২২৯তম অধ্যায়
কুমারীগণের বালমাতৃকত্ব গ্ৰহণ
মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “হে ধর্ম্মানন্দন! এদিকে সেই ছয়জন মহর্ষিপত্নী স্ব স্ব পতিকর্ত্তৃক পরিত্যক্ত হইয়া অসামান্য শ্ৰীসম্পন্ন দেবসেনাপতি কার্ত্তিকেয়ের সমীপে আগমনপূর্ব্বক কহিতে লাগিলেন, “বৎস! আমাদিগের স্বামীগণ ক্ৰোধপরতন্ত্র হইয়া বিনাপরাধে আমাদিগকে পরিত্যাগ করিয়াছেন। কোন ব্যক্তি আমাদিগকে ভর্ত্তৃগণকে কহিয়াছে, আমরা তোমাকে সমুৎপাদন করিয়াছি; তাঁহারা এই কথা-শ্রবণে বিচার না করিয়াই আমাদিগকে পরিত্যাগ করিয়াছেন; এক্ষণে তুমি আমাদিগকে পরিত্ৰাণ কর। হে মহাভাগ! তোমার প্রসাদে আমাদের অক্ষয় স্বৰ্গলাভ হইবে; আমরা তন্নিমিত্তই তোমাকে পুত্ৰ করিতে বাসনা করি। তুমি আমাদের পুত্র হইয়া মাতৃঋণ হইতে মুক্ত হও।”
“স্কন্দ কহিলেন, “হে মহর্ষিপত্নীগণ! আপনারা আমার মাতা, আমি আপনাদের পুত্র, এতদ্ভিন্ন আপনারা আর যাহা অভিলাষ করেন, তৎসমুদয়ও সম্পূর্ণ হইবে।” অনন্তর কার্ত্তিকেয় দেবরাজকে বিবক্ষু [কহিতে ইচ্ছুক] দেখিয়া কহিতে লাগিলেন, ‘সুরাজ! কি করিতে হইবে, আজ্ঞা করুন।’ ইন্দ্ৰ কহিলেন, “হে মহাত্মন! রোহিণীর কনিষ্ঠা ভগিনী অভিজিৎ স্পৰ্দ্ধা করিয়া জ্যেষ্ঠ হইবার বাসনায় তপানুষ্ঠান করিতে বনে গমন করিয়াছে; তন্নিমিত্ত আমি নক্ষত্রসংখ্যাপূরণে অসমর্থ হইয়াছি; অতএব এক্ষণে তুমি ব্ৰহ্মার সহিত মিলিত হইয়া গগনচ্যুত অভিজিতের পরিবর্তে অন্য নক্ষত্র প্রতিষ্ঠিত করিবার উপায় চিন্তা কর।” স্কন্ধ ইন্দ্ৰকর্ত্তৃক এইরূপ অভিহিত হইয়া ব্রহ্মার নিকট গমন করিলে তিনি ধনিষ্ঠাদি কালের কল্পনা করিলেন। সেইকালই পূর্ব্বে রোহিণী নক্ষত্র হইয়াছিল। এদিকে কৃত্তিকাগণ ইন্দ্রের অভিপ্ৰায় অবগত হইয়া নক্ষত্রসংখ্যা পূরণ করিবার নিমিত্ত স্বর্গে গমন করিলেন। তাহারা ছয়জন গারুড়ীর সহিত মিলিত হইয়া সপ্তশীষাভ নক্ষত্ররূপ অদ্যাপি দীপ্তি পাইতেছেন।
“অনন্তর বিনতা স্কন্দকে কহিলেন, “হে মহাভাগ! তুমিই আমার পিণ্ডদ পুত্র, আমি তোমার সহিত সতত একত্র বাস করিতে বাসনা করি।”
“স্কন্দ কহিলেন, “জননী! আপনার অভিলাষ পূর্ণ করিলাম, আপনাকে নমস্কার। আপনি পুত্ৰস্নেহসহকারে আমাকে প্রতিপালন ও আপনার স্নষার সহিত সুখস্বচ্ছন্দে বাস করুন।”
“অনন্তর মাতৃগণ একত্র হইয়া স্কন্দকে কহিলেন, “হে কুমার! পণ্ডিতগণ আমাদিগকে সর্ব্বলোকমাতা বলিয়া কীর্ত্তন করিয়াছেন; তন্নিমিত্ত আমরা তোমার মাতা হইতে বাসনা কর; তুমি আমাদিগকে পূজা কর।”
“স্কন্দ কহিলেন, “আপনারা আমার মাতা, আমি আপনাদের পুত্র, আজ্ঞা করুন, আপনাদিগের কি অভিলাষ সম্পাদন করিব।”
“বিনতাদি মাতৃগণ কহিলেন, ‘ব্রাহ্মী, মাহেশ্বরী প্রভৃতি যাহারা পূর্ব্বে মাতৃত্বপদে পরিকল্পিত হইয়াছে, এক্ষণে তাহাদের সেই পদ আর না থাকে; আমরা যেন তাহাদের স্থানীয় হইয়া লোকের পূজনীয় হই; কেহ যেন তাহাদিগকে পূজা না করে। আর তোমার নিমিত্ত তাহারা আমাদের ভর্ত্তৃগণকে প্রকোপিত করিয়া যে সমস্ত সন্তান-সন্ততি বিনষ্ট করিয়াছে, তৎসমুদয় আমাদিগকে প্ৰদান কর।”
“স্কন্দ কহিলেন, “হে মাতৃগণ! আমি আগ্রহাতিশয়সহকারে প্রার্থনা করিলেও মহর্ষিগণ আপনাদের গ্রহণে সম্মত হইবেন না; অতএব এক্ষণে অন্য কোন প্রকার প্রজা আপনাদের অভিলষণীয়, বলুন।”
“মাতৃগণ কহিলেন, “আমরা তোমার সহিত একত্র মিলিত হইয়া সেই সমুদয় পূর্বোক্ত মাতৃগণের প্রজা ও পিত্ৰাদিকে ভক্ষণ করিতে বাসনা করি।”
“স্কন্দ কহিলেন, “হে মাতৃগণ! আমি আপনাদিগকে প্রজা প্ৰদান করিতেছি; কিন্তু আপনারা অতি দারুণ বাক্য প্রয়োগ করিয়াছেন, অতএব প্ৰণতিপূর্ব্বক কহিতেছি, আপনারা অনুগ্রহ করিয়া ঐ প্ৰজাগণকে রক্ষা করুন।”
“মাতৃগণ কহিলেন, “হে মহাত্মন! আমরা তোমার ইচ্ছানুসারে ঐ সন্তানগণকে রক্ষা করিব; কিন্তু তোমার সহিত চিরকাল একত্র বাস করিতে বাসনা করি।”
“স্কন্দ কহিলেন, “মানবসন্ততিগণের যতদিন ষোড়শবর্ষ বয়ঃক্রম পরিপূর্ণ না হইবে, তাবৎকাল আপনারা নানাবিধ রূপ ধারণপূর্ব্বক তাহাদিগের বিঘ্ন উৎপাদন করুন। আর আমি আপনাদিগকে এক রৌদ্র অব্যয়পুরুষ প্রদান করিতেছি, আপনারা তাহার সহিত বাস করিবেন।”
“ভগবান স্কন্দ এই কথা কহিবামাত্র তাঁহার শরীর হইতে অগ্নিতুল্য এক বীরপুরুষ বিনির্গত হইল; মনুষ্যগণের সন্তানসন্ততি ভক্ষণ করাই উহার উদ্দেশ্য; ঐ পুরুষ উৎপন্ন হইবামাত্র ক্ষুধায় একান্ত কাতর ও বিসংজ্ঞপ্ৰায় হইয়া সহসা ধরাতলে নিপতিত হইল এবং তৎপরে স্কন্দের অনুজ্ঞানুসারে ঘোররূপ গ্ৰহ হইয়া উঠিল। ব্রাহ্মণগণ ঐ গ্রহকে স্কন্দাপস্মার, মহারৌদ্র, বিনতাকে শকুনিগ্রহ, রাক্ষসী পূতনাকে পূতনাগ্রহ ও কষ্টদায়িনী ঘোররূপ নিশাচরী পিশাচীকে শীতপূতনা কহিয়া থাকেন। শীতপূতনা মানুষীগণের গর্ভ-সমুদয় হরণ করে। অদিতি রেবতী বলিয়া বিখ্যাত; উহার গ্রহের নাম রৈবত। ঐ মহাঘোর গ্রহও বালকগণের বিঘ্ন উৎপাদন করিয়া থাকে। দৈত্যগণের মাতা দিতিকে মুখমণ্ডিকা কহে। দুরাসদা মুখমণ্ডিকা সাতিশয় শিশুমাংসলোলুপ।
“হে পাণ্ডবনাথ! যে যে কুমার-কুমারীগণ স্কন্দ হইতে সমুদ্ভূত হইয়াছে, তাহারা সকলেই মহাগ্রহ ও গৰ্ভভোজী। ঐ সমুদয় কুমারগণ উক্ত কুমারীগণের পতি, উহারা সকলেই অজ্ঞাতসারে বালকগণকে হরণ করিয়া থাকে।
“প্রাজ্ঞ লোক-সমুদয় গোমাতাকে সুরভি কহিয়া থাকেন। শকুনিগ্ৰহ তাঁহার উপর আরোহণপূর্ব্বক বালকগণকে ভোজন করে। কুক্কুরমাতা সরমা সর্ব্বদা মানুষীগণের গর্ভ হরণ করিয়া থাকে। পাদপসমূদয়ের মাতাকে করঞ্জনিলয়া কহে। তিনি সাতিশয় অনুকম্পপরতন্ত্র, সৌম্যমূর্ত্তি ও বরপ্রদা; এই নিমিত্ত পুত্রার্থী ব্যক্তিগণ করঞ্জপাদপ অবলোকন করিলেই তাহাকে নমস্কার করে। এই অষ্টাদশ ও অন্যান্য গ্ৰহসমুদয় মাংসভক্ষণ ও মধুপানে নিতান্ত অভিলাষী, উহারা দশ দিবস অনবরত সূতিকাগৃহে বাস করে।
“হে মহারাজ! নাগমাতা কদ্রু সূক্ষ্মকলেবর পরিগ্রহ করিয়া গর্ভিণীর শরীরে প্রবেশপূর্ব্বক গর্ভ ভক্ষণ করে। গন্ধৰ্ব্বগণের মাতা গর্ভিণীর গর্ভ গ্রহণপূর্ব্বক প্রস্থান করে; এই নিমিত্ত লোকে কোন কোন নারীর গর্ভ বিলীন হইতে দৃষ্ট হইয়া থাকে। অন্সরাদিগের জননী গর্ভিণীগণের গর্ভ গ্রহণ করিয়া থাকে। এই নিমিত্ত পণ্ডিতগণ গৰ্ভ বিনষ্ট হইয়াছে কহেন। লোহিত সমুদ্রের কন্যা স্কন্দের ধাত্রী, উহার নাম লোহিতযোনি; কদম্ববৃক্ষে উহাকে পূজা করে। পুরুষগণের মধ্যে রুদ্র যেমন সর্ব্বশ্রেষ্ঠ, স্ত্রীগণের মধ্যে আৰ্য্যাও তদ্রূপা৷ আৰ্য্যা কুমারের মাতা, লোকে অভিলাষসিদ্ধির নিমিত্ত উহাকে পৃথক পূজা করিয়া থাকে।
বালকগণের মহাগ্ৰহাবেশ-প্ৰতিকার
“হে রাজন! যে সমুদয় মহাগ্রহের বিষয় কীর্ত্তিত হইল, তাহারা বালকগণের ষোড়শ বর্ষ বয়ঃক্রম পৰ্য্যন্ত অমঙ্গলবিধান করে। আর যে সমুদয় পুরুষগ্রহ ও মাতৃগণের বিষয় কীর্ত্তন করিলাম, উহারা স্কন্দগ্ৰহ বলিয়া বিখ্যাত। স্নান, ধূপ, অঞ্জন, বলি ও উপহার-প্ৰদানদ্বারা উহাদিগের শান্তি হয়। উহারা উক্ত প্রকারে সম্যকরূপে অভ্যর্চিত হইলে মনুষ্যগণকে আয়ু, বীৰ্য্য প্রভৃতি শুভ ফল প্ৰদান করে। হে মহারাজ! এক্ষণে মনুষ্যগণের ষোড়শ বৎসর বয়ঃক্ৰম অতিক্রান্ত হইলে যে-সকল গ্রহ দ্বারা তাহাদের অপকার হয়, আমি মহেশ্বরকে নমস্কার করিয়া তৎসমুদয় বিষয় কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর।
“হে পাণ্ডবনাথ! মনুষ্যগণ নিদ্রা বা জাগরণাবস্থায় দেবগণকে দেখিবামাত্ৰ যে উন্মত্ত হইয়া উঠে, উহাকে দেবগ্রহ কহে। মানবজাতি আসীন বা শয়ান হইয়া পিতৃগণকে দেখিবামাত্র যে উন্মাদগ্ৰস্ত হয়, উহাকে পিতৃগ্রহ কহে। সিদ্ধগণকে অবমাননা করিয়া বা তাঁহাদিগের ক্ৰোধপ্রযুক্ত অভিশপ্ত হইয়া যে হঠাৎ উন্মত্ত হয়, উহার নাম সিদ্ধগ্ৰহ। বিবিধ প্রকার গন্ধ বা রস আঘ্রাণ করিবামাত্র যে সহসা উন্মত্ত হয়, উহাকে রাক্ষসগ্রহ কহে; গন্ধৰ্বের আবেশবশতঃ যে সহসা উন্মত্ত হইয়া উঠে, উহার নাম গন্ধর্ব্বগ্রহ। নিত্য নিত্য পিশাচের আরোহণবশতঃ যে ক্ষিপ্ত হয়, উহাকে পৈশাচ গ্রহ কহে এবং যক্ষের আবেশবশতঃ যে হঠাৎ উন্মাদগ্ৰস্ত হইয়া উঠে, উহাকে যক্ষগ্রহ কহে। দোষবশতঃ চিত্ত প্ৰকুপিত হওয়াতে যে ব্যক্তি উন্মত্ত হয়, শাস্ত্ৰমতে অতিশীঘ্ৰ তাহার চিকিৎসা করা বিধেয়। যে ব্যক্তি বৈক্লব্য, ভয় বা ঘোরদর্শনদ্বারা হঠাৎ উন্মত্ত হইয়া উঠে, সান্ত্ববাদই তাহার রোগোপশমের উত্তম উপায়।.
“হে রাজন! গ্রহ তিন প্রকার; কোন কোন গ্ৰহ ক্ৰীড়াভিলাষী, কোন কোন গ্ৰহ ভোগাভিলাষী ও কেহ কেহ কামক্রীড়াভিলাষী। এই সকল গ্ৰহ মনুষ্যগণের সপ্ততি বৎসর বয়ঃক্রম পৰ্যন্ত অহিতাচরণ করিয়া থাকে, তৎপরে গ্রহসদৃশ জ্বর তাহাদিগকে আক্রমণ করে। হে রাজন! যে ব্যক্তি জিতেন্দ্ৰিয়, দান্ত, শুচি, অতীন্দ্ৰিত, আস্তিক ও শ্রদ্ধাবান এবং মহেশ্বরের প্রতি যাহার অবিচলিত ভক্তি, গ্ৰহগণ কদাচ তাহাদিগকে আক্রমণ করিতে সমর্থ হয় না।”