২২৬তম অধ্যায়
দৈবনির্ভরশীলের শান্তি-ইন্দ্র-নমুচিসংবাদ
ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! আমি এক্ষণে অহঙ্কারত্যাগের উপলক্ষে ইন্দ্র-নমুচিসংবাদ নামক পুরাতন ইতিহাস কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। যৎকালে ভূতগণের উৎপত্তিপ্রলয়জ্ঞ [সৃষ্টিসংহারবিষয়ে অভিজ্ঞ] নমুচিরাজ শ্রীবিহীন হইয়াও অক্ষোভ্য সাগরের ন্যায় অবিচলিতচিত্তে কাল হরণ করিতেছিলেন, সেই সময় দেবরাজ ইন্দ্র তাঁহার নিকট গমনপূৰ্ব্বক কহিলেন, ‘দৈত্যরাজ! তুমি রাজ্যভ্রষ্ট, শত্রুর বশীভূত ও পাশবদ্ধ হইয়াও কিরূপে শোকশূন্যচিত্তে অবস্থান করিতেছ?’
“তখন নমুচি কহিলেন, ‘দেবরাজ! অনিবার্য্য শোকে আক্রান্ত হইলে কেবল শরীরকে সন্তাপিত ও শত্রুগণকে সন্তুষ্ট করা হয়। কেহই অন্যের শোকে শোকযুক্ত হইয়া তাহার দুঃখনাশ করিতে সমর্থ হয় না। এই নিমিত্ত আমি শোক পরিত্যাগ করিয়াছি। জগতে যাহা কিছু দৃষ্ট হইতেছে, সকলই নশ্বর। সন্তাপনিবন্ধন রূপ, শ্রী, আয়ুঃ ও ধৰ্ম্ম, সমুদয়ই বিনষ্ট হইয়া যায়; অতএব বিজ্ঞ ব্যক্তি উপস্থিত সন্তাপ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক মনে মনে হৃদ্গত কল্যাণময় পরমাত্মাকে চিন্তা করিবে। মনুষ্য পরমাত্মাতে মনোনিবেশ করিতে পারিলেই তাহার সমুদয় কামনাসিদ্ধি হয়, সন্দেহ নাই। পরমাত্মা ব্যতীত আর কেহই নিয়ন্তা নাই। তিনি গর্ভস্থ বালককেও কার্য্যে প্রবর্তিত করিয়া থাকেন। নিম্নপ্রদেশপ্রবণ [নিম্নদিকে গতিশীল] সলিলের ন্যায় আমি তাঁহারই নিয়মের বশবর্তী হইয়া অবস্থান করিতেছি। আমি বন্ধ ও মোক্ষ উভয়ই অবগত আছি; তথাপি ঐ উভয়ের মধ্যে শ্রেয়স্কর মোক্ষলাভের উপায় আশ্রয় করিতে সমর্থ হইতেছি না। পরমাত্মার নিয়োগানুসারে আমাকে কখন ধৰ্ম্মের ও কখন অধর্ম্মের অনুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হইতে হইতেছে।
যাহার যাহা প্রাপ্তব্য, তাহার তাহাই প্রাপ্তি হইয়া থাকে। কেহ কখন ভবিতব্যকে অতিক্রম করিতে পারে না। বিধাতা প্রাণীগণকে বারংবার যে যে গর্ভবাসে নিযুক্ত করেন, তাহাদিগকে সেই সেই গর্ভেই বাস করিতে হয়। কোন প্রাণীই স্বীয় ইচ্ছানুসারে গর্ভ আশ্রয় করিতে পারে না। যে ব্যক্তি সুখ বা দুঃখ উপস্থিত হইলে ভবিতব্যকেই তাহার কারণ বলিয়া জ্ঞান করে, তাহাকে কখনই বিমোহিত হইতে হয় না। প্রাণীগণ কালপ্রভাবেই পর্য্যায়ক্রমে সুখদুঃখ প্রাপ্ত হইয়া থাকে। এক ব্যক্তি কখন অন্য ব্যক্তিকে সুখদুঃখ প্রদান করিতে পারে না। অতএব দুঃখের প্রতি দ্বেষ প্রকাশ ও আপনাকে কৰ্ত্তা বলিয়া জ্ঞান করাই মূখতার কার্য্য। কি তপস্বী, কি দেবতা, কি মহাশূর, কি ত্রিবেদজ্ঞ [ঋক্, সাম ও যজুঃ এই বেদত্রয়ে অভিজ্ঞ] ব্রাহ্মণ, কি বনবাসী আপদ সকলকেই আক্রমণ করিয়া থাকে; কিন্তু সদসদ্বিচারজ্ঞ [ভাল-মন্দ বিচারে অভিজ্ঞ] মহাত্মারা সেই আপদ্ দর্শনে কখনই ভীত হয়েন না। হিমালয়ের ন্যায় স্থিরপ্রকৃতি পণ্ডিতদিগকে কখনই ক্রুদ্ধ, বিষয়াসক্ত, অবসন্ন ও হৃষ্ট দেখিতে পাওয়া যায় না। তাঁহারা দুর্নিবার দুঃখের সময়েও শোকপ্রকাশ করেন না; মহতী অর্থসিদ্ধিও তাঁহাদিগকে হৃষ্ট করিতে পারে না। যিনি ঘোরতর ব্যসনেও মুগ্ধ হয়েন না এবং যিনি অবিচলিতচিত্তে সুখজনক, দুঃখজনক ও সুখদুঃখমিশ্রিত অবস্থা ভোগ করেন, তাঁহাকেই ধুরন্ধর [জীবনভারবহনে সমর্থ] বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায় । মনুষ্য যখন যে অবস্থায় অবস্থিত হউক না কেন, দুঃখজনক মানসিক সন্তাপ পরিত্যাগপূৰ্ব্বক সন্তোষ অবলম্বন করা তাহার অবশ্য কর্ত্তব্য। অধাৰ্মিক ব্যক্তি যে সভায় গমন করিয়া ধৰ্ম্মবিপ্লবনিবন্ধন ভীত না হয়, তাহাকে সভ্য ও তত্রত্য ব্যক্তিদিগকে সভ্য বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায় না। যে বুদ্ধিমান ব্যক্তি ধর্ম্মতত্ত্ব সবিশেষ আলোচনা করিয়া তদনুরূপ কাৰ্য্য করেন, তিনিই প্রকৃত সত্য বলিয়া পরিগণিত হয়েন। প্রাজ্ঞ ব্যক্তির কাৰ্য্য অতিশয় দুর্জ্ঞেয়। তাঁহারা মোহকালেও মুগ্ধ হয়েন না। মহর্ষি গৌতম গার্হস্থাশ্রমশনিবন্ধন ঘোরতর বিপদে নিপতিত হইয়াও বিমোহিত হয়েন নাই। যখন মনুষ্য মন্ত্রবল, বীর্য্য, প্রজ্ঞা, পৌরুষ, চরিত্র, ব্যবহার বা অর্থসম্পত্তি প্রভাবেও অলভ্য বস্তু লাভ করিতে পারে না, তখন কোন দ্রব্য লাভ হইল না বলিয়া পরিতাপ করা নিতান্ত নিষ্ফল। বিধাতা পূৰ্ব্বে আমার যে যে কাৰ্য্য নির্দ্দিষ্ট করিয়া দিয়াছেন, আমি সেই সেই কার্য্যেরই অনুষ্ঠান করিতেছি; সুতরাং মৃত্যু হইলে আমার কিছুমাত্র ভয় নাই। মনুষ্য লব্ধব্য বস্তুই লাভ করে, প্রাপ্তব্য সুখদুঃখই প্রাপ্ত হয় এবং গন্তব্য স্থানে গমন করিয়া থাকে। যে মহাত্মা এই বিষয় বিশেষরূপে অবগত হইয়া বিমুগ্ধ না হয়েন, তিনি দুঃখের সময়েও নির্ব্বিঘ্নে কাল হরণ করিতে পারেন এবং তাঁহাকেই সমুদয় ধনের অধিপতি বলিয়া নির্দ্দেশ করা যায়।”