পার্থ বলিলেন, শুন বিরাট কুমার।
যেই হেতু যেই নাম, হইল আমার।।
দুই ভুজে ধনু আমি ধরি সমান।
সমান প্রয়োগ অস্ত্র, সমান সন্ধান।।
গুণের ঘর্ষণে দেখ কঠিন দুহাত।
তেঁই সব্যসাচী নাম লোকে হৈল খ্যাত।।
সসাগরা ধরাতলে রহে যত জন।
রূপেতে আমার সম নাহি অন্য জন।।
সমান দেখিয়া সবে মোর রূপ গুণ।
এ কারণে মম নাম রাখিল অর্জ্জুন।।
ফল্গুনি নক্ষত্র মধ্যে জনম আমার।
ফাল্গুনী বলিয়া তেঁই ঘোষয়ে সংসার।।
চতুর্দ্দশ ভুবনেতে ইন্দ্র-অধিপতি।
ইন্দ্র ভুজাশ্রিত যত ইতিমধ্যে স্থিতি।।
সবারে জিনিয়া ইন্দ্র জিষ্ণু নাম ধরে।
এবে ইন্দ্র সহ জয় করিনু সবারে।।
সে কারণে সবে মিলি যত দেবগণ।
জিষ্ণু নাম মোরে সবে করেন অর্পণ।।
নীলোৎপল কৃষ্ণবর্ণ দেখি মম কায়।
কৃষ্ণ নাম বলি তাত রাখিল আমার।।
প্রতিজ্ঞা আমার শুন বিরাটনন্দন।
যুধিষ্ঠির রক্তপাত করিবে যে জন।।
সবংশে মারিয়া তারে করিব নিপাত।
পূর্ব্বাপর সত্য মম, সব লোকে জ্ঞাত।।
এত শুনি রাজসুত ক্ষণ স্তব্ধ হয়ে।
কহিতে লাগিল পুনঃ প্রণাম করিয়ে।।
হে বীর কমল-চক্ষে চাহ একবার।
অজ্ঞানের অপরাধ ক্ষমহ আমার।।
বহুদোষে দোষী আমি তোমার চরণে।
সে সকল কিছু আর না করিবে মনে।।
যে যে কর্ম্ম তুমি করিয়াছ মহামতি।
তোমা বিনা করে হেন কাহার শকতি।।
বড় ভাগ্য মম জনকের কর্ম্মফলে।
শরণ লইনু আমি তব পদতলে।।
কৃষ্ণের আশ্রিত যেন তোমা পঞ্চ জন।
তেন আমি তব পদে নিলাম শরণ।।
যদি অনুগ্রহ তুমি করিলে আমায়।
দাস হয়ে সদা আমি সেবিব তোমায়।।
অর্জ্জুন বলেন, প্রীত হলেম তোমারে।
ধনু অস্ত্র লয়ে তুমি আইস সত্বরে।।
কুরুগণে জিনি তব গোধন অর্পিব।
মহা আর্ত্ত আজি কুরুসৈন্যেরে করিব।।
কুরুসৈন্য সিন্ধু রাখে শত্রুগণ ভুজে।
সকল দহিব আমি অস্ত্র অগ্নিতেজে।।
পাছে তুমি ভয় কর সংগ্রামের স্থলে।
আমার রক্ষণে তব ভয় নাহি তিলে।।
উত্তর বলিল, মোর আর ভয় কারে।
ধনঞ্জয় মহাবীর রাখিবে যাহারে।।
তব পরাক্রম আমি ভালমাতে জানি।
নাহি মোর ভয়, যতি আসে শূলপাণি।।
এ বড় অদ্ভুত কথা জাগে মোর মনে।
এ রূপেতে কাল কাট কিসের কারণে।।
কি কারণে নপুংসক হৈলে মহাবল।
ইহার বৃত্তান্ত মোরে কহিবে সকল।।
নিরন্তর এই কথা মনে মোর ছিল।
এ হেন শরীরে কেন ক্লীবত্ব পাইল।।
অর্জ্জুন বলেন, শুন বিরাট-নন্দন।
অরণ্যেতে যবে মোরা ছিনু পঞ্চ জন।।
যুধিষ্ঠির আজ্ঞা লয়ে যাই হিমগিরি।
শিবেরে সন্তোষ কৈনু উগ্র তপ করি।।
তুষ্ট হৈল পশুপতি দেব ত্রিলোচন।
তাঁর অনুগ্রহে তুষ্ট হৈল দেবগন।।
কুবের বরুণ যম অস্ত্রগণ দিল।
মাতলি পাঠায়ে ইন্দ্র স্বর্গে মোরে নিল।।
নিবাতকবচ আর কালকেয় গণ।
স্বর্গে আসি উপদ্রব করে সর্ব্বক্ষণ।।
লুটিয়া পুটিয়া স্বর্গ করে ছারখার।
দৈত্য-ভয়ে দেবে দুঃখ হইল অপার।।
সব দুষ্টগণে আমি একা সংহারিনু।
সকল অমরপুরী নিষ্কণ্টক কৈনু।।
যতেক অমরগণ আনন্দিত হৈল।
তুষ্ট হয়ে দেবগণ মোরে বর দিল।।
ধন্য ধন্য ধনঞ্জয় কুন্তীর নন্দন।
তোমা সম বীর নাই এ তিন ভুবন।।
অচিরে হইবে তব দুঃখ বিমোচন।
কৌরব জিনিয়া প্রাপ্ত হবে রাজ্যধন।।
এরূপে অমরপুরী আছি কত দিন।
নানাবিদ্যা শস্ত্র-শাস্ত্র করিনু পঠন।।
দৈবে একদিন পিতা দেব পুরন্দর।
নৃত্যগীত করাইল অপ্সরী অপ্সর।।
ঊর্ব্বশী নামেতে তাহে ছিল বিদ্যাধরী।
সবার সে শ্রেষ্ঠা হয় পরমা সুন্দরী।।
যত যত বিদ্যাধরী কৈল নৃত্য গীত।
চক্ষু মেলি নাহি চাহিলাম কদাচিত।।
দেখিলাম ঊর্ব্বশীর নর্ত্তন নিমিষে।
সে কারণে নিশাযোগে আসে মম পাশে।।
প্রার্থিল কামতৃষ্ণা করিবারে পূরণ।
প্রত্যাখান করিলে সে কহিল তখন।।
সকল অপ্সরা ত্যজি মোরে নিরখিলে।
সে কারণে আসিলাম এই নিশাকালে।।
না করিলে মম তোষ পুরুষের কাজ।
ক্লীবত্ব পাইয়া থাক স্ত্র্রীগণের মাঝ।।
শুনিয়া বিনয় ভাষে কহিলাম তায়।
কামভাবে আমি নাহি দেখিনু তোমায়।।
পূর্ব্ব-পিতামহ যে যে পুরুষ পুরাতন।
তোমার গর্ভেতে জন্মাইল পুত্রগণ।।
অনেক পুরুষ পূর্ব্ব হতে হয়ে গেল।
তোমার যুবতী দশা স্লান না পাইল।।
এই হেতু পুনঃ পুনঃ দেখেছি তোমারে।
কুলের জননী, কৃপা করিবে আমারে।।
কুন্তী মাদ্রী যথা মম, যথা শচীন্দ্রাণী।
ততোধিক তোমা আমি গরিষ্ঠেতে গণি।।
আপনার বংশ বলি জানহ আমারে।
লজ্জা পেয়ে ঊব্বশী যে কহে আরবারে।।
যজ্ঞ ব্রত ফলে তব যত পিতৃগণ।
ইন্দ্রের ভুবনে আসি থাকে হৃষ্ট মন।।
সবে মোর সহ করে রতি-ব্যবহার।
কেহ নাহি করে, যথা তোমার বিচার।।
কহিল আমার শাপ নহিবে লঙ্ঘন।
বৎসরেক ক্লীব রবে বিরাট ভবন।।
শাপ হতে বর তুল্য হবে তব কাজ।
অন্য বেশে লুকাইতে নার ক্ষিতিমাঝ।।
বরষ রহিবে, বলি করে নিরূপণ।
এই ক্লীবত্বের হেতু বিরাট নন্দন।।
বৎসরেক ক্লীব হইলাম সেই দায়।
সদাকাল ক্লীব আমি পরের দারায়।।
উত্তর বলিল, মোরে হৈলে কৃপাবান।
তেঁই মোরে নিজ কর্ম্ম করিলে বাখান।।
আজ্ঞা কর কোন্ ধর্ম্ম করিব এখন।
শুনিয়া অর্জ্জুন বীর বলেন বচন।।
সারথি হইয়া তুমি বৈস মম রথে।
কৌতুক দেখহ কুরুসৈন্যের মধ্যেতে।।
উত্তর বলিল, আমি তোমার প্রসাদে।
সকল ভুবন আজি দেখি তৃণপদে।।
ইন্দ্রের মাতলি কিম্বা দারুক সারথি।
তাদৃশ সারথ্য কর্ম্মে আমার শকতি।।
বিশেষ তোমার ভুজাশ্রিত মহাবলী।
এখনি লইব রথ সৈন্য মধ্যস্থলী।।
মহাভারতের কথা সুধাসিন্ধুবত।
কাশীদাস কহে, সাধু পিয়ে অনুব্রত।।