২৩৮তম অধ্যায়
যুগভেদে আচরণ-ভেদ
“ব্যাস বলিলেন, ইতিপূৰ্ব্বে ব্রাহ্মণগণের যেসমুদয় অনুষ্ঠেয় কার্য্য নির্দ্দিষ্ট হইল, ঐ সমুদয় আশ্রয় করা তাতাঁদের অবশ্য কৰ্ত্তব্য। জ্ঞানবান ব্যক্তিরা যদি কৰ্ম্ম নিত্য, কি জ্ঞানজনকত্বনিবন্ধন কাম্য, এই সংশয় পরিত্যাগপূৰ্ব্বক যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করেন, তাহা হইলে তাঁহাদের নিশ্চয়ই সিদ্ধিলাভ হয়। জ্ঞানজনকত্বনিবন্ধন কৰ্ম্মকে কাম্য বলিয়া নির্দ্দেশ করা অকৰ্ত্তব্য। কারণ, কর্ম্ম যদি ব্রহ্মলাভজনক জ্ঞান উৎপাদন করে, তাহা হইলে উহাকে অবশ্যই নিত্য বলিয়া স্বীকার করিতে হইবে। এক্ষণে আমি যুক্তি ও অনুভব প্রদর্শনপূর্ব্বক কর্ম্মের বিষয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। কেহ কেহ পুরুষকারকে, কেহ কেহ দৈবকে ও কেহ কেহ বা স্বভাবকে কার্য্যের কারণ বলিয়া নির্দ্দেশ করেন এবং কেহ কেহ ঐ তিনের প্রত্যেকের প্রাধান্য স্বীকার না করিয়া উহারা একত্র সমাগত হইয়াই সদয় কাৰ্য্য নির্ব্বাহ করিতেছে বলিয়া থাকেন। কৰ্ম্মনিরত ব্যক্তিরাই এইরূপে কেহ পুরুষকারই কারণ, কেহ পুরুষকার কারণ নহে, কেহ দৈব ও পুরুষকার উভয়ই কারণ এবং কেহ বা ঐ উভয়ই কারণ নহে, বলিয়া নানাপ্রকার বিবাদ করিয়া থাকেন। কিন্তু যোগপরায়ণ মহাত্মারা ব্রহ্মই সকল কার্য্যের কারণ বলিয়া নির্দ্দেশ করেন।
‘সত্যযুগে সমুদয় মনুষ্য তপানুষ্ঠাননিরত, সংশয়বিহীন ও সত্ত্বগুণসম্পন্ন ছিলেন। ত্রেতা হইতে সকলেই সংশয়াপন্ন হইয়া আসিতেছে। সত্যযুগে মানবগণ ঋক, সাম ও যজুৰ্ব্বেদে অভেদবুদ্ধি আশ্রয় করিয়া কামদ্বেষ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক কেবল তপস্যার অনুষ্ঠান করিতেন। তপানুষ্ঠাননিরত ধর্ম্মপরায়ণ সংযত ব্যক্তিরা তপোবলে অনায়াসে স্বীয় মনোরথ পূর্ণ করিতে পারেন। তপস্যাদ্বারা জগৎস্রষ্টা জগদীশ্বরকে প্রাপ্ত হওয়া যায়। যে ব্যক্তি তপোবলে সেই পরব্রহ্মকে প্রাপ্ত হইতে পারেন, তাঁহাকেই সমুদয় লোকের প্রভু বলিয়া নির্দ্দেশ করা যাইতে পারে। কৰ্ম্মকাণ্ডবেদে ব্রহ্ম ইন্দ্রাদি দেবতারূপে নিরূপিত হইয়াছেন বলিয়া, কৰ্ম্মকাণ্ডবেদবিদ্ ব্যক্তিরা তাঁহাকে পরিজ্ঞাত হইতে পারেন না। জ্ঞানকাণ্ডবেদে তিনি ব্যক্তরূপে কথিত হইয়াছেন; এই নিমিত্ত জ্ঞানকাণ্ডবেদবেত্তা, তত্ত্বজ্ঞ ব্যক্তিরাই তাঁহাকে দর্শন করিতে সমর্থ হয়েন। ব্রাহ্মণের জপ, ক্ষত্রিয়ের দেবগণের তৃপ্তিসাধনার্থ পশুহিংসা, বৈশ্যের দেবদ্বিজের তৃপ্তিসাধনার্থ শস্যোৎপাদন ও শূদ্রের তিন বর্ণের সেবাই যজ্ঞ বলিয়া নির্দ্দিষ্ট আছে। ব্রাহ্মণ স্বাধ্যায়পরতন্ত্র, স্বকার্য্যনিষ্ঠ ও সকলের সহিত মিত্রভাবাপন্ন হইলে তিনি আর কোন কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করুন বা না করুন, তাঁহাকে যথার্থ ব্রাহ্মণ বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়। ত্রেতাযুগের প্রথমে বেদাধ্যয়ন, যজ্ঞানুষ্ঠান এবং বর্ণ ও আশ্রমের নিয়ম বিশেষরূপে বিহিত ছিল। দ্বাপরযুগে মনুষ্যগণের আয়ুর অল্পতাযুক্ত তৎসমুদয়ের ক্ষয় হইতে আরম্ভ হইয়াছে। কলিযুগের শেষে ঐ সমুদয় একবারে বিলুপ্ত হইয়া যাইবে। কলিযুগে বেদাদি কখন বা ঈষৎ প্রকাশিত ও কখন বা একেবারে অপ্রকাশিত হইবে। কলিযুগে মানবগণ স্বধর্ম্মভ্রষ্ট ও অধৰ্ম্মনিপীড়িত এবং গো, ভূমি ও ওষধিসমুদয় হীনরস হইবে। জলের মধুরত্ব থাকিবে না। বেদাধ্যয়ন ও বেদোক্ত আশ্ৰমধৰ্ম্মসমুদয় তিরোহিত হইয়া যাইবে; স্বধর্ম্মাক্রান্ত ব্যক্তিরা দুঃখভোগ করিবে এবং স্থাবরজঙ্গমাত্মক সমুদয় পদার্থই বিকারযুক্ত হইবে। পার্থিব উদ্ভিজ্জগণ যেমন বৃষ্টিদ্বারা বর্দ্ধিত হয়, তদ্রূপ প্রতিযুগে বেদদ্বারা যোগাঙ্গসমুদয় পুষ্ট হইয়া থাকে। পূৰ্বে আমি যে আদ্যন্তশূন্য বিবিধ রূপধারী কালের বিষয় কীৰ্ত্তন করিয়াছি, সেই কাল হইতেই সমুদয় প্রাণীর সৃষ্টি ও সংহার হইতেছে। কালই প্রাণীগণের নিয়ন্তা এবং উৎপত্তিনাশের কারণ। জীবগণ এই কালকেই আশ্রয় করিয়া স্বভাবে অবস্থিত রহিয়াছে। এই আমি তোমার নিকট জিজ্ঞাসানুসারে সৃষ্টি, কাল, ধৈৰ্য্য, বেদ, কৰ্ত্তা, কাৰ্য্য ও ক্রিয়াফলের বিষয় সবিস্তর কীৰ্ত্তন করিলাম।’ ”