২৩৪তম অধ্যায়
আশ্ৰমধৰ্ম্ম—ব্রাহ্মণের কর্ত্তব্য
“ব্যাস বলিলেন, “জগদীশ্বর যেরূপে মহাভূতসমুদয়ের সৃষ্টি করিয়াছেন, তাহা কীৰ্ত্তন করিলাম। এক্ষণে ব্রাহ্মণের কৰ্ত্তব্য কৰ্ম্মসমুদয় কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।
‘ব্রাহ্মণের পিতা তাঁহার জাতকৰ্ম্ম [জন্মমাত্রে সূতিকাগৃহে অনুষ্ঠেয় কার্য্য] অবধি সমাবর্ত্তন [উপনয়নের পর গুরুগৃহবাসান্তে গার্হস্থধর্ম্মগ্রহণের জন্য স্বগৃহে প্রতাবর্ত্তন] পৰ্য্যন্ত ক্রিয়াকলাপ সম্পাদন করিবেন। সমাবর্ত্তন সুসম্পন্ন হইলে ব্রাহ্মণ বেদপারদর্শী আচার্য্যের নিকট নিখিল বেদাধ্যয়ন সমাপনপূর্ব্বক গুরুশুশ্রূষায় নিরত হইয়া গুরুঋণ হইতে বিমুক্ত হইবেন। তৎপরে গুরু অনুমতি প্রদান করিলে তিনি দেহের মুক্তিলাভ পর্য্যন্ত গৃহস্থাশ্রমে অবস্থানপূর্ব্বক দারপরিগ্রহ করিয়া পুত্রোৎপাদন, ব্রহ্মচর্য্য অবলম্বন, বানপ্রস্থধর্ম্ম গ্রহণ অথবা যতিধৰ্ম্মের অনুষ্ঠান করিয়া কালযাপন করিবেন। গৃহী ব্যক্তি এই সমুদয় ধৰ্ম্মেরই মূল কারণ। গৃহস্থ ব্যক্তি দমগুণান্বিত, কামক্রোধাদিবর্জ্জিত হইলেই অনায়াসে সিদ্ধিলাভ করিতে সমর্থ হয়েন। ব্রাহ্মণ পুত্রবান, বেদপারদর্শী ও যাজ্ঞিক হইয়া পিতৃলোক, ঋষি ও দেবতাদিগের ঋণ হইতে মুক্তিলাভপূৰ্ব্বক অন্যান্য আশ্রমে গমন করিবেন। এই পৃথিবীমধ্যে যে-যে স্থান তাঁহার পবিত্র বলিয়া বোধ হইবে, সেই সেই স্থানে অবস্থান করা এবং কীৰ্ত্তিবিষয়ে আদর্শস্বরূপ হইতে যত্নবান হওয়া তাঁহার সৰ্ব্বোতোভাবে বিধেয়।
‘দুষ্কর তপানুষ্ঠান, বিদ্যায় পারদর্শিতা এবং যজ্ঞ ও দানদ্বারা ব্রাহ্মণদিগের যশোবৃদ্ধি হইয়া থাকে। যে ব্রাহ্মণের কীৰ্ত্তি যত কাল ভূমণ্ডলে বিরাজমান থাকে, তিনি তত দিন পুণ্যাত্মা ব্যক্তিদিগের সহিত স্বর্গলোকে অবস্থান করিতে সমর্থ হয়েন। যজন, যাজন, অধ্যয়ন ও অধ্যাপন ব্রাহ্মণের অবশ্য কর্ত্তব্য। বৃথা দান ও বৃথা প্রতিগ্রহ করা কদাপি বিধেয় নহে। যজমান হইতে ধনাগম হইলে তদ্দ্বারা যজ্ঞানুষ্ঠান, শিষ্য হইতে ধনাগম হইলে তাহা দান এবং কন্যার শ্বশুরাদির নিকট হইতে ধনাগম হইলে তাহা বিতরণ করা অবশ্য কর্ত্তব্য। গৃহী ব্রাহ্মণের দেবতা, পিতৃলোক, ঋষি ও গুরুজনদিগের অর্চ্চনা করা অবশ্য কর্ত্তব্য। সুতরাং তাঁহার প্রতিগ্রহ ব্যতিরেকে ঐ সকল কাৰ্য্যসম্পাদনের উপায়ান্তর নাই। যারপরনাই ক্লেশ স্বীকার করিয়াও বৃদ্ধ, আতুর, বুভুক্ষু ও শত্রুসন্তপ্ত ব্যক্তিদিগকে আহার প্রদান করা অবশ্য কর্ত্তব্য। যথার্থ যোগ্যপাত্রে কিছু অদেয় নাই। সাধুব্যক্তি যদি উচ্চৈঃশ্রবা অশ্ব গ্রহণ করিতে ইচ্ছা করেন, যে-কোনরূপে হউক, তাঁহাকে তাহাও প্রদান করিতে চেষ্টা করা উচিত।
ব্রাহ্মণরক্ষার্থে ক্ষত্রিয় নৃপতিগণের দান
‘মহাব্রতাবলম্বী [উত্তম ব্রতধারী] রাজা সত্যসন্ধ অতি বিনীতভাবে স্বীয় জীবনদানদ্বারা ব্রাহ্মণকে পরিত্রাণ, সংস্কৃতিনন্দন রন্তিদেব মহাত্মা বশিষ্ঠকে শীতোষ্ণ [শীতল ও উষ্ণ—গ্রীষ্মে শীতল, শীতে উষ্ণ] সলিল প্রদান, অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন আত্রেয় ইন্দ্ৰদমন উপযুক্ত পাত্রে বিবিধ ধনদান, উশীনরপুত্র শিবি ব্রাহ্মণার্থ স্বীয় অঙ্গ ও পুত্র সমর্পণ, কাশীপতি প্রতর্দ্দন ব্রাহ্মণকে স্বীয় নয়নদ্বয় প্রদান; দেবাবৃধ অতি উৎকৃষ্ট অষ্ট সুবর্ণশলাকাসংযুক্ত ছত্রদান, আত্রেয় সাংকৃতি স্বীয় শিষ্যগণকে নির্গুণ ব্রহ্মের উপদেশ প্রদান, মহাপ্রতাপশালী অম্বরীষ বিপ্রগণকে একাদশ অর্ব্বুদ গোদান, সাবিত্রী ব্রাহ্মণকে দিব্যকুণ্ডলদ্বয়, জনমেজয় ব্রাহ্মণার্থ স্বীয় দেহ পরিত্যাগ, যুবনাশ্ব ব্রাহ্মণের হস্তে সমুদয় রত্ন, প্রিয়তমা পত্নী ও অতিরমণীয় বাসস্থান সমর্পণ, নিমি বিপ্রগণকে স্বীয় রাজ্য এবং জমদগ্নিপুত্র পরশুরাম ও গয়রাজ ব্রাহ্মণদিগকে সমুদয় পৃথিবী প্রদান করিয়া স্বর্গলোকে গমন ও উভয়লোকে উৎকৃষ্ট কীর্ত্তিলাভ করিয়াছেন। অনাবৃষ্টি উপস্থিত হইলে মহর্ষি বশিষ্ঠ দ্বিতীয় প্রজাপতির ন্যায় প্রজাগণকে রক্ষা করিয়া অত্যুৎকৃষ্ট পুণ্যলাভে অধিকারী হইয়াছেন। করন্ধমের পুত্র মরুত্তরাজা মহর্ষি অঙ্গিরাকে স্বীয় কন্যা প্রদান, অসাধারণ ধীশক্তিসম্পন্ন পাঞ্চালাধিপতি ব্রাহ্মণদিগকে ব্রহ্মদত্ত মহানিধি শঙ্খদান, রাজা সৌদাস মহর্ষি বশিষ্ঠকে স্বীয় পত্নী ময়ন্তীকে সমর্পণ, রাজর্ষি সহস্ৰজিৎ ব্রাহ্মণার্থে আপনার জীবন পরিত্যাগ, শতদ্যুম্ন মুদগলকে সৰ্ব্বসমৃদ্ধিসম্পন্ন সুবর্ণময় অট্টালিকা দান, শাল্বদেশের অধীশ্বর প্রবল প্রতাপশালী দ্যুতিমান ঋচীককে রাজাপ্রদান, রাজর্ষি মদিরাশ্ব হিরণ্যহস্তকে সুমধ্যমা কন্যা সম্প্রদান, নরপতি লোমপাদ ঋষ্যশৃঙ্গের হস্তে স্বীয় কন্যা শান্তাকে সমর্পণ এবং মহাতেজস্বী প্রসেন ব্রাহ্মণগণকে একলক্ষ সবৎসা গাভী প্রদান করিয়া স্বর্গে গমন করিয়াছেন। ইঁহাদের এবং অন্যান্য যে যে মহাত্মা জিতেন্দ্রিয় নরপতি দান ও তপানুষ্ঠান করিয়া স্বর্গগমনে অধিকারী হইয়াছেন, তাঁহাদের কীৰ্ত্তি চিরকাল এই ভূমণ্ডলে দেদীপ্যমান থাকিবে।’ ”