২৩৮তম অধ্যায়
ঘোষযাত্রায় ধৃতরাষ্ট্রের অনিচ্ছা
বৈশম্পায়ন কহিলেন, মহারাজ! অনন্তর তাঁহারা সকলে অনাময়প্রশ্নপূর্ব্বক ধৃতরাষ্ট্রের সহিত সাক্ষাৎ করিলে তিনিও তাঁহাদিগের কুশলাদি জিজ্ঞাসা করিলেন।
অনন্তর সমঙ্গ নামে একজন গোপ তাঁহাদিগের বিচনানুসারে ধৃতরাষ্ট্রকে নিবেদন করিল, “মহারাজ! ধেনুসকল সমীপে রহিয়াছে।” পরে রাধেয় ও শকুনি পার্থিব্যশ্রেষ্ঠ ধৃতরাষ্ট্রকে কহিলেন, “হে কৌরবরাজ! ঘোষপল্লী অতিরমনীয় স্থানে সন্নিবেশিত আছে, গোবৎসদিগের বয়ঃক্রম, বর্ণ ও সংখ্যাদি নিরূপক অঙ্ক প্ৰদান করিবারও উত্তম সময় উপস্থিত হইয়াছে এবং আপনার পুত্ৰ দুৰ্য্যোধনেরও সাতিশয় মৃগয়াভিলাষ জন্মিয়াছে, অতএব গমনে অনুমতি প্ৰদান করুন।”
ধৃতরাষ্ট্র কহিলেন, “মৃগয়া উত্তম বটে এবং ধেনুগণের পৰ্য্যবেক্ষণ করাও আবশ্যক; কিন্তু গোপগণের নিকট বিশ্বস্ত হইয়া গমন করা অনুচিত, কারণ, আমি শুনিয়াছি, নরব্যাঘ্ৰ পাণ্ডবেরা তথায় অবস্থিতি করিতেছে, অতএব আমি তোমাদিগকে সে স্থানে গমন করিতে অনুমতি প্ৰদান করিতে পারি না। পাণ্ডবেরা সকলেই তপোবলসম্পন্ন, সমর্থ ও মহারথী; তোমরা কেবল কপটতাচরণপূর্ব্বক তাঁহাদিগকে পরাজয় করিয়া অরণ্যমধ্যে অনেক কষ্ট দিয়াছ। যুধিষ্ঠির পরমধার্ম্মিক, তিনি সেই ক্ৰোধ পরিত্যাগ করিলেও করিতে পারেন; কিন্তু ভীমসেন মহাত্ৰুদ্ধস্বভাব এবং দ্রুপদরাজনন্দিনীও সাতিশয় তেজস্বিনী, কদাচি ক্ষমাপর নহেন। তোমরা হিতাহিতবিবেকবিমূঢ় ও অত্যন্ত গর্ব্বিত, তথায় গমনপূর্ব্বক পাণ্ডবগণের কিছুমাত্র অপরাধ করিলেই তাঁহারা হয়ত তপঃপ্রভাবে তোমাদিগকে দগ্ধ করিবে, নতুবা অমর্ষপ্রধীপ্ত হইয়া অস্ত্রানলে ভস্মীভূত করিবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। অথবা যদি তোমরা বহুসংখ্যক বলিয়া কোনক্রমে তাহাদিগকে পরাভব কর, তাহা হইলেও নিতান্ত অভদ্রতা প্ৰকাশ পাইবে। আর তাহাও সহজ ব্যাপার নহে; পাণ্ডবগণকে পরাজয় করা অতিশয় সুকঠিন।
“মহাবাহু অর্জ্জুন ইন্দ্ৰলোকে বাস করিয়া সমুদয় দিব্যান্ত্রে সুশিক্ষিত হইয়া বনে প্রত্যাগমন করিয়াছেন। তিনি যখন অস্ত্ৰশিক্ষায় সুনিপুণ হয়েন নাই, তখনই সাগরাম্বার পৃথিবী জয় করিয়াছেন, অধুনা কৃতাস্ত্ৰ হইয়া কি তোমাদিগকে নিহত করিবেন না? অতএব আমার বাক্যানুসারে সর্ব্বদা সাবধান থাকিবে, পাণ্ডবদিগকে বিশ্বাস করিলেই তোমাদিগের অত্যন্ত দুঃখ উপস্থিত হইবে, তাহাতে সন্দেহ নাই। যদ্যপি কোন সৈনিক পুরুষ যুধিষ্ঠিরের অপকার করে, তাহা হইলে সেই অবিবেকৃত কর্ম্ম দ্বারা তোমাদিগেরই দোষ হইতে পারে। অতএব ধেনুগণের রূপ, গুণ ও বয়ঃক্রমাদিনিরূপক চিহ্ন প্ৰদান করিবার নিমিত্ত বিশ্বস্ত পুরুষদিগকে প্রেরণ কর, স্বয়ং তোমার তথায় গমন করা আমার অভিপ্ৰায়সিদ্ধ হয় না।”
কৰ্ণ, শকুনিবাক্যে ধৃতরাষ্ট্রের ঘোষযাত্রায় অনুমোদন
শকুনি কহিলেন, “মহারাজ! পাণ্ডবজ্যেষ্ঠ যুধিষ্ঠির পরমধার্ম্মিক; তিনি সভামধ্যে প্রতিজ্ঞা করিয়াছেন যে, দ্বাদশ বৎসর বনে বাস করিবেন এবং তদীয় ধর্ম্মচারী অনুজেরাও তাঁহার নিতান্ত অনুগত, অতএব তাঁহারা প্রতিজ্ঞাভঙ্গভয়ে আমাদিগের প্রতি কদাচ ক্ৰোধ করিবেন না। মৃগয়ায় আমাদিগের অত্যন্ত অভিলাষ হইয়াছে এবং ধেনুগণকে অঙ্কন করিতে ইচ্ছা করিয়াছি, কিন্তু পাণ্ডবগণের সহিত সাক্ষাৎ করিতে বাসনা নাই। আমরা তাহাদিগের আশ্রমে গমন করিব না এবং তথায় কোনপ্রকার অত্যাচারও করিবার অভিলাষ নাই।”
মহারাজ ধৃতরাষ্ট্র শকুনির বাক্যশ্রবণানন্তর অনিচ্ছাপূর্ব্বক অমাত্যসমেত দুৰ্য্যোধনকে দ্বৈতবনগমনে অনুজ্ঞা করিলেন। দুৰ্য্যোধন অনুমতিপ্ৰাপ্তিমাত্ৰ কৰ্ণ, শকুনি, দুঃশাসন, অন্যান্য ভ্রাতৃগণ, সহস্ৰ সহস্ৰ মহিলা এবং মহতী সেনা-সমভিব্যাহারী হইয়া দ্বৈতবনে যাত্ৰা করিলেন। পৌরগণ স্ব স্ব পত্নীসমভিব্যাহারে তাঁহার অনুগমন করিতে লাগিল। অষ্টসহস্র রথ, তিন-অযুত হন্তী, নবতিশত অশ্ব ও সহস্ৰ সহস্র পদাতি তাঁহার সমভিব্যাহারে চলিল। অসংখ্য শকট, আপণ, বেশ্যা, বণিক, বন্দী ও মৃগয়াশীল পুরুষ পশ্চাৎ পশ্চাৎ গমন করিতে লাগিল।
এইরূপে নরপতি দুৰ্য্যোধনের প্রয়াণসময়ে জনতার আধিক্য হওয়াতে বর্ষাকালীন সমুদ্ধত মহাবায়ুনিঃস্বনের ন্যায় ঘোরতর গভীর কোলাহলধ্বনি সমুত্থিত হইল। নরপতি সেই জনতাসমভিব্যাহারে গমন করিয়া দ্বৈতবনে সমুপস্থিত হইবার দুই ক্রোশ পথ অবশিষ্ট থাকিতে এক বাসোচিত স্থানে অবস্থিত করিলেন।