[নিমন্ত্রিত হইয়া স্বামীজী পঞ্জাব ও কাশ্মীরের নানা স্থানে ভ্রমণ করেন এবং ইংরেজী ও হিন্দীতে অনেক স্থানে বক্তৃতা দেন ও আলোচনাদি করেন; শিয়ালকোটে দুইটি বক্তৃতা দেন—একটি ইংরেজীতে এবং অপরটি হিন্দীতে। এটি হিন্দী বক্তৃতার অনুবাদ।]
জগতে বিভিন্ন ধর্মের উপাসনা-প্রণালী বিভিন্ন হইলেও প্রকৃতপক্ষে সেগুলি এক। কোথাও লোকে মন্দির নির্মাণ করিয়া উপাসনা করিয়া থাকে, কোথাও বা অগ্নি-উপাসনা প্রচলিত, কোথাও বা লোকে প্রতিমাপূজা করিয়া থাকে, আবার অনেকে ঈশ্বরের অস্তিত্বই বিশ্বাস করে না। সত্য বটে—এই-সকল বিভিন্ন ভাব বিদ্যমান, কিন্তু যদি প্রত্যেক ধর্মে ব্যবহৃত যথার্থ কথাগুলি, উহাদের মূল তথ্য, উহাদের সার সত্যের দিকে লক্ষ্য কর, দেখিবে—তাহারা বাস্তবিক অভিন্ন। এমন ধর্মও আছে, যাহা ঈশ্বরোপাসনার প্রয়োজনীয়তা স্বীকৃত নয়, যে ধর্মের ‘দর্শন’ ঈশ্বরের অস্তিত্ব পর্যন্ত মানে না, তথাপি দেখিবে ঐ ধর্মাবলম্বীরা সাধু-মহাত্মাদিগকে ঈশ্বরের ন্যায় উপাসনা করিতেছে। বৌদ্ধধর্মই এই বিষয়ের প্রসিদ্ধ উদাহরণ।
ভক্তি সকল ধর্মেই আছে—কোথাও এই ভক্তি ঈশ্বরে, কোথাও বা মহাপুরুষে অর্পিত। সর্বত্রই এই ভক্তিরূপ উপাসনার প্রভাব দেখিতে পাওয়া যায়, আর জ্ঞান অপেক্ষা ভক্তি লাভ করা সহজ। জ্ঞানলাভ করিতে হইলে দৃঢ় অভ্যাস, অনুকূল অবস্থা প্রভৃতির প্রয়োজন হইয়া থাকে। শরীর সম্পূর্ণ সুস্থ ও রোগশূন্য এবং মন সম্পূর্ণ বিষয়াসক্তিশূন্য না হইলে যোগ অভ্যাস করা যাইতে পারে না। কিন্তু সকল অবস্থার লোক অতি সহজেই ভক্তির সাধন করিতে পারে। ভক্তিমার্গের আচার্য শাণ্ডিল্য ঋষি বলিয়াছেন, ঈশ্বরে পরমানুরাগই ভক্তি। প্রহ্লাদও এইরূপ কথাই বলিয়াছেন। যদি কোন ব্যক্তি একদিন খাইতে না পায়, তবে তাহার মহাকষ্ট হয়। সন্তানের মৃত্যু হইলে লোকের প্রাণে কী যন্ত্রণা হয়! যে ভগবানের প্রকৃত ভক্ত, তাহার প্রাণও ভগবানের বিরহে ঐরূপ ছটফট করিয়া থাকে। ভক্তির মহৎ গুণ এই যে, উহা দ্বারা চিত্তশুদ্ধি হয়, আর পরমেশ্বরে দৃঢ় ভক্তি হইলে কেবল উহা দ্বারাই চিত্ত শুদ্ধ হইয়া থাকে।
‘নাম্নামকারি বহুধা নিজসর্বশক্তিঃ’৪৪ ইত্যাদিঃ
‘হে ভগবান্, তোমার অসংখ্য নাম আর তোমার প্রত্যেক নামেই তোমার অনন্ত শক্তি বিদ্যমান। প্রত্যেক নামেরই গভীর তাৎপর্য আছে, আর তোমার নাম উচ্চারণ করিবার জন্য স্থান-কাল কিছু বিচার করিতে হয় না।’ মৃত্যু যখন স্থান-কাল বিচার না করিয়াই মানুষকে আক্রমণ করে, তখন ঈশ্বরের নাম করিবার কি স্থান-কাল বিচার করিতে হইবে?
ঈশ্বর বিভিন্ন সাধক কর্তৃক বিভিন্ন নামে উপাসিত হন বটে, কিন্তু এই ভেদ আপাতদৃষ্টিমাত্র, বাস্তব নহে। কেহ কেহ মনে করেন, তাঁহাদের সাধনপ্রণালীই অধিক কার্যকর, অপরে আবার তাঁহাদের সাধনপ্রণালীকেই আশু মুক্তিলাভের সহজ উপায় বলিয়া নির্দেশ করিয়া থাকেন। কিন্তু যদি তাঁহাদের সাধন-পদ্ধতির মূল ভিত্তি অনুসন্ধান করিয়া দেখা যায়, তবে দেখিতে পাওয়া যাইবে—উভয় পদ্ধতিই এক প্রকার। শৈবগণ শিবকে সর্বাপেক্ষা শক্তিশালী বলিয়া বিশ্বাস করেন; বৈষ্ণবেরা তাঁহাদের সর্বশক্তিমান্ বিষ্ণুতেই অনুরক্ত, আর দেবীর উপাসকগণ দেবীকেই সর্বাপেক্ষা শক্তিসম্পন্না বলিয়া বিশ্বাস করেন। কিন্তু যদি স্থায়ী ভক্তি লাভ করিবার ইচ্ছা থাকে, তবে এই দ্বেষভাব একেবারে পরিত্যাগ করিতে হইবে। দ্বেষ ভক্তিপথের মহান্ প্রতিবন্ধক—যে ব্যক্তি দ্বেষ পরিত্যাগ করিতে পারেন, তিনিই ঈশ্বরলাভ করেন। দ্বেষভাব অবশ্য পরিত্যাজ্য, তাহা হইলেও ইষ্টনিষ্ঠা প্রয়োজন। ভক্তশ্রেষ্ঠ হনুমান বলিয়াছেনঃ
শ্রীনাথে জানকীনাথে অভেদঃ পরমাত্মনি।
তথাপি মম সর্বস্বো রামঃ কমললোচনঃ॥
আমি জানি যিনি লক্ষ্মীপতি, তিনিই সীতাপতি; পরমাত্মদৃষ্টিতে উভয়ে এক, তথাপি কমললোচন রামই আমার সর্বস্ব।
মানুষের প্রত্যেকেরই ভাব ভিন্ন ভিন্ন। এই-সকল বিভিন্ন ভাব লইয়া মানুষ জন্মিয়া থাকে। সে কখনও ঐ ভাবকে অতিক্রম করিতে পারে না। জগৎ যে কখনও একধর্মাবলম্বী হইতে পারে না, ইহাই তাহার একমাত্র কারণ। ঈশ্বর করুন, জগৎ যেন কখনও একধর্মাবলম্বী না হয়। তাহা হইলে জগতে এই সামঞ্জস্যের পরিবর্তে বিশৃঙ্খলা উপস্থিত হইবে। সুতরাং মানুষ যেন নিজ নিজ প্রকৃতি অনুসরণ করে; আর যদি সে এমন গুরু পায়, যিনি তাঁহার ভাব অনুযায়ী এবং সেই ভাবের পুষ্টিবিধায়ক উপদেশ দেন, তবেই সে উন্নতি করিতে সমর্থ হইবে। তাহাকে সেই ভাবের বিকাশ-সাধন করিতে হইবে। কোন ব্যক্তি যে পথে চলিতে ইচ্ছা করে, তাহাকে সেই পথে চলিতে দিতে হইবে; কিন্তু যদি আমরা তাহাকে অন্য পথে টানিয়া লইয়া যাইতে চেষ্টা করি, তবে তাহার যেটুকু আছে, তাহাও সে হারাইবে; সে একেবারে অকর্মণ্য হইয়া পড়িবে।
একজনের মুখ আর একজনের মুখের সঙ্গে মেলে না, সেইরূপ একজনের প্রকৃতি আর একজনের প্রকৃতির সঙ্গে মেলে না। আর তাহাকে তাহার নিজের প্রকৃতি অনুযায়ী চলিতে দিতে বাধা কি? কোন নদী এক বিশেষ দিকে প্রবাহিত হইতেছে—সেই দিকেই যদি উহাকে একটি নির্দিষ্ট খাতে প্রবাহিত করা যায়, তবে উহার স্রোত আরও প্রবল হয়, উহার বেগ বর্ধিত হয়; কিন্তু উহা স্বভাবতঃ যে দিকে প্রবাহিত হইতেছে, সেই দিক হইতে সরাইয়া অন্যদিকে প্রবাহিত করিবার চেষ্টা কর, তাহা হইলে দেখিবে কি ফল হয়। উহার স্রোত ক্ষীণতর হইয়া যাইবে, স্রোতের বেগও হ্রাস পাইবে। এই জীবন একটা গুরুতর ব্যাপার—নিজ ভাব অনুযায়ী ইহাকে পরিচালিত করিতে হইবে। ধর্মব্যাপারে যে-দেশে সকলকে এক পথে পরিচালিত করিবার চেষ্টা করা হয়, সে-দেশ ক্রমশঃ ধর্মহীন হইয়া দাঁড়ায়। ভারতে কখনও এরূপ চেষ্টা করা হয় নাই। বিভিন্ন ধর্মের মধ্যে কখনও বিরোধ ছিল না, অথচ প্রত্যেক ধর্মই স্বাধীনভাবে নিজ নিজ কার্যসাধন করিয়া গিয়াছে—সেইজন্যই এখানে প্রকৃত ধর্মভাব এখনও জাগ্রত। এখানে ইহাও স্মরণ রাখিতে হইবে, বিভিন্ন ধর্মে বিরোধ দেখা দেয়, তাহার কারণ একজন মনে করিতেছে—সত্যের চাবি আমার কাছে, আর যে আমায় বিশ্বাস না করে, সে মূর্খ। অপর ব্যক্তি আবার মনে করিতেছে—ও-ব্যক্তি কপট, কারণ তাহা না হইলে সে আমার কথা শুনিত।
সকল ব্যক্তিই এক ধর্মের অনুসরণ করুক, ইহাই যদি ঈশ্বরের ইচ্ছা হইত, তবে এত বিভিন্ন ধর্মের উৎপত্তি হইল কিরূপে? তোমরা কি সেই সর্বশক্তিমানের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কাজ করিতে পার? সকলকে এক ধর্মাবলম্বী করিবার জন্য অনেক প্রকার উদ্যোগ ও চেষ্টা হইয়াছে, কিন্তু তাহাতে কোন ফল হয় নাই। এমন কি, তরবারি-বলে সকলকে একধর্মাবলম্বী করিবার চেষ্টাও যেখানে হইয়াছে, ইতিহাস বলে—সেখানেও একবাড়িতে দশটি ধর্মের উৎপত্তি হইয়াছে। সমগ্র জগতে একটি ধর্ম কখনও থাকিতে পারে না। বিভিন্ন শক্তি মানব-মনে ক্রিয়া ও প্রতিক্রিয়া করে বলিয়াই মানুষ চিন্তা করিতে সমর্থ হয়। এই বিভিন্ন শক্তির ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া না থাকিলে মানুষ চিন্তা করিতেই সমর্থ হইত না, এমন কি মনুষ্যপদবাচ্যই হইত না। ‘মন্’ ধাতু হইতে মনুষ্য-শব্দ ব্যুৎপন্ন হইয়াছে—মনুষ্য-শব্দের অর্থ মননশীল। মনের পরিচালনা না থাকিলে চিন্তাশক্তিও লোপ পায়, তখন সেই ব্যক্তিতে ও একটা সাধারণ পশুতে কোন প্রভেদ থাকে না। তখন এরূপ ব্যক্তিকে দেখিয়া সকলেরই ঘৃণার উদ্রেক হয়। ঈশ্বরেচ্ছায় ভারতের যেন কখনও এমন অবস্থা না হয়!
অতএব মনুষ্যত্ব যাহাতে বজায় থাকে, সেজন্য এই একত্বের মধ্যে বহুত্বের প্রয়োজন। সকল বিষয়েই এই বহুত্ব বা বৈচিত্র্য রক্ষা করা প্রয়োজন; কারণ যতদিন এই বহুত্ব থাকিবে, ততদিনই জগতের অস্তিত্ব। অবশ্য বহুত্ব বা বৈচিত্র্য বলিলে ইহা বুঝায় না যে, উহার মধ্যে ছোট-বড় আছে। যদি সকলেই সমানও হয়, তথাপি এই বৈচিত্র্য থাকিবার কোন বাধা নাই। সকল ধর্মেই ভাল ভাল লোক আছে, এই কারণেই সেই-সব ধর্ম লোকের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিয়া থাকে, সুতরাং কোন ধর্মকেই ঘৃণা করা উচিত নয়।
এখানে এই প্রশ্ন উঠিতে পারে, যে-ধর্ম অন্যায় কার্যের পোষকতা করিয়া থাকে, সেই ধর্মের প্রতিও কি সম্মান দেখাইতে হইবে? অবশ্য, ইহার উত্তর ‘না’ ব্যতীত আর কি হইতে পারে? এইরূপ ধর্ম যত শীঘ্র সম্ভব দূরীভূত করিতে পারা যায়, ততই মঙ্গল; কারণ উহা দ্বারা লোকের অকল্যাণই হইয়া থাকে। নীতির উপরই যেন সকল ধর্মের ভিত্তি প্রতিষ্ঠিত হয়, আর ব্যক্তিগত পবিত্রতা বা শুদ্ধ ভাবকে ধর্ম অপেক্ষা উচ্চতর মনে করা উচিত। এখানে ইহাও বলা কর্তব্য যে, ‘আচার’ অর্থে বাহ্য ও আভ্যন্তর উভয় প্রকার শুদ্ধি। জল এবং শাস্ত্রোক্ত অন্যান্য বস্তুসংযোগে শরীরের শুদ্ধি সম্পাদন করা যাইতে পারে। আভ্যন্তর শুদ্ধির জন্য মিথ্যাভাষণ সুরাপান ও অন্যান্য গর্হিত কার্য পরিত্যাগ করিতে হইবে, সঙ্গে সঙ্গে পরোপকার করিতে হইবে। মদ্যপান চৌর্য দ্যূতক্রীড়া মিথ্যাভাষণ প্রভৃতি অসৎকার্য হইতে যদি বিরত থাক, তবে তো ভালই—উহা তো তোমার কর্তব্য। ইহার জন্য তুমি কোনরূপ প্রশংসা পাইতে পার না। অপরেরও যাহাতে কল্যাণ হয়, সেজন্য কিছু করিতে হইবে।
এখানে আমি ভোজনের নিয়ম সম্বন্ধে কিছু বলিতে ইচ্ছা করি। ভোজন সম্বন্ধে প্রাচীন বিধি সবই এখন লোপ পাইয়াছে; কেবল এই ব্যক্তির সঙ্গে খাইতে নাই, উহার সঙ্গে খাইতে নাই—এইরূপ একটা অস্পষ্ট ধারণা লোকের মধ্যে রহিয়াছে দেখিতে পাওয়া যায়। শত শত বৎসর পূর্বে আহার সম্বন্ধে যে-সকল সুন্দর নিয়ম ছিল, এখন ঐগুলির ভগ্নাবশেষরূপে এই স্পৃষ্টাস্পৃষ্ট বিচারমাত্র দেখিতে পাওয়া যায়। শাস্ত্রে খাদ্যের ত্রিবিধ দোষ কথিত আছেঃ জাতিদোষ—যে-সকল আহার্য-বস্তু স্বভাবতই অশুদ্ধ, যেমন পেঁয়াজ রশুন প্রভৃতি, সেগুলি খাইলে জাতিদুষ্ট খাদ্য খাওয়া হইল। যে-ব্যক্তি ঐ-সকল খাদ্য অধিক পরিমাণে খায়, তাহার কাম প্রবল হয় এবং সে-ব্যক্তি ঈশ্বর ও মানুষের চক্ষে ঘৃণিত অসৎ কর্মসকল করিতে থাকে। আবর্জনা-কীটাদি-পূর্ণ স্থানে আহারকে নিমিত্তদোষ বলে। এই দোষবর্জনের জন্য আহারের এমন স্থান নির্দিষ্ট করিতে হইবে, যে-স্থান খুব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন। আশ্রয়দোষ—অসৎ ব্যক্তি কর্তৃক স্পৃষ্ট অন্ন পরিত্যাগ করিতে হইবে, কারণ এরূপ অন্ন ভোজন করিলে মনে অপবিত্র ভাব উদিত হয়। এমন কি ব্রাহ্মণ-সন্তান যদি লম্পট ও কুক্রিয়াসক্ত হয়, তবে তাহার হাতেও খাওয়া উচিত নয়।
এখন এ-সব আনুষ্ঠানিক ক্রিয়াকর্মের প্রভাব চলিয়া গিয়াছে—এখন শুধু এইটুকু অবশিষ্ট আছে যে, আমাদের আত্মীয়-স্বজন না হইলে তাহার হাতে আর খাওয়া হইবে না—ঐ ব্যক্তি যতই জ্ঞানী ও সাধু হউক না কেন। অথচ প্রকৃত নিয়ম যে কিভাবে উপেক্ষিত হইয়া থাকে, ময়রার দোকানে গেলে তাহার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাইবে। দেখিবে মাছিগুলি চারিদিকে ভন্ ভন্ করিয়া উড়িয়া দোকানের সব জিনিসে বসিতেছে—রাস্তার ধূলি উড়িয়া মিঠাই-এর উপর পড়িতেছে, আর ময়রার কাপড়খানা এমনি যে, চিমটি কাটিলে ময়লা উঠে। কেন, ক্রেতারা সকলে মিলিয়া বলুক না—দোকানে গ্লাসকেস না বসাইলে আমরা কেহ মিঠাই কিনিব না। এইরূপ করিলে আর মাছি আসিয়া খাবারের উপর বসিতে পারিবে না এবং কলেরা ও অন্যান্য সংক্রামক রোগের বীজ ছড়াইবে না। পূর্বকালে লোকসংখ্যা অল্প ছিল—তখন যে-সব নিয়ম ছিল, তাহাতেই কাজ চলিয়া যাইত। এখন লোকসংখ্যা বাড়িয়াছে, অন্যান্য অনেক প্রকার পরিবর্তনও ঘটিয়াছে; সুতরাং এই-সকল বিষয়ে আমাদের উৎকৃষ্টতর বিধিব্যবস্থা প্রণয়ন করা উচিত ছিল। কিন্তু আমরা উন্নতি না করিয়া ক্রমশঃ অবনতই হইয়াছি। মনু বলিয়াছেন, ‘জলে থুথু ফেলিও না’; আর আমরা কি করিতেছি? আমরা গঙ্গায় ময়লা ফেলিতেছি। এই-সকল বিবেচনা করিয়া স্পষ্ট প্রতীত হয় যে, বাহ্য শৌচ বিশেষ আবশ্যক। শাস্ত্রকারেরাও তাহা জানিতেন, কিন্তু এখন এই-সকল শুচি-অশুচি-বিচারের প্রকৃত উদ্দেশ্য লোপ পাইয়াছে—এখন শুধু উহার খোসাটা পড়িয়া আছে। চোর, লম্পট, মাতাল, অতি ভয়ানক জেলখাটা আসামী—ইহাদিগকে আমরা স্বচ্ছন্দে জাতিতে লইব, কিন্তু একজন সৎ ও সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি যদি নিম্নবর্ণের অথচ তাহার মত সমমর্যাদাসম্পন্ন কোন ব্যক্তির সঙ্গে বসিয়া খায়, তবে তৎক্ষণাৎ সে জাতিচ্যুত হইবে—চিরদিনের জন্য পতিত হইয়া যাইবে। ইহাতেই আমাদের দেশে ঘোরতর অনিষ্ট হইতেছে। সুতরাং এইটি স্পষ্টরূপে জানা উচিত যে, পাপীর সংসর্গে পাপ এবং সাধুর সঙ্গে সাধুতা আসিয়া থাকে, এবং অসৎ-সংসর্গ দূর হইতে পরিহার করাই বাহ্য শৌচ। আভ্যন্তর শুদ্ধি আরও কঠিন। অন্তঃশৌচসম্পন্ন হইতে গেলে সত্যভাষণ, দরিদ্রসেবা এবং বিপন্ন ও অভাবগ্রস্তদের সাহায্য করা আবশ্যক।
কিন্তু আমরা সচরাচর কি করিয়া থাকি? লোকে নিজের কাজের জন্য কোন ধনী লোকের বাড়ি গেল এবং তাঁহাকে ‘গরীবের বন্ধু’ প্রভৃতি উচ্চ বিশেষণে ভূষিত করিল; কিন্তু কোন গরীব ঐ ধনীর বাটীতে আসিলে তিনি হয়তো তাহার গলা কাটিতে প্রস্তুত। অতএব ঐরূপ ধনী ব্যক্তিকে ‘দরিদ্রের বন্ধু’ বলিয়া সম্বোধন করা তো স্পষ্টই মিথ্যা কথা। আর ইহাই আমাদের চিত্ত অশুদ্ধ করিয়া ফেলিতেছে। এই জন্য শাস্ত্র সত্যই বলিয়াছেন, যদি কোন ব্যক্তি বারো বৎসর ধরিয়া সত্যভাষণাদি দ্বারা চিত্তশুদ্ধি করেন, আর এই দ্বাদশবর্ষকাল যদি তাঁহার মনে কখনও কুচিন্তার উদয় না হয়, তবে তাঁহার বাক্সিদ্ধি হইবে—তাঁহার মুখ দিয়া যে-কথা বাহির হইবে, তাহাই ফলিবে। সত্যভাষণের এমনই অমোঘ শক্তি, এবং যিনি নিজের অন্তর বাহির দুই-ই শুদ্ধ করিয়াছেন, তিনিই ভক্তির অধিকারী।
তবে ভক্তিরও এমনই মাহাত্ম্য যে, ভক্তি নিজেই মনকে অনেক পরিমাণে শুদ্ধ করিয়া দেয়। তুমি যে-ধর্ম সম্বন্ধেই বিচার করিয়া দেখ না, দেখিবে সকল ধর্মেই ভক্তির প্রাধান্য এবং সকল ধর্মই বাহ্য ও অভ্যন্তর শৌচের আবশ্যকতা স্বীকার করিয়া থাকে। যদিও য়াহুদী, মুসলমান ও খ্রীষ্টানগণ বাহ্য শৌচের বাড়াবাড়ির বিরোধী, তথাপি তাহারাও কোন না কোনরূপে কিছু না কিছু বাহ্য শৌচ অবলম্বন করিয়া থাকে; তাহারা মনে করে, সর্বদাই কিছু না কিছু পরিমাণে বাহ্য শৌচ প্রয়োজন।
য়াহুদীদের মধ্যে প্রতিমাপূজা নিষিদ্ধ ছিল, তথাপি তাহাদের এক মন্দিরে ‘আর্ক’ নামক এক সিন্দুক এবং ঐ সিন্দুকের ভিতর ‘মুশার দশটি আদেশ’ (Tables of the Law) রক্ষিত থাকিত। ঐ সিন্দুকের উপর বিস্তারিত-পক্ষযুক্ত দুইটি স্বর্গীয় দূতের মূর্তি থাকিত, এবং উহাদের ঠিক মধ্যস্থলে তাঁহারা ঈশ্বরাবির্ভাব দর্শন করিতেন। অনেক দিন হইল য়াহুদীদের সেই প্রাচীন মন্দির নষ্ট হইয়া গিয়াছে, কিন্তু নূতন নূতন মন্দিরগুলিও সেই প্রাচীন ধরনেই নির্মিত হইয়া থাকে, আর এখন খ্রীষ্টানদের মধ্যে ঐ সিন্দুকে ধর্মপুস্তক রাখা হয়। রোমান ক্যাথলিক ও গ্রীক খ্রীষ্টানদের মধ্যে প্রতিমাপূজা অনেক পরিমাণে প্রচলিত। উহারা যীশুর এবং তাঁহার মাতার প্রতিমূর্তি পূজা করিয়া থাকে। প্রোটেষ্ট্যাণ্টদের মধ্যে প্রতিমাপূজা নাই, কিন্তু তাহারাও ঈশ্বরকে ব্যক্তিবিশেষরূপে উপাসনা করিয়া থাকে। উহাও প্রতিমাপূজার রূপান্তর মাত্র। পারসী ও ইরানীদের মধ্যে অগ্নিপূজা খুব প্রচলিত। মুসলমানেরা বড় বড় সাধু-মহাপুরুষদের পূজা করিয়া থাকেন, আর প্রর্থনার সময় ‘কাবা’র দিকে মুখ ফিরান। এই-সকল দেখিয়া মনে হয় যে, ধর্মসাধনের প্রথমাবস্থায় লোকের কিছু বাহ্য সহায়তার প্রয়োজন থাকে। যখন চিত্ত অনেকটা শুদ্ধ হইয়া আসে, তখন সূক্ষ্ম হইতে সূক্ষ্মতর বিষয়সমূহে ক্রমশঃ মন নিবিষ্ট করা যাইতে পারে।
উত্তমো ব্রহ্মসদ্ভাবো ধ্যানভাবস্তু মধ্যমঃ।
স্ততির্জপোঽধমো ভাবো বাহ্যপূজাধমাধমা॥৪৫
ব্রহ্মভাবে অবস্থিতিই সর্বোৎকৃষ্ট, ধ্যান মধ্যম, স্তুতি ও জপ অধম এবং বাহ্যপূজা অধমাধম।
কিন্তু এখানে এই কথাটি বিশেষভাবে বুঝিতে হইবে যে, বাহ্যপূজা অধমাধম হইলেও ইহাতে কোন পাপ নাই। যে যেমন পারে, তাহার তেমন করা উচিত। যদি তাহাকে সেই পথ হইতে নিবৃত্ত করা যায়, তবে সে নিজের কল্যাণের জন্য—নিজের উদ্দেশ্যসিদ্ধির জন্য অন্য কোনরূপে উহা করিবে। এই জন্য যে প্রতিমাপূজা করিতেছে, তাহার নিন্দা করা উচিত নয়। সে উন্নতির ঐ সোপান পর্যন্ত আরোহণ করিয়াছে, সুতরাং তাহার বাহ্যপূজা চাই-ই চাই। যাঁহারা সমর্থ, তাঁহারা ঐ-সকল ব্যক্তির চিত্তের অবস্থার উন্নতিসাধনের চেষ্টা করুন—তাহাদের দ্বারা ভাল ভাল কাজ করাইয়া লউন। কিন্তু তাহাদের উপাসনা-প্রণালী লইয়া বিবাদের প্রয়োজন কি?
কেহ ধন, কেহ বা পুত্রলাভের জন্য ভগবানের উপাসনা করিয়া থাকে। আর উপাসনা করে বলিয়া তাহারা নিজেদের ‘ভাগবত’ বলিয়া পরিচয় দেয়। কিন্তু উহা প্রকৃত ভক্তি নহে, তাহারাও যথার্থ ভাগবত নহে। যদি তাহারা শুনিতে পায়, অমুক স্থানে এক সাধু আসিয়াছে—সে তামাকে সোনা করিতে পারে, অমনি তাহার নিকট তাহারা দলে দলে ছুটিতে থাকে। তথাপি তাহারা নিজেদের ‘ভাগবত’ বলিয়া পরিচয় দিতে কুণ্ঠিত হয় না। পুত্রলাভের জন্য ঈশ্বরের উপাসনাকে ভক্তি বলা যায় না, ধনী হইবার জন্য ঈশ্বরের উপাসনাকেও ভক্তি বলা যায় না, স্বর্গলাভের জন্য ঈশ্বরের উপাসনাকেও ভক্তি বলা যায় না, এমন কি নরক-যন্ত্রণা হইতে নিস্তার পাইবার জন্য ঈশ্বরের উপাসনাকেও ভক্তি নামে অভিহিত করিতে পারা যায় না। ভয় বা কামনা হইতে ভক্তির উদ্ভব হয় না। তিনিই প্রকৃত ভাগবত, যিনি বলিতে পারেনঃ
ন ধনং ন জনং ন সুন্দরীং কবিতাং বা জগদীশ কাময়ে।
মম জন্মনি জন্মনীশ্বরে ভবাতাদ্ভক্তিরহৈতুকী ত্বয়ি॥৪৬
হে জগদীশ্বর, আমি ধন জন পরমাসুন্দরী স্ত্রী অথবা পাণ্ডিত্য কিছুই কামনা করি না, জন্মে জন্মে তোমাতে যেন আমার অহৈতুকী ভক্তি থাকে।
যখন এই অবস্থা লাভ হয়, যখন মানুষ সর্বভূতে ঈশ্বর এবং ঈশ্বরে সর্বভূতকে দর্শন করে, তখনই সে পূর্ণ ভক্তি লাভ করে, তখনই সে আব্রহ্মস্তম্ব পর্যন্ত সর্বভূতেই বিষ্ণুকে অবতীর্ণ দেখিতে পায়, তখনই সে প্রাণে প্রাণে বুঝিতে পারে, ঈশ্বর ব্যতীত আর কিছুই নাই; তখন—কেবল তখনই সে নিজেকে দীনের দীন জানিয়া প্রকৃত ভক্তের দৃষ্টিতে ভগবানকে উপাসনা করে; তখন তাহার আর বাহ্য অনুষ্ঠান এবং তীর্থভ্রমণাদির প্রবৃত্তি থাকে না, সে প্রত্যেক মানুষকেই যথার্থ দেবমন্দির বলিয়া মনে করে।
আমাদের শাস্ত্রে ভক্তি নানারূপে বর্ণিত হইয়াছে, কিন্তু যতদিন না আমাদের প্রাণে ভক্তিলাভের জন্য যথার্থ ব্যাকুলতা জাগিতেছে, ততদিন আমরা উহার কোনটিরই প্রকৃত তত্ত্ব যথার্থরূপে হৃদয়ঙ্গম করিতে পারি না। দৃষ্টান্তস্বরূপ দেখ, আমরা ঈশ্বরকে আমাদের ‘পিতা’ বলিয়া থাকি। কেন তাঁহাকে পিতা বলিব? পিতা-শব্দে সচরাচর যাহা বুঝায়, উহা কখনই ঈশ্বরের সম্বন্ধে ব্যবহৃত হইতে পারে না। ঈশ্বরকে মাতা বলাতেও ঐ আপত্তি। কিন্তু যদি আমরা ঐ দুইটি শব্দের প্রকৃত তাৎপর্য আলোচনা করি, তবে দেখিব—ঐ দুইটি শব্দের যথার্থই সার্থকতা আছে। ঐ দুইটি শব্দ গভীর প্রেমসূচক—প্রকৃত ভাগবত ঈশ্বরকে প্রাণে প্রাণে ভালবাসেন বলিয়াই তিনি তাঁহাকে পিতা বা মাতা না বলিয়া থাকিতে পারেন না। রাসলীলায় রাধাকৃষ্ণের উপাখ্যান আলোচনা কর। ঐ উপাখ্যানে শুদ্ধ ভক্তেরই প্রকৃত ভাব ব্যক্ত হইয়াছে—কারণ সংসারের আর কোন প্রেমই নরনারীর পরস্পরের প্রতি প্রেম অপেক্ষা অধিকতর নহে। যেখানে এইরূপ প্রবল অনুরাগ, সেখানে কোন ভয় থাকে না, কোন বাসনা থাকে না, এবং কোন আসক্তি থাকে না—শুধু এক অচ্ছেদ্য প্রেমের বন্ধন উভয়কে তন্ময় করিয়া রাখে। পিতামাতার প্রতি সন্তানদের যে ভালবাসা, সে ভালবাসা শ্রদ্ধাজনিত—ভয়-মিশ্রিত। ঈশ্বর কিছু সৃষ্টি করিয়া থাকুন বা না-ই করিয়া থাকুন, তিনি আমাদের রক্ষাকর্তা হউন বা না-ই হউন, এ-সকল জানিয়া আমাদের কি লাভ? তিনি আমাদের প্রাণের প্রিয়তম আরাধ্য দেবতা, সুতরাং ভয়ের ভাব ছাড়িয়া দিয়া তাঁহার উপাসনা করা উচিত। যখন মানুষের সকল বাসনা চলিয়া যায়, তখন সে অন্য কোন বিষয়ের চিন্তা করে না; যখন সে ঈশ্বরের জন্য উন্মত্ত হয়, তখনই মানুষ ভগবানকে যথার্থভাবে ভালবাসিয়া থাকে। সংসারে প্রেমিক যেমন তাঁহার প্রেমাস্পদকে ভালবাসিয়া থাকে, তেমনি আমাদের ভগবানকে ভালবাসিতে হইবে। কৃষ্ণ স্বয়ং ঈশ্বর—রাধা তাঁহার প্রেমে উন্মত্ত। যে-সকল গ্রন্থে রাধা-কৃষ্ণের উপাখ্যান আছে, সে-সকল গ্রন্থ পাঠ কর, তখন বুঝিবে কিরূপে ঈশ্বরকে ভালবাসিতে হয়। কিন্তু এ অপূর্ব প্রেমের তত্ত্ব কে বুঝিবে? অনেক ব্যক্তি আছে, যাহাদের অন্তরের অন্তস্তল পর্যন্ত পাপে পূর্ণ, তাহারা জানে না—পবিত্রতা বা নীতি কাহাকে বলে; তাহারা কি এই-সব তত্ত্ব বুঝিবে? তাহারা কোনমতেই এ-সকল তত্ত্ব বুঝিতে পারিবে না। যখন লোকে মন হইতে সমুদয় অসৎ চিন্তা দূরীভূত করিয়া পবিত্র নৈতিক ও আধ্যাত্মিক পরিবেশে বাস করে, তখন তাহারা—মূর্খ হইলেও শাস্ত্রের অতি জটিল ভাষার রহস্যও ভেদ করিতে সমর্থ হয়। কিন্তু এরূপ লোক সংসারে কয়জন? কয়জনের এরূপ হওয়া সম্ভব?
এমন কোন ধর্ম নাই, যাহা অসৎ লোক কলুষিত করিতে না পারে। জ্ঞানমার্গের দোহাই দিয়া মানুষ অনায়াসেই বলিতে পারে—আত্মা যখন দেহ হইতে সম্পূর্ণ পৃথক্, তখন দেহ যাহাই করুক না কেন, আত্মা তাহাতে কখনই লিপ্ত হন না। যদি মানুষ যথার্থভাবে ধর্ম অনুসরণ করিত, তবে কি হিন্দু, কি মুসলমান, কি খ্রীষ্টান—যে-কোন ধর্মাবলম্বীই হউক না, সকলেই পবিত্রতার মূর্ত প্রতীক হইত। কিন্তু প্রকৃতি মন্দ হইলে লোকে মন্দ হইয়া থাকে; আর মানুষ নিজ নিজ প্রকৃতি-অনুযায়ী পরিচালিত হয়—ইহা অস্বীকার করিবার উপায় নাই। কিন্তু অসাধু লোকের সংখ্যা বেশী হইলেও সকল ধর্মেই এমন কতকগুলি ব্যক্তি আছেন, যাঁহারা ঈশ্বরের নাম শুনিলেই মাতিয়া উঠেন, ঈশ্বরের গুণগান কীর্তন করিতে করিতে প্রেমাশ্রু বিসর্জন করেন। এরূপ লোকই যথার্থ ভক্ত।
ধর্মজীবনের প্রথম অবস্থায় মানুষ ঈশ্বরকে প্রভু ও নিজেকে তাঁহার দাস মনে করে। সে কৃতজ্ঞচিত্তে বলে, ‘হে প্রভু, আজ আমাকে দু-পয়সা দিয়াছ—সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ দিতেছি।’ এইভাবে কেহ বলে, ‘হে ঈশ্বর, ভরণপোষণের জন্য আমাদিগকে আহার দাও।’ কেহ বলে, ‘হে প্রভো, এই এই কারণে আমি তোমার প্রতি বড়ই কৃতজ্ঞ’ ইত্যাদি। এই ভাবগুলি একেবারে পরিত্যাগ কর। শাস্ত্র বলেন, জগতে একটিমাত্র আকর্ষণী শক্তি আছে—সেই আকর্ষণী শক্তির বশে সূর্য চন্দ্র এবং অন্যান্য সকলেই বিচরণ করিতেছে। সেই আকর্ষণী শক্তি ঈশ্বর। এই জগতে সকল বস্তু—ভালমন্দ যাহা কিছু সবই ঈশ্বরাভিমুখে চলিতেছে। আমাদের জীবনে যাহা কিছু ঘটিতেছে—ভালই হউক, মন্দই হউক—সবই আমাদিগকে তাঁহার দিকে লইয়া যাইতেছে। নিজের স্বার্থের জন্য একজন আর একজনকে খুন করিল। অতএব নিজের জন্যই হউক আর অপরের জন্যই হউক, ভালবাসাই ঐ কার্যের মূলে। ভালই হউক বা মন্দই হউক, ভালবাসাই সকলকে প্রেরণা দেয়। সিংহ যখন ছাগশিশুকে হত্যা করে, তখন সে নিজে বা তাহার শাবকেরা ক্ষুধার্ত বলিয়াই ঐরূপ করিয়া থাকে। যদি জিজ্ঞাসা করা যায়, ‘ঈশ্বর কি?’, তাহা হইলে বলিতে হইবে—ঈশ্বর প্রেমস্বরূপ। সর্বদা সকল অপরাধ ক্ষমা করিতে প্রস্তুত—এরূপ অনাদি অনন্ত ঈশ্বর সর্বভূতে বিরাজমান। তাঁহাকে লাভ করিবার জন্য কোন নির্দিষ্ট সাধনপ্রণালী অনুষ্ঠান করিতে হইবে, নতুবা তাঁহাকে লাভ করা যাইবে না—ইহা তাঁহার অভিপ্রায় নয়। মানুষ জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে তাঁহার দিকেই চলিয়াছে। পতির পরম অনুরাগিণী পত্নী জানে না যে, তাহার পতির মধ্যে যে দিব্যভাব ও শক্তি রহিয়াছে—তাহাই তাহাকে স্বামীর দিকে আকর্ষণ করিতেছে। আমাদের উপাস্য কেবল এই প্রেমের ঈশ্বর। যতদিন আমরা তাঁহাকে স্রষ্টা পাতা ইত্যাদি মনে করি, ততদিন বাহ্য পূজার প্রয়োজন থাকে, কিন্তু যখন ঐ-সকল চিন্তা পরিত্যাগ করিয়া তাঁহাকে প্রেমের মূর্ত প্রতীক বলিয়া চিন্তা করি এবং সকল বস্তুতে তাঁহাকে এবং তাঁহার মধ্যে সকল বস্তু অবলোকন করি, তখনই আমরা পরাভক্তি লাভ করিয়া থাকি।