যদি, কাল আমরা জিনিশপত্র সব ফেলে দিয়ে বেলুনকে হালকা না-করতুম, তাহলে এতক্ষণে আমাদের যে কী পরিণতি হতো, তা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো?
এখনও অত ভয় পাচ্ছো কেন তুমি? আমরা তো সব পেরিয়ে এলুম। তোমার অনুমতি ছাড়া এখন আর বেলুন নিচে নামবে না।
তা জানি। কিন্তু নিচে তাকিয়ে দ্যাখো একবার। ফার্গুসন বললেন।
বনের সীমান্ত যেখানে শেষ হয়েছে, সেখান থেকে চল্লিশজন ঘোড়সোয়ার রে-রে করে ছুটে আসছে। তাদের কারু হাতে বল্লম, কারু হাতে বন্দুক। ভিক্টরিয়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে তারা তলা দিয়ে। মাঝে-মাঝে ওপর দিকে তাকিয়ে বিকট গলায় চেঁচিয়ে উঠে নানারকম উৎকট অঙ্গভঙ্গি করছে। তাদের রাগি চঁচামেচি শুনে মনে হলো একবার ধরতে পারলে তারা যেন সব্বাইকে ছিড়ে-খুঁড়ে ফেঁড়ে ফেলবে। অসমতল উঁচু-নিচু পথ দিয়ে অসীম ক্ষিপ্রতায় অনায়াসে ঘোড়া ছুটিয়ে চলে আসছে। তারা পুরোদমে জোরকদমে।
ফার্গুসন জানালেন, এরা হলো নিষ্ঠুর ট্যালিবাস-জাতীয় জংলি, আফ্রিকার অন্যতম ভীষণ জাতি। কোনোকিছুতেই বাগ মানে না, পোষ মানে না, নরম হয় না। কালোদেরও এরা রেহাই দেয় না। আমি বরং বুনো জানোয়ারদের সামনেও পড়তে রাজি, কিন্তু এদের সামনে নয়। পশুর চেয়েও হিংস্র এরা, কোনোরকম মানবিক মূল্যবোধই নেই এদের।
ওদের চেহারাছিরি চালচলন দেখে তোমার কথাই ঠিক বলে মনে হয়। কী ভীষণ দেখতে একেক জন! আর চাউনিতে যেন আগুন জ্বলছে! ভাগ্যিশ ওরা উড়তে পারে না—নইলে আর দেখতে হতো না।
ঐ পোড়া গ্রামগুলো দেখতে পাচ্ছো-ধসে চুরমার হয়ে পড়ে আছে? সব এদের কীর্তি। যে-সব জমিতে এককালে সোনালি ফসল দুলে উঠতো হাওয়ায়, আগুন লাগিয়ে সব ছারখার করে দিয়ে কেবল কালো ছাই আর পোড়া মাটি রেখে দিয়ে গেছে এরা।
আমাদের ওরা ধরবে কী করে? একবার নদীর ওপারে পৌঁছুতে পারলেই তো নিরাপদ।
ঠিকই বলেছে। এখন ঈশ্বর যদি দয়া করেন, তাহলেই হয়। বেলুনের ক্ষমতায় এখন আর-কোনো আস্থা নেই আমার। যে-কোনো মুহূর্তে সব গ্যাস শেষ হয়ে বেলুন নিচে নেমে পড়তে পারে। আর, একবার নামলেই আর-কোনো কথা নেই, চক্ষের পলকে এই দস্যুরা আমাদের ছিন্নভিন্ন করে দেবে।
সারা সকালটা ফেউয়ের মতো দস্যুরা তাদের সঙ্গে-সঙ্গে তাড়া করে এলো। বেলা এগারোটার সময় হিশেব করে দেখলেন, এতক্ষণে মাত্র পনেরো মাইল পথ অতিক্রম করেছেন।
এমন সময় বিপদের গুরুত্বকে আরো বাড়িয়ে দেবার জন্যেই যেন দিগন্ত থেকে, হাতির মতো কালো শুঁড় বাড়িয়ে, এগিয়ে এলো মেঘ। ঝড়ের আশঙ্কায় ফার্গুসন রীতিমত বিচলিত হয়ে পড়লেন। ঝড় যদি আবার তাদের নাইজারের দিকে উড়িয়ে নিয়ে যায়। তাহলে আর রেহাই নেই। আর অবস্থা যখন এইরকম, তখন বেলুনও যেন চক্রান্ত করলে তাদের বিরুদ্ধে। স্পষ্ট দেখা গেল ক্রমশ সে নিচের দিকে নেমে আসছে। যাত্রা শুরু করার পর থেকে এতক্ষণের মধ্যে প্রায় তিনশো ঘন ফিট গ্যাস নষ্ট হয়ে গেছে। এখনও কম করেও বারো মাইল দূরে রয়েছে সেনেগল নদী। বেলুন যে-হারে অতি ধীরে-ধীরে এগুচ্ছে, তাতে অন্তত আরো ঘণ্টাতিনেক সময় লাগবে।
এদিকে নিচে অনুসরণকারী দস্যুদের বিকট চীৎকারে ক্রমশ উল্লাসের ভাব জেগে উঠলো। তার কারণ আর কিছুই নয়, বেলুন এখন ক্রমশ নিচে নেমে যাচ্ছে। মিনিট পনেরো মধ্যেই দোলনা মাটি থেকে প্রায় দেড়শো ফিট ওপর দিয়ে চলতে লাগলো; তবে হাওয়ার সাপট একটু বেশি বলে, এখন তার গতি আগের চেয়ে অপেক্ষাকৃত বেড়েছে। দস্যুরা এখন থেকেই বেলুন তাগ করে মুহুর্মুহু গুলি চালাতে শুরু করে দিয়েছে। ভার বা ব্যালাস্ট আর না-কমালে রেহাই নেই। ফার্গুসনের নির্দেশে শেষখাদ্যটুকুও ফেলে দেয়া হলো। সঙ্গে-সঙ্গে বেলুন ওপরে উঠে গেলো বটে, কিন্তু আধঘণ্টা যেতে না যেতেই আবার নিচের দিকে নামতে শুরু করে দিলে বেলুনের রেশমি খোলটা দু-এক জায়গায় ফেঁশে গিয়েছে, তাই দিয়ে ই-ই করে গ্যাস বেরিয়ে যাচ্ছে, আর তার ফলেই বেলুনের নিচের দিকে টানটা আগের চেয়ে আরো দ্রুত হয়ে উঠেছে।
অল্পক্ষণের মধ্যেই দোলনা মাটি স্পর্শ করলো; সঙ্গে-সঙ্গে হৈ-হৈ করে দস্যুরা ছুটে এলো সেদিকে। কিন্তু এ-রকম সময়ে সাধারণত যা হয়ে থাকে তা-ই ঘটলো–মাটিতে ধাক্কা খেয়ে বেলুন বলের মতো তক্ষুনি আবার বিপরীত আঘাতে আকাশে লাফিয়ে উঠে প্রায় মাইলখানেক ভেসে গেলো।
নাঃ, দস্যুদের হাত থেকে দেখছি কিছুতেই নিস্তার নেই। অসহায় রাগে কেনেডি নিশপিশ করে উঠলেন।
সব ফেলে দাও-এমনকী শেষ নোঙরটাও ফেলে দাও। ফার্গুসন হেঁকে বললেন।
সব যন্ত্রপাতি ফেলে দেয়া হলো বিশেষ কিছুই ফল হলো না, বেলুন শুধু একটুক্ষণের জন্যে আকাশে উঠে ফের মাটিতে নেমে আসছে। হিংস্র জানোয়ারের মতো প্রবল বেগে ঘোড়ায় চেপে আসছে ট্যালিবাস দস্যুরা। তারা যখন প্রায় দুশো গজের মদ্যে এসে পড়লো ফার্গুসন চেঁচিয়ে বললেন, আর তোমার বন্দুকের মায়া কোরো না, ডিক। চট করে সব বন্দুক ফেলে দাও।
আগে কয়েকটাকে গুলি না-করে ফেলছি না! কেনেডি দস্যুদের লক্ষ্য করে পর-পর কতগুলি গুলি ছুঁড়লেন। অব্যর্থ টিপ তার, কিন্তু এটা কে জানতো যে তার এই অমোঘ উদগিরণ শেষটায় মানুষ শিকারে লাগবে? উৎকট আর্তনাদ করে কয়েকটি দস ঘোড়া থেকে ছিটকে পড়লো।
রবারের বলের মতো আবার বেলুন একলাফে আকাশে উঠলো বটে, কিন্তু এঅবস্থায় বেশিক্ষণ চললো না। হঠাৎ এক দমকে অনেকটা গ্যাস বেরিয়ে গিয়ে বেলুন চুপসে গেলো।
সব শেষ হয়ে গেলো তাহলে! আর এখন রক্ষে নেই। কেনেডির গলা হতাশায়। ভাঙা-ভাঙা শোনালো।
না, ফার্গুসন হঠাৎ দৃঢ় স্বরে বলে উঠলেন অস্বাভাবিক একটি দীপ্তিতে হঠাৎ তার চোখদুটি চকচক করে উঠলো। না, এত সহজে হাল ছাড়বো না! আরো-একটি জিনিশের মায়া আমাদের ছাড়তে হবে, তাহলে প্রায় শো-তিনেক পাউণ্ড হালকা হবে ভিক্টরিয়া।
শো-তিনেক পাউণ্ড হালকা হবে? বিমূঢ় হয়ে গেলেন কেনেডি।সেটা আবার কী?
আমাদের দোলনা। শিগগির বেলুনের খোলের দড়ি-দড়া ধরে ঝুলে পড়ো। এমনিভাবে ঝুলেই আমরা নদী পেরুতে পারবো। শিগগির কলোরা, হাতে একটুও সময় নেই!
মৃত্যুকে প্রতিরোধ করার জন্যে এক অমানুষিক শক্তিতে ভরে গেলেন অভিযাত্রীরা। বেলুনের দড়ি ধরে ঝুলে পড়লেন তারা, আর জো এক হাতে দোলনার দড়ি কেটে দিলে। নিমেষের মধ্যে নিচে আছড়ে পড়লো দোলনাটা, আর বেলুন সে করে একসঙ্গে শো-কয়েক ফিট ওপরে উঠে এলো।
শিকার পালিয়ে যায় দেখে দস্যুরাও তখন মরীয়া হয়ে উঠেছে, পাগলের মতো অনবরত চাবুক মারতে লাগলো তারা ঘোড়ার পিঠে, আর মুখের ফেনা তুলে পুয়োকদমে ছুটতে লাগলো আরবদের বিখ্যাত ঘোড়াগুলি। খুরে-খুরে নীল ফুলকি ছিটিয়ে দিচ্ছে তারা, ফেনার সঙ্গে নিশ্বাসে হলকা ছাড়ছে। কিন্তু ভিক্টরিয়া ততক্ষণে প্রবল হাওয়ার তোড়ে আরো জোরে ভেসে চলেছে, একটু পরেই একটা ছোটো পাহাড় পেরিয়ে এলো সে অনায়াসে। পাহাড়ের গায়ে ঘোড়ার চলার পথ নেই বলে দস্যুরা শেষটায় হাল ছেড়ে দিয়ে সেখানেই থেমে যেতে বাধ্য হলো।
পাহাড় পেরিয়েই ফার্গুসন চেঁচিয়ে উঠলেন, ঐ-যে, ঐ-যে নদী! ঐ দ্যাখো, সেনেগল নদী!
দূরে দেখা গেলো নদীর রুপোলি জলস্রোত ঘুরে-ঘুরে এঁকেবেঁকে বয়ে যাচ্ছে, যেন একটা রুপোর তৈরি সজীব তরল সাপ। যেন ধীরে-ধীরে সুন্দর একটি চকচকে সাপ কুণ্ডলী ছাড়িয়ে ঘুম ভেঙে জেগে উঠে বুকে হেঁটে দূরের দিকে চলে যাচ্ছে। তখনও তা প্রায় মাইল-দুয়েক দূরে; নদীটা পুরোপুরি পেরিয়ে যেতে পারলে সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত হওয়া যায়। ভাগ্য যদি আর তাঁদের জীবন নিয়ে আর কোনো ছিনিমিনি নাখেলে তাহলে আর মিনিট পনেরোর মধ্যেই তারা আপাতত নিরাপদ হয়ে যাবেন, আরকোনো আশঙ্কাই থাকবে না প্রাণের।
কিন্তু তা বুঝি আর হয় না।