জরাসন্ধ বধ
বৈশম্পায়ন কহিলেন, তদসন্তর কৌশলাভিজ্ঞ ভীমসেন জরাসন্ধবধাভিলাষে বাসুদেবকে কহিলেন, “হে কৃষ্ণ! এই পাপাত্মার কক্ষদেশ এরূপ বসনবদ্ধ আছে যে ইহাকে প্রাণবিযুক্ত করা সহজ ব্যাপার নহে!” পুরুষব্যাঘ্র বাসুদেব জরাসন্ধবধাভিলাষে সত্বর হইয়া বৃকোদরকে কহিলেন, “হে ভীম! তোমার যে দৈববল ও বায়ুবল আছে, আশু তাহা জরাসন্ধকে প্ৰদৰ্শন করাও।” মহাবল ভীম এই প্রকার অভিহিত হইয়া জরাসন্ধকে উৎক্ষিপ্ত করিয়া ঘূর্ণিত করিতে লাগিলেন; শতবার ঘূর্ণিত করিয়া জানুদ্বারা আকুঞ্চিনপূর্ব্বক তাহার পৃষ্ঠদেশ ভঙ্গ ও নিষ্পেষণপূর্ব্বক সিংহনাদসহকারে তাহার চরণদ্বয় করকবলিত করিয়া দ্বিধাবিভক্ত করিলেন। নিষ্পিষ্যমাণ জরাসন্ধের আর্তরবে এবং ভীমসেনের গর্জনে মগধবাসী সমস্ত লোক ত্ৰস্ত ও গর্ভিণীর গর্ভস্রাব হইয়া গেল। ভীমসেনের ভয়ঙ্কর নিনাদে মগধেরা বোধ করিল যে, হয় হিমালয়, না হয় মহীতল বিদীর্ণ হইতেছে।
তদনন্তর অরিন্দম কৃষ্ণ, অর্জ্জুন ও ভীম গতজীবিত ও প্রসুপ্তের ন্যায় পতিত জরাসন্ধকে পরিত্যাগ করিয়া নিস্ক্রান্ত হইলেন। কৃষ্ণ জরাসন্ধের পতাকাশালী রথ সংযোজিত এবং তাহাতে ভ্রাতৃদ্বয়কে আরোপিত করিয়া বান্ধবগণকে কারামুক্ত করিলেন। মহীপালগণ মহাভয় হইতে পরিত্রাণ পাইয়া কৃষ্ণের নিকট গমনপূর্ব্বক রত্ন দ্বারা তাঁহার সমুচিত সম্মান করিলেন। অক্ষত, শস্ত্ৰসম্পন্ন, জিতারি বাসুদেব সেই দিব্যরথে আরোহণ করিয়া রাজগণের সহিত গিরিব্রজ হইতে প্ৰস্থান করিলেন। ভীমার্জ্জুন দুই যোদ্ধা তাহাতে আরূঢ় এবং কৃষ্ণ তাহার সারথি হওয়াতে সেই রথ সমধিক শোভিত হইয়াছিল। যে রথ তারকাজালের ন্যায় সমুজ্জ্বল, ইন্দ্র এবং বিষ্ণু যাহাতে আরোহণ করিয়া সংগ্রাম করিতেন, যদ্দ্বারা পুরন্দর নবনবতিবার দানবগণকে নিহত করিয়াছিলেন, তপ্ত-কাঞ্চনের ন্যায় যাহার আভা, মেঘনির্ঘোষের ন্যায় যাহার শব্দ, সেই কিঙ্কিণীজলজড়িত অপূর্ব্ব রথ প্রাপ্ত হইয়া তাঁহারা সাতিশয় পরিতুষ্ট হইলেন। মগধেরা মহাবাহু কৃষ্ণকে ভীম ও অর্জ্জুনের সহিত সেই রথে আরূঢ় দেখিয়া বিস্ময়াপন্ন হইল। বায়ুবেগশালী সেই রথ দিব্য ঘোটকে সংযুক্ত ও কৃষ্ণ কর্তৃক অধিষ্ঠিত হইয়া অতীব শোভমান হইয়াছিল। সেই দেবনির্মিত রথ শক্ৰধনুর ন্যায় প্রভাসম্পন্ন দৃষ্ট হইতে লাগিল।
জরাসন্ধবন্দীকৃত রাজগণের মুক্তি
অনন্তর কৃষ্ণ গরুড়কে স্মরণ করিবামাত্র তিনি সমাগত হইলেন। বিস্তৃতানন, মহানাদ গরুত্মান সমারাঢ় হইলে সেই দিব্য রথ উন্নত চৈত্যবৃক্ষের উপমেয় হইয়া উঠিল। সহস্রকিরণবৃত মধ্যাহ্নসহস্ৰাংশুর ন্যায় প্রাণীগণের দুনিরীক্ষ্য সেই রথ তেজো দ্বারা সমধিক দীপ্যমান হইল। তাহার দিব্য ধ্বজ বৃক্ষেও সংলগ্ন হইত না এবং বাণেও বিদ্ধ হইত না, এক্ষণে মানবের দৃশ্যমান হইতে লাগিল। সে রথ রাজা বসু বাসব হইতে, বৃহদ্ৰথ বসু হইতে, পরিশেষে জরাসন্ধ বৃহদ্ৰথ হইতে প্ৰাপ্ত হইয়াছিলেন, পুরুষব্যাঘ্ৰ আচ্যুত ভীম ও অর্জ্জুনের সহিত সেই মেঘনাদ রথে আরোহণ করিয়া প্ৰয়াণ করিলেন। তদনন্তর পুণ্ডরীকক্ষ বাসুদেব গিরিব্রজ হইতে নিৰ্গত হইয়া বহিঃপ্রদেশে উপস্থিত হইলেন। তখন তথায় ব্রাহ্মণ প্রভৃতি নগরবাসীরা সৎকার ও বিধিবিহিত কর্ম্ম দ্বারা তাহার সমীপবর্তী হইলেন। বন্ধনবিমুক্ত রাজারাও স্তুতিপূর্ব্বক মধুসূদনের পূজা করিয়া কহিতে লাগিলেন, “হে মহাবাহো! ভীমার্জ্জুনের সহিত আপনি যে ধর্ম্মরক্ষা করিলেন, আদ্য যে দুঃখরূপ পঙ্কে পঙ্কিল জরাসন্ধরূপ হ্রদে নিমগ্ন নৃপতিগণের উদ্ধারসাধন করিলেন, ইহা আশ্চর্য্যের বিষয় নহে। হে বিষ্ণো! হে যদুনন্দন! আপনি, দারুণ গিরিদুর্গে অবসন্ন দুর্ভাগ্যদিগের মোচনজনিত দীপ্ত যশোরাশি প্রাপ্ত হইলেন। আপনি নৃপতিগণের দুষ্কর কর্ম্ম করিলেন, এক্ষণে এই ভৃত্যদিগকে কি করিতে হইবে, অনুমতি করুন।”
জরাসন্ধপুত্র সহদেবের রাজ্যাভিষেক
মনস্বী হৃষীকেশ তাঁহাদিগকে কহিলেন, “রাজা যুধিষ্ঠির রাজসূয়-যজ্ঞ করিতে অভিলাষ করিয়াছেন, আপনারা সেই সাম্রাজ্যচিকীর্ষু ধামিকের সাহায্য করেন, ইহাই প্রার্থনা।” নৃপতিগণ “তাঁহাই করিব।” বলিয়া স্বীকার করিলেন। জরাসন্ধানন্দন সহদেব অমাত্যের সহিত পুরোহিতকে অগ্রবর্তী করিয়া অতি বিনীতভাবে প্রতিপাতসহকারে বহুরত্নপ্রদানপূর্ব্বক নরদেব বাসুদেবের উপাসনা করিয়া তাঁহার শরণাপন্ন হইলেন। পুরুষোত্তম কৃষ্ণ ভয়াৰ্ত্ত সহদেবকে অভয় প্রদান করিয়া তৎপ্রদত্ত মহামূল্য রত্নসমুদয় গ্রহণ করিলেন। কৃষ্ণ, ভীম ও অর্জ্জুন একত্র হইয়া সানন্দে সৎকারপূর্ব্বক তাহাকে সেই মগধরাজ্যে অভিষিক্ত করিলেন। মহাবাহু সহদেব মহাত্মাগণ কর্তৃক অভিষিক্ত হইয়া রাজধানীতে প্ৰবেশ করিলেন।
সকৃষ্ণ ভীমাৰ্জুনের স্বপুরে আগমন
এদিকে শ্ৰীমান পুরুষোত্তম ভুরি ভুরি রত্নজাত সংগ্ৰহ করিয়া ভীমার্জ্জুনের সহিত ইন্দ্রপ্রস্থে প্রস্থিত হইলেন এবং তথায় উপস্থিত হইয়া রাজা যুধিষ্ঠিরকে সম্বোধন করিয়া আনন্দের সহিত কহিতে লাগিলেন, মহারাজ! বৃকোদর বলবান জরাসন্ধকে নিপাতিত করিয়াছেন, কারারুদ্ধ ভূপতিগণও বন্ধনমুক্ত হইয়াছেন। ভাগ্যক্রমে ভীমসেন এবং ধনঞ্জয় কৃতকাৰ্য্য হইয়া অক্ষত-শরীরে স্বনগরে আগমন করিয়াছেন। রাজা যুধিষ্ঠির শ্রবণমাত্র আহ্লাদিত হইয়া বাসুদেবকে সমুচিত পূজা ও ভ্রাতৃদ্বয়কে আলিঙ্গন করিলেন। ভীমার্জ্জুন জরাসন্ধকে নিহত করিয়া জয়লাভ করিয়াছেন, ইহাতে সভ্রাতৃক যুধিষ্ঠিরের আর আহ্লাদের সীমা রহিল না। অনন্তর তাহারা বয়স অনুসারে সৎকার ও পূজা করিয়া ভূপতিগণকে বিদায় করিলেন। ভূপতিগণ যুধিষ্ঠির কর্তৃক অনুজ্ঞাত হইয়া প্ৰফুল্লচিত্তে উচ্চাবচ [সম অসম-প্রধান অপ্রধান] যানে আরোহণ করিয়া স্ব স্ব দেশে গমন করিলেন। বুদ্ধিমান শত্রুনিসূদন কৃষ্ণ পাণ্ডবগণ দ্বারা চিরশত্রু জরাসন্ধকে বিনষ্ট করিয়া ধর্ম্মরাজের অনুজ্ঞা লইয়া কুন্তী, কৃষ্ণা, সুভদ্রা, ভীমসেন, ধনঞ্জয় এবং ধৌম্যকে আমন্ত্ৰণ করিয়া ধর্ম্মরাজপ্রদত্ত মনস্তুল্যগামী সেই দিব্য রথে দশদিক মুখরিত করিয়া নিজনগরে যাত্ৰা করিলেন। তাহার গমনসময়ে অজাতশত্রু যুধিষ্ঠির প্রভৃতি পাণ্ডবগণ তাঁহাকে প্ৰদক্ষিণ করিলেন। রাজা যুধিষ্ঠির জরাসন্ধের বধসাধন ও গিরিদুর্গ হইতে বিধার্থনীত নরপদিদিগের উদ্ধার করায় তাঁহার যশোরাশি ক্রমে চারিদিকে বিস্তৃত হইয়া পড়িল। হে ভারতবংশাবতংস। জনমেজয়! এইরূপে পাণ্ডবগণ দ্রৌপদীর প্রীতিবৰ্দ্ধন ও তৎকালোচিত ধর্ম্মকামার্থ্যেপেতভাবে প্রজাপালনপূর্ব্বক পরম-সুখে বাস করিতে লাগিলেন।
জরাসন্ধবদ্ধপর্ব্বাধ্যায় সমাপ্ত।