[লাহোরে ধ্যান সিং-এর হাবেলীতে প্রদত্ত বক্তৃতা]
এই সেই ভূমি—যাহা পবিত্র আর্যাবর্তের মধ্যে পবিত্রতম বলিয়া পরিগণিত; এই সেই ব্রহ্মাবর্ত—যাহার বিষয় আমাদের মনু মহারাজ উল্লেখ করিয়াছেন। এই সেই ভূমি—যেখানে হইতে আত্মতত্ত্বজ্ঞানের জন্য সেই প্রবল আকাঙ্ক্ষা ও অনুরাগ প্রসূত হইয়াছে, ইতিহাসের সাক্ষ্য অনুসারে বোঝা যায়—ভবিষ্যতে এই ভাব সমগ্র জগৎকে প্রবল বন্যায় প্লাবিত করিবে। এই সেই ভূমি—যেখানে ইহার বেগশালিনী স্রোতস্বিনীকুলের ন্যায় চতুর্দিকে বিভিন্ন আধারে প্রবল ধর্মানুরাগ বিভিন্নভাবে উৎপন্ন হইয়া, ক্রমশঃ একাধারে মিলিয়া, শক্তিসম্পন্ন হইয়া পরিশেষে জগতের চতুর্দিকে বিস্তৃত হইয়াছে এবং বজ্রনির্ঘোষে উহার মহীয়ষী শক্তি সমগ্র জগতে ঘোষণা করিয়াছে। এই সেই বীরভূমি—যাহা যতবার এই দেশ অসভ্য বহিঃশত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হইয়াছে, ততবারই বুক পাতিয়া প্রথমে সেই আক্রমণ সহ্য করিয়াছে। এই সেই ভূমি—এত দুঃখ-নির্যাতনেও যাহার গৌরব ও তেজ সম্পূর্ণরূপে নষ্ট হয় নাই। এখানেই অপেক্ষাকৃত আধুনিককালে দয়াল নানক তাঁহার অপূর্ব বিশ্বপ্রেম প্রচার করেন। এখানেই সেই মহাত্মা তাঁহার প্রশস্ত হৃদয়ের দ্বার খুলিয়া এবং বাহু প্রসারিত করিয়া সমগ্র জগৎকে—শুধু হিন্দুকে নয়, মুসলমানগণকে পর্যন্ত আলিঙ্গন করিতে ছুটিয়াছিলেন। এখানেই আমাদের জাতির শেষ এবং মহামহিমান্বিত বীরগণের অন্যতম গুরু গোবিন্দসিংহ জন্মগ্রহণ করেন, যিনি ধর্মের জন্য নিজের এবং নিজ-প্রাণসম প্রিয়তম আত্মীয়বর্গের রক্তপাত করিয়াছিলেন, এবং যাহাদের জন্য এই রক্তপাত করিলেন, তাহারাই যখন তাঁহাকে পরিত্যাগ করিল, তখন মর্মাহত সিংহের ন্যায় দক্ষিণ দেশে গিয়া নির্জনবাস আশ্রয় করিলেন এবং নিজ দেশের প্রতি বিন্দুমাত্র অভিশাপ-বাক্য উচ্চারণ না করিয়া, বিন্দুমাত্র অসন্তোষের ভাব প্রকাশ না করিয়া মর্ত্যধাম হইতে অপসৃত হইলেন।
হে পঞ্চনদের সন্তানগণ, এখনে—এই আমাদের প্রাচীন দেশে—আমি তোমাদের নিকট আচার্যরূপে উপস্থিত হই নাই, কারণ তোমাদিগকে শিক্ষা দিবার মত জ্ঞান আমার অতি অল্পই আছে। দেশের পূর্বাঞ্চল হইতে আমি পশ্চিমাঞ্চলের ভ্রাতৃগণের সহিত সম্ভাষণ বিনিময় করিতে এবং পরস্পরের ভাব মিলাইবার জন্য আসিয়াছি। আমি এখানে আসিয়াছি— আমাদের মধ্যে কি বিভিন্নতা আছে তাহা বাহির করিবার জন্য নহে, আসিয়াছি আমাদের মিলনভূমি কোথায় তাহাই অন্বেষণ করিতে; কোন্ ভিত্তি অবলম্বন করিয়া আমরা চিরকাল সৌভ্রাত্রসূত্রে আবদ্ধ থাকিতে পারি, কোন্ ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত হইলে যে-বাণী অনন্তকাল ধরিয়া আমাদিগকে আশার কথা শুনাইয়া আসিতেছে, তাহা প্রবল হইতে প্রবলতর হইতে পারে, তাহা বুঝিবার চেষ্টা করিতে আমি এখানে আসিয়াছি। আমি এখানে আসিয়াছি— তোমাদিগের নিকট কিছু গঠনমূলক প্রস্তাব করিতে, কিছু ভাঙিবার পরামর্শ দিতে নয়।
সমালোচনার দিন চলিয়া গিয়াছে, আমরা এখন কিছু গড়িবার জন্য অপেক্ষা করিতেছি। জগতে সময় সময় সমালোচনা—এমন কি কঠোর সমালোচনারও প্রয়োজন হইয়া থাকে; কিন্তু সে অল্পদিনের জন্য। অনন্ত কালের জন্য আছে কার্য—উন্নতির চেষ্টা ও গঠন, সমালোচনা বা ভাঙাচোরা নয়। প্রায় গত এক শত বর্ষ ধরিয়া আমাদের দেশের সর্বত্র সমালোচনার বন্যা বহিয়াছে—পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের তীব্র রশ্মিজাল অন্ধকারময় দেশগুলির উপর পড়িয়া অন্যান্য স্থান অপেক্ষা আমাদের আনাচে-কানাচে, গলিঘুঁজিতেই যেন সাধারণের দৃষ্টি বেশী আকর্ষণ করিয়াছে। স্বভাবতই আমাদের দেশে সর্বত্র বড় বড় মনীষিগণের—শ্রেষ্ঠ মহিমময় সত্যনিষ্ঠ ন্যায়ানুরাগী মহাত্মাগণের অভ্যুদয় হইল। তাঁহাদের হৃদয়ে অপার স্বদেশপ্রেম এবং সর্বোপরি ঈশ্বর ও ধর্মের প্রতি প্রবল অনুরাগ ছিল। আর এই মহাপুরুষগণ স্বদেশকে এত প্রাণের সহিত ভালবাসিতেন বলিয়া, তাঁহাদের প্রাণ স্বদেশের জন্য কাঁদিত বলিয়া, তাঁহারা যাহা কিছু মন্দ বলিয়া মনে করিতেন তাহাই তীব্রভাবে আক্রমণ করিতেন। অতীতকালের এই মহাপুরুষগণ ধন্য—তাঁহারা দেশের অনেক কল্যাণসাধন করিয়াছেন; কিন্তু বর্তমান যুগের মনোভাব ধ্বনিত হইতেছেঃ যথেষ্ট! সমালোচনা যথেষ্ট হইয়াছে, দোষদর্শন যথেষ্ট হইয়াছে; এখন নূতন করিয়া গড়িবার সময় আসিয়াছে, এখন আমাদের সমস্ত বিক্ষিপ্ত শক্তিকে সংহত করিবার, এগুলিকে কেন্দ্রীভূত করিবার সময় আসিয়াছে, সেই সমষ্টিশক্তির সহায়তায় বহু শতাব্দী ধরিয়া যে জাতীয় অগ্রগতি প্রায় রুদ্ধ হইয়া রহিয়াছে, তাহা সম্মুখে আগাইয়া দিতে হইবে। এখন বাড়ি পরিষ্কার হইয়াছে; ইহাতে নূতন করিয়া বাস করিতে হইবে। পথ পরিষ্কার হইয়াছে; আর্যসন্তানগণ, সম্মুখে অগ্রসর হও।
ভদ্রমহোদয়গণ, এই কথা বলিবার জন্যই আমি আপনাদের কাছে আসিয়াছি, আর প্রথমেই আপনাদিগকে বলিতে চাই যে, আমি কোন দল বা বিশেষ সম্প্রদায়ভুক্ত নহি। আমার চক্ষে সকল সম্প্রদায়ই মহান্ ও মহিমময়, আমি সকল সম্প্রদায়কেই ভালবাসি, এবং সমগ্র জীবন ধরিয়া উহাদের মধ্যে যাহা সত্য, যাহা উপাদেয়, তাহাই বাহির করিবার চেষ্টা করিতেছি। অতএব আজ রাত্রে আমার প্রস্তাব এই যে, তোমাদের নিকট এমন কতকগুলি তত্ত্ব বলিব, যেগুলি সম্বন্ধে আমরা সকলে একমত; যদি পারি—আমাদের পরস্পরের মিলনভূমি আবিষ্কার করিবার চেষ্টা করিব, এবং যদি ঈশ্বরের কৃপায় ইহা সম্ভব হয়, তবে ঐ তত্ত্ব কার্যে পরিণত করিতে হইবে। আমরা হিন্দু। আমি এই ‘হিন্দু’ শব্দটি কোন মন্দ অর্থে ব্যবহার করিতেছি না; আর যাহারা মনে করে, ইহার কোন মন্দ অর্থ আছে, তাহাদের সহিত আমার মতের মিল নাই। প্রাচীনকালে ইহাদ্বারা কেবল সিন্ধুনদের পূর্বতীরবর্তী লোকদিগকে বুঝাইত, আজ যাহারা আমাদিগকে ঘৃণা করে, তাহাদের মধ্যে অনেকে ইহার কুৎসিত ব্যাখ্যা করিতে পারে, কিন্তু নামে কিছু আসে যায় না। আমাদিগেরই উপর সম্পূর্ণ নির্ভর করিতেছে—‘হিন্দু’ নাম সর্ববিধ মহিমময়, সর্ববিধ আধ্যাত্মিক বিষয়ের বাচক হইবে, না চিরদিনই ঘৃণাসূচক নামেই পর্যবসিত থাকিবে, না উহা দ্বারা পদদলিত অপদার্থ ধর্মভ্রষ্ট জাতি বুঝাইবে। যদি বর্তমানকালে ‘হিন্দু’ শব্দে কোন মন্দ জিনিষ বুঝায়, বুঝাক; এস, আমাদের কাজের দ্বারা লোককে দেখাইতে প্রস্তুত হই যে, কোন ভাষাই ইহা অপেক্ষা উচ্চতর শব্দ আবিষ্কার করিতে সমর্থ নহে। যে-সকল নীতি অবলম্বন করিয়া আমার জীবন পরিচালিত হইতেছে, তন্মধ্যে একটি এই যে, আমি কখনও আমার পূর্বপুরুষগণকে স্মরণ করিয়া লজ্জিত হই নাই। জগতে যত গর্বিত পুরুষ জন্মগ্রহণ করিয়াছে, আমি তাহাদের অন্যতম; কিন্তু আমি তোমাদিগকে স্পষ্ট ভাষায় বলিতেছি, আমার নিজের কোন গুণ বা শক্তির জন্য আমি অহঙ্কার করি না, আমি আমার প্রাচীন পিতৃপুরুষগণের গৌরবে গৌরব অনুভব করিয়া থাকি। যতই আমি অতীতের আলোচনা করি, যতই আমি পিছনের দিকে চাহিয়া দেখি, ততই গৌরব বোধ করি, ইহাতেই আমার বিশ্বাসের দৃঢ়তা ও সাহস আসিয়াছে, ইহা আমাকে পৃথিবীর ধূলি হইতে তুলিয়া আমাদের মহান্ পূর্বপুরুষগণের মহতী পরিকল্পনা কার্যে পরিণত করিতে নিযুক্ত করিয়াছে। সেই প্রাচীন আর্যদের সন্তানগণ, ঈশ্বরের কৃপায় তোমাদেরও হৃদয়ে সেই গর্ব আবির্ভূত হউক, তোমাদের পূর্বপুরুষগণের উপর সেই বিশ্বাস শোণিতের সহিত মিশিয়া তোমাদের জীবনের অঙ্গীভূত হউক, উহা দ্বারা সমগ্র জগতের উদ্ধার সাধিত হউক।
ভদ্রমহোদয়গণ, আমাদের সকলের মিলনভূমি ঠিক কোথায়, আমাদের জাতীয় জীবনের সাধারণ ভিত্তি কি, তাহা বাহির করিবার চেষ্টার পূর্বে একটি বিষয় আমাদের মনে রাখিতেই হইবে। প্রত্যেক মানুষের যেমন ব্যক্তিত্ব আছে, প্রত্যেক জাতিরও সেইরূপ একটি ব্যক্তিত্ব আছে। যেমন এক ব্যক্তির অপর ব্যক্তি হইতে কতকগুলি বিশেষ বিষয়ে পার্থক্য আছে, প্রত্যেক ব্যক্তিরই যেমন কতকগুলি বিশেষত্ব আছে, সেইরূপ একজাতিরও অপর জাতি হইতে কতকগুলি বিশেষ বিশেষ লক্ষণগত প্রভেদ আছে। আর যেমন প্রত্যেক ব্যক্তিকেই প্রকৃতির কোন বিশেষ উদ্দেশ্য সাধন করিতে হয়, যেমন তাহার নিজ অতীত কর্মের দ্বারা নির্দিষ্ট বিশেষ দিকে তাহাকে চলিতে হয়, জাতির পক্ষেও সেইরূপ। প্রত্যেক জাতিকেই এক-একটি বিধিনির্দিষ্ট পথে চলিতে হয়, প্রত্যেক জাতিরই জগতে কিছু বার্তা ঘোষণা করিবার আছে, প্রত্যেক জাতিকেই ব্রতবিশেষ উদ্যাপন করিতে হয়। অতএব প্রথম হইতেই আমাদিগকে জানিতে হইবে—জাতীয় ব্রত কি, জানিতে হইবে—বিধাতা এই জাতিকে কি কার্যের জন্য নিযুক্ত করিয়াছেন, বুঝিতে হইবে—বিভিন্ন জাতির প্রগতিতে ইহার স্থান কোথায়, জানিতে হইবে—বিভিন্ন জাতির সঙ্গীতের ঐক্যতানে তাহাকে কোন্ সুর বাজাইতে হইবে। আমাদের দেশে ছেলেবেলায় গল্প শুনিতাম, কতকগুলি সাপের মাথায় মণি আছে—তুমি সাপটিকে লইয়া যাহা ইচ্ছা করিতে পার, কিন্তু যতক্ষণ উহার মাথায় ঐ মণি থাকিবে, ততক্ষণ তাহাকে কোনমতে মারিতে পারিবে না। আমরা রাক্ষস-রাক্ষসীর অনেক গল্প শুনিয়াছি। রাক্ষসীর প্রাণ একটি ছোট পাখির ভিতর থাকিত। যতদিন ঐ পাখিটিকে মারিতে না পারিতেছ, ততদিন সেই রাক্ষসীকে টুকরা টুকরা করিয়া কাটিয়া ফেল, তাহাকে যাহা ইচ্ছা কর, কিন্তু রাক্ষসী মরিবে না। জাতি সম্বন্ধেও এই কথা খাটে। জাতিবিশেষের জীবন কোন নির্দিষ্ট ভাবের মধ্যে থাকে, সেইখানেই সেই জাতির জাতীয়ত্ব, যতদিন না তাহাতে আঘাত লাগে, ততদিন সেই জাতির মৃত্যু নাই। এই তত্ত্বের আলোকে আমরা জগতের ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা বিস্ময়কর ব্যাপারটি বুঝিতে পারিব। বর্বর জাতির আক্রমণ-তরঙ্গ বার বার আমাদের এই জাতির মস্তকের উপর দিয়া চলিয়া গিয়াছে। শত শত বৎসর ধরিয়া ‘আল্লা হো আকবর’ রবে ভারতগগন মুখরিত হইয়াছে, এবং এমন হিন্দু কেহ ছিল না, যে প্রতিমুহূর্তে নিজের বিনাশ আশঙ্কা না করিয়াছে। জগতের ইতিহাসে প্রসিদ্ধ দেশগুলির মধ্যে ভারতবর্ষ সর্বাপেক্ষা বেশী অত্যাচার ও নিগ্রহ সহ্য করিয়াছে। তথাপি আমরা পূর্বে যেরূপ ছিলাম, এখনও সেইরূপই আছি, এখনও আমরা নূতন বিপদের সম্মুখীন হইতে প্রস্তুত; শুধু তাহাই নহে, আমরা শুধু যে নিজেরাই অক্ষত তাহা নহে, সম্প্রতি আমরা বাহিরে যাইয়াও অপরকে আমাদের ভাব দিতে প্রস্তুত—তাহার চিহ্ন দেখিতে পাইতেছি। বিস্তারই জীবনের চিহ্ন। আজ আমরা দেখিতেছি, আমাদের চিন্তা ও ভাবসমূহ শুধু ভারতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নহে, কিন্তু আমরা ইচ্ছা করি বা না করি, ঐগুলি বাহিরে যাইয়া অপর জাতির সাহিত্যের মধ্যে প্রবেশ করিতেছে, অন্যান্য জাতির মধ্যে স্থানলাভ করিতেছে, শুধু তাই নয়, কোন কোন স্থলে ভারতীয় ভাবধারা স্বীয় প্রভাব বিস্তার করিতেছে। ইহার কারণ এই—মানবজাতির মন যে-সকল বিষয় লইয়া ব্যাপৃত থাকিতে পারে, তাহাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ ও মহত্তম বিষয়—দর্শন ও ধর্মই জগতের জ্ঞানের ভাণ্ডারে ভারতের মহৎ দান।
আমাদের পূর্বপুরুষগণ অন্যান্য অনেক বিষয়ে উন্নতির চেষ্টা করিয়াছিলেন—অন্যান্য সকলের ন্যায় তাঁহারাও প্রথমে বহির্জগতের রহস্য আবিষ্কার করিতে অগ্রসর হইয়াছিলেন—আমরা সকলেই এ-কথা জানি, আর ঐ বিরাট্ মস্তিষ্কসম্পন্ন অদ্ভুত জাতি চেষ্টা করিলে সেই পথের এমন অদ্ভুত অদ্ভুত বিষয় আবিষ্কার করিতে পারিতেন, যাহা আজও সমগ্র জগতের স্বপ্নের অগোচর, কিন্তু তাঁহারা উচ্চতর বস্তুলাভের জন্য ঐ পথ পরিত্যাগ করিলেন—সেই উচ্চতর বিষয়ের প্রতিধ্বনি বেদের মধ্যেই শুনা যাইতেছেঃ ‘অথ পরা—যয়া তদক্ষরমধিগম্যতে।’৪৭ তাহাই পরা বিদ্যা, যাহা দ্বারা সেই অক্ষর পুরুষকে লাভ করা যায়। এই পরিবর্তনশীল, অনিত্য, প্রকৃতি-সম্বন্ধীয় বিদ্যা, মৃত্যু-দুঃখ-শোকপূর্ণ এই জগতের বিদ্যা খুব বড় হইতে পারে, কিন্তু যিনি অপরিণামী আনন্দময়, একমাত্র যাঁহাতে শান্তি বিরাজিত, একমাত্র যাঁহাতে অনন্ত জীবন ও পূর্ণত্ব, একমাত্র যাঁহার নিকট পৌঁছিলে সকল দুঃখের অবসান হয়, তাঁহাকে জানাই আমাদের পূর্বপুরুষগণের মতে শ্রেষ্ঠ বিদ্যা। যে-সকল বিদ্যা বা বিজ্ঞান আমাদিগকে শুধু অন্ন-বস্ত্র দিতে পারে, স্বজনদের উপর প্রভুত্ব বিস্তার করিবার ক্ষমতা দিতে পারে, যে-সকল বিদ্যা শুধু মানুষকে জয় ও শাসন করিবার এবং দুর্বলের উপর সবলের আধিপত্য করিবার শিক্ষা দিতে পারে; ইচ্ছা করিলে তাঁহারা অনায়াসেই সেই-সকল বিজ্ঞান, সেই-সকল বিদ্যা আবিষ্কার করিতে পারিতেন। কিন্তু ঈশ্বরের কৃপায় তাঁহারা ওদিকে কিছুমাত্র দৃষ্টিপাত না করিয়া একেবারে অন্য পথ ধরিলেন, যাহা পূর্বোক্ত পথ অপেক্ষা অনন্তগুণে মহৎ, পূর্বোক্ত পথ অপেক্ষা যাহাতে অনন্তগুণ বেশী আনন্দ। ঐ পথ ধরিয়া তাঁহারা এমন একনিষ্ঠভাবে অগ্রসর হইলেন যে, এখন উহা আমাদের জাতীয় বিশেষত্ব হইয়া দাঁড়াইয়াছে, সহস্র সহস্র বৎসর ধরিয়া পিতা হইতে পুত্রে উত্তরাধিকারসূত্রে আসিয়া উহা আমাদের জীবনের অঙ্গীভূত হইয়াছে, আমাদের ধমনীর প্রত্যেক শোণিতবিন্দুর সহিত মিশিয়া গিয়াছে, আমাদের স্বভাবসিদ্ধ হইয়াছে। এখন ধর্ম ও হিন্দু—এই দুইটি শব্দ একার্থবাচক হইয়া দাঁড়াইয়াছে। ইহাই আমাদের জাতির বিশেষত্ব, ইহাতে আঘাত করিবার উপায় নাই। অসভ্য জাতিসমূহ তরবারি ও বন্দুক লইয়া বর্বর ধর্মসমূহ আমদানি করিয়াছে, কিন্তু একজনও সেই সাপের মাথার মণি ছুঁইতে পারে নাই, একজনও এই জাতির প্রাণপাখিকে মারিতে পারে নাই। অতএব এই ধর্মই আমাদের জাতির জীবনীশক্তি, আর যতদিন আধ্যাত্মিকতা অব্যাহত থাকিবে, ততদিন জগতের কোন শক্তিই এই জাতিকে ধ্বংস করিতে পারিবে না। যতদিন আমরা উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত মহত্তম রত্নস্বরূপ এই ধর্মকে ধরিয়া থাকিব, ততদিন আমরা জগতের সর্বপ্রকার অত্যাচার, উৎপীড়ন ও দুঃখের অগ্নিরাশির মধ্য হইতেও প্রহ্লাদের ন্যায় অক্ষত শরীরে বাহির হইয়া আসিব। হিন্দু যদি ধার্মিক না হয়, তবে তাহাকে আমি ‘হিন্দু’ বলি না। অন্যান্য দেশে রাজনীতি-চর্চা লোকের মুখ্য অবলম্বন হইতে পারে এবং তাহার সঙ্গে সঙ্গে সে একটু-আধটু ধর্মের অনুষ্ঠান করিতে পারে, কিন্তু এখানে—এই ভারতে আমাদের জীবনের সর্বপ্রথম কর্তব্য ধর্মানুষ্ঠান, তারপর যদি সময় থাকে, তবে অন্যান্য জিনিষ তাহার সঙ্গে অনুষ্ঠিত হয়, তাহাতে ক্ষতি নাই। এই বিষয়টি মনে রাখিলে আমরা ভাল করিয়া বুঝিতে পারিব যে, জাতীয় কল্যাণের জন্য অতীতকালে যেমন, বর্তমানকালেও তেমনি, চিরকালই তেমনি আমাদিগকে প্রথমে আমাদের জাতির সমগ্র আধ্যাত্মিক-শক্তি খুঁজিয়া বাহির করিতে হইবে। ভারতের বিক্ষিপ্ত আধ্যাত্মিক-শক্তিগুলিকে একত্র করাই ভারতের জাতীয় একত্ব-সাধনের একমাত্র উপায়। যাহাদের হৃদয়তন্ত্রী একই প্রকার আধ্যাত্মিক সুরে বাঁধা, তাহাদের সম্মিলনেই ভারতের জাতি গঠিত হইবে।
ভদ্রমহোদয়গণ, এদেশে সম্প্রদায়ের অভাব নাই। এখনই যথেষ্ট রহিয়াছে, আর ভবিষ্যতেও অনেক হইবে। কারণ আমাদের ধর্মের ইহাই বিশেষত্ব, ইহার মূলতত্ত্বগুলি অতি উদার, যদিও ঐগুলি হইতেই অনেক বিস্তারিত ও খুঁটিনাটি ব্যাপারের উদ্ভব হইয়াছে, তথাপি ঐগুলি সেই মূল তত্ত্বসমূহের কার্যে পরিণত রূপ—যে-তত্ত্বগুলি আমাদের মাথার উপরের আকাশের মত উদার এবং প্রকৃতির মত নিত্য ও সনাতন। অতএব সম্প্রদায়গুলি যে স্বভাবতই চিরদিন থাকিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই, কিন্তু তাই বলিয়া সাম্প্রদায়িক বিবাদের কোন প্রয়োজন নাই। সম্প্রদায় থাকুক, সাম্প্রদায়িকতা দূর হউক। সাম্প্রদায়িকতা দ্বারা জগতের কোন উন্নতি হইবে না, কিন্তু সম্প্রদায় না থাকিলে জগৎ চলিতে পারে না। একদল লোক তো সব কাজ করিতে পারে না। অসীমপ্রায় শক্তিরাশি অল্প কয়েকটি লোকের দ্বারা কখনই পরিচালিত হইতে পারে না। এই বিষয়টি বুঝিলেই আমরা বুঝিব, কি প্রয়োজনে আমাদের ভিতর সম্প্রদায়-ভেদরূপ এই শ্রমবিভাগ অবশ্যম্ভাবিরূপে আসিয়াছে। বিভিন্ন আধ্যাত্মিক-শক্তিসমূহের সুপরিচালনার জন্য সম্প্রদায় থাকুক, কিন্তু আমাদের পরস্পরের বিবাদ করিবার কি প্রয়োজন, যখন আমাদের অতি প্রাচীন শাস্ত্রসকল ঘোষণা করিতেছে যে, এই ভেদ আপাতপ্রতীয়মান, এই-সকল আপাতদৃষ্ট বিভিন্নতাসত্ত্বেও সম্প্রদায়গুলির মধ্যে মিলনের স্বর্ণসূত্র বিদ্যমান, ঐগুলির মধ্যে সেই পরম মনোহর একত্ব রহিয়াছে। আমাদের অতি প্রাচীন গ্রন্থসমূহ ঘোষণা করিয়াছেন, ‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি’—জগতে এক বস্তুই বিদ্যমান, ঋষিগণ তাঁহাকেই বিভিন্ন নামে বর্ণনা করেন। অতএব যদি এই ভারতে—যেখানে চিরদিন সকল সম্প্রদায়ই সম্মানিত হইয়া আসিয়াছেন—সেই ভারতে এখনও এই-সব সাম্প্রদায়িক বিবাদ, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে পরস্পর দ্বেষহিংসা থাকে, তবে ধিক্ আমাদিগকে, যাহারা সেই মহিমান্বিত পূর্বপুরুষগণের বংশধর বলিয়া নিজদিগকে পরিচয় দেয়।
ভদ্রমহোদয়গণ, আমার বিশ্বাস—কতকগুলি প্রধান প্রধান তত্ত্বে আমাদের সকলেরই সম্মতি আছে। আমরা বৈষ্ণব বা শৈব হই, শাক্ত বা গাণপত্য হই, প্রাচীন বা আধুনিক বৈদান্তিক—যাঁহাদেরই পদানুসরণ করি না কেন, প্রাচীন গোঁড়া সম্প্রদায়েরই হই বা আধুনিক সংস্কারপন্থী সম্প্রদায়েরই হই, যে নিজেকে হিন্দু বলিয়া পরিচয় দেয়, আমার ধারণায় সে-ই এ-সকল তত্ত্বে বিশ্বাস করিয়া থাকে। অবশ্য ঐ তত্ত্বগুলির ব্যাখ্যাপ্রণালীতে ভেদ থাকিতে পারে, আর থাকাও উচিত; কারণ আমরা সকলকেই আমাদের ভাবে আনিতে পারি না; আমরা যেরূপ ব্যাখ্যা করিব, সকলকেই সেই ব্যাখ্যা গ্রহণ করিতে হইবে বা সকলকেই আমাদের প্রণালী অবলম্বন করিয়া চলিতে হইবে—জোর করিয়া এরূপ করিবার চেষ্টা করা অত্যন্ত অন্যায়।
ভদ্রমহোদয়গণ, আজ যাঁহারা এখানে সমবেত হইয়াছেন, তাঁহারা বোধ হয় সকলেই একবাক্যে স্বীকার করিবেন যে, আমরা বেদকে আমাদের ধর্মরহস্যসমূহের সনাতন উপদেশ বলিয়া বিশ্বাস করি। আমরা সকলেই বিশ্বাস করি, এই পবিত্র শব্দরাশি অনাদি অনন্ত; প্রকৃতির যেমন আদি নাই, অন্ত নাই, বেদেরও তেমনি; এবং যখনই আমরা এই পবিত্র গ্রন্থের সান্নিধ্যে দণ্ডায়মান হই, তখনই আমাদের ধর্মসম্বন্ধীয় সকল ভেদ, সকল প্রতিদ্বন্দ্বিতার অবসান হয়। আমাদের ধর্মসম্বন্ধীয় সর্বপ্রকার ভেদের শেষ মীমাংসাকারী—শেষ বিচারক এই বেদ। বেদ কি—এই বিষয়ে আমাদের মধ্যে মতভেদ থাকিতে পারে। কোন সম্প্রদায় বেদের অংশবিশেষকে অন্য অংশ অপেক্ষা পবিত্রতর জ্ঞান করিতে পারে। কিন্তু তাহাতে কিছুই আসে যায় না, যতক্ষণ আমরা বলিতে পারি—বেদবিশ্বাসে আমরা সকলেই ভাই ভাই। আজ আমরা যে-সব পবিত্র মহৎ উত্তম বস্তুর অধিকারী, তাহার সে-সবই আসিয়াছে এই সনাতন পবিত্র অপূর্ব গ্রন্থ হইতে। বেশ, তাই যদি আমরা বিশ্বাস করি, তবে এই তত্ত্বটিই ভারতভূমির সর্বত্র প্রচারিত হউক। যদি ইহা সত্য হয়, তবে বেদ চিরদিনই যে প্রাধান্যের অধিকারী এবং বেদের যে প্রাধান্যে আমরাও বিশ্বাসী, তাহা বেদকে দেওয়া হউক। অতএব আমাদের মিলনের প্রথম ভূমি—বেদ।
দ্বিতীয়তঃ আমরা সকলেই ঈশ্বর বিশ্বাস করিয়া থাকি। তিনি জগতের সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়কারী শক্তি—তাঁহাতে কালে সমগ্র জগৎ লয়প্রাপ্ত হয়, আবার তাঁহা হইতেই জগদ্ব্রহ্মাণ্ডরূপ এই অদ্ভুত প্রপঞ্চ বহির্গত হয়। আমাদের ঈশ্বরসম্বন্ধীয় ধারণা ভিন্ন ভিন্ন রূপ হইতে পারে—কেহ হয়তো সম্পূর্ণ সগুণ ঈশ্বরে বিশ্বাসী, কেহ বা সগুণ অথচ ব্যক্তিভাবশূন্য ঈশ্বরে বিশ্বাসী, অপর কেহ আবার সম্পূর্ণ নির্গুণ ঈশ্বর মানিতে পারেন, আর সকলেই কিন্তু বেদ হইতে নিজ নিজ মতের প্রমাণ দেখাইতে পারেন। এই-সব ভেদ-সত্ত্বেও আমরা সকলেই ঈশ্বরে বিশ্বাস করিয়া থাকি। অন্য কথায় বলিতে গেলে বলিতে হয়, যাঁহা হইতে সবকিছু উৎপন্ন হইতেছে, যাঁহাকে অবলম্বন করিয়া সকলে জীবিত, অন্তে সবকিছুই যাঁহাতে লীন হইবে, সেই অত্যদ্ভুত অনন্ত শক্তিকে যে বিশ্বাস না করে, তাহাকে ‘হিন্দু’ বলা যাইতে পারে না। যদি তাই হয়, তবে এই তত্ত্বটিও ভারতভূমির সর্বত্র প্রচার করিবার চেষ্টা করিতে হইবে। ঈশ্বরের যে-ভাবই তুমি প্রচার কর না কেন, তোমাতে আমাতে প্রকৃতপক্ষে কোন ভেদ নাই—আমরা তোমার সঙ্গে উহা লইয়া বিবাদ করিব না—কিন্তু যেরূপেই হউক, তোমাকে ঈশ্বরতত্ত্ব প্রচার করিতে হইবে। আমরা ইহাই চাই। এগুলির মধ্যে ঈশ্বরসম্বন্ধীয় কোন একটি ধারণা অপরটি অপেক্ষা উৎকৃষ্টতর হইতে পারে, কিন্তু মনে রাখিও ইহার কোনটিই মন্দ নহে। একটি উৎকৃষ্ট, অন্যটি উৎকৃষ্টতর, অপরটি উৎকৃষ্টতম হইতে পারে, কিন্তু আমাদের ধর্মতত্ত্বের পারিভাষিক শব্দ-নিচয়ের মধ্যে ‘মন্দ’ শব্দটির স্থান নাই। অতএব যিনি যেভাবে ইচ্ছা ঈশ্বরের নাম প্রচার করেন, তিনিই ঈশ্বরের আশীর্বাদভাজন। তাঁহার নাম যতই প্রচারিত হইবে, ততই এই জাতির কল্যাণ। আমাদের সন্তানগণ বাল্যকাল হইতে এই ভাব শিক্ষা করুক; এই ঈশ্বরের নাম সর্বাপেক্ষা দরিদ্র ও নীচ ব্যক্তির গৃহ হইতে সর্বাপেক্ষা ধনী ও মানী—সকলের গৃহে প্রবিষ্ট হউক।
ভদ্রমহোদয়গণ, তৃতীয় তত্ত্ব যাহা আমি আপনাদের নিকট বলিতে চাই, তাহা এইঃ পৃথিবীর অন্যান্য জাতির মত আমরা বিশ্বাস করি না যে, জগৎ মাত্র কয়েক সহস্র বৎসর পূর্বে সৃষ্ট হইয়াছে, আর একদিন উহা একেবারে ধ্বংস হইয়া যাইবে; আমরা ইহাও বিশ্বাস করি না যে, জীবাত্মা এই জগতের সঙ্গে সঙ্গেই শূন্য হইতে সৃষ্ট হইয়াছে। আমার বিবেচনায় এই বিষয়েও সকল হিন্দুই একমত। আমরা বিশ্বাস করি, প্রকৃতি অনাদি অনন্ত, তবে কল্পনাতে এই স্থূল বাহ্য জগৎ সূক্ষ্মাবস্থায় পরিণত হয়, কিছুকালের জন্য ঐরূপ অবস্থায় থাকিয়া আবার অভিক্ষিপ্ত হইয়া প্রকৃতি-নামধেয় এই অনন্ত প্রপঞ্চকে প্রকাশ করে এবং তরঙ্গাকার এই গতি অনন্তকাল ধরিয়া—যখন কালেরও আরম্ভ হয় নাই, তখন হইতেই চলিতেছে এবং অনন্তকাল ধরিয়া চলিবে।
সকল হিন্দুই আরও বিশ্বাস করে যে, স্থূল জড় দেহটা, এমন কি তাহার অভ্যন্তরে মন নামক সূক্ষ্ম শরীরও প্রকৃত ‘মানুষ’ নহে, কিন্তু প্রকৃত মানুষ এইগুলি অপেক্ষা মহত্তর। কারণ স্থূলদেহ পরিণামী, মনও তদ্রূপ, কিন্তু এতদুভয়ের অতীত আত্মা-নামধেয়—এই ‘আত্মা’ শব্দটির ইংরেজী অনুবাদ করিতে আমি অক্ষম; যে শব্দের দ্বারাই ইহার অনুবাদ করা যাক না কেন, তাহা ভুল হইবে—সেই অনির্বচনীয় বস্তুর আদি-অন্ত কিছুই নাই, মৃত্যু নামক অবস্থাটির সহিত উহা পরিচিত নহে।
তারপর আর একটি বিশেষ বিষয়ে অন্যান্য জাতির সহিত আমাদের ধারণার সম্পূর্ণ প্রভেদ—তাহা এই যে, আত্মা এক দেহের পর আর এক দেহ ধারণ করে; এইরূপ করিতে করিতে তাহার এমন এক অবস্থা আসে, যখন তাহার কোনরূপ শরীরধারণের প্রয়োজন বা ইচ্ছা থাকে না, তখন সে মুক্ত হইয়া যায়, তাহার আর জন্ম হয় না। আমি আমাদের শাস্ত্রে উল্লিখিত সংসারবাদ বা পুনর্জন্মবাদ এবং ‘নিত্য আত্মা’ সম্বন্ধীয় মতবাদের কথা বলিতেছি। আমরা যে সম্প্রদায়ভুক্তই হই না কেন, এই আর একটি বিষয়ে আমরা সকলেই একমত। এই আত্মা ও পরমাত্মার সম্বন্ধবিষয়ে আমাদের মধ্যে মতভেদ থাকিতে পারে। এক সম্প্রদায়ের মতে এই আত্মা পরমাত্মা হইতে নিত্য ভিন্ন হইতে পারে, কাহারও মতে আবার উহা সেই অনন্ত বহ্নির স্ফুলিঙ্গমাত্র হইতে পারে, অন্যের মতে হয়তো উহা অনন্তের সহিত অভেদ। আমরা এই আত্মা ও পরমাত্মার সম্বন্ধ লইয়া যেরূপ ইচ্ছা ব্যাখ্যা করি না কেন, তাহাতে বিশেষ কিছু আসিয়া যায় না; কিন্তু যতক্ষণ আমরা এই মূলতত্ত্ব বিশ্বাস করি যে, আত্মা অনন্ত, উহা কখনও সৃষ্ট হয় নাই, সুতরাং কখনই উহার বিনাশ হইবে না, উহাকে বিভিন্ন শরীর ধরিয়া ক্রমশঃ উন্নতিলাভ করিতে হইবে, অবশেষে মনুষ্যশরীর ধারণ করিয়া পূর্ণত্বলাভ করিতে হইবে—ততক্ষণ আমরা সকলেই একমত।
তারপর প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভাবের মধ্যে সম্পূর্ণ পার্থক্যসূচক, ধর্মরাজ্যের মহত্তম ও অপূর্বতম আবিষ্কার-রূপ তত্ত্বটির কথা তোমাদিগকে বলিব। তোমাদের মধ্যে যাহারা পাশ্চাত্য তত্ত্বরাশির আলোচনায় বিশেষভাবে নিযুক্ত, তাহারা ইতঃপূর্বেই লক্ষ্য করিয়া থাকিবে যে, একটা মৌলিক প্রভেদ যেন প্রাচ্য হইতে পাশ্চাত্যকে এক কুঠারাঘাতে পৃথক্ করিয়া দিতেছে; সেটি এইঃ আমরা ভারতে সকলেই বিশ্বাস করি—আমরা শাক্তই হই, শৈবই হই, বৈষ্ণবই হই, এমন কি বৌদ্ধ বা জৈনই হই—আমরা সকলেই বিশ্বাস করি যে, আত্মা স্বভাবতই শুদ্ধ ও পূর্ণস্বভাব, অনন্তশক্তিসম্পন্ন ও আনন্দময়। কেবল দ্বৈতবাদীর মতে আত্মার এই স্বাভাবিক আনন্দ অতীত-অসৎকর্ম দ্বারা সঙ্কোচপ্রাপ্ত হইয়াছে, আর ঈশ্বরানুগ্রহে উহা আবার সঙ্কোচমুক্ত হইবে এবং আত্মা নিজ পূর্ণস্বভাব পুনঃপ্রাপ্ত হইবেন। আত্মা কিছুদিনের জন্য সঙ্কোচ প্রাপ্ত হন, অদ্বৈতবাদীর মতে এ ধারণাটিও আংশিকভাবে ভ্রমাত্মক—মায়াবৃত হওয়ার ফলেই আমরা ভাবি যে, আত্মা যেন তাঁহার সমুদয় শক্তি হারাইয়াছেন, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ঐ অবস্থাতেও তাঁহার সমুদয় শক্তি পূর্ণভাবেই থাকে। দ্বৈত ও অদ্বৈতবাদীর মতে এই প্রভেদ থাকিলেও মূল তত্ত্বে অর্থাৎ আত্মার স্বাভাবিক পূর্ণত্বে সকলেই বিশ্বাসী, আর এখানেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য ভাবের মধ্যে অবস্থিত ব্যবধান দুরপনেয়। প্রাচ্য জাতি—যাহা কিছু মহৎ, যাহা কিছু ভাল, তাহা অন্তরে অন্বেষণ করে; উপাসনার সময় আমরা চক্ষু মুদিয়া ঈশ্বরকে অন্তরে লাভ করিবার জন্য চেষ্টা করি, পাশ্চাত্য জাতি ঈশ্বরকে বাহিরে অন্বেষণ করে। পাশ্চাত্যগণের ধর্মপুস্তকসমূহ Inspired—সুতরাং শ্বাস-গ্রহণের ন্যায় বাহির হইতে ভিতরে আসিয়াছে। আমাদের পবিত্র শাস্ত্রসমূহ কিন্তু Expired—শ্বাসপরিত্যাগের ন্যায় ভিতর হইতে বাহিরে আসিয়াছে—ঐগুলি ঈশ্বর-নিঃশ্বসিত, ঈশ্বরই মন্ত্রদ্রষ্টা ঋষিগণের অন্তর্যামী, শাস্ত্র তাঁহারাই প্রকাশ করিয়াছেন।৪৮
এইটিই একটি প্রধান বুঝিবার জিনিষ; হে আমার বন্ধুগণ, আমার ভাতৃগণ, আমি তোমাদিগকে বলিতেছি, ভবিষ্যতে এই বিষয়টি আমাদিগকে বিশেষভাবে বার বার লোককে বুঝাইতে হইবে। কারণ আমার দৃঢ় বিশ্বাস এবং আমি তোমাদিগকেও এই বিষয়টি ভাল করিয়া বুঝিবার জন্য অনুরোধ করিতেছি যে, যে ব্যক্তি দিবারাত্র নিজেকে দীন দুঃখী হীন ভাবে, সে হীনই হইয়া যায়। যদি তুমি বল—‘আমার মধ্যেও শক্তি আছে’, তোমার ভিতর শক্তি জাগিবে; আর যদি তুমি বল—‘আমি কিছুই নই’, ভাব যে তুমি কিছুই নও, দিবারাত্র যদি ভাবিতে থাক যে তুমি ‘কিছুই নও’, তবে তুমি ‘কিছু না’ হইয়া দাঁড়াইবে। এই মহান্ তত্ত্বটি তোমাদের মনে রাখা কর্তব্য। আমরা সেই সর্বশক্তিমানের সন্তান, আমরা সেই অনন্ত ব্রহ্মাগ্নির স্ফুলিঙ্গ। আমরা কিরূপে ‘কিছু না’ হইতে পারি? আমরা সব করিতে প্রস্তুত, সব করিতে পারি, আমাদিগকে সব কাজ করিতেই হইবে। আমাদের পূর্বপুরুষগণের হৃদয়ে এই আত্মবিশ্বাস ছিল, এই আত্মবিশ্বাসরূপ প্রেরণাশক্তিই তাঁহাদিগকে সভ্যতার উচ্চ হইতে উচ্চতর স্তরে উন্নীত করিয়াছিল, আর যদি এখন অবনতি হইয়া থাকে, যদি আমাদের ভিতর দোষ আসিয়া থাকে, তবে আমি তোমাদিগকে নিশ্চয় করিয়া বলিতেছি—যেদিন আমাদের দেশের লোক এই আত্মপ্রত্যয় হারাইয়াছে, সেইদিন হইতেই এই অবনতি আরম্ভ হইয়াছে। নিজের উপর বিশ্বাস হারানোর অর্থ ঈশ্বরে অবিশ্বাস। তোমরা কি বিশ্বাস কর, সেই অনন্ত মঙ্গলময় বিধাতা তোমাদের মধ্য দিয়া কাজ করিতেছেন? তোমরা যদি বিশ্বাস কর যে, সেই সর্বব্যাপী অন্তর্যামী প্রত্যেক অণুতে পরমাণুতে, তোমাদের দেহে মনে আত্মায় ওতপ্রোতভাবে রহিয়াছেন, তাহা হইলে কি তোমরা নিরুৎসাহ হইতে পার? আমি হয়তো একটি ক্ষুদ্র জলবুদ্বুদ্, তুমি হয়তো একটি পর্বতপ্রায় তরঙ্গ। তাহাতে কি আসে যায়! সেই অনন্ত সমুদ্র যেমন তোমার আশ্রয়, আমারও সেইরূপ। সেই প্রাণ শক্তি ও আধ্যাত্মিকতার অনন্ত সমুদ্রে তোমারও যেমন অধিকার, আমারও তেমনি। আমার জন্ম হইতেই—আমারও যে জীবন আছে, তাহা হইতেই—স্পষ্ট প্রতীয়মান হইতেছে যে, পর্বতপ্রায় উচ্চ তরঙ্গস্বরূপ তোমার ন্যায় আমিও সেই অনন্ত জীবন, অনন্ত শিব ও অনন্ত শক্তির সহিত নিত্যসংযুক্ত। অতএব হে ভ্রাতৃগণ, তোমাদের সন্তানগণকে—তাহাদের জন্ম হইতেই এই জীবনপ্রদ, মহত্ত্ববিধায়ক, উচ্চ মহান্ তত্ত্ব শিক্ষা দিতে আরম্ভ কর। তাহাদিগকে অদ্বৈতবাদ শিক্ষা দিবার প্রয়োজন নাই, তাহাদিগকে দ্বৈতবাদ বা যে-কোন বাদ ইচ্ছা শিক্ষা দাও; আমরা পূর্বেই দেখিয়াছি, আত্মার পূর্ণত্বরূপ এই অপূর্ব মতটি ভারতে সর্বসাধারণ—সকল সম্প্রদায়ই বিশ্বাস করিয়া থাকে।
আমাদের শ্রেষ্ঠ দার্শনিক কপিল বলিয়াছেন, যদি পবিত্রতা আত্নার স্বরূপ না হয়, তবে আত্মা কখনই পরে পবিত্রতা লাভ করিতে সমর্থ হইবে না; কারণ যাহা স্বভাবতই পূর্ণ নহে, তাহা কোনরূপে পূর্ণতা লাভ করিলেও ঐ পূর্ণতা আবার চলিয়া যাইবে। যদি অপবিত্রতাই মানবের স্বভাব হয়, তবে যদিও ক্ষণকালের জন্য সে পবিত্রতা লাভ করে, তথাপি চিরকালের জন্য তাহাকে অপবিত্রই থাকিতে হইবে। এমন সময় আসিবে, যখন এই পবিত্রতা ধুইয়া যাইবে, চলিয়া যাইবে এবং আবার সেই প্রাচীন স্বাভাবিক অপবিত্রতা রাজত্ব করিবে। এজন্য আমাদের সকল দার্শনিক বলেন, পবিত্রতাই আমাদের স্বভাব, অপবিত্রতা নহে; পূর্ণত্বই আমাদের স্বভাব, অপূর্ণতা নহে—এইটি স্মরণ রাখিও। মৃত্যুকালে যে মহর্ষি তাঁহার নিজ মনকে তাঁহার কৃত উৎকৃষ্ট কার্যাবলী ও উৎকৃষ্ট চিন্তারাশি স্মরণ করিতে বলিতেছেন, তাঁহার কথা স্মরণ রাখিও।৪৯ কই, তিনি তো তাঁহার মনকে সমুদয় দোষ-দুর্বলতা স্মরণ করিতে বলিতেছেন না। অবশ্য মানুষের জীবনে দোষ-দুর্বলতা যথেষ্ট আছে; কিন্তু সর্বদাই তোমার প্রকৃত স্বরূপ স্মরণ কর—ঐ দোষ-দুর্বলতার প্রতিকার করিবার ইহাই একমাত্র উপায়।
ভদ্রমহোদয়গণ, আমার বোধ হয়, পূর্বকথিত কয়েকটি মত ভারতের সকল বিভিন্ন ধর্মসম্প্রদায়ই স্বীকার করিয়া থাকেন, আর সম্ভবতঃ ভবিষ্যতে এই সাধারণ ভিত্তির উপর গোঁড়া বা উদার, প্রাচীন বা নব্যপন্থী, সকলেই সম্মিলিত হইবেন। কিন্তু সর্বোপরি, আর একটি বিষয় স্মরণ রাখা আবশ্যক এবং আমি দুঃখের সহিত বলিতেছি যে, ইহা আমরা সময় সময় ভুলিয়া যাই—ভারতে ধর্মের অর্থ প্রত্যক্ষানুভূতি, তাহা না হইলে উহা ধর্ম নামেরই যোগ্য নহে। ‘এইমতে বিশ্বাস করিলেই তোমার পরিত্রাণ নিশ্চিত’—এ-কথা আমাদিগকে কেহ কখনও শিখাইতে পারিবে না; কারণ আমরা ও-কথায় বিশ্বাসই করি না। তুমি নিজেকে যেরূপ গঠন করিবে, তুমি তাহাই হইবে। তুমি যাহা—তাহা তুমি ঈশ্বরানুগ্রহে এবং নিজের চেষ্টায় হইয়াছ। সুতরাং কেবল কতকগুলি মতামতে বিশ্বাস করিলে তোমার বিশেষ কিছু উপকার হইবে না। ভারতের আধ্যাত্মিক গগন হইতেই এই মহাশক্তিময়ী বাণী আবির্ভূত হইয়াছে—‘অনুভূতি’; আর একমাত্র আমাদের শাস্ত্রই বারবার বলিয়াছেন, ‘ঈশ্বরকে দর্শন করিতে হইবে।’ খুব সাহসের কথা বটে, কিন্তু উহার একবর্ণও মিথ্যা নয়—আগাগোড়া সত্য। ধর্ম সাক্ষাৎ করিতে হইবে, কেবল শুনিলে হইবে না, কেবল তোতাপাখির মত কতকগুলি কথা মুখস্থ করিলেই চলিবে না, কেবল বুদ্ধির সায়—বুদ্ধিগত সম্মতি দিলেই চলিবে না; ইহাতে কিছুই হয় না, ধর্ম আমাদের ভিতর প্রবেশ করা চাই। প্রাচীনেরা এবং আধুনিকেরাও সেই ঈশ্বরকে দেখিয়াছেন—ইহাই আমাদের নিকট ঈশ্বরের অস্তিত্বের শ্রেষ্ঠ প্রমাণ। আমাদের যুক্তিবিচার এইরূপ বলিতেছে—এ-জন্যই যে আমরা ঈশ্বরে বিশ্বাসী, তাহা নহে। আত্মার অস্তিত্ব প্রমাণ করিবার উৎকৃষ্ট যুক্তি আছে বলিয়াই যে আমরা আত্মায় বিশ্বাসী, তাহা নহে; আমাদের বিশ্বাসের প্রধান ভিত্তি এই যে, এই ভারতে প্রাচীনকালে সহস্র সহস্র ব্যক্তি এই আত্মাকে দর্শন করিয়াছেন, বর্তমান কালেও খুঁজিলে অনন্তঃ দশজন আত্মজ্ঞ পুরুষের সাক্ষাৎ মিলিবে এবং ভবিষ্যতেও সহস্র সহস্র ব্যক্তির অভ্যুদয় হইবে, যাঁহারা আত্মদর্শন করিবেন। আর যতদিন না মানুষ ঈশ্বর-দর্শন করিতেছে, যতদিন না সে আত্মা উপলব্ধি করিতে সমর্থ হইতেছে, ততদিন তাহার মুক্তি অসম্ভব। অতএব সর্বাগ্রে এই-বিষয়টি আমাদিগকে বিশেষভাবে বুঝিতে হইবে এবং আমরা উহা যতই ভাল করিয়া বুঝিব, ততই ভারতে সাম্প্রদায়িকতা হ্রাস পাইবে। কারণ সে-ই প্রকৃত ধার্মিক, যে ঈশ্বরকে দর্শন করিয়াছে—তাঁহাকে লাভ করিয়াছে।
ভিদ্যতে হৃদয়গ্রন্থিশ্ছিদ্যন্তে সর্বসংশয়াঃ। ক্ষীয়ন্তে চাস্য কর্মাণি তস্মিন্ দৃষ্টে পরাবরে॥৫০
তাঁহারই হৃদয়গ্রন্থি ছিন্ন হয়, তাঁহারই সকল সংশয় চলিয়া যায়, তিনিই কর্মফল হইতে মুক্ত হন, যিনি কার্য ও কারণ-রূপী পরমাত্মাকে দর্শন করেন।
হায়, আমরা অনেক সময় অনর্থক বাগাড়ম্বরকে আধ্যাত্মিক সত্য বলিয়া ভ্রম করি, পাণ্ডিত্যপূর্ণ বক্তৃতাচ্ছটাকে গভীর ধর্মানুভূতি মনে করি; তাই সাম্প্রদায়িকতা, তাই বিরোধ! যদি আমরা একবার বুঝিতে পারি—প্রত্যক্ষানুভূতিই প্রকৃত ধর্ম, তাহা হইলে নিজ হৃদয়ের দিকে দৃষ্টিপাত করিয়া বুঝিতে চেষ্টা করিব—আমরা ধর্মের সত্যসমূহ উপলব্ধি করিবার পথে কতদূর অগ্রসর। তাহা হইলেই আমরা বুঝিব যে, আমরা নিজেরাই অন্ধকারে ঘুরিতেছি এবং অপরকেও সেই অন্ধকারে ঘুরাইতেছি। আর ইহা বুঝিলেই আমাদের সাম্প্রদায়িকতা ও দ্বন্দ্ব বিদূরিত হইবে। কোন ব্যক্তি সম্প্রদায়িক বিবাদ করিতে উদ্যত হইলে তাহাকে জিজ্ঞাসা করঃ তুমি কি ঈশ্বর দর্শন করিয়াছ? তুমি কি আত্মদর্শন করিয়াছ? যদি না করিয়া থাক, তবে তাঁহাকে প্রচার করিবার তোমার কি অধিকার? তুমি নিজেই অন্ধকারে ঘুরিতেছ, আবার আমাকেও সেই অন্ধকারে লইয়া যাইবার চেষ্টা করিতেছ? অন্ধের দ্বারা নীয়মান অন্ধের ন্যায়৫১ আমরা উভয়েই যে খানায় পড়িয়া যাইব! অতএব অপরের সহিত বিবাদ করিবার পূর্বে একটু ভাবিয়া-চিন্তিয়া অগ্রসর হও। সকলকেই নিজ নিজ সাধন-প্রণালী অবলম্বন করিয়া প্রত্যক্ষানুভূতির দিকে অগ্রসর হইতে দাও, সকলেই নিজ নিজ হৃদয়ে সেই সত্যদর্শন করিতে চেষ্টা করুক। আর যখনই তাহারা সেই ভূমা, অনাবৃত সত্য দর্শন করিবে, তখনই তাহারা সেই অপূর্ব আনন্দের আস্বাদ পাইবে—ভারতের প্রত্যেক ঋষি, যিনি সত্যকে সাক্ষাৎ করিয়াছেন, তিনিই এ-কথা বলিয়া গিয়াছেন। তখন সেই হৃদয় হইতে কেবল প্রেমের বাণী উৎসারিত হইবে; কারণ যিনি সাক্ষাৎ প্রেমস্বরূপ—তিনি যে সেই হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হইয়াছেন; তখন—কেবল তখনই সকল সাম্প্রদায়িক বিবাদ অন্তর্হিত হইবে এবং তখনই আমরা ‘হিন্দু’ শব্দটিকে এবং প্রত্যেক হিন্দুনামধারী ব্যক্তিকে যথার্থরূপে বুঝিতে, হৃদয়ে গ্রহণ করিতে, গভীরভাবে ভালবাসিতে এবং আলিঙ্গন করিতে সমর্থ হইব।
আমার কথা বিশ্বাস কর, তখন—কেবল তখনই তুমি প্রকৃত হিন্দুপদবাচ্য, যখন ঐ নামটিতেই তোমার ভিতরে মহাবৈদ্যুতিক শক্তি সঞ্চারিত হইবে; তখন—কেবল তখনই তুমি প্রকৃত হিন্দুপদবাচ্য হইবে, যখন যে-কোন দেশীয়, যে-কোন ভাষাভাষী ব্যক্তি হিন্দুনামধারী হইলেই অমনি তোমার পরমাত্মীয় বোধ হইবে; তখন—কেবল তখনই তুমি হিন্দুপদবাচ্য, যখন হিন্দুনামধারী যে-কোন ব্যক্তির দুঃখকষ্ট তোমার হৃদয় স্পর্শ করিবে আর তুমি নিজ সন্তান বিপদে পড়িলে যেরূপ উদ্বিগ্ন হও, তাহার কষ্টেও সেইরূপ উদ্বিগ্ন হইবে; তখন—কেবল তখনই তুমি হিন্দুপদবাচ্য, যখন তুমি তাহাদের সর্বপ্রকার অত্যাচার ও নির্যাতন সহ্য করিতে প্রস্তুত হইবে। ইহার উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্তস্বরূপ তোমাদের সেই মহান্ গুরুগোবিন্দসিংহের বিষয়ে আমি এই বক্তৃতার আরম্ভেই বলিয়াছি।
এই মহাত্মা দেশের শত্রুগণের সহিত যুদ্ধ করিলেন, হিন্দুধর্ম রক্ষার জন্য নিজ শোণিতপাত করিলেন, নিজ পুত্রগণকে যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন করিতে দেখিলেন, কিন্তু যাহাদের জন্য নিজের এবং আত্মীয়স্বজনগণের রক্তপাত করিলেন, তাহারা তাঁহাকে সাহায্য করা দূরে থাক, তাহারাই তাঁহাকে পরিত্যাগ করিল, এমন কি দেশ হইতে তাড়াইয়া দিল; অবশেষে এই আহত কেশরী নিজ কার্যক্ষেত্র হইতে ধীরভাবে দক্ষিণদেশে গিয়া মৃত্যুর প্রতীক্ষা করিতে লাগিলেন, কিন্তু যাহারা অকৃতজ্ঞভাবে তাঁহাকে পরিত্যাগ করিল, তাহাদের প্রতি একটি অভিশাপবাক্যও তাঁহার মুখ হইতে নিঃসৃত হইল না।
আমার বাক্য অবধান কর—যদি তোমরা দেশের হিতসাধন করিতে চাও, তোমাদেরও প্রত্যেককে এক এক জন গোবিন্দসিংহ হইতে হইবে। তোমরা স্বদেশবাসীদের ভিতর সহস্র দোষ দর্শন করিতে পার, তথাপি যাহাদের মধ্যে হিন্দুরক্ত আছে, যাহারা ভারতবাসী তাহাদের সকলকেই দেবতারূপে পূজা করিতে হইবে—যদিও তাহারা সর্বপ্রকারে তোমাদের অনিষ্ট করিবার চেষ্টা করে। যদিও তাহারা প্রত্যেকেই তোমার প্রতি অভিশাপ বর্ষণ করে, তথাপি তুমি তাহাদের প্রতি প্রেমের বাণী প্রয়োগ করিবে। যদি তাহারা তোমাকে তাড়াইয়া দেয়, তবে সেই বীরকেশরী গোবিন্দসিংহের মত সমাজ হইতে দূরে যাইয়া নিস্তব্ধতার মধ্যে মৃত্যুর প্রতীক্ষা কর। এইরূপ ব্যক্তিই হিন্দুনামের যোগ্য; আমাদের সম্মুখে সর্বদাই এরূপ আদর্শ থাকা আবশ্যক। পরস্পর বিরোধ ভুলিতে হইবে—চতুর্দিকে প্রেমের প্রবাহ বিস্তার করিতে হইবে।
‘ভারত-উদ্ধার’ সম্বন্ধে, যাহার যাহা ইচ্ছা হয় বলুক। আমি সারা জীবন কার্য করিতেছি, অন্ততঃ কার্য করিবার চেষ্টা করিতেছি; আমি তোমাদিগকে বলিতেছি, যতদিন না তোমরা প্রকৃতপক্ষে ধার্মিক হইতেছ, ততদিন ভারতের উদ্ধার হইবে না। তোমাদের আধ্যাত্মিকতার উপর শুধু ভারতের নহে, সমগ্র জগতের কল্যাণ নির্ভর করিতেছে। কারণ আমি তোমাদিগকে স্পষ্টই বলিতেছি, এখন পাশ্চাত্য সভ্যতার মূল ভিত্তি পর্যন্ত বিচলিত হইয়াছে। জড়বাদের শিথিল বালুকাভিত্তির উপর স্থাপিত বড় বড় অট্টালিকা পর্যন্ত একদিন না একদিন ধ্বংসপ্রাপ্ত হইবেই হইবে। এ-বিষয়ে জগতের ইতিহাসই আমাদের প্রকৃষ্ট সাক্ষ্য। জাতির পর জাতি উঠিয়া জড়বাদের উপর নিজ মহত্ত্বের ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করিয়াছিল, তাহারা জগতের নিকট ঘোষণা করিয়াছিল—মানুষ জড়মাত্র। লক্ষ্য করিয়া দেখ, পাশ্চাত্য ভাষা মৃত্যুর কথা বলিতে গিয়া বলে, ‘মানুষ আত্মা ত্যাগ করে।’৫২আমাদের ভাষা কিন্তু বলে, ‘সে দেহত্যাগ করিল।’ পাশ্চাত্যদেশীয় লোক নিজের কথা বলিতে গেলে প্রথমে দেহকেই লক্ষ্য করিয়া থাকে, তারপর তাহার একটি আত্মা আছে বলিয়া উল্লেখ করে; কিন্তু আমরা প্রথমেই নিজেকে আত্মা বলিয়া চিন্তা করি, তরপর আমার একটা দেহ আছে—এই কথা বলি। এই দুইটি বাক্য আলোচনা করিলেই প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য চিন্তাপ্রণালীর পার্থক্য বুঝিতে পারিবে। এই কারণে যে-সকল সভ্যতা দৈহিক সুখস্বাচ্ছন্দ্যরূপ বালির ভিত্তির উপর স্থাপিত, সেগুলি অল্পদিনমাত্র জীবিত থাকিয়া জগৎ হইতে একে একে লুপ্ত হইয়াছে, কিন্তু ভারত এবং অন্যান্য যে-সকল জাতি ভারতের পদপ্রান্তে বসিয়া শিক্ষালাভ করিয়াছে—যথা চীন ও জাপান—এখনও জীবিত; এমন কি, উহাদের ভিতর পুনরভ্যুত্থানের লক্ষণসমূহ দেখা যাইতেছে। তাহারা যেন ফিনিক্স-পক্ষীর ন্যায়; সহস্রবার ধ্বংসপ্রাপ্ত হইয়াও তাহারা পুনরুজ্জীবিত হইয়া নূতন মহিমায় প্রকাশিত হইতেছে। কিন্তু জড়বাদের উপর যে সভ্যতার ভিত্তি স্থাপিত, তাহা একবার নষ্ট হইলে আর কখনও মাথা তুলিতে পারে না; একবার সেই অট্টালিকা পড়িয়া গেলে একেবারে চূর্ণবিচূর্ণ হইয়া যায়। অতএব ধৈর্যধারণপূর্বক অপেক্ষা কর; ভবিষ্যৎ গৌরব আমাদের জন্য সঞ্চিত রহিয়াছে।
ব্যস্ত হইও না; অপর কাহাকেও অনুকরণ করিতে যাইও না। আমাদিগকে এই আর একটি বিশেষ বিষয় স্মরণ রাখিতে হইবে—অপরের অনুকরণ কখনও সভ্যতা বা উন্নতির লক্ষণ নহে। আমি নিজেকে রাজার বেশে ভূষিত করিতে পারি, তাহাতেই কি আমি রাজা হইব? সিংহচর্মাবৃত গর্দভ কখনও সিংহ হয় না। অনুকরণ—হীন কাপুরুষের মত অনুকরণ কখনই উন্নতির কারণ হয় না, বরং উহা মানুষের ঘোর অধঃপতনের চিহ্ন। যখন মানুষ নিজেকে ঘৃণা করিতে আরম্ভ করে, তখন বুঝিতে হইবে—তাহার উপর শেষ আঘাত পড়িয়াছে; যখন সে নিজ পূর্বপুরুষগণকে স্বীকার করিতে লজ্জিত হয়, তখন বুঝিতে হইবে— তাহার বিনাশ আসন্ন। এই আমি হিন্দুজাতির মধ্যে একজন অতি নগণ্য ব্যক্তি; তথাপি আমি আমার জাতির—আমার পূর্বপুরুষগণের গৌরবে গৌরব অনুভব করিয়া থাকি। আমি নিজেকে হিন্দু বলিয়া পরিচয় দিতে গর্ব অনুভব করিয়া থাকি। আমি যে তোমাদের একজন অযোগ্য দাস, ইহাতে আমি গর্ব অনুভব করিয়া থাকি। তোমরা ঋষির বংশধর, সেই অতিশয় মহিমময় পূর্বপুরুষগণের বংশধর—আমি যে তোমাদের স্বদেশীয়, ইহাতে আমি গর্ব অনুভব করিয়া থাকি। অতএব তোমরা আত্মবিশ্বাসসম্পন্ন হও, তোমাদের পূর্বপুরুষগণের নামে লজ্জিত না হইয়া তাঁহাদের নামে গৌরব অনুভব কর; আর অনুকরণ করিও না, অনুকরণ করিও না। যখনই তোমরা অপরের ভাবানুসারে পরিচালিত হইবে, তখনই তোমরা নিজেদের স্বাধীনতা হারাইবে। আধ্যাত্মিক বিষয়েও যদি তোমরা অপরের অধীন হইয়া কার্য কর, তোমরা সকল শক্তি, এমন কি চিন্তাশক্তি পর্যন্ত হারাইয়া ফেলিব।
তোমাদের ভিতরে যাহা আছে, নিজ শক্তিবলে তাহা প্রকাশ কর, কিন্তু অনুকরণ করিও না; অথচ অপরের যাহা ভাল, তাহা গ্রহণ কর। আমাদিগকে অপরের নিকট শিখিতে হইবে। বীজ মাটিতে পুঁতিলে উহা মৃত্তিকা, বায়ু ও জল হইতে রস সংগ্রহ করে বটে, কিন্তু বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হইয়া প্রকাণ্ড মহীরুহে পরিণত হইলে কি উহা মাটি, জল বা বাযুর আকার ধারণ করে? না, তাহা করে না। বীজ মৃত্তিকাদি হইতে প্রয়োজনীয় সারাংশ গ্রহণ করিয়া নিজের প্রকৃতি-অনুযায়ী একটি বৃহৎ বৃক্ষে পরিণত হয়। তোমরাও এইরূপ কর। অবশ্য অপরের নিকট হইতে আমাদের অনেক কিছু শিখিবার আছে; যে শিখিতে চায় না, সে তো পূর্বেই মরিয়াছে। আমাদের মনু বলিয়াছেনঃ৫৩
শ্রদ্দধানঃ শুভাং বিদ্যামাদদীতাবরাদপি। অন্ত্যাদপি পরং ধর্মং স্ত্রীরত্নং দুষ্কুলাদপি॥
নীচ ব্যক্তির সেবা করিয়া তাহার নিকট হইতেও যত্নপূর্বক শ্রেষ্ঠ বিদ্যা শিক্ষা করিবে। হীন চণ্ডালের নিকট হইতেও শ্রেষ্ঠ ধর্ম শিক্ষা করিবে, ইত্যাদি।
অপরের নিকট ভাল যাহা কিছু পাও শিক্ষা কর, কিন্তু সেইটি লইয়া নিজেদের ভাবে গঠন করিয়া লইতে হইবে—অপরের নিকট শিক্ষা করিতে গিয়া তাহার সম্পূর্ণ অনুকরণ করিয়া নিজের স্বাতন্ত্র্য হারাইও না। এই ভারতের জাতীয় জীবন হইতে একেবারে বিচ্ছিন্ন হইয়া যাইও না; এক মুহূর্তের জন্য মনে করিও না, যদি ভারতের সকল অধিবাসী অপর জাতিবিশেষের পোশাক-পরিচ্ছদ, আচার-ব্যবহার অনুকরণ করিত, তাহা হইলেই ভাল হইত। কয়েক বৎসরের অভ্যাস পরিত্যাগ করাই কি কঠিন ব্যাপার, তাহা তোমরা বেশ জান। আর ঈশ্বরই জানেন, কত সহস্র সহস্র বৎসর ধরিয়া এই জাতীয় জীবনস্রোত এক বিশেষ দিকে প্রবাহিত হইতেছে; ঈশ্বর জানেন—তোমাদের শোণিতে কত সহস্র বৎসরের সংস্কার রহিয়াছে, আর তোমরা কি সাগরে মিলিতপ্রায় এই শক্তিশালিনী স্রোতস্বতীকে ঠেলিয়া আবার হিমালয়ের সেই তুষাররাশির নিকটে লইয়া যাইতে চাও? ইহা অসম্ভব। এইরূপ করিতে চেষ্টা করিলে তোমরাই বিনষ্ট হইবে। অতএব এই জাতীয় জীবনস্রোতকে প্রবাহিত হইতে দাও। যে-সকল প্রবল অন্তরায় এই বেগবতী নদীর স্রোত রুদ্ধ করিয়া রাখিয়াছে, সেগুলিকে সরাইয়া দাও, পথ পরিষ্কার করিয়া দাও, নদীর খাত সরল করিয়া দাও, তাহা হইলে উহা নিজ স্বাভাবিক গতিতে প্রবলবেগে অগ্রসর হইবে—এই জাতি সর্ববিধ উন্নতিসাধন করিতে করিতে চরম লক্ষ্যের দিকে ছুটিয়া চলিবে।
ভদ্রমহোদয়গণ, ভারতের আধ্যাত্মিক উন্নতিবিধানের জন্য আমি পূর্বকথিত উপায়গুলি নির্দেশ করিলাম। আরও অনেক বড় বড় সমস্যা আছে, সেগুলি সময়াভাবে আজ রাত্রে আলোচনা করিতে পারিলাম না—দৃষ্টান্তস্বরূপ, জাতিভেদ-সম্বন্ধীয় অদ্ভুত সমস্যা রহিয়াছে। আমি সারা জীবন ধরিয়া এই সমস্যার সব দিক্ বিচার করিতেছি। ভারতের প্রায় প্রত্যেক প্রদেশে গিয়া এই সমস্যার আলোচনা করিয়াছি, এদেশের প্রায় সর্বস্থানে গিয়া সকল জাতির লোকের সঙ্গে মিশিয়াছি; কিন্তু যতই আমি এই সমস্যার আলোচনা করিতেছি, ততই উহার উদ্দেশ্য ও তাৎপর্য ধারণা করিতে গিয়া কিংকর্তব্যবিমূঢ় হইয়া পড়িতেছি। অবশেষে আমার সম্মুখে যেন ক্ষীণ রশ্মিধারা পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে, আমি সম্প্রতি ইহার মূল উদ্দেশ্য উপলব্ধি করিতে আরম্ভ করিয়াছি।
তারপর আবার ভোজনপানাদি-সম্বন্ধীয় গুরুতর সমস্যা রহিয়াছে। বাস্তবিকই ইহা একটি গুরুতর সমস্যা। আমরা সাধারণতঃ যতটা মনে করি, ব্যাপারটি ততটা অনাবশ্যক নহে। আমি এই সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি যে, আমরা এখন এই আহারাদি সম্বন্ধে যে-বিষয়ে ঝোঁক দিতে যাই, তাহা এক কিম্ভূতকিমাকার ব্যাপার, উহা শাস্ত্রানুমোদিত নহে অর্থাৎ আমরা ভোজনপান-বিষয়ে যথার্থ শুদ্ধতা রক্ষা করিতে অবহেলা করিয়াই এই কষ্ট পাইতেছি—আমরা শাস্ত্রানুমোদিত পানভোজন-প্রথা ভুলিয়া গিয়াছি।
আরও কয়েকটি প্রশ্ন আছে, সেগুলি আমি আপনাদের সমক্ষে উপস্থিত করিতে চাই। আর এই সমস্যাগুলির সমাধানই বা কি, কিরূপেই বা সেগুলি কার্যে পরিণত করা যাইতে পারে, সে সম্বন্ধে আমি ভাবিয়া-চিন্তিয়া কি সিদ্ধান্তে উপনীত হইয়াছি, তাহাও আপনাদিগকে বলিতে চাই। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সুশৃঙ্খলভাবে সভায় কার্য আরম্ভ করিতেই বিলম্ব হইয়াছে, আর এখন অনেক রাত্রি হইয়া গিয়াছে। সুতরাং আমি মাননীয় সভাপতি মহাশয়ের এবং আপনাদের রাত্রির আহারের আর অধিক বিলম্ব ঘটাইতে ইচ্ছা করি না। অতএব আমি জাতিভেদ ও অন্যান্য বিষয় সম্বন্ধে আমার বক্তব্য ভবিষ্যতের জন্য রাখিয়া দিলাম। আশা করি, ভবিষ্যতে আমরা সকলেই অপেক্ষাকৃত শান্ত ও সুশৃঙ্খলভাবে সভায় যোগদান করিতে চেষ্টা করিব।
ভদ্রমহোদয়গণ, আর একটি কথা বলিলেই আমার আধ্যাত্মিক তত্ত্বসম্বন্ধে বক্তব্য শেষ হইবে। ভারতে অনেক দিন ধরিয়া ধর্ম নিশ্চল অবস্থায় আছে—আমরা চাই উহাকে গতিশীল করিতে। আমি প্রত্যেক ব্যক্তির জীবনে এই ‘ধর্ম’ প্রতিষ্ঠিত করিতে চাই। অতীতকালে বরাবর যেরূপ হইয়া আসিয়াছে, তেমনি এখনও রাজপ্রাসাদে এবং দরিদ্রের পর্ণকুটিরে ধর্ম যেন সমভাবে প্রবেশ করে। এই জাতির সাধারণ উত্তরাধিকার এবং জন্মগত সর্বজনীন স্বত্বরূপে প্রাপ্ত ধর্মকে প্রত্যেক ব্যক্তির গৃহ-দ্বারে মুক্তহস্তে লইয়া যাইতে হইবে। ঈশ্বরের রাজ্যে বায়ু যেমন সকলের অনায়াস-লভ্য, ভারতের ধর্মকেও ঐরূপ সুলভ করিতে হইবে। ভারতে আমাদিগকে এইভাবেই কাজ করিতে হইবে, কিন্তু ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সম্প্রদায় গঠন করিয়া এবং মতানৈক্য লইয়া বিবাদ করিয়া নহে।
আমি তোমাদিগকে কার্যপ্রণালীর আভাস এইটুকু দিতে চাই যে, যে-সকল বিষয়ে আমারা সকলেই একমত, সেইগুলি প্রচার করা হউক; যে-সকল বিষয়ে মতভেদ আছে, সেগুলি আপনা-আপনি দূর হইয়া যাইবে। আমি যেমন বার বার বলিয়াছি, কোন ঘরে যদি বহু শতাব্দীর অন্ধকার থাকে, এবং যদি আমরা সেই ঘরে গিয়া ক্রমাগত চীৎকার করিয়া বলিতে থাকি, ‘উঃ কি অন্ধকার! কি অন্ধকার!’ তবে কি অন্ধকার দূর হইবে? আলোক লইয়া আইস, অন্ধকার চিরকালের জন্য চলিয়া যাইবে। মানুষের সংস্কার-সাধন করিবার ইহাই রহস্য। তাহাদিগকে উচ্চতর বিষয়সমূহের আভাস দাও—প্রথমেই মানুষের উপর অবিশ্বাস লইয়া কার্যক্ষেত্রে অবতীর্ণ হইও না। আমি মানুষের উপর—খুব খারাপ মানুষের উপরও বিশ্বাস করিয়া কখনও বিফল হই নাই। সর্বস্থলেই পরিণামে জয়লাভ হইয়াছে। মানুষকে বিশ্বাস কর—তা সে পণ্ডিতই হউক বা অজ্ঞ মূর্খ বলিয়াই প্রতীয়মান হউক। মানুষকে বিশ্বাস কর—তা তাহাকে দেবতা অথবা সাক্ষাৎ শয়তান বলিয়াই বোধ হউক। প্রথমে মানুষের উপর বিশ্বাস স্থাপন কর, তারপর এই বিশ্বাস হৃদয়ে লইয়া ইহাও বুঝিতে চেষ্টা কর—যদি তাহার ভিতর কোন অসম্পূর্ণতা থাকে, যদি সে কিছু ভুল করে, যদি সে অতিশয় ঘৃণিত ও অসার মত অবলম্বন করে, তবে জানিও—তাহার প্রকৃত স্বভাব হইতে ঐগুলি প্রসূত হয় নাই, উচ্চতর আদর্শের অভাব হইতেই ঐরূপ হইয়াছে। কোন ব্যক্তি যে অসত্যের দিকে আকৃষ্ট হয়, তাহার কারণ এই—সে সত্যকে ধরিতে পারিতেছে না। অতএব যাহা মিথ্যা, তাহা দূর করিবার একমাত্র উপায়—যাহা সত্য, তাহা মানুষকে দিতে হইবে। সত্য কি, তাহাকে জানাইয়া দাও। সত্যের সহিত সে নিজ ভাবের তুলনা করুক। তুমি তাহাকে সত্য জানাইয়া দিলে, ঐখানেই তোমার কাজ শেষ হইয়া গেল। সে এখন মনে মনে তাহার পূর্ব-ধারণার সহিত উহার তুলনা করুক। আর ইহাও নিশ্চিত জানিও যে, যদি তুমি তাহাকে যথার্থ সত্য দিয়া থাক, তবে মিথ্যা অবশ্যই অন্তর্হিত হইবে; আলোক অবশ্যই অন্ধকার দূর করিবে; সত্য অবশ্যই তাহার ভিতরের সদ্ভাবকে প্রকাশিত করিবে। যদি সমগ্র দেশের আধ্যাত্মিক সংস্কার করিতে চাও, তবে ইহাই পথ—ইহাই একমাত্র পথ; বিবাদ-বিসংবাদে কোন ফল হইবে না; বা তাহারা যাহা করিতেছে, তাহা মন্দ—এ কথা বলিলেও কিছু হইবে না। তাহাদের সম্মুখে ভালটি ধর, দেখিবে কি আগ্রহের সহিত তাহারা উহা গ্রহণ করে! মানুষের অন্তর্যামী সেই অবিনাশী ঐশীশক্তি জাগ্রত হইয়া যাহা কিছু উত্তম, যাহা কিছু মহিমময়, তাহারই জন্য হস্ত প্রসারণ করে।
যিনি আমাদের সমগ্র জাতির সৃষ্টিকর্তা ও রক্ষাকর্তা, যিনি আমাদের পূর্বপুরুষগণের ঈশ্বর—যাঁহাকে বিষ্ণু শিব শক্তি বা গণপতি, যে নামেই ডাকা হউক না কেন—যাঁহাকে সগুণ বা নির্গুণ যেরূপেই উপাসনা করা হউক না কেন, আমাদের পূর্বপুরুষগণ যাঁহাকে জানিয়া ‘একং সদ্বিপ্রা বহুধা বদন্তি’ বলিয়া গিয়াছেন, তিনি তাঁহার মহান্ প্রেম লইয়া আমাদের ভিতর প্রবেশ করুন, তিনি আমাদের উপর তাঁহার শুভাশীর্বাদ বর্ষণ করুন, তাঁহার কৃপায় আমরা যেন পরস্পরকে বুঝিতে সমর্থ হই, তাঁহার কৃপায় যেন আমরা প্রকৃত প্রেম ও তীব্র সত্যানুরাগের সহিত পরস্পরের জন্য কাজ করিতে পারি, এবং ভারতের আধ্যাত্মিক উন্নতিসাধন-রূপ মহৎ কার্যের মধ্যে যেন আমাদের ব্যক্তিগত যশ ও স্বার্থ—ব্যক্তিগত গৌরবের আকাঙ্ক্ষা প্রবেশ না করে!