুতি প্রদান করিয়া থাকেন, ঐ আহুতি প্রদানে সমুদয় ব্রহ্মাণ্ড পরিতৃপ্ত হয়। যাঁহারা ত্রিগুণসমাবৃত মায়াময় জীবাত্মাকে অতি শ্রেষ্ঠ পরমাত্মারূপে পরিজ্ঞাত হইতে সমর্থ হয়েন, তাঁহারা কি ভূলোক, কি দ্যুলোক, সর্ব্বত্রই পূজা ও সাধুবাদ লাভ করিয়া থাকেন। যিনি আত্মাতেই চারি বেদ, কৰ্ম্মকাণ্ড, আকাশাদি পদার্থ, পরলোক ও পরমার্থবিষয় রহিয়াছে বলিয়া অবগত হয়েন এবং নির্লিপ্ত, অপরিমেয়, জ্ঞানময় শরীরমধ্যে আবির্ভূত পরমাত্মাকে হৃদয়াকাশে অবস্থিত বলিয়া বুঝিতে পারেন, দেবতারা তাঁহাকে সেবা করিবার জন্য নিয়ত যত্নবান্ হইয়া থাকেন। ছয় ঋতু যাহার নাভি [চক্ৰমধ্যমণ্ডল], দ্বাদশ মাস যাহার অর [নেমি], অমাবস্যাদি যাহার পৰ্ব্ব, কখনই যাহার অন্ত হইবে না, যাহা নিরন্তর ঘূর্ণিত হইতেছে এবং বিশ্বসংসার যাহার আস্যদেশে প্রবিষ্ট হয়, সেই কালচক্র যোগীদের হৃদয়াকাশে অবস্থান করে। যে স্থাবরজঙ্গমাত্মক দেহ সমুদয় বিশ্বে পরিব্যাপ্ত রহিয়াছে, জীবাত্মা সেই দেহে অবস্থানপূর্ব্বক প্রাণাদি দেবতাদিগকে পরিতৃপ্ত করেন; তাঁহাদিগের তৃপ্তিলাভ হইলেই তিনি স্বয়ং পরিতৃপ্ত হয়েন। যিনি স্বয়ং তেজোময়, নিত্য ও অপরিমেয়, যিনি কোন প্রাণী হইতে ভীত না হয়েন এবং প্রাণীগণ যাঁহা হইতে শঙ্কিত না হয়, তিনিই ভয়শূন্য অনন্তলোক লাভ করিয়া থাকেন। যিনি সতত লোকের নিকট অনিন্দনীয় এবং স্বয়ং অন্যকে নিন্দা না করেন, তিনিই পরমাত্মার সহিত সাক্ষাৎ করিতে সমর্থ হয়েন। নিষ্পাপ ও মোহপরিশূন্য ব্যক্তিরা কি ইহলোক, কি পরলোক কুত্রাপি ভোগনিবন্ধন সুখ অনুভব করেন না। যে ব্যক্তির লোষ্ট্র ও কাঞ্চন, প্রিয় ও অপ্রিয় এবং নিন্দা ও স্তুতি সর্ব্বত্রই সমান জ্ঞান হইয়া থাকে; সন্ধি, বিগ্রহ, রাগ ও মোহের লেশমাত্রও যাঁহার থাকে না এবং যিনি সম্পদ্বিহীন হইয়া উদাসীনের ন্যায় ইতস্ততঃ বিচরণ করেন, তিনিই যথার্থ, ভিক্ষুক।’ ”