২৪১. প্রবৃত্তি-নিবৃত্তিরূপ—দুর্জ্ঞেয় কৰ্ম্মগতি-নিরূপণ

২৪১তম অধ্যায়

প্রবৃত্তি-নিবৃত্তিরূপ—দুর্জ্ঞেয় কৰ্ম্মগতি-নিরূপণ

“শুকদেব কহিলেন, ভগবন্! বেদে জ্ঞানীর প্রতি কৰ্ম্মত্যাগ ও কর্মীর প্রতি ধৰ্ম্মানুষ্ঠান এই উভয়ের বিধি আছে, কর্ম্ম ও জ্ঞান ইহারা পরস্পর প্রতিকূলভাবে অবস্থান করিতেছে। অতএব কৰ্ম্মপ্রভাবে লোকগণ কোন্ গতিলাভ এবং জ্ঞানবলেই বা কিরূপ গতি প্রাপ্ত হইয়া থাকে, আমি ইহা শ্রবণ করিতে অভিলাষ করি।”

‘মহাত্মা শুকদেব এই কথা কহিলে, বেদব্যাস তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, বৎস! নশ্বর কৰ্ম্ম ও অবিনশ্বর জ্ঞানের বিষয় তোমার নিকট কীৰ্ত্তন করিতেছি। কৰ্ম্মপ্রভাবে যে গতিলাভ করা যায় এবং জ্ঞানবলে যে গতি প্রাপ্ত হওয়া যায়, তাহা তুমি অনন্যমনে শ্রবণ কর। এই দুই বিষয় অতিশয় দুর্জ্ঞেয়। যে ব্যক্তি ধৰ্ম্মের অস্তিত্ব স্বীকার করে, তাহার নিকট ধর্ম্মের নাস্তিকত্ব প্রতিপাদন করিলে সে যেমন ক্ষুব্ধ হয়, সেইরূপ তোমার মুখে জ্ঞান ও কৰ্ম্ম উভয়ের প্রাধান্য শ্রবণ করিয়া আমিও ক্ষুব্ধ হইলাম। যাহাই হউক, এক্ষণে তুমি যেরূপ প্রশ্ন করিলে, তাহার প্রত্যুত্তর প্রদান করিতেছি, শ্রবণ কর। 

‘বেদে প্রবৃত্তিলক্ষণ ও নিবৃত্তিলক্ষণ এই দুই প্রকার ধর্ম্ম নির্দ্দিষ্ট আছে। জীব কৰ্ম্মপ্রভাবে সংসারপাশে বদ্ধ এবং জ্ঞানপ্রভাবে নিন্মুক্ত হইয়া থাকে; এই নিমিত্ত পারদর্শী যতিরা কদাচ কর্ম্মের অনুষ্ঠান করেন না। জীব কৰ্ম্মপ্রভাবে পুনৰ্ব্বার জন্মগ্রহণ করিয়া থাকে; কিন্তু জ্ঞানপ্রভাবে তাহার নিত্য অমৃতত্বলাভ হয়। অল্পবুদ্ধিসম্পন্ন মনুষ্যেরা কৰ্ম্মেরই সবিশেষ প্রশংসা করিয়া থাকে, এই নিমিত্ত তাহাদিগকে বারংবার দেহ পরিগ্রহ করিতে হয়। যাঁহারা সুনিপুণরূপে ধৰ্ম্মতত্ত্ব নির্ণয় করিতে পারেন এবং যাঁহারা সর্বোৎকৃষ্ট বুদ্ধি লাভ করেন, তাঁহারা নদীজলপায়ী যেমন কূপের সমাদর করে না, সেইরূপ কদাচ কৰ্ম্মের প্রশংসা করেন না। কর্ম্মদ্বারা সুখদুঃখ ও জন্মমৃত্যু প্রাপ্ত হইতে হয়; কিন্তু যে স্থানে জন্ম নাই, মৃত্যু নাই, শোক নাই এবং যথায় গমন করিলে আর প্রতিনিবৃত্ত হইতে হয় না; জ্ঞান ভিন্ন সেই স্থান উপলব্ধ হইবার উপায়ান্তর নাই। লোকের জ্ঞান জন্মিলেই তাহার অন্তরে অব্যক্ত, স্থির, প্রপঞ্চাতীত, নিশ্চেষ্ট, অমৃত ও সৰ্ব্বব্যাপী ব্রহ্ম প্রকাশিত হয়েন। তখন জীবকে আর সুখদুঃখ অনুভব করিতে হয় না। এবং তাঁহার সঙ্কল্পও আপনার মোহজাল বিস্তার করিতে পারে না। সেই অবস্থায় জীব সৰ্ব্বভূতের হিতানুষ্ঠানে একান্ত আসক্ত হইয়া থাকে এবং সকলের প্রতি তুল্যরূপে মিত্রভাব প্রকাশ করে। কর্ম্মময় পুরুষ ও জ্ঞানময় পুরুষ ইহারা পরস্পর অত্যন্ত বিভিন্ন অমাবস্যায় সূক্ষ্মকলাসম্পন্ন চন্দ্রমা যেমন অদৃশ্য থাকে অথচ উহা বিনষ্ট হয় না, সেইরূপ জ্ঞানময় পুরুষ নিত্যকাল অবিনষ্টই থাকেন। আর নভোমণ্ডলে বক্রাকার অভিনব শশাঙ্ক যেমন হ্রাসবৃদ্ধিসম্পন্ন হয়েন, সেইরূপ কর্ম্মময় পুরুষ জন্মমৃত্যু প্রাপ্ত হইয়া থাকেন। মহর্ষিগণ জ্ঞান ও কর্ম্মের এইরূপ ফল নির্দ্দেশ করিয়া গিয়াছেন। মন ও ষোড়শকলাসঞ্চিত লিঙ্গশরীর কর্ম্মদ্বারাই লব্ধ হইয়া থাকে। সেই লিঙ্গশরীরে পদ্মাপত্রস্থ সলিলবিন্দুর ন্যায় যে দেবতা অবস্থান করিতেছেন, তিনিই ক্ষেত্রজ্ঞ। লোক যোগবলে তাঁহার সাক্ষাৎকার লাভ করিয়া থাকে।

‘সত্ত্ব, রজ ও তম এই তিনটি বুদ্ধির গুণ, বুদ্ধি জীবাত্মার গুণ এবং জীবাত্মা পরমাত্মার গুণ। আত্মতত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তিরা কহেন যে, দেহ স্বভাবতঃ জড়; উহা চৈতন্যস্বরূপ জীবের সহিত যুক্ত হইলেই সচেতন হইয়া থাকে। জীবই দেহকে সচেষ্ট ও জীবিত করে। ঐ জীব হইতে শ্রেষ্ঠ আর এক পরম বস্তু আছেন; তাহা হইতেই সপ্ত ভুবন কল্পিত হইয়াছে।’ ”