২৩৫. গার্হস্থ-ধর্ম্ম—সংসার-সাগরপারের উপায়

২৩৫তম অধ্যায়

গার্হস্থ-ধর্ম্ম—সংসার-সাগরপারের উপায়

“ব্যাস বলিলেন, ‘ঋক্, সাম, যজু ও অথর্ব্ব চারি বেদ এবং শিক্ষা কল্প প্রভৃতি বেদাঙ্গ সমুদয়ে যে বিদ্যা নির্দ্দিষ্ট আছে, সেই বিদ্যার আলোচনা করা মনুষ্যের অবশ্য কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম। ঈশ্বর বেদোক্ত ষট্‌কাৰ্য্যেই নিত্য অবস্থিত রহিয়াছেন। বেদবেদাঙ্গবেত্তা অধ্যাত্মকুশল সত্ত্বগুণাবলম্বী মহাত্মারাই সেই পরব্রহ্মকে দর্শন করিতে পারেন। ব্রাহ্মণ এইরূপ ধৰ্ম্মানুসারে যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান ও অন্যকে নিপীড়িত না করিয়া আপনার বৃত্তিবিধান করিবেন এবং সাধুদিগের নিকট জ্ঞানাভ্যাসপূর্ব্বক শাস্ত্রবিচক্ষণ, শিষ্ট, সত্ত্বগুণসম্পন্ন ও স্বধর্ম্মানুরক্ত হইয়া নিরন্তর বেদোক্ত ষট্‌কার্য্যের অনুশীলন ও পঞ্চবিধ যজ্ঞের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইবেন। ধৃতিমান, অপ্রমত্ত, জিতেন্দ্রিয়, ধর্ম্মবেত্তা, আত্মতত্ত্বজ্ঞ ও হর্ষক্রোধবিহীন ব্রাহ্মণকে কোনকালেই অবসন্ন হইতে হয় না। দান, অধ্যয়ন, যজ্ঞ, তপস্যা, লজ্জা, সরলতা ও দর্ম্মগুণ দ্বারা তেজের বৃদ্ধি ও পাপের ধ্বংস হইয়া থাকে। বুদ্ধিমান ব্রাহ্মণ অগ্রে পাপবিহীন, অল্পাহারনিরত ও জিতেন্দ্রিয় হইয়া কামক্রোধকে বশে আনয়নপূর্ব্বক ব্ৰহ্মপদ লাভ করিতে বাসনা করিবেন। দুষ্ট বাক্য ও অবৈধ হিংসা পরিত্যাগপূর্ব্বক অগ্নি ও ব্রাহ্মণগণের অর্চ্চনা এবং দেবগণকে প্রণাম করা ব্রাহ্মণের কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম। যে ব্রাহ্মণগণ এই বৃত্তি অবলম্বন ও শাস্ত্রজ্ঞান লাভ করিয়া যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করেন, তাঁহারাই অনায়াসে সিদ্ধিলাভ করিতে সমর্থ হয়েন।

‘বুদ্ধিমান ব্যক্তি পঞ্চেন্দ্রিয়রূপ সলিলে সমাকীর্ণ, ক্রোধরূপ পঙ্কসমন্বিত, লোভরূপ কুলসম্পন্ন, দুস্তর সংসারনদী অক্লেশে উত্তীর্ণ হইতে পারেন। মোহপ্রদ কালকে নিরন্তর সমুদ্যত দর্শন করা তাঁহার অবশ্য কর্ত্তব্য। স্বভাবরূপ স্রোত, বরুপ আবৰ্ত্ত, মাসরূপ তরঙ্গ, ঋতুরূপ বেগ, পক্ষরূপ উপল [প্রস্তর], নিমেষ ও উন্মেষরূপ ফেন, দিবারাত্রি ও অর্থরূপ জল, কামরূপ গ্রাহ, বেদ ও যজ্ঞরূপ পোত, ধৰ্ম্মরূপ দ্বীপ, সত্যবাক্য ও মোক্ষরূপ তীর, অহিংসারূপ তরু ও যুগরূপ হ্রদসমুদয় আশ্রয় করিয়া নিরন্তর যুক্ত [অবিচ্ছিন্ন], অপ্রতিহত বলশালী, ব্ৰহ্মাদ্ভূত, কালরূপ মহানদী বিশ্বসংসার প্রবাহিত করিয়া, ঈশ্বরসৃষ্ট ভূতগণকে শমনভবনে নীত করিতেছে। উদারচেতাঃ পণ্ডিতেরা জ্ঞানময় পোতদ্বারা অনায়াসে এই কালনদী উত্তীর্ণ হইয়া থাকেন। জ্ঞানপোতবিহীন লঘুচেতাঃ মানবগণ কখনই উহা পার হইতে সমর্থ হয় না। প্রাজ্ঞ ব্যক্তি যে অক্লেশে কালনদী উত্তীর্ণ হইতে পারেন এবং অপ্রাজ্ঞ ব্যক্তি যে উহাতে অসমর্থ হয়, ইহা অতিশয় যুক্তিসিদ্ধ। জ্ঞানবান ব্যক্তিরা দূর হইতেই সকল বিষয়ের গুণদোষ দর্শন করিতে পারেন; সুতরাং কালনদী উত্তীর্ণ হওয়া তাঁহাদের পক্ষে কঠিন হয় না। আর কামাত্মা, চলচিত্ত, লঘুচেতাঃ ব্যক্তিরা সততই সংশয়াপন্ন থাকে, সুতরাং তাহাদের ঐ নদী পার হইবার সম্ভাবনা কি? যদিও জ্ঞানপ্লববিহীন [১] পুরুষ মহাদোষসমুদয় গোপন করিবার মানসে প্রযত্নসহকারে চিত্ত সংযমিত করিয়া যৎকিঞ্চিৎ জ্ঞান লাভ করে, তথাপি তাহার কামাত্মতানিবন্ধন সেই জ্ঞান কখনই কালনদীর পোতস্বরূপ হয় না; অতএব উৎকৃষ্ট জ্ঞানসম্পন্ন পণ্ডিতেরা উহা উত্তীর্ণ হইতে অবশ্য যত্নবান্ হইবেন। ব্রহ্মজ্ঞ ব্যক্তিরাই কালনদী পার হইতে পারেন। মনুষ্য বিশুদ্ধ কুলে জন্ম পরিগ্রহ করিয়াও ঈশ্বর, জীব ও মুক্তি এই ত্রিবিধ কার্য্যে অনুরক্ত হয়; অতএব বুদ্ধিমান ব্যক্তির ঐ সমুদয় সন্দেহ ও ঐ সমুদয় কাৰ্য্য পরিত্যাগপূৰ্ব্বক জ্ঞান প্রভাবে কালনদী উত্তীর্ণ হইতে চেষ্টা করা কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম। সংস্কারাপন্ন দমগুণান্বিত সংযতাত্মা বিজ্ঞ ব্যক্তিরা উভয় লোকেই সিদ্ধিলাভ করিতে পারেন। গৃহী ব্যক্তিরা ক্রোধ ও অসূয়াবিহীন হইয়া শমদমাদি গুণ অনুসরণপূর্ব্বক নিরন্তর পঞ্চবিধ যজ্ঞের অনুষ্ঠান ও সকলের ভোজনাবসানে ভোজন করিবেন। হিংসা পরিত্যাগ, সাধুদিগের ধর্ম্মানুষ্ঠান, শিষ্টাচার আশ্রয় ও অন্যকে নিপীড়িত না করিয়া আপনার বৃদ্ধিবিধান তাঁহাদের অবশ্য কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম। শ্রুতবিজ্ঞানতত্ত্বজ্ঞ, শিষ্টাচারপরায়ণ, স্বধর্ম্মপরতন্ত্র, ধর্ম্মসঙ্কর বর্জ্জিত, ক্রিয়াবান, শ্রদ্ধান্বিত, দাতা, অসুয়াবিহীন, ধর্ম্মাধর্ম্মের বিশেষ তত্ত্বজ্ঞ, জ্ঞানবান ব্যক্তিরা সমুদয় দুস্তর বিষয় হইতে অনায়াসেই উত্তীর্ণ হইতে পারেন। ধৈর্য্যশালী, অপ্রমত্ত, জিতেন্দ্রিয়, ধর্ম্মপরায়ণ, আত্মতত্ত্বজ্ঞ ও হর্য্যক্রোধবিহীন ব্রাহ্মণকে কোন কালেই অবসন্ন হইতে হয় না। ধৈর্য্য, অপ্রমাদ, জিতেন্দ্রিয়তা ও চিরন্তন শব্দব্যবহার আশ্রয় করা ব্রাহ্মণের কর্ত্তব্য কৰ্ম্ম। যে ব্রাহ্মণ জ্ঞানানুসারে যজ্ঞাদির অনুষ্ঠান করেন, তিনি অবশ্যই সিদ্ধিলাভে সমর্থ হয়েন। মুঢ় ব্যক্তিরা ধর্ম্মাকাঙ্ক্ষী হইয়া অধর্ম্মের অনুষ্ঠান ও ধৰ্ম্মকে অধৰ্ম্ম বলিয়া জ্ঞান করে। যে ব্যক্তি ধৰ্ম্মানুষ্ঠান করিতেছি মনে করিয়া অধর্ম্মসঞ্চয়ে প্রবৃত্ত হয় ও অধৰ্ম্ম করিতে অভিলাষী হইয়া ধর্ম্মের অনুষ্ঠান করে, সেই ব্যক্তি বালকের ন্যায় ঐ উভয় কাৰ্য্যই পরিজ্ঞাত হইতে পারে না; সুতরাং তাহাকে জন্মমরণনিবন্ধন বারংবার কষ্টভোগ করিতে হয়।”