ধৃতরাষ্ট্রদর্শনে যুধিষ্ঠিরের উদ্যোগ
বৈশম্পায়ন বলিলেন, মহাত্মা পাণ্ডবগণ এইরূপে মাতা ও জ্যেষ্ঠতাত প্রভৃতির বিরহে নিতান্ত অভিভূত হইয়া পূৰ্ব্ববৎ রাজকার্য্যের অনুষ্ঠানে এককালে বিরত হইলেন। ঐ সময় কোন বিষয়েই আর তাঁহাদিগের আমোদ রহিল না। তাঁহারা সততই শোকাবিষ্টের ন্যায় কালযাপন করিতে লাগিলেন। ফলতঃ উঁহারা গাম্ভীর্য্যে সাগরতুল্য হইয়াও তৎকালে শোকে একেবারে হতজ্ঞান হইয়া পড়িলেন। তখন তাঁহারা পরস্পর পরস্পরের প্রতি দৃষ্টিপাতপূৰ্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “হায়! আমাদের জননী নিতান্ত কৃশাঙ্গী। তিনি কিরূপে অন্ধরাজ ও গান্ধারীর শুশ্রূষা করিতেছেন? পুত্রবিহীন অন্ধরাজ কিরূপে সেই শ্বাপদসঙ্কুল বিজন বিপিনে কালহরণ করিতেছেন এবং হতবান্ধব জননী গান্ধারীই বা কিরূপে সেই দুর্গমবনে বৃদ্ধ অন্ধপতির শুশ্রূষায় নিরত রহিয়াছেন?”
সহদেবাদির সহগমনে সহানুভূতি
পাণ্ডবগণ এইরূপে কিয়ৎক্ষণ আক্ষেপ করিয়া অন্ধরাজকে দর্শন করিবার নিমিত্ত নিতান্ত সমুৎসুক হইলেন। তখন মহাত্মা সহদেব ধৰ্ম্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে প্রণিপাতপূৰ্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! আপনি অন্ধরাজকে দর্শন করিতে বাসনা করিয়াছেন, ইহাতে আমার পরম পরিতোষ লাভ হইল। উহাকে দর্শন করিবার বাসনা আমার মনোমধ্যে নিরন্তর জাগরূক রহিয়াছে। আমি কেবল আপনার গৌরবনিবন্ধন আপনার নিকট ইহা প্রকাশ করিতে সমর্থ হই নাই। হায়! পূৰ্ব্বে যে মাতা রমণীয় অট্টালিকায় অবস্থানপূৰ্ব্বক পরমসুখে কালহরণ করিয়াছিলেন, এক্ষণে তিনি কিরূপে মস্তকে জটাধারণ ও কুশশয্যায় শয়ন করিয়া তপস্বিনীর বেশে অরণ্যে অবস্থান করিতেছেন? আমার কি কখন এমন সৌভাগ্য উপস্থিত হইবে যে, আমি তাঁহার সাক্ষাৎকার লাভ করিতে পারিব? যখন রাজপুত্রী হইয়াও মাতাকে অরণ্যে ক্লেশভোগ করিতে হইতেছে, তখন নিশ্চয় বুঝিলাম, ইহলোকে কেহই চিরকাল একরূপ অবস্থায় কালহরণ করিতে সমর্থ হয় না।”
সহদেব এই কথা কহিলে, মহানুভবা দ্রৌপদী বিনয়বাক্যে ধৰ্ম্মরাজকে সম্বোধনপূর্ব্বক কহিলেন, “মহারাজ! কখন আমি শত্রুকে দর্শন করিব? তাঁহাকে জীবিত দর্শন করিলেই আমার জীবন সার্থক হইবে। আপনার বুদ্ধি ও মন ধৰ্ম্ম হইতে যেন কখন বিচলিত না হয়। আজ আপনার প্রসাদে আমাদিগের পরম শ্ৰেয়োলাভ হইবে; আমি শ্বশুর অন্ধরাজ এবং জননী গান্ধারী ও কুন্তীকে দর্শন করিবার নিমিত্ত প্রস্তুত হইয়া রহিয়াছি।”
মহানুভবা দ্রৌপদী এই কথা কহিলে ধৰ্ম্মরাজ সেনাপতিদিগকে আহ্বানপূৰ্ব্বক কহিলেন, “হে সৈন্যাধ্যক্ষগণ! তোমরা অবিলম্বে হস্তী, অশ্ব ও রথসমুদয় সুসজ্জিত কর। সৈন্যগণও সুসজ্জিত হইয়া অগ্রসর হউক। আমি অচিরাৎ অন্ধরাজকে দর্শন করিবার নিমিত্ত অরণ্যে যাত্রা করিব।”
মহারাজ যুধিষ্ঠির সৈন্যাধ্যক্ষগণকে এই কথা কহিয়া, অন্তঃপুরের অধ্যক্ষদিগকে কহিলেন, “তোমরা সত্বর বিবিধ যান, শিবিকা [পাল্কী], শকট [গাড়ী] ও আপণ[শকটবাহিত বাজার]সমুদয় সুসজ্জিত কর। শিল্পকর ও এ কোষাধ্যক্ষেরা কুরুক্ষেত্রের আশ্রমাভিমুখে যাত্রা করুক। পুরবাসী যে-কোন ব্যক্তি অন্ধরাজকে দর্শন করিতে বাসনা করেন, তিনি যেন অক্লেশে সুরক্ষিত হইয়া তথায় গমন করিতে পারেন। এক্ষণে তোমরা পাচক ও অন্যান্য লোকসমুদয়কে যাত্রা করিতে আদেশ করিয়া ভক্ষ্যভোজ্যসমুদয় শকটে সংস্থাপনপূর্ব্বক অন্ধরাজের আশ্রমাভিমুখে প্রেরণ কর এবং আমরা কল্য প্রভাতে যাত্রা করিব, এই কথা নগরের সর্ব্বত্র ঘোষণা করিয়া দেও। আজই যেন পথিমধ্যে আমাদের বাসগৃহসমুদয় প্রস্তুত করা হয়।”
ধৰ্ম্মরাজ ভ্রাতৃগণের সহিত অধ্যক্ষদিগকে এইরূপ আদেশ করিয়া সেই দিবস পুরমধ্যে অবস্থান করিলেন। পরদিন প্রভাত হইবামাত্র তিনি গাত্রোত্থানপূৰ্ব্বক বৃদ্ধ ও অন্তঃপুরিকাদিগকে অগ্রসর করিয়া ভ্রাতৃগণের সহিত পুর হইতে বহির্গত হইলেন এবং লোকসংগ্রহ করিবার নিমিত্ত সেইদিন অবধি পাঁচদিন পুরের বহির্ভাগে অবস্থান করিতে লাগিলেন।