২২. সুহাস মিত্রকে তার অফিসে পাওয়া গেল না

সুহাস মিত্রকে তার অফিসে পাওয়া গেল না। সুহাস সেদিন অফিসেই আসেনি। কিরীটী আর সুব্রত তখন সোজা তার কলুটোলার বাড়িতে গেল।

সুহাস বাড়িতেই ছিল। বাইরের ঘরে জানালা দরজা সব বন্ধ করে একটা টেবিল ফ্যান চালিয়ে দিয়ে-পরনে একটা লুঙ্গি আর ছেড়া ময়লা গেঞ্জি—সুহাস শুয়ে ছিল।

বাচ্চা চাকরটা খবর দিতে তাড়াতাড়ি সে উঠে বসল–আসুন—কে!

চশমাটা চোখে ছিল না, পাশেই ছিল, তাড়াতাড়ি চশমাটা তুলে সুহাস চোখে পরে নিল, কিরীটীবাবু, সুব্রতবাবু—আপনারা—

আপনাকে একটু বিরক্ত করতে এলাম সুহাসবাবু, কিরীটী বললে।

না, না, বিরক্তির কি আছে, বসুন। কিন্তু হঠাৎ আমার কাছে—

কিরীটী আর সুব্রত বসলো চৌকিটার উপরেই, কারণ বসবার আর কোন জায়গা ছিল।

বলুন কি ব্যাপার?

সেই পুরোনো প্রশ্নটাই আবার করছি সুহাসবাবু, কিরীটী বললে, কার কাছে আপনি শুনেছিলেন মিত্রানী অন্য কাউকে ভালবাসে? আপনাদের বন্ধু সজল চক্রবর্তী কি?

না।

তবে?

সে কথা আর কেন কিরীটীবাবু, যা চিরদিনের মতই চুকেবুকে গিয়েছে—যা অতীত, তাকে আজ আর বর্তমানে টেনে এনে লাভ কি?

লাভ আপনার দিকে কিছু না হলেও, ব্যাপারটা জানতে পারলে আমার পক্ষে মিত্রানীর হত্যা-রহস্যের শেষ জটটি খুলতে হয়ত অনেকটা সুবিধা হতে পারে। তাছাড়া মিত্রানীকে তো আপনি সত্যিই ভালবাসতেন সুহাসবাবু, আপনি কি চান না তার হত্যাকারী শুধু হত্যাকারীই নয়, যে তার মৃতদেহটার উপর জঘন্য অত্যাচার করতে পর্যন্ত এতটুকু দ্বিধা বোধ করেনি সে ধরা পড়ক!

সুহাস চুপ করে রইলো।

বলুন সুহাসবাবু, মিত্রানীর প্রতি আপনার ভালবাসার কি কোন দায়িত্বই নেই?

কিরীটীবাবু, আমাকে অনুরোধ করবেন না–

বেশ—একখণ্ড কাগজে আমি নামটা লিখে এনেছি সেটা দেখুন একটিবার—বলতে বলতে কিরীটী পকেট থেকে একটা ভাঁজ করা ছোট কাগজ বের করে সুহাসের দিকে এগিয়ে দিল, দেখুন তো নামটা মেলে কিনা

সুহাস কাগজের ভাঁজ খুলে নামটা পড়ে যেন একেবারে বোবা হয়ে বসে রইলো, তার মুখ দিয়ে কোন কথাই বের হয় না। কাগজটা হাতেই ধরা থাকে তার।

বুঝেছি আর আপনাকে বলতে হবে না—দিন কাগজটা-বলে সুহাসের হাত কাগজটা নিয়ে কিরীটী কাগজটা সুব্রতর দিকে এগিয়ে দিল, পুড়ে দেখ সুব্রত নামটা—এই মিত্রানীর হত্যাকারী–

সুব্রতও যেন নামটা পড়ে একেবারে বোবা হয়ে যায়।

সে শুধু অস্ফুট কণ্ঠে একটি মাত্র শব্দই উচ্চারণ করলো, আশ্চর্য!

ভাবতেই পারিসনি বোধ হয় ব্যাপারটা–কিরীটী বললে—

না।

কিন্তু তিনটি কারণে তোরও সন্দেহ হওয়া উচিত ছিল—প্রথমত ঝড় ঠিক ওঠবার মুখে ঐ লোকটিই ছিল মিত্রানীর একেবারে কাছের জন—দুই রুমালটা-তিন ওরই। পরামর্শে সম্ভব সজল চক্রবর্তী সেদিন সুহাসের পরিচয়ে মিত্রানীকে ফোন করেছিল। আর সর্বশেষ যেটা, কেউ ভাবেনি কখনো—মিত্রানীর প্রতি মানুষটার লোভ থাকতে পারে—সে যে কথাটা প্রকাশ করেনি, কারণ সে ভাল ভাবেই জানত মিত্রানী সুহাসবাবুকে গভীরভাবে ভালবাসে-তাই নিজেকে কখনো প্রকাশ করেনি মিত্রানীর কাছে যেমন—তেমনি শেষ চালে সুহাসবাবুকেও ধ্বংস করতে চেয়েছিল।

সুহাস কথা বললে, সত্যি সত্যি বলছেন আপনি কিরীটীবাবু!

হ্যাঁ। আশ্চর্য—এখনো যেন কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছি না—

শুনলে ব্যাপারটা আপনাদের মত সকলেই বিস্মিত হবে—কিন্তু জানেন তো টুথ ইজ স্ট্রেঞ্জার দ্যান ফিকশন বলে একটি চলতি প্রবাদ আছে! কিন্তু সে যাই হোক, সত্যটা জানবার পর এখন তো বুঝতে পারছেন, আপনাদের দুজনার প্রতিই তার প্রচণ্ড ঘৃণা কি ভাবে এক নিষ্ঠুর আক্রোশে পরিবর্তিত হয়েছিল, যে আক্রোশের জন্য মিত্রানীকে নিষ্ঠুর মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে এবং আপনিও এগিয়ে এসেছিলেন ফাঁসির দড়ির দিকে।

সুহাস স্তব্ধ হয়ে বসে রইলো। কিরীটী আবার বললে, এবারে বলুন তো সুহাসবাবু, আপনি কি সেদিন সত্যি সত্যিই স্পষ্ট দেখতে পেয়েছিলেন, সেই বেতের টুপি মাথায়-মুখে দাড়ি চোখে রঙিন চশমা লোকটাকে, না কেউ আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করায় সেদিকে আপনার নজর পড়েছিল।

সুহাস চুপ করে থাকে।

আমার অনুমান কিন্তু, আপনার নজরে আসেনি প্রথমে এবং আপনার ঐ বন্ধুই সেই দিকে আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল—তাই নয় কি?

হ্যাঁ।

এখন তো বুঝতে পারছেন, সকলের মধ্যে বিশেষ করে আপনারই তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করবার পিছনে তার বিশেষ উদ্দেশ্য ছিল—

পারছি বৈকি! কিন্তু এখনো বুঝতে পারছি না—-মিত্রানীকে তার যদি প্রয়োজনই ছিল তো সে অমন বাঁকা পথে গেল কেন?

আকর্ষণটা হয়ত ভালবাসা নয়—একটা জৈবিক আকর্ষণ মাত্র—রিপুর তাড়না!

মনে হচ্ছে—সুহাস বললে, মিত্ৰাণীও বোধ হয় ব্যাপারটা কখনো এতটুকু আঁচ করতে পারেনি!

আঁচ করতে পারলে তার ডাইরীতেই হয়ত থাকতো। কি জানেন সুহাসবাবু— আপনাদের ঐ বন্ধুটি কেবলমাত্র যে আপনার বন্ধুত্বেরই সুযোগ নিয়েছে তাই নয়–আপনার চোখের ক্ষীণ দৃষ্টিরও সুযোগ নিয়েছে—

কি বলছেন আপনি?

ঠিকই বলছি, এবং আপনার রুমালটার ব্যাপারেও আমার অনুমান—সেদিন অফিসে আপনাকে পিকনিকের কথা বলতে গিয়ে আপনার রুমালটা হাতসাফাই করেছিল– চোখের ক্ষীণ দৃষ্টির জন্য হয়ত ব্যাপারটা আপনার নজরে আসেনি–

ঐ রুমালটা তাহলে–

হ্যাঁ  সুহাসবাবু—আপনার প্রতি পুলিসের সন্দেহটা যাতে আরো বেশী ঘনীভূত হয়-সেই কারণেই রুমালটা হাতসাফাই করেছিল–

সুব্রত এতক্ষণে কথা বললে, সবই করেছিল—প্ল্যানটা তার সাকসেসফুলও হয়েছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্য ভদ্রলোকের যে মিত্রানী কিরীটী রায়ের মাস্টারমশাইয়ের মেয়ে–

কিরীটীবাবু—

বলুন—

এখন কি তাহলে ওকে আপনি পুলিসের হাতে তুলে দেবেন?

সমাজের মধ্যে বাস করে একজন দেশের নাগরিকের সাধারণ কর্তব্যবুদ্ধি তো তাই বলে সুহাসবাবু, তবে যে মুহূর্তে আমার কাছে সমস্ত ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছে—তখুনি মনে হয়েছে ফাঁসির দড়ি বোধ হয় ওর যোগ্য শাস্তি নয়—এক মুহূর্তেই। তো সব শেষ হয়ে যাবে—এবং সেটা ওর প্রতি অনুকম্পাই প্রকাশ করা হবে-তা আমি ঠিক চাই না—

আপনি তাহলে—

দেখি, এখনো ঠিক ভেবে উঠতে পারিনি—

কিন্তু ফাঁসিই তো ওর যোগ্য শাস্তি কিরীটীবাবু—সুহাস বললে।

ঠিক–কিন্তু প্রমাণ করবেন কি করে যে ওই হত্যাকারী! আদালত চায় প্রমাণ আইন চায় প্রমাণ, কাজেই ওর তখুনি ফাঁসি হতে পারে যদি ওর স্বীকারোক্তি পাই আমরা।

তা কি ও দেবে?

দেবে না সহজে জানি, কিন্তু তবু শেষ চেষ্টা আমি করবোই—আপনার কাছে আমার একটা বিশেষ অনুরোধ সুহাসবাবু—

বলুন—

ঘুণাক্ষরেও যেন ও নামটা কেউ না এখন জানতে পারে—

না কিরীটীবাবু, আমি কারো কাছে বলবো না।

ঠিক আছে—আমরা তাহলে এবার উঠবো।

সুহাস মিত্র কোন কথা বললো না। ওরা দুজনে উঠে নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

দুটো দিন তারপর কিরীটী আর কোথাও বের হলো না। তবে মধ্যে মধ্যে দু-একজনকে ফোন করল। কয়েক জায়গা থেকে ফোনও এলো।

সুব্রত আর ফিরে যায়নি—সর্বক্ষণ কিরীটীর পাশে পাশেই রয়েছে।

কিরীটীকে কোন কথা জিজ্ঞাসা করেনি—নিজেও কোন কথা বলেনি। প্রতীক্ষা করেছে কেবল কিরীটী কখন মুখ খুলবে!

তৃতীয় দিন দ্বিপ্রহরে হঠাৎ কিরীটী মুখ খুললো। বললে, পেয়েছি রে সুব্রত–পথ খুঁজে পেয়েছি–

কি—সুশীল নন্দীকে সব জানাবি?

হ্যাঁ জানাবো, তবে—

তবে?

সোজাসুজি নয়—

কিভাবে তাহলে তাকে ব্যাপারটা জানবি?

একটা চিঠি—

চিঠি। চিঠি সুশীল নন্দীকে?

না–সুশীল নন্দীকে নয়—

তবে কাকে?

হত্যাকারীকে একটা চিঠি দেবো—

হত্যাকারীকে চিঠি! কিন্তু সে চিঠি পাবার পর যদি লোকটা একেবারে উধাও হয়ে যায়?

আমার বিশ্বাস যাবে না—আর যদি যায়ই আমাদের উদ্দেশ্য পুরোপুরিই সফল হবে–

সফল হবে। নিশ্চয়ই। সে-ই যে অপরাধী সেটা তার ঐ পলায়ন থেকে প্রমাণিত হয়ে যাবে— তখনই পুলিস তাকে অনায়াসে হত্যাকারী বলে চিহ্নিতও করতে পারবে।

কিন্তু চিঠি লিখবো বললেও কিরীটী ঠিক করে উঠতে পারে না কিভাবে চিঠিটা লিখবে কোথায় তার শুরু, কোথায় তার শেষ।

মনে মনে অনেক মুসাবিদা করে কিরীটী কিন্তু কোনটাই যেন পছন্দ হয় না।

ঐদিনই মধ্যরাত্রে কিরীটী লেখার প্যাড ও কলম নিয়ে বসলো, তারপর শুরু করলো তার চিঠি–

কি ভাবে আপনাকে সম্বোধন করবো চিঠির শুরুতে তা অনেক ভেবেও স্থির করতে পারলাম না। প্রিয়বরেষুও লিখতে পারি না–সবিনয় নিবেদন দিয়েও শুরু করতে পারি না—তবু লিখতেই হবে চিঠিটা আপনাকে—তাই কোন সম্বোধন না করেই শুরু করছি চিঠি।

চিঠিটা আমি ডাকে দেবো না কারো হাত দিয়ে পৌঁছে দেবো, যাতে পথে না মারা যায় চিঠিটা।

কিরীটী লিখতে লাগল।