২২তম অধ্যায় – পাণ্ডবগণসহ দুর্য্যোধনের একক যুদ্ধ
সঞ্জয় কহিলেন, “হে মহারাজ! ঐ সংগ্রামে আপনার পুত্র মহারথ দুর্য্যোধন রথোপরি অবস্থানপূর্ব্বক প্রবলপ্রতাপান্বিত রুদ্রদেবের ন্যায় শোভা পাইতে লাগিলেন। তাঁহার শরনিকরে সমরভূমি সমাচ্ছন্ন হইল। জলধর যেমন ভূধরগণের উপর বারিধারা বর্ষণ কর, তদ্রূপ তিনি অরাতিগণের উপর অনবরত শরধারা বর্ষণ করিতে লাগিলেন। তৎকালে পাণ্ডবসৈন্যমধ্যে কি হস্তী, কি অশ্ব, কি রথ, কি মনুষ্য, কেহই অক্ষত রহিল না। আমরা সকলকেই কুরুরাজের শরে সমাচিত দেখিলাম। সমুত্থিত রজোরাশিদ্বারা সৈন্যসকল যেমন সমাচ্ছন্ন হইয়াছিল, দুৰ্য্যোধনের শরনিকরেও তদ্রূপ আচ্ছন্ন হইয়া পড়িল। তখন সমস্ত পৃথিবী শরময় বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। তৎকালে আমরা কৌরব ও পাণ্ডবপক্ষীয় সহস্র সহস্র যোদ্ধার মধ্যে দুর্য্যোধনকেই অদ্বিতীয় বলিয়া বোধ করিলাম। ঐ সময় পাণ্ডবগণ একত্র সমবেত হইয়াও তাঁহাকে অতিক্রম করিতে পারিলেন না, ইহা দেখিয়া সকলেই বিস্ময়াবিষ্ট হইল।
“অনন্তর কুরুরাজ সেই সমস্থলে যুধিষ্ঠিরকে একশত, ভীমসেনকে সপ্ততি, সহদেবকে সাত, নকুলকে চতুঃষষ্টি, ধৃষ্টদ্যুম্নকে সাত, দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্রকে সাত এবং সাত্যকিকে তিন শরে বিদ্ধ করিয়া এক ভল্লে সহদেবের শাসন ছেদন করিয়া ফেলিলেন। তখন মহাবলপরাক্রান্ত সহদেব সেই ছিন্ন শরাসন পরিত্যাগ ও অন্য কামুক গ্রহণপূর্ব্বক দ্রুতবেগে দুৰ্য্যোধনের প্রতি ধাবমান হইয়া তাঁহাকে দশ শরে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর নকুলও কুরুরাজকে অতি ভীষণ শরে বিদ্ধ করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় দ্রৌপদীর পাঁচ পুত্র সপ্ততি, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির পাঁচ, ভীমসেন অশীতি ও সাত্যকি এক শরে দুর্য্যোধনকে বিদ্ধ করিলেন। মহাবীর দুর্য্যোধন সসৈন্য-সমক্ষে এইরূপে শরনিকরে সমাচ্ছন্ন হইয়াও কিছুমাত্র বিচলিত হইলেন না। তাঁহার হস্তলাঘব ও বীৰ্য্য সৰ্ব্বাপেক্ষা অধিক বলিয়া বোধ হইতে লাগিল। পলায়মান কৌরবপক্ষীয় যোধগণ কিয়দ্দূর মাত্র গমন করিয়া পুনরায় দুৰ্য্যোধনের সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। তাঁহাদিগের আগমনে তরঙ্গমালা-সঙ্কুল সমুদ্রের নিস্বনের ন্যায় ঘোরতর শব্দ সমুত্থিত হইল। তখন সেই মহাধনুর্ধরগণ অরাতিনাশন পাণ্ডবগণের অভিমুখে গমন করিবেন।
“ঐ সময় মহাবীর দ্রোণতনয় ভীমসেনকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। তাঁহাদের উভয়ের শরনিকরে সমুদয় দিগ্বিদিক সমাচ্ছন্ন হওয়াতে যোধগণ আর কিছুই অবলোকন করিতে সমর্থ হইলেন না। তখন অসহ্য পরাক্রমশালী মহাবীর অশ্বত্থামা ও বৃকোদর পরস্পর প্রতিকারপরায়ণ হইয়া দশদিক্ বিত্ৰাসিত করিয়া ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ করিলেন। এদিকে মহাবীর শকুনি যুধিষ্ঠিরকে নিপীড়িত, তাহার চারি অশ্বকে নিহত ও সৈন্যগণকে কম্পিত করিয়া সিংহনাদ করিতে লাগিলেন। প্রবল প্রতাপশালী সহদেব রাজা যুধিষ্ঠিরকে শকুনির শরে নিপীড়িত দেখি স্বীয় রথে আরোপিত করিয়া তথা হইতে অপসৃত হইলেন। অনন্তর ধর্মনন্দন সত্বর অন্য এক রথে আরোহণপূর্ব্বক শকুনির সম্মুখীন হইয়া তাঁহাকে প্রথমে নয় ও তৎপরে পাঁচ বাণে বিদ্ধ করিয়া সিংহনাদ পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। ঐ বীরদ্বয়ের যুদ্ধ অতি বিচিত্র, ঘোরতর ও সিদ্ধ চারণ প্রভৃতি দর্শকগণের তৃপ্তিজনক হইয়াছিল।
ভীষণ সঙ্কুল যুদ্ধ– বহু লোকক্ষয়
“ঐ সময় শকুনির পুত্র মহাবীর উলূক যুদ্ধদুৰ্ম্মদ মহাধনুর্দ্ধর নকুলের প্রতি শরবর্ষণ করিয়া ধাবমান হইলেন; মহাবল মাদ্রীতনয়ও চতুর্দ্দিক হইতে শরবর্ষণ করিয়া তাঁহাকে নিবারণ করিতে লাগিলেন। এইরূপে সেই পরস্পর প্রতিকারপরায়ণ মহারথদ্বয়ের ঘোরতর যুদ্ধ আরম্ভ হইল শত্রুসূদন সাত্যকি, দেবরাজ যেমন বলির সহিত যুদ্ধ করিয়াছিলেন, তদ্রূপ কৃতবর্ম্মার সহিত ঘোরতর যুদ্ধ করিতে লাগিলেন। ঐ সময় রাজা দুর্য্যোধন ধৃষ্টদ্যুম্নের শাসন ছেদন করিয়া তাঁহাকে নিশিতশরনিকরে নিপীড়িত করিলেন। মহাবীর ধৃষ্টদ্যুম্নও মহাস্ত্র ধারণ করিয়া ধনুর্ধরগণের সমক্ষে তাঁহার সহিত সমরে প্রবৃত্ত হইলেন। অনন্তর প্রভিন্নগণ্ড বন্য মাতঙ্গদ্বয়ের ন্যায় তাঁহাদিগের তুমুল যুদ্ধ উপস্থিত হইল। মহাবীর কৃপাচার্য্য কোপান্বিত হইয়া নতপৰ্ব্ব শরনিকর দ্বারা মহাবলপরাক্রান্ত দ্রৌপদীতনয়গণকে বিদ্ধ করিতে লাগিলেন। ইন্দ্রিয়গণের সহিত প্রাণীর যেরূপ বিরোধ হয়, তদ্রূপ পাঞ্চালীতনয়গণের সহিত কৃপাচার্যের অনিবাৰ্য ভীষণ যুদ্ধ উপস্থিত হইল। ইন্দ্রিয়সকল মূর্খকে [অজ্ঞানকে] যেমন কষ্ট প্রদান করে, তদ্রূপ দ্রৌপদীনন্দনগণ তাঁহাকে কষ্ট প্রদান করিতে লাগিলেন। তখন মহাত্মা কৃপাচার্য্যও ক্রুদ্ধ হইয়া তাঁহাদিগকে শরাঘাত করিতে আরম্ভ করিলেন, এইরূপে দ্রৌপদীতনয়দিগের সহিত কৃপাচার্যের অতি বিচিত্র যুদ্ধ হইতে লাগিল।
“হে মহারাজ! ঐ সময় অতি ভীষণ ঘোরতর সঙ্কুল যুদ্ধ আরম্ভ হইল; পদাতিগণ পদাতিদিগকে, গজঘূথ গজঘূথকে, অশ্ব সকল অশ্ব-সকলকে এবং রথীগণ রথীদিগকে আক্রমণ করিতে লাগিলেন। শত্রুসূদন বীরগণ পরস্পর সংগ্রামে মিলিত হইয়া পরস্পরকে বিদ্ধ ও আহত করিতে আরম্ভ করিলেন। তাহাদের অস্ত্রবেগ, করিকুলের নিশ্বাস এবং রথ ও অশ্বরোহিগণের গমনাগমনজনিত বায়ুবেগে সমরাঙ্গন হইতে ধূলিপটল সমুত্থিত হইয়া ভূমণ্ডল ও অন্তরীক্ষ সমাচ্ছন্ন করিল। তখন নভোমণ্ডল সন্ধ্যারাগরঞ্জিত বলিয়া বোধ হইতে লাগিল, দিবাকরের প্রভা তিরোহিত হইয়া গেল ও বীরগণ এককালে অদৃশ্য হইলেন। অনন্তর পরস্পর প্রহারপরায়ণ বীরগণের গাত্র হইতে শোণিতধারা নিঃসৃত হওয়াতে অতি অল্পক্ষণমধ্যে সেই প্রভূত রজোরাশি প্রশমিত হইয়া গেল। যোদ্ধাদিগের বর্ম্মের উপর মধ্যাহ্নকালীন দিবাকরের করজাল নিপতিত হওয়াতে উহা সমধিক সমুজ্জল হইয়া উঠিল। তখন আমরা পুনরায় বীরগণের দ্বন্দ্বযুদ্ধ অবলোকন করিতে লাগিলাম। তাঁহাদের শরপতনশব্দ পৰ্ব্বতোপরি দহ্যমান বেণুবনের শব্দের ন্যায় শ্রবণগোচর হইতে লাগিল।”