২২. পাগল হে নাবিক!

পাগল হে নাবিক!

ঝপঝপ করে বন্ধ হয়ে গেলো সবগুলি জানলা। নটিলাস-এর ভিতরটা অন্ধকার আর থমথমে। পাগলের মতো এই ভয়ংকর পাতাল ছেড়ে ছুটে পালাচ্ছে নটিলাস–কিন্তু বিবেকের হাত থেকে সে পালাবে কোথায়?

খ্যাপা জানোয়ারের মতো কথন সে ভেসে ওঠে, কখনো সে ডুব দেয়, আর সারাক্ষণ প্রচণ্ড গতিতে ছুটে চলে। যেন অমোঘ বিবেকের দংশন এড়িয়ে পালাতে চাচ্ছে কোনো আর্ত, ব্যর্থ, ব্যাকুল মানুষ।

এক-এক করে কুড়ি দিন কেটে গেলো একই ভাবে। দিন নেই, রাত্রি নেই, শুধু এক ভয়ংকর গতি সর্বক্ষণ। কারো দেখা মেলে না। আমরা তিন দৈবাত যাত্রী শুকনো মুখে বসে থাকি। আর রাতের বেলায় শুনি পাগল অর্গানের আর্ত কলরোল। সময় নেই, অসময় নেই ঝমঝম করে কেবল আর্ত হৃৎপিণ্ডের মতো কঁদে ওই অর্গ্যান। যেন কোনো শনিতে-পাওয়া দিনরাত্রি হানা দিয়েছে এখানে।

আর নয়। পালাতেই হবে।

স্বপ্নের ঘোরে শুনি নি কথা কটি; ধড়মড় করে উঠে বসে দেখি নেঙ আমার উপর ঝুকে পড়ে ফিশফিশ করে বলছে, আর নয়। পালাতেই হবে। এবং আজ রাতেই।

কখন? আস্তে শুধোলুম।

রাত্রে। ওরা পাহারা সরিয়ে নিয়েছে। অথচ ডাঙা এখান থেকে কাছেই। কুয়াশার মধ্যে ঝাঁপসা দেখতে পেয়েছি আমি—কয়েক মাইল দূরে কালো তীরের রেখা।

তা-ই হবে। আজ রাতেই পালাবো।

নটিলাস তখন স্ক্যাণ্ডিনেভিয়ার উপকূল ধরে যাচ্ছে। সারা দিন ধরে আমি শেষবার ঘুরে বেড়ালুম নটিলাস-এর ঘরে-ঘরে। তার গ্রন্থাগার, সংগ্রহশালা, রত্নগৃহ —সমস্ত এই দশ মাসের স্মৃতিতে ভরে আছে। আমার দিনলিপিতে প্রতিদিনের কথা লেখা আছে, কিন্তু তবু কেমন অদ্ভুত ঘোরর মধ্যে সারা দিন কেটে গেলো।

রাত্রে খাবার সময় নেড চুপিচুপি জানিয়ে দিলে যে সাড়ে দশটায় চাঁদ উঠবে, তার আগেই অন্ধকার থাকতে থাকতে পালাতে হবে আমাদের।

আর রাতের অন্ধকারেই আবার কোন অফুরন্ত কাম্বার প্রস্রবণ খুলে গেলো–বেজে উঠলো বিষয় অর্গ্যান।

সর্বনাশ!

ক্যাপ্টেন নেমো সেলুনে আছেন এখন–অথচ ওখান দিয়েই যে আমাকে যেতে হবে। ভয় করি আমি তাকে, তার মুখোমুখি দাঁড়ালে আমি দুর্বল হয়ে যাবে

এই আর্ত মানুষটিকে ছেড়ে তাহলে আর আমার পালানো হবে না।

সেলুনের ভিতরে সন্তর্পণে তাকিয়ে দেখি মিশমিশে অন্ধকারে ভূতের মতো বসে আছেন তিনি অর্গানে-ঝমঝম সেই আর্ত কদনের মধ্যে যেন কোনো-এক তৃতীয় ভুবন হাড়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। আস্তে সেলুন পেরিয়ে এলুম আমি, পা টিপেটিপে, সন্তর্পণে।

লাইব্রেরির দরজা খুলে বেরিয়ে পড়বে, এমন সময় ক্যাপ্টেন নেমোর বুক চিরে এক দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো। কে যেন আমাকে পেরেক ঠুকে আটকে দিলে সেখানে। দেখলুম উঠে দাড়ালেন তিনি আন্তে; নিঃশব্দে, বুকের উপর দুই হাত ভাঁজ করে, প্রেতের মতো এগিয়ে এলেন তিনি। আর তার আর্ত হৃদয় ছিড়ে এই কটি যন্ত্রণাহত কথা বেরিয়ে এলো। হা ভগবান। যথেষ্ট! যথেষ্ট! আর নয়!

মরিয়া হয়ে লাইব্রেরির মধ্যে দিয়ে ছুটে গিয়ে কয়েক লাফে সিঁড়ি টপকে প্ল্যাটফর্মে উঠে গেলুম। সেখানে নৌকোর মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে ঢুকে পড়তেই দেখলুম নেড আর কোনসাইলও আগে থেকে এসে বসে আছে সেখানে। আমার চেতনা তখন আচ্ছন্ন। সেই অনুতপ্ত কথা কটি এখনো যেন গুমরে উঠছে আমার দুই কানে।

শিগগির। বেরিয়ে পড়ো, এক্ষুনি! রুদ্ধশ্বাসে বলে উঠলুম আমি।

নেড হালে বসলো, আর কোনসাইল আংটা খুলে দিলে সন্তর্পণে। আর তক্ষুনি এক দারুণ কোলাহল উঠলো জাহাজে।

তবে কি ওরা জেনে ফেলেছে যে আমরা পালাচ্ছি! নেড তাড়াতাড়ি আমার হাতে একটা ছোরা গুজে দিলে। আর তখনই একটা প্রবল শোরগোল কানে এলো। মেলস্ট্রম! মেলস্ট্রম!

কী সর্বনাশ! মেলস্ট্রম!

আতঙ্কে আমার সর্বাঙ্গ হিম হয়ে এলো। শেষকালে নোয়ের উপকূলের সেই ভীষণ ঘূর্ণিপাকে এসে পড়লুম, যার হাত থেকে এমনকি মন্ত জাহাজেরাও রেহাই পায় না সচরাচর। কিন্তু পরক্ষণেই বোঁ করে ঘুরপাক খেয়ে ছুটে বেরিয়ে গেলো নৌকোটা, আর লোহার ফ্রেমে দারুণভাবে বা খেয়ে আমি আর্তনাদ করে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে গেলুম!