গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

২৩. গৌড়ের সিংহাসন

ত্রয়োবিংশ পরিচ্ছেদ – গৌড়ের সিংহাসন

অমাবস্যার পরদিন প্রত্যূষে কর্ণসুবর্ণের অধিবাসীরা শয্যা ত্যাগ করিবার পূর্বেই শুনিল, রাজপথ দিয়া ডঙ্কা বাজাইতে বাজাইতে একদল পদাতিক সৈন্য চলিয়াছে। সকলে দ্বার গবাক্ষ খুলিয়া দেখিতে লাগিল। পথ দিয়া দীর্ঘ সর্পিল সেনাদল চলিয়াছে। তাহাদের পৃষ্ঠে চর্ম, হস্তে শল্য, কটিবন্ধে তরবারি। তাহারা রাজপ্রাসাদের দিকে চলিয়াছে।

সেনাদলের অগ্রভাগে একটি সুসজ্জিত রথ। রথের ছত্র নাই, মুক্ত রথে পাশাপাশি বজ্র ও কোদণ্ড মিশ্র দাঁড়াইয়া আছেন। কোদণ্ড মিশ্রের শীর্ণ হস্তে অশ্বের রশ্মি, তিনি রথ চালাইতেছেন। তাঁহাকে দেখিয়া মনে হয়, শুদ্ধ প্রাণশক্তির বলে তিনি দাঁড়াইয়া আছেন। কিন্তু তাঁহার চক্ষে বিজয় গর্ব পরিস্ফুট। তাঁহার পাশে বক্ষ বাহুবদ্ধ করিয়া বজ্র দাঁড়াইয়া। বজ্রের মাথায় ধাতুময় শিরস্ত্রাণ, বক্ষে বর্ম, মুখে বজ্রকঠোর দৃঢ়তা। সে অচঞ্চলচক্ষে সম্মুখ দিকে চাহিয়া আছে।

রথের অগ্রে অশ্বপৃষ্ঠে কোকবর্মা। সে কদাকার মুখে বিকৃত ভঙ্গিমা লইয়া অশ্বপৃষ্ঠে বসিয়া আছে, দেহে লৌহজালিক, হস্তে বিনিষ্ক্রান্ত অসি। সে দক্ষিণে বামে মর্কট-চক্ষু ফিরাইয়া পথিপার্শ্বস্থ জনগণের মুখভাব পর্যবেক্ষণ করিতেছে, যেন মুখ দেখিয়া তাহাদের মনোভাব নির্ণয়ের চেষ্টা করিতেছে।

সর্বাগ্রে শাসন-ডিণ্ডিম ধ্বনিত করিয়া ঘোষক পদব্রজে চলিয়াছে। চলিতে চলিতে ডিণ্ডিম থামাইয়া উচ্চকণ্ঠে ঘোষণা করিতেছে— নগরবাসিগণ, অবহিত হও। অগ্নিবর্মার কালান্ত হয়েছে। কিন্তু গৌড়ের সিংহাসন শূন্য নয়। পুরুষব্যাঘ্র মহারাজ শশাঙ্কদেবের পৌত্র, অমিতবীর্য মহারাজ মানবদেবের পুত্র পরমভট্টারক শ্রীমন্মহারাজ বজ্রদেব তাঁর পিতৃপুরুষের সিংহাসনে আরোহণ করলেন। তোমরা মহারাজ বজ্রদেবের জয় ঘোষণা কর।

নাগরিকেরা কিন্তু জয় ঘোষণা করিতেছে না। তাহারা উৎসুক নেত্রে শোভাযাত্রা নিরীক্ষণ করিতেছে, কিন্তু এই রাজ-পরিবর্তন ব্যাপারে নিজেদের অংশভাক্ মনে করিতেছে না। কোন রাজা মরিল, কোন নূতন রাজা আসিল, এ বিষয়ে তাহাদের কৌতূহল থাকিতে পারে কিন্তু তদধিক কিছু নয়। কে যাইবে রাজা মহারাজার ব্যাপারে মাথা গলাইতে? নিরুপদ্রবে বাঁচিয়া থাকিতে পারিলেই যথেষ্ট।

জনগণের মধ্যে কেবল একদল লোক এই আকস্মিক ঘটনাসম্পাতে হতবুদ্ধি হইয়া পড়িয়াছিল। তাহারা জয়নাগের দল। জয়নাগের ষড়যন্ত্র প্রায় সম্পূর্ণ হইয়া আসিয়াছিল; সাধারণ যাত্রিকের বেশে তাঁহার দলের পাঁচ সহস্র যোদ্ধা কর্ণসুবর্ণে প্রবেশ করিয়াছিল। স্বয়ং জয়নাগ ছদ্মবেশে উপস্থিত ছিলেন। গৌড়ের সেনাপতিরা যে-সময় দণ্ডভুক্তির সীমান্ত ঘিরিয়া বসিয়া জয়নাগের গতিরোধের চেষ্টা করিতেছিলেন, চতুর জয়নাগ সেই অবকাশে জলপথে কর্ণসুবর্ণে প্রবেশ করিয়া রাজ্যের কেন্দ্রস্থান অধিকার করিবার কৌশল করিয়াছিলেন। গৌড়ের সেনাপতিগণ যতক্ষণে সংবাদ পাইয়া রাজধানী রক্ষার জন্য ফিরিবে, ততক্ষণে পশ্চাৎ হইতে আক্রান্ত এবং সম্মুখে প্রতিবদ্ধ হইয়া ইতোনষ্টস্ততোভ্রষ্ট হইয়া যাইবে। জয়নাগের এই কূটকৌশল কার্যে পরিণত হইতে আর দুই চারিদিন মাত্র বিলম্ব ছিল, সহসা এই নূতন সংস্থার উদ্ভব হইয়া তাঁহাকে বিচলিত করিয়া তুলিল।

সে যাহা হউক, কোকবর্মার সৈন্যদল ডঙ্কা বাজাইতে বাজাইতে রাজপুরীর সম্মুখে উপস্থিত হইল। অগ্নিবর্মার মৃত্যুসংবাদ রাজপুরীতে গোপন ছিল না, রক্ষী প্রতীহার দৌবারিক যে যেখানে ছিল পলায়ন করিয়াছিল। তৎপরিবর্তে কোদণ্ড মিশ্রের সংগৃহীত দুইশত পণ্য-যোদ্ধা পুরদ্বার রক্ষা করিতেছিল। ইহারা খস্-পুক্‌কস-হূণ-যবন শ্রেণীর যোদ্ধা; ইহাদের দেশ নাই, জাতি নাই, যে বেতন দিবে তাহার জন্যই যুদ্ধ করিবে। ইহারা দুর্ধর্ষ যোদ্ধা, যাহার বেতন লইয়াছে তাহার সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করে না।

কোদণ্ড মিশ্রের আজ্ঞায় তাহারা তোরণদ্বার খুলিয়া দিল। কোকবর্মা সদলবলে পুরভূমিতে প্রবেশ করিল এবং পঞ্চাশজন বাছা বাছা অনুচর লইয়া অন্তঃপুর অভিমুখে ধাবিত হইল। আর সকলে পুরী লুণ্ঠন করিতে আরম্ভ করিল। চিৎকার আর্তনাদ হুড়াহুড়ির শব্দে রাজপুরী পূর্ণ হইয়া উঠিল।

কোদণ্ড মিশ্র বজ্রকে লইয়া রাজভবনের একদিকে চলিলেন। খস্-পুক্‌কসদের কয়েকজন প্রধান যোদ্ধা রক্ষিরূপে তাঁহাদের সঙ্গে রহিল।

কোদণ্ড মিশ্র রাজার প্রমোদভবনে উপনীত হইলেন। লুণ্ঠনকারীরা এখনও এদিকে আসে নাই, কেবল একজন পুরুষ প্রমোদভবনের দ্বারে দাঁড়াইয়া আছে, সে রাজার অন্তরঙ্গ অর্জুনসেন। তাহার কেশকলাপ সুবিন্যস্ত, চক্ষু দুটি উজ্জ্বল, বাষ্পোৎফুল্ল। অর্জুনসেন প্রফুল্ল মুখে বলিল— ‘আর্য কোদণ্ড মিশ্র, আমার প্রণাম গ্রহণ করুন। মহারাজের জয় হোক।’

কোদণ্ড মিশ্র বলিলেন— ‘অগ্নিবর্মার দেহ কোথায়?’

‘এই যে। আসুন।’ অর্জুনসেন অগ্রবর্তী হইয়া তাহাদের ভিতরে লইয়া গেল। বিশাল ভবন শূন্য, ছায়ান্ধকার; রাত্রির ক্লেদ যেন এখনও তাহার বাতাসে লাগিয়া আছে। কোথাও পলাতকা সভানন্দিনীর দেহচ্যুত রঙ্গিন উত্তরীয় রক্তরেখার ন্যায় পড়িয়া আছে, কোথাও স্খলিত নূপুর গড়াগড়ি যাইতেছে। কৃষ্ণবর্ণ শিলাকুট্টিমের উপর শুভ্র বস্ত্রাচ্ছাদিত একটি শব। অর্জুনসেন বস্ত্রের প্রান্ত তুলিয়া দেখাইল। মৃত্যুর কঠিন স্পর্শে অগ্নিবর্মার কামনা-বিধ্বস্ত দেহ চিরতরে স্থির হইয়াছে।

বজ্র একবার সেইদিকে দেখিয়া চক্ষু ফিরাইয়া লইল। কোদণ্ড মিশ্র কিয়ৎকাল মৃত মুখের উপর দৃষ্টি রাখিয়া বিতৃষ্ণাসূচক মুখভঙ্গি করিলেন, তারপর রক্ষীদের বলিলেন— ‘মৃতদেহ গঙ্গার জলে নিক্ষেপ কর। হয়তো সদ্‌গতি হবে।’

অগ্নিবর্মার দেহ প্রাকারশীর্ষ হইতে ভাগীরথীর জলে নিক্ষিপ্ত হইল। বজ্র ভাবিল তাহার পিতার দেহও এই পথে গিয়াছিল! গৌড় রাজগণের রাজপুরী হইতে নির্গমনের ইহাই বুঝি একমাত্র পথ।

অতঃপর সকলে সভাগৃহে আসিলেন।

ওদিকে রাজ-অবরোধে যে বীভৎস ব্যাপার চলিতেছিল তাহার বর্ণনা নিষ্প্রয়োজন। বেলা দ্বিপ্রহরে কোকবর্মা ও তাহার সৈন্যগণ লুণ্ঠনকার্য শেষ করিয়া লুণ্ঠিত দ্রব্য পুরপ্রাঙ্গণে রক্ষণ করিল; রানী শিখরিণীকে দোলায় তুলিল। তারপর বিদায় গ্রহণের পূর্বে কোকবর্মা কোদণ্ড মিশ্রের সহিত সাক্ষাৎ করিতে আসিল। কার্যসিদ্ধির দম্ভে তাহার কদর্য মুখ আরও কদর্য আকার ধারণ করিয়াছে, মদমত্ততার বশে দেহ টলিতেছে। সে উচ্চ বিকৃতকণ্ঠে হাস্য করিয়া বলিল— ‘ঠাকুর, আমার কাজ শেষ হয়েছে, এবার আমি চললাম। তোমার রাজা আর তুমি মনের সুখে রাজত্ব কর।’ বলিয়া আবার ধৃষ্টতা-ভরা হাসি হাসিল।

কোকবর্মাকে দেখিয়া বজ্রের অন্তর দুঃসহ ঘৃণায় ভরিয়া উঠিয়াছিল। নরকের পশুটাকে পদাঘাত করিবার প্রবল ইচ্ছা দমন করিয়া সে মুখ ফিরাইয়া বাতায়ন সম্মুখে গিয়া দাঁড়াইল।

কোকবর্মা বোধহয় কোদণ্ড মিশ্র ও বজ্রের নিকট বহু প্রশস্তি ও চাটুবচন আশা করিয়াছিল, কিন্তু বজ্রকে মুখ ফিরাইয়া চলিয়া যাইতে দেখিয়া তাহার ক্ষুদ্র চক্ষু ক্রোধে জ্বলিয়া উঠিল। সে শ্বাপদের ন্যায় দশন নিষ্ক্রান্ত করিয়া বলিল— ‘কুকুরের মাথায় রাজছত্র কতদিন থাকে দেখব।’

বজ্র বিদ্যুদ্বেগে ফিরিয়া দাঁড়াইল। কিন্তু কোকবর্মা উচ্চ ব্যঙ্গহাস্য করিতে করিতে দ্রুতপদে সভাগৃহ ছাড়িয়া চলিয়া গেল। তাহার মনে যতই গরল থাক, বজ্রের সহিত বাহুযুদ্ধে প্রবৃত্ত হইবার দুঃসাহস তাহার নাই।

দুই দণ্ডের মধ্যে কোকবর্মার দল রাজপুরী ত্যাগ করিল। কোদণ্ড মিশ্রের সৈন্যদল তখন পুরী রক্ষার ভার লইল। তোরণে প্রাকারশীর্ষে সর্বত্র ধনুর্ধর রক্ষিগণ পাহারা দিতে লাগিল।

সভাগৃহে বজ্র ও কোদণ্ড মিশ্র ভিন্ন আর কেহ ছিল না; একটি রমণী দ্বারের নিকট উঁকি মারিল। বজ্র অমনি ছুটিয়া গিয়া তাহার হাত ধরিল— ‘কুহু। তুমি কোথায় ছিলে?’

কুহু হাসিয়া বলিল— ‘লুকিয়ে ছিলাম।’ তারপর নতজানু হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে বলিল— ‘শ্রীমন্মহারাজ বিজদেবের জয় হোক।’

বজ্রের মুখ কঠিন হইল। সে কুহুকে হাত ধরিয়া তুলিয়া কিছু বলিবার উপক্রম করিতেছিল, কোদণ্ড মিশ্র আসিয়া বলিলেন— ‘কুহু! ভালই হল। এখনই রাজার অভিষেক হবে। আজই অভিষেক করব। তুমি ব্যবস্থা কর।’

কুহু সবিস্ময়ে বলিল— ‘সে কি ঠাকুর। লোকজন কৈ, সভাসদ কৈ? কার সাক্ষাতে অভিষেক হবে?’

কোদণ্ড মিশ্র বলিলেন— ‘আমি নগরে খবর দিয়েছি, প্রধান নাগরিকেরা এখনি আসবে। যদি না আসে তবু আমি একাই অভিষেক করব।’

‘ভাল।’ বলিয়া কুহু অভিষেকের ব্যবস্থা করিতে গেল।

প্রধান নাগরিকেরা আসিলেন না, কেহই আসিল না। কোদণ্ড মিশ্র কয়েকজন রক্ষীকে ডাকিয়া রাজসভায় সমবেত করিলেন। অবরোধে যে-কয়েকজন প্রৌঢ়া নারী অবশিষ্টা ছিল তাহারা আসিয়া হুলুধ্বনি করিল, লাজাঞ্জলি ছড়াইল; কুহু শঙ্খধ্বনি করিল। কোদণ্ড মিশ্র বজ্রের ললাটে রাজটিকা পরাইয়া দিলেন। বজ্র পিতৃপুরুষের সিংহাসনে বসিল। এইভাবে অভিষেকের হাস্যকর অভিনয় সম্পন্ন হইল।

সভা আবার শূন্য হইলে কোদণ্ড মিশ্র সভাগৃহের এক প্রান্তে একটি বেদিকার উপর শয়ন করিলেন। বৃদ্ধের মনের অবস্থা অনুমান করা যায় না, কিন্তু দেহ যে ক্লান্তির শেষ সীমায় পৌঁছিয়াছে তাহাতে সন্দেহ নাই। গত তিন চারিদিন যাবৎ তিনি অন্নজল গ্রহণ করেন নাই, নিদ্রাও যান নাই; এক সর্বগ্রাসী ভাবনা তাঁহাকে আবিষ্ট করিয়া রাখিয়াছে। তিনি চক্ষু মুদিত করিয়া বেদিকার উপর শয়ান রহিলেন।

সভাগৃহের অন্য প্রান্তে বসিয়া কুহু ও বজ্র নিম্নস্বরে কথা বলিতেছিল।

বজ্র জিজ্ঞাসা করিল— ‘অবরোধের অবস্থা কি?’

কুহু বলিল— ‘ভাল নয়। যেন কদলী বনে একপাল বুনো হাতি ঢুকেছিল।’

‘আর রানী?’

কুহু মলিন মুখে বলিল— ‘রানীকে কোকবর্মা ধরে নিয়ে গেছে। ভেবেছিলাম আমার আনন্দ হবে, কিন্তু দেখে কান্না এল।’

বজ্র সহসা বলিল— ‘কুহু, চল এবার পালিয়ে যাই।’

কুহু বিস্ফারিত চক্ষে চাহিয়া বলিল— ‘সে কি, কোথায় পালিয়ে যাবেন?’

‘যেখানে হোক। রাজা তো হলাম, আর কি!’ বলিয়া বজ্র একটু তিক্ত হাসিল।

‘কিন্তু— কিন্তু— এখনও যে সবই বাকি!’

‘থাক বাকি। সত্যি বলছি, কুহু, আমার রাজা হওয়ার সাধ মিটে গেছে, নাগরিক জীবনে ঘৃণা জন্মেছে। এ জীবনযাত্রা আমার জন্যে নয়। আমি চলে যেতে চাই।’

কুহু গালে আঙ্গুল রাখিয়া চিন্তা করিল, বজ্রের মুখের উপর গুপ্ত স্নেহদৃষ্টি বুলাইল, শেষে কোদণ্ড মিশ্রের দিকে মাথা নাড়িয়া বলিল— ‘কিন্তু উনি? আপনি যদি চলে যান ওঁর কি অবস্থা হবে?’

বজ্র নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল— ‘সেই একটা কথা। ওঁর এই রাজা-রাজা খেলা দেখে কৌতুক আর করুণা দুইই অনুভব করছি, কিন্তু ওঁকে ছেড়ে যেতে পারছি না।’

বেলা তৃতীয় প্রহরে একজন গূঢ়পুরুষ সংবাদ লইয়া আসিল। বলিল— ‘জয়নাগ ছয় হাজার সৈন্য নিয়ে রাজপুরীর দিকে আসছেন।’

কোদণ্ড মিশ্র উঠিয়া বসিলেন— ‘জয়নাগ!’

গুপ্তচর জয়নাগ সম্বন্ধে সামান্য যাহা সংবাদ পাইয়াছিল তাহা বলিল। শুনিয়া কোদণ্ড মিশ্র শূন্য দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিলেন।

অল্পকাল পরে দ্বিতীয় গুপ্তচর আসিল। সে সংবাদ দিল— ‘কোকবর্মা জয়নাগের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। দু’জনে একসঙ্গে পুরী অধিকার করতে আসছে।’

কোদণ্ড মিশ্রের কণ্ঠমধ্যে অস্পষ্ট একটি শব্দ হইল। তিনি ধীরে ধীরে আবার শয়ন করিলেন।

সঙ্কল্পিত কর্মে সহসা অপ্রত্যাশিত বাধা পাইয়া জয়নাগ চারিদিকে গুপ্তচর প্রেরণ করিয়াছিলেন। তাহারা যে সংবাদ লইয়া আসিল তাহাতে তিনি যথেষ্ট আশ্বস্ত হইলেন। বজ্রদেব নামক এক যুবক নিজেকে মানবদেবের পুত্র বলিয়া পরিচয় দিয়া অগ্নিবর্মাকে হত্যা করিয়াছে এবং নিজে রাজা হইয়া বসিয়াছে। তাহার পৃষ্ঠপোষক কেবল কোদণ্ড মিশ্র নামধারী এক বৃদ্ধ ব্রাহ্মণ এবং দুই সহস্র সেনার অধিনায়ক কোকবর্মা।

কোকবর্মার পরিচয় জয়নাগ পূর্বেই সংগ্রহ করিয়াছিলেন। তাহার দুই হাজার সৈন্য ব্যতীত অন্য কোনও রাজকীয় সেনাদল উপস্থিত কর্ণসুবর্ণে নাই। কোকবর্মার সেনাদল উত্তম যোদ্ধা বটে, কিন্তু কোকবর্মা স্বয়ং অতি হীন চরিত্র ব্যক্তি। উপযুক্ত উৎকোচ পাইলে সে যুদ্ধ করিবে না।

তারপর জয়নাগ সংবাদ পাইলেন, কোকবর্মা রাজপুরী লুঠপাট করিয়া সসৈন্যে নগরের বাহিরে চলিয়া যাইতেছে। জয়নাগ এই বিচিত্র সংবাদে উদ্বিগ্ন হইলেন, কোকবর্মা কোথায় যাইতেছে, কি জন্য যাইতেছে বুঝিতে পারিলেন না। কিন্তু তিনি ত্বরিতকর্মা কূটনীতিজ্ঞ ব্যক্তি; তিনি তৎক্ষণাৎ কোকবর্মার নিকট দূত পাঠাইলেন।

কর্ণসুবর্ণে কোকবর্মার বাসভবন ও সেনানিবাস ছিল। দূত সেখানে না গিয়া নগরের উত্তর তোরণের নিকট কোকবর্মাকে ধরিল। জনান্তিকে উভয়ে কথা হইল। দূতের প্রস্তাব শুনিয়া কোকবর্মার পাপবুদ্ধি আবার জাগ্রত হইল। সে বলিল— ‘জয়নাগের প্রস্তাবে আমি সম্মত। তিনি যে গৌড় গ্রাস করবেন তা আগেই জানতাম, তাই সময় থাকতে কর্ণসুবর্ণ ছেড়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু তিনি যখন আমাকে তাঁর সেনাপতিদের মধ্যে স্থান দিচ্ছেন তখন আমি তাঁর দলে; যে কুকুরটাকে আমি সিংহাসনে বসিয়েছি, তাকে আমিই সিংহাসন থেকে নামিয়ে দেব। জয়নাগকে কোনও কষ্টই করতে হবে না।’

নিয়তির দ্বারা আকৃষ্ট হইয়া কোকবর্মা ফিরিয়া চলিল। ইতিমধ্যে জয়নাগ প্রকাশ্যভাবে নিজে সৈন্যদের সমবেত করিতে আরম্ভ করিয়াছিলেন, গোপনতার আর প্রয়োজন ছিল না। কোকবর্মা লুণ্ঠিত দ্রব্যাদি এবং বন্দিনী রানীকে নিজভবনে পাহারার মধ্যে রাখিয়া জয়নাগের সঙ্গে যোগ দিল।

জয়নাগ স্থির করিয়াছিলেন নূতন রাজাকে শক্তি সংগ্রহ করিবার সময় দেওয়া হইবে না, গাছ শিকড় গাড়িবার পূর্বেই তাহাকে উৎপাটিত করিতে হইবে। তিনি কোকবর্মাকে পার্শ্বে লইয়া সম্মিলিত সৈন্যদলের অগ্রে অশ্বপৃষ্ঠে চলিলেন। নগরের অধিবাসিগণ প্রাতঃকালে যেমন শোভাযাত্রা দেখিয়াছিল অপরাহ্ণেও তেমনি শোভাযাত্রা দেখিল। কেহ একটি অঙ্গুলি উত্তোলন করিল না।