২২৮তম অধ্যায়
লক্ষ্মীলাভের লক্ষণ—লক্ষ্মী-বাসবসংবাদ
যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! লোকের ভাবী সম্পদ ও বিপদের পূর্ব্বলক্ষণ কি, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।”
ভীষ্ম কহিলেন, “ধৰ্ম্মরাজ! চিত্তই মনুষ্যদিগের ভাবী সম্পদ ও বিপদের লক্ষণ প্রকাশ করিয়া দেয়। এই স্থলে লক্ষ্মী-বাসবসংবাদ নামে এক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্তিত আছে, কহিতেছি, শ্রবণ কর। ব্রহ্মার ন্যায় তেজঃপুঞ্জকলেবর, নিষ্পাপ, মহাতপস্বী নারদ স্বীয় অসাধারণ তপস্যার ফলে ব্রহ্মলোকনিবাসী ঋষিগণের তুল্যতা লাভ করিয়া সমুদয় লোক সন্দর্শনপূৰ্ব্বক স্বেচ্ছানুসারে ত্রিলোকমধ্যে বিচরণ করিতেন। একদা তিনি প্রাতঃকালে গাত্রোত্থানপূর্ব্বক অবগাহনবাসনায় ধ্রুবলোকে গঙ্গাপুলিনে উপস্থিত হইয়াছেন, এমন সময় পাকশাসন, শম্বরনিহন্তা, ব্রজপাণি পুরন্দরও তথায় আগমন করিলেন। তাঁহারা উভয়ে একত্র স্নান আহ্নিক সমাধানপূৰ্ব্বক অতি সূক্ষ্ম কাঞ্চনময় বালুকাপরিপূর্ণ তীরভূমিতে উপবেশন করিয়া দেবর্ষিগণকথিত পূৰ্ব্ববৃত্তান্তসমুদয় কথোপকথন করিতে লাগিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে ভগবান মরীচিমালীর পূর্ণমণ্ডল সমুদিত হইল। তখন তাঁহারা ভক্তিভাবে গাত্রোত্থানপূর্ব্বক তাঁহার স্তব করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় দিবাকরের অভিমুখে অপর ভাস্করের ন্যায় আর একটি জ্যোতিৰ্ম্মণ্ডল তাঁহাদের নয়নগোচর হইল। সেই জ্যোতিৰ্ম্মণ্ডলের প্রভায় ত্রিলোক উদ্ভাসিত হইয়া উঠিল। সুররাজ পুরুন্দর ও দেবর্ষি নারদ অনিমেষলোচনে উহা অবলোকন করিতে লাগিলেন।
লক্ষ্মীচৰ্য্যায় লক্ষ্মীলাভ—ইন্দ্রক্ষ্মীসংবাদ
“অনন্তর সেই জ্যোতির্ম্মণ্ডল ক্রমে ক্রমে সমীপবর্তী হইলে তাঁহারা নক্ষত্রসমপ্রভ [নক্ষত্রমালার ন্যায় কান্তিযুক্ত] অলঙ্কারে সমলতা মুক্তামালাধারিণী সাক্ষাৎ লক্ষ্মীকে মনোহরবেশা অপ্সরাদিগের অগ্রে অগ্রে হুতাশনশিখার ন্যায় আগমন করিতে দেখিলেন। কিয়ৎক্ষণ পরে কমলবাসিনী কমলা বিমান হইতে অবতীর্ণ হইয়া ত্রিলোকেশ্বর ইন্দ্র ও দেবর্ষি নারদের সমীপে সমুপস্থিত হইলেন। লক্ষ্মী সমাগত হইবামাত্র দেবরাজ ইন্দ্র নারদের সহিত তাঁহার সম্মুখীন হইয়া কৃতাঞ্জলিপুটে বিনীতভাবে তাঁহাকে অর্চ্চনা করিয়া কহিলেন, চারুহাসিনি! আপনি কে? কি নিমিত্ত কোন্ স্থান হইতে এখানে উপস্থিত হইলেন এবং কোন্ স্থানেই বা আপনাকে গমন করিতে হইবে, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।
“লক্ষ্মী কহিলেন, ‘দেবরাজ! এই বিশ্বসংসারমধ্যে কি স্থাবর, কি জঙ্গম সকলেই আমাকে লাভ করিবার বাসনায় যত্ন করিয়া থাকে। আমি সমুদয় লোকের ভূতির [ঐশ্বর্য্যের] নিমিত্ত সূর্য্যকিরণবিকশিত পদ্ম হইতে সমুৎপন্ন হইয়াছি। আমি পদ্মা, লক্ষ্মী, ভূতি, শ্রী, শ্রদ্ধা, মেধা, সন্নতি, বিজিতি, স্থিতি, ধৃতি, সিদ্ধি, স্বাহা, স্বধা, নিয়তি ও স্মৃতি এবং আমি তোমার সম্পত্তিস্বরূপ। আমি জয়শালী ধার্ম্মিক নরপতিদিগের সেনামুখ, ধ্বজ, রাজ্য ও অন্তঃপুর এবং সংগ্রামে পলায়নপরাঙ্মুখ, জয়শালী, সত্যবাদী, ধর্ম্মপরায়ণ, সুবুদ্ধি, ব্ৰহ্মনিষ্ঠ, দানশীল বীরগণের নিকট বাস করিয়া থাকি। আমি পুৰ্ব্বে সত্যধর্ম্মপ্রভাবে সংযত হইয়া অসুরগণের নিকট বাস করিয়াছিলাম, এক্ষণে তাহাদিগের বুদ্ধিবিপর্য্যয় অবলোকন করিয়া সম্প্রতি তোমার নিকট অবস্থান করিতে অভিলাষিণী হইয়াছি।
“ইন্দ্র কহিলেন, ‘দেবি! আপনি কি নিমিত্ত দৈত্যদিগকে আশ্রয় করিয়াছিলেন এবং কি অপরাধেই বা এক্ষণে তাহাদিগকে পরিত্যাগপূৰ্ব্বক আমার নিকট আগমন করিলেন?’
“লক্ষ্মী কহিলেন, ‘দেবরাজ! যাহারা স্বধর্ম্মপরায়ণ, ধৈৰ্য্যশালী ও স্বর্গলাভে অনুরক্ত, আমি সেই সমস্ত পুরুষের প্রতিই অনুরক্ত থাকি। পূৰ্ব্বে দৈত্যগণের দান, অধ্যয়ন, সত্য, যজ্ঞানুষ্ঠান, দেবতা ও পিতৃগণের আরাধনা এবং গুরু ও অতিথিদিগের সৎকারবিষয়ে বিলক্ষণ অনুরাগ ছিল। তাহারা গৃহমার্জ্জনতৎপর, জিতেন্দ্রিয়, হোমপরায়ণ, গুরুশুশ্রূষানিরত, দান্ত, ব্রাহ্মণের হিতকারী, শ্রদ্ধান্বিত, জিতক্রোধ ও অসূয়াবিহীন হইয়া যত্নপূৰ্ব্বক পুত্র, কলত্র ও অমাত্যদিগকে প্রতিপালন করিত। তাহারা কখনই পরস্পর ক্রুদ্ধ হইয়া পরস্পরকে আক্রমণ করিত না। কেহই পরশ্রীদর্শনে কাতর হইত না। সকলেই দাতা, গৃহীতা, মান্য, বিনয়জ্ঞ, প্রসাদ [প্রসন্নতাপূর্ণ], গুণসম্পন্ন, সরল, দৃঢ়ভক্তিসমন্বিত, ভূত ও অমাত্যগণের পরিপোষক, কৃতজ্ঞ, প্রিয়বাদী, লজ্জাশীল, যতব্রত [অস্খলিত ব্রত], সুস্নাত, সুগন্ধচর্চ্চিত, বিদ্যালঙ্কারসমলঙ্কৃত, উপবাসপরায়ণ, তপানুষ্ঠাননিরত, বিশ্বস্ত, ব্রহ্মবাদী এবং সমুচিত মান ও অর্থসংগ্রহে যত্নবান্ ছিল। তাহারা সকলেই সূর্যোদয়ের পূর্ব্বে গাত্রোত্থান করিত। কেহই প্রাতঃকালে শয়ন, দিবসে নিদ্ৰাসেবন এবং রাত্রিযোগে দধি ও শক্ত ভোজন করিত না। তাহারা প্রযত ও ব্রহ্মবাদী হইয়া প্রাতঃকালে ঘৃত ও মাঙ্গল্যবস্তু দর্শন, ব্রাহ্মণগণের পূজা, নিশীথসময়ে শয়ন, দীন, অনাথ, বৃদ্ধ, দুর্ব্বল, পীড়িত ও স্ত্রীগণের প্রতি অনুগ্রহ প্রকাশ ও তাহাদিগকে ধনদান এবং ভীত, বিষঃ, উদ্বিগ্ন, ব্যাধিযুক্ত, কৃশ, হৃতসৰ্ব্বস্ব ও দুঃখাৰ্ত্ত ব্যক্তিদিগকে সৰ্ব্বদা আশ্বাস প্রদান করিত। পরস্পর হিংসাপরতন্ত্র হইয়া ধর্ম্মের অতিক্রম করিত না। সতত তপস্যায় অনুরক্ত এবং গুরু ও বৃদ্ধদিগের শুশ্রূষায় নিরত থাকিত। দেবতা, পিতৃলোক ও অতিথিগণের যথাবিধি সৎকার ও তাহাদিগের ভুক্তাবশিষ্ট দ্রব্য ভোজন করিত। একাকী উৎকৃষ্ট দ্রব্য ভোজন ও পরস্ত্রীগমনে পরাঙ্মুখ ছিল। সৰ্ব্বজীবের প্রতি আত্মবৎ দয়া প্রকাশ করিত। শূন্যস্থানে, পশুযোনিতে বা অযোনিতে অথবা পৰ্ব্বকালে বীৰ্য্যত্যাগ করিত না। সকলেই দান, দক্ষতা, সরলতা, উৎসাহ, অহঙ্কার, সৌহার্দ্য, সত্য, তপস্যা, শৌচ, করুণা, প্রীতিকর বাক্য ও মিত্রগণের প্রতি অদ্রোহ প্রভৃতি উৎকৃষ্ট গুণসমুদয়ে সমলঙ্কৃত ছিল। নিদ্রা, অসম্প্রীতি, অসূয়া, অনবধানতা, বিষাদ ও অন্যান্য স্পৃহা তাহাদিগকে স্পর্শ করিতে পারিত না।
অলক্ষ্মীচৰ্য্যায় অবনতি
‘পূৰ্ব্বে দানবগণ এইরূপ গুণসম্পন্ন হওয়াতে আমি তখন সৃষ্টির আরম্ভ অবধি অনেক যুগ পর্য্যন্ত তাহাদিগকে আশ্রয় করিয়া ছিলাম। কালক্রমে এক্ষণে উহারা ঐ সমুদয় গুণ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক কামক্রোধের বশীভূত হইয়াছে। ধৰ্ম্ম উহাদিগকে পরিত্যাগ করিয়া গিয়াছেন। ধার্ম্মিক বৃদ্ধ সভাসদগণ ধৰ্ম্মকথা কহিতে আরম্ভ করিলে যুবকগণ তাঁহাদের প্রতি উপহাস ও ঈর্ষা প্রদর্শন করিতে আরম্ভ করিয়াছে। ধর্ম্মপরায়ণ বৃদ্ধগণ উপবিষ্ট যুবকদিগের সন্নিধানে সমুপস্থিত হইলে তাহারা আর পূৰ্ব্ববৎ অভ্যুত্থান ও অভিবাদনদ্বারা তাঁহাদিগের সম্মান করে না। পিতা বর্ত্তমান থাকিতে পুত্র প্রভুত্ব প্রদর্শন করিতেছে। অনেকে বেতন ব্যতীত দাসত্বস্বীকারপূর্ব্বক নির্লজ্জ হইয়া আপনাদের নাম প্রখ্যাপিত করিতেছে এবং ধর্ম্মহীন গর্হিত কাৰ্য্যদ্বারা প্রভূত অর্থ সংগ্রহ করিতে অভিলাষী হইয়াছে। রাত্রিযোগে তাহাদিগের চীৎকারধ্বনি শ্রুত এবং অগ্নির প্রভা মন্দীভূত হইয়া থাকে। পুত্র পিতার ও স্ত্রী স্বামীর আজ্ঞা অতিক্রম করিতেছে। সকলেই সন্তানপালনে পরাঙ্মুখ হইয়াছে; মাতা, পিতা, গুরু, বৃদ্ধ, আচার্য্য ও অতিথিদিগকে অশ্রদ্ধা করিতেছে। ভিক্ষা প্রদান এবং দেবতা, অতিথি ও গুরুদিগের সৎকার না করিয়া স্বয়ং ভোজন করিতে আরম্ভ করিয়াছে। তাহাদিগের পাচকেরা সৰ্ব্বদা অশুচি হইয়া পাক করে ও তাহারা গুরুজনের নিষেধ না শুনিয়া শাস্ত্রনিষিদ্ধ ও অনাচ্ছাদিত অন্ন ভক্ষণ করিয়া থাকে। তাহাদিগের ধান্যসমুদয় ইতস্ততঃ বিকীর্ণ এবং দুগ্ধ অনাবৃত হইয়া কাক ও মূষিকের উচ্ছিষ্ট হইতেছে। তাহারা উচ্ছিষ্টহস্তে ঘৃত স্পর্শ করে। তাহাদিগের গৃহিণীগণ কুদ্দল [কোদাল], দাত্র [দা—কাটারী], পেটক [পেটরা], কাংস্য[কাসার পাত্র]পাত্র ও অন্যান্য গৃহোপকরণ সমুদয় চতুর্দ্দিকে বিকীর্ণ থাকিলেও তৎসমুদয়ে উপেক্ষা করিয়া থাকে।
‘প্রাচীর বা গৃহ ভগ্ন হইলে কেহই আর তাহার সংস্কার করে না। সকলেই পশুদিগকে বদ্ধ করিয়া তাহাদিগকে তৃণ জল প্রদান করিতে পরাঙ্মুখ হয় এবং ভৃত্যবর্গ ও সম্মুখস্থ বালকদিগকে বঞ্চিত করিয়া ভক্ষ্যবস্তু ভোজন করে। তাহারা বৃথামাংস ভক্ষণে নিরত এবং কেবল আপনাদের আহারের নিমিত্ত পায়স, তিলান্ন ও শঙ্কুলি [তিল-মামিশ্রিত যবের পিষ্টক] প্রভৃতি পিষ্টকসমুদয় পাক করাইয়া থাকে। সূর্যোদয় হইলেও কেহই শয্যা হইতে গাত্রোত্থান করে না। তাহাদের প্রতিগৃহে দিবারাত্রি কলহ হইতেছে। উপবিষ্ট মান্য ব্যক্তিকে কেহই সম্মান করে না। সকলেই ধর্ম্মভ্রষ্ট হইয়া আশ্রমবাসীদিগের প্রতি দ্বেষভাব প্রকাশ করিতেছে। শৌচানুষ্ঠানে কাহারও আস্থা নাই। তাহাদের মধ্যে জাতিসঙ্করের বিলক্ষণ প্রাদুর্ভাব হইয়াছে। তাহারা, আর বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণদিগের বিশেষ সম্মান বা বেদহীন ব্রাহ্মণদিগের শাসন করে না। দাসীগণ দুৰ্জ্জনাচরিত ব্যবহারে প্রবৃত্ত হইয়া, হারবলয়াদি বিবিধ আভরণ ধারণ করিতে আরম্ভ করিয়াছে। স্ত্রীলোকেরা পুরুষবেশ এবং পুরুষেরা স্ত্রীবেশধারণপূৰ্ব্বক ক্রীড়া বিহারাদিতে মহা আহ্লাদ প্রকাশ করিতেছে। পূৰ্ব্বপুরুষেরা উপযুক্ত পাত্রে অর্থদান করিলে পুত্রপৌত্রাদিরা তাহার ফলভোগ করিয়া থাকে; কিন্তু নাস্তিকতানিবন্ধন উহাদের মধ্যে কেহই আর সে ফলভোগে অধিকারী হইতেছে না। কাহার কোন দ্রব্য অপহৃত হইলে সে অতি বিশ্বাসের পাত্র মিত্রের উপর সন্দিহান হইয়া তাহাকে সেই দ্রব্যের কথা জিজ্ঞাসা করে। অনেকে অতি অল্পমাত্র ধনদ্বারা সম্ভূয়সমুত্থানে প্রবৃত্ত হইয়া মিত্রগণের অপরিমিত ধন অপহরণ করিতেছে। সদ্বংশজাত ব্যক্তিরাও পরধনাপহরণমানসে ক্রয়বিক্রয়কার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছে।
‘শূদ্রগণ তপস্যা করিতে আরম্ভ করিয়াছে; অনেকেই বিনা নিয়মে এবং কেহ কেহ বা বৃথা নিয়ম ধারণপূৰ্ব্বক অধ্যয়ন করিতেছে। শিষ্যেরা গুরুসেবায় পরাঙ্মুখ হইয়াছে। গুরুগণ শিষ্যের সহিত সখ্যব্যবহার করিতেছেন। বৃদ্ধ পিতামাতা পুত্রের উপর প্রভুত্ব প্রদর্শনে অসমর্থ হইয়া তাহাদিগের নিকট দীনভাবে আহার প্রার্থনা করিতেছেন। সমুদ্রতুল্য গাম্ভীর্য্যশালী বেদবিদাগ্রগণ্য [বেদজ্ঞগণের শ্রেষ্ঠ] বিজ্ঞ ব্যক্তিরা কৃয্যাদিকার্য্যে প্রবৃত্ত হইয়াছেন। মূর্খেরা শ্রাদ্ধান্ন ভোজন করিতেছে। আচাৰ্য্যগণ শিষ্যের মতানুসারে প্রাতঃকালে তাহাদিগের কুশল প্রশ্নজিজ্ঞাসা ও তাহাদিগের কথানুসারে ইতস্ততঃ গমনাগমন করিয়া থাকে। কুলবধূরা শ্বশ্রূ ও শ্বশুরের সমক্ষেত্র [তুল্যবয়স] ভৃত্যগণের শাসন ও স্বামীকে আহ্বানপূর্ব্বক গর্ব্বিতভাবে তাহার সহিত কথোপকথন করে। পিতা অতিযত্নসহকারে পুত্রের মনোরঞ্জন করিতেছেন। অনেকে ক্রোধভরে ধনবিভাগপূৰ্ব্বক পুত্রগণকে প্রদান করিয়া স্বয়ং অতিকষ্টে অবস্থান করিতেছেন। কোন ব্যক্তির ধন রাজা বা তস্করকর্ত্তৃক অপহৃত অথবা অগ্নিদাহে দগ্ধ হইলে তাহার বন্ধুবান্ধবগণ বিদ্বেষ প্রভাবে তাহার প্রতি উপহাস করে। ফলতঃ দৈত্যকুলের সমুদয় লোকই কৃতঘ্ন, নাস্তিক, পাপাত্মা, গুরুদারাপহারী, অভ্যক্ষভক্ষণে অনুরক্ত, নিয়মবিহীন ও শ্রীভ্রষ্ট হইয়াছে।
আচারভ্রষ্ট অসুরগৃহ হইতে লক্ষ্মীর অন্তর্দ্ধান
‘হে দেবেন্দ্র! দানবগণ এক্ষণে অনাচারে প্রবৃত্ত হওয়াতে আর আমি তাহাদিগের নিকট অবস্থান করিব না স্থির করিয়া স্বয়ং তোমার নিকট উপস্থিত হইয়াছি। এক্ষণে তুমি আমার সংবর্দ্ধন কর, তাহা হইলে সকল দেবতাই আমায় সম্মান করিবেন। আমি যে স্থানে অবস্থান করি, আমার প্রিয়সহচরী জয়া, আশা, শ্রদ্ধা, ধৃতি, ক্ষান্তি, বিজিতি, সন্নতি ও ক্ষমা এই অষ্ট দেবীও সেই স্থানে বাস করিয়া থাকেন। উহাদের মধ্যে জয়াই সর্ব্বাগ্রগণ্য। সম্প্রতি আমি উহাদিগকে লইয়া অসুরগণকে পরিত্যাগপূর্ব্বক তোমার নিকট আগমন করিয়াছি। আমি অতঃপর ধৰ্ম্মানুষ্ঠাননিরত দেবগণমধ্যে অবস্থান করিব, এই আমার অভিলাষ।
“দেবী লক্ষ্মী এই কথা কহিলে দেবর্ষি নারদ ও বৃত্রাসুরনিহন্তা বাসব উভয়ে তাঁহার আনন্দবর্দ্ধনার্থ মহা আহ্লাদ প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিলেন। ঐ সময় অনলসখা সমীরণ সুগন্ধি ও সুখস্পর্শ হইয়া দেবতাদিগের প্রতিগৃহে মন্দ-মন্দভাবে সঞ্চারিত হইতে লাগিলেন। প্রায় সমুদয় দেবতাই লক্ষ্মীর সহিত সমাসীন ইন্দ্রকে সন্দর্শন করিবার বাসনায় অতিপবিত্র স্থানে অবস্থান করিতে লাগিলেন। অনন্তর দেবরাজ ইন্দ্র লক্ষ্মী ও স্বীয় সুহৃদ দেবর্ষি নারদের সহিত সমবেত হইয়া হরিদশ্বসংযুক্ত [সবুজবৰ্ণ অশ্বযুক্ত] রথে আরোহণপূৰ্ব্বক দেবগণকর্ত্তৃক সম্মানিত হইয়া সভামধ্যে গমন করিলেন। ঐ সময় দেবর্ষি নারদ ইন্দ্রের মনোগত অভিপ্রায় অবগত হইয়া লক্ষ্মীর সম্মানার্থ মহর্ষিগণসমভিব্যাহারে তাঁহাকে স্বাগত প্রশ্ন করিলেন। তখন স্বর্গ হইতে অমৃতবৃষ্টি হইতে লাগিল। দুন্দুভিসমুদয় স্বয়ং ধ্বনিত হইয়া উঠিল। দিকসকল প্রসন্ন হইয়া অপূৰ্ব্ব শোভা ধারণ করিল। মেঘ যথাসময়ে শস্যার্থ বারিবর্ষণ করিতে লাগিল। কেহই আর ধর্ম্মপথ হইতে বিচলিত হইল না। মর্ত্যলোকের মঙ্গলার্থ বিবিধ রত্নের আকর বসুন্ধরা বেদধ্বনিতে পরিপূর্ণ হইয়া উঠিল। মনুষ্যমাত্রেই সৎকার্য্যে অনুরক্ত, মনস্বী ও পুণ্যকার্য্যপরায়ণ হইল। দেবতা, কিন্নর, যক্ষ, রাক্ষস ও মনুষ্য মহাসমৃদ্ধিশালী ও উদারস্বভাব হইয়া উঠিলেন। বৃক্ষসমুদয় পবনপ্রভাবে পরিচালিত হইলেও তৎসমুদয়ের অকালে ফলের কথা দূরে থাকুক, পুষ্প পৰ্য্যন্ত নিপতিত হইল না। ধেনুসকল দুগ্ধবতী ও কামদুঘা [দিবারাত্রির যে-কোন সময়ে দোহনমাত্রে দুগ্ধদাত্রী] হইল। কটুবাক্য তিরোহিত হইয়া গেল।
“হে ধৰ্ম্মরাজ! ইন্দ্রাদি দেবগণ এইরূপে লক্ষ্মীর সম্মান করিতে লাগিলেন। যাঁহারা ব্রাহ্মণসভায় সমবেত হইয়া ইহা পাঠ করেন, তাঁহারা পূর্ণমনোরথ হইয়া লক্ষ্মীকে প্রাপ্ত হয়েন। তুমি যে সম্পত্তি ও বিপত্তির পূর্ব্বরূপের কথা জিজ্ঞাসা করিয়াছিলে, আমি তাহার উদাহরণস্বরূপ উৎকৃষ্ট ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিলাম, তুমি স্থিরচিত্তে ইহার যথার্থ তত্ত্ব অবধারণ কর।”