আলো জ্বলে উঠতেই কাকাবাবু ঘরের ভেতরটা স্পষ্ট দেখতে পেলেন। তখনও তিনি কুকুরটার মুখ শক্ত করে ধরে আছেন। কুকুরটাকে নিয়ে মহা মুশকিল, ছেড়ে দিলেই ও কামড়াতে আসে। অনেক রকম আদর করলেও সে শান্ত হয় না, সারা শরীর কুঁকড়ে সে ছাড়া পেতে চাইছে।
ঘরটার একদিক জুড়ে রয়েছে বিরাট একটা যন্ত্র। তার ঠিক মাঝখানে সেই আলোটা জ্বলছে। যন্ত্রটা দেখলেই কেমন যেন ভয়-ভয় করে, মনে হয় যেন এক একচক্ষু দানব। কিছু প্যাকিং বাক্স ছড়ানো আছে চারদিকে, কাকাবাবু দুএকটা বাক্স খুলে দেখলেন তার মধ্যে রয়েছে নানারকম যন্ত্রপাতির অংশ।
লাল চক্ষুওয়ালা যন্ত্রটার দিকে কাকাবাবু চেয়ে রইলেন একটুক্ষণ। যন্ত্রপাতি সম্পর্কে তাঁর বেশি জ্ঞান নেই, ওটা কিসের যন্ত্র তিনি বুঝতে পারলেন না। একবার ভাবলেন, এটা কি কমপিউটার? হিমালয়ের এই দুৰ্গম জায়গায় মাটির নীচে ঘর বানিয়ে কী ভাবে এরা এই এতবড় একটা যন্ত্র বসাল সে-কথা ভেবে আশ্চর্য হয়ে গেলেন কাকাবাবু।
এক পা এক পা করে তিনি যন্ত্রটার দিকে এগিয়ে গেলেন। হঠাৎ তাঁর মনে পড়ল, এই যন্ত্রটায় হাত দিলেই যে কিছু বিপদ ঘটবে, তা তো হতে পারে না। কুকুরটা এই ঘরের মধ্যে ছিল, কুকুরটা এই যন্ত্রটা নিশ্চয়ই দু একবার টুয়েছে, ওর তো কিছু হয়নি!
কাকাবাবু যন্ত্রটার খুব কাছে এগিয়ে যেতেই পেছন দিকের দরজায় দুম-দুম শব্দ হল।
কাকাবাবু ফিরে দেখলেন, দরজাটা লোহার তৈরি এবং খুব মজবুত। তিনি খিল আটকে দিয়েছেন, আর বাইরে থেকে খোলার সাধ্য কারুর নেই। এখন এই ঘরের মধ্যেই তিনি নিরাপদ।
বাইরে থেকে কেইন শিপটনের গলার আওয়াজ শোনা গেল, মিঃ রায়চৌধুরী, ডোনট বিহেভ লাইক আ ফুল। দরজা খুলে দাও।
কাকাবাবু বললেন, না, আমি দুঃখিত, এখন দরজাটা খুলতে পারছি না?
কেইন শিপটন বলল, শিগগির খোলো? কাকাবাবু বললেন, আমি ব্যস্ত আছি। একটু। প্লীজ আমায় বিরক্ত কোরো না।
কেইন শিপটন বলল, এক্ষুনি খুলে দাও, নইলে ব্লাস্ট করে আমরা দরজাটা ভেঙে ফেলব।
কাকাবাবু বললেন, তোমাদের দরজা তোমরা ভাঙবে, এতে আমার কী করার আছে। ইচ্ছে হলে ভাঙো।
কাকাবাবু যন্ত্রটার সামনে গিয়ে দাঁড়ালেন। বিভিন্ন রঙের অনেকগুলো বোতাম যন্ত্রটার গায়ে সার-স্যার সাজানো। কাকাবাবু সাহস করে একটা বোতাম টিপলেন।
অমনি যন্ত্রটার মধ্য থেকে খুব জোরে আওয়াজ বেরিয়ে এল, টু টু নাইন। কে ওয়াই সেভেন সেভেন। আলফা ওমেগা-
আওয়াজটা এত হঠাৎ আর এত জোরে হল যে, কাকাবাবু চমকে খানিকটা পিছিয়ে এলেন। যন্ত্র তো কথা বলতে পারে না, নিশ্চয়ই ওর মধ্যে রেকর্ড করা আছে। এগুলো কোনও সাঙ্কেতিক সূত্র।
ক্লেইন শিপটন বলল, খবরদার ঐ যন্ত্রে আর হাত দিও না, তুমি মরে যাবে। দরজা খোলো, তোমার ভাইপো সম্পর্কে জরুরি কথা আছে।
এ দুটোই যে ধাপ্পা, তা বুঝতে একটুও অসুবিধে হল না। কাকাবাবুর। তিনি হাসলেন।
কেইন শিপটনকে তিনি বললেন, তার চেয়েও জরুরি কাজে আমি ব্যস্ত আছি, ওসব কথা পরে হবে।
কাকাবাবু আর-একটা বোতাম টিপতেই ফটাস করে যন্ত্রটার খানিকটা স্ক্রিপ্রংয়ের ডালার মতন খুলে গেল। ভেতরটায় কাচের ঢাকা দেওয়া অনেকগুলো ঘড়ির মতন জিনিস। সেগুলোর মধ্যে বিকিঝিকি শব্দ হচ্ছে। কাকাবাবু ওতে হাত দিলেন না। তিনি আর-একটা বোতাম টিপলেন, তখন যন্ত্রটা দিয়ে বীপ বীপবীপ বীপ শব্দ হতে লাগল।
দরজার বাইরে থেকে কেইন শিপটন পাগলের মতন চিৎকার করছে। কাকাবাবু ওর কথায় আর কোনও উত্তর দিলেন না। কেইন শিপটন কেন এত ক্ষেপে যাচ্ছে তা কাকাবাবু এবার বুঝতে পারলেন। এই যন্ত্রটা বাইরে খবর পাঠায়। কাকাবাবু নানারকম বোতাম এক সঙ্গে টিপে দিলে যন্ত্রটা নানারকম উল্টেপোল্ট খবর এক সঙ্গে পাঠাতে শুরু করবে। তার ফলে, যে-দেশে এই খবরগুলো যাওয়ার কথা সেখানে বুঝে যাবে যে এখানে কিছু গণ্ডগোল হয়েছে। কেইন শিপটন তা জানাতে চায় না।
কেইন শিপটন বলল, রায়চৌধুরী, শোনো। তোমাকে একটা সুযোগ দিচ্ছি। তুমি যদি দরজা খুলে বেরিয়ে আসো, আমরা তোমার কোনও ক্ষতি করব না। তোমাকে মুক্তি দেব।
কাকাবাবু বললেন, তাই নাকি, হঠাৎ এত উদার হলে যে?
যন্ত্রটায় হাত দিও না! তুমি জানো না, ওর মধ্যে একটা বোতাম টিপলে এই পুরো জায়গাটাই বিস্ফোরণে উড়ে যাবে?
এই কথা আমাকে বিশ্বাস করতে বলে?
আমি সত্যিই বলছি।
বেশ তো। তোমাদের হাত থেকে ছাড়া পাবার যখন কোনও উপায় নেই, তখন এই পুরো জায়গাটা আমি বিস্ফোরণে উড়িয়ে দিতেই চাই।
তোমাকে আমরা বাঁচার সুযোগ দিচ্ছি। তোমার ভাইপোকেও আমরা ছেড়ে দেব।
আমার ভাইপো কোথায়?
সে এখানেই আছে।
তাকে কথা বলতে বলো। তার গলা শুনতে চাই।
এবার কেইন শিপটন চুপ করে গেল। তার মিথ্যে ধরা পড়ে গেছে। সন্তুকে এখনও ওরা ধরতে পারেনি। সাত-আটজন লোক মিলে সন্তুকে তাড়া করলেও এখনও সন্তুকে ওরা ধরতে পারেনি। সন্তু নানান সুড়ঙ্গের মধ্যে ওদের সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে।
কেইন শিপটন তার সঙ্গীদের প্রচণ্ড ধমক দিয়ে বলল, এখনও তোমরা ছেলেটাকে ধরতে পারলে না? অপদার্থের দল?
কাকাবাবু একটুক্ষণ থেমে রইলেন। কেইন শিপটন যে বলল, একটা বোতাম টিপলে পুরো জায়গাটাই বিস্ফোরণে উড়ে যাবে, সে-কথা কি সত্যি? গুপ্তচরদের মধ্যে অনেক সময় এরকম ব্যাপার থাকে। ধরা দেবার বদলে তারা নিজেরাই সব কিছু ধ্বংস করে দেবার ব্যবস্থা রাখে। কিন্তু এখান থেকে পালাবার কি আর অন্য রাস্তা নেই? কেইন শিপটনের দলবল পালাতে চাইছে না কেন?
কাকাবাবু চেঁচিয়ে বললেন, কেইন শিপটন, এবার আমি তোমাদের হুকুম দিচ্ছি, শোনো। যদি প্ৰাণে বাঁচতে চাও, পালাও! আমি পরপর সবকটা বোতামই টিপব শেষ পর্যন্ত!
কেইন শিপটন বলল, ব্লাড ফুল, তা হলে তুমিও মরবে!
তোমাদের হাতে মরার চেয়ে তোমাদের সকলকে ধবংস করে মরা অনেক ভাল।
রায়চৌধুরী, এদিকে এসো, দরজার কাছে, প্লীজ, একটা কথা শোনে—
কাকাবাবু এরই মধ্যে একটা অজগর সাপের ফোঁসফোঁসানির মতন শব্দ শুনতে পেলেন। শব্দ। কিন্তু ঐ যন্ত্রটা থেকে আসছে না। একটু লক্ষ করতেই কাকাবাবু টের পেলেন শব্দটা আসছে। দরজার বাইরে থেকে। এটাও বুঝতে পারলেন, শব্দটা আগুনের। লোহা-গালানো আগুন দিয়ে ওরা দরজাটা গালিয়ে ফেলতে চাইছে। কিংবা দরজার গায় একটা ফুটো করতে পারলেই সেখান দিয়ে ওরা কাকাবাবুকে গুলি করতে পারবে। সেই সময়টুকু কাটাবার জন্য কেইন শিপটন কথা বলে কাকাবাবুকে ভুলিয়ে রাখতে চাইছে।
আর কোনও উত্তর না দিয়ে কাকাবাবু যন্ত্রটার এক পাশে সরে এসে দাঁড়ালেন, দরজাটা গালিয়ে ফেললে আবার তাঁকে ধরা পড়তেই হবে। এবার আর ওরা ছাড়বে না।
তিনি বোতামগুলো পরীক্ষা করতে লাগলেন। কোন বোতামটা সবচেয়ে সাঙ্ঘাতিক সেটা বোঝার উপায় নেই। কাকাবাবু নিজের মৃত্যুর জন্য চিন্তা করেন না, কিন্তু সন্তুর কথা ভেবে একটু দ্বিধা করতে লাগলেন। সন্তু এখনও ধরা পড়েনি, বিস্ফোরণে সব কিছু উড়িয়ে দিলে সন্তুও মারা পড়বে!
এখনও চোদ্দটা বোতাম টেপা বাকি আছে, এর মধ্যে সেইটা কোনটা? অথচ বেশি সময়ও হাতে নেই। কাকাবাবু একটা হলুদ বোতাম টিপে দিলেন।
সঙ্গে-সঙ্গে এমন একটা ব্যাপার হল যে, কাকাবাবু আনন্দে ওঃ বলে উঠলেন। হলুদ বোতামটা টিপতেই মাথার ওপর সর-সর শব্দ করে ঘরের ছাদটা খুলে গেল। দেখা গেল আকাশ। কাকাবাবুর মনে হল, তিনি যেন কতকাল পরে আকাশ দেখলেন! বুক ভরে নিশ্বাস নিতে লাগলেন বারবার।
কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া এসে লাগল। তাঁর গায়ে।
ছাদটা খুলে গেলেও দেয়ালগুলো বেশ উঁচু। কাকাবাবুর পক্ষে লাফিয়ে ওপরে ওঠা অসম্ভব। এখনও তাঁর মুক্তি পাবার তেমন আশা নেই। কিন্তু তিনি প্রথমেই একটা কাজ করলেন।
এক হাতে তিনি তখনও কুকুরটাকে শক্ত করে ধরে ছিলেন, এবার দু হাতে কুকুরটাকে ধরে খুব জোরে বাইরে ছুঁড়ে দিয়ে বললেন, যাঃ!
কুকুরটা বাইরে বরফের ওপর পড়ে ঘেউ-ঘেউ করে প্রচণ্ড জোরে ডাকতে লাগল।