২২৪তম অধ্যায়
বলিকর্ত্তৃক অহঙ্কারত্যাগের প্রশংসা
ভীষ্ম কহিলেন, “হে ধৰ্ম্মরাজ! দানবরাজ বলি এই কথা বলিয়া মত্তমাতঙ্গের ন্যায় সুদীর্ঘ নিশ্বাস পরিত্যাগ করিতে লাগিলেন। তখন দেবরাজ ইন্দ্র পুনরায় তাঁহাকে উপহাস করিয়া কহিলেন, দানবরাজ! তুমি জ্ঞাতিগণে পরিবেষ্টিত হইয়া বিবিধ যানে আরোহণপূৰ্ব্বক সমুদয় লোকের উপর আধিপত্য প্রকাশ ও আমাদিগকে উপহাস করিয়া বিচরণ করিতে। পূৰ্ব্বে সমুদয় লোক তোমার বশীভূত ছিল বলিয়া তুমি মহা আহ্লাদ প্রকাশ করিয়াছিলে; কিন্তু এক্ষণে জ্ঞাতি ও বন্ধুবান্ধবগণও তোমার হীনাবস্থা অবলোকন করিয়া তোমাকে পরিত্যাগ করিয়াছে; অতএব বল দেখি, এইরূপ পরাভবনিবন্ধন তোমার অনুতাপ হইতেছে কি না?’
“তখন দানবরাজ কহিলেন, “পুরন্দর! কোন বস্তুই নিত্য নহে। কালসহকারে সকলেরই নাশ হইয়া থাকে। এইজন্য আমি কিছুতেই শোক প্রকাশ করি না। কালবশতঃ সকল কার্য্যের সংঘটন হইয়া থাকে। সুতরাং আমার এই খরত্বপ্রাপ্তি আমার অপরাধমূলক নহে। প্রাণীগণের দেহও বিনশ্বর। উহাদের প্রাণ ও দেহ স্বভাবতঃ একত্র সম্ভূত, একত্র পরিবর্দ্ধিত ও একত্র বিনষ্ট হইয়া থাকে। বিশেষতঃ যখন আমি এইরূপ খরযোনি প্রাপ্ত হইয়াও কাহারও বশীভূত হই নাই বলিয়া অবগত হইতেছি, তখন আর আমার অনুতাপের বিষয় কি? যাবতীয় স্রোত যেমন সমুদ্রে নিপতিত হয়, তদ্রূপ সমুদয় প্রাণীই মৃত্যুমুখে নিপতিত হইয়া থাকে। যে ব্যক্তি ইহা সম্যকরূপে অবগত হইতে পারে, তাহাকে কখনই মুগ্ধ হইতে হয় না। নির্বোধ মোহান্ধ ব্যক্তিরাই ইহা অবগত হইতে না পারিয়া কষ্টে নিপতিত ও অবসন্ন হয়।
‘মানবগণ জ্ঞানলাভদ্বারা সমুদয় পাপকে দূরীভূত করিতে পারে, পাপ বিগত হইলে সত্ত্বজ্ঞানের উদয় হয় এবং সত্ত্বজ্ঞানের উদয় হইলেই আর মোহজন্য কলুষতার বশীভূত হইতে হয় না। যাহারা সত্ত্বগুণ হইতে পরান্মুখ হইয়া রজঃ বা তমোগুণ অবলম্বন করে, তাহাদিগকেই বারংবার জন্মপরিগ্রহ ও কামাদি-ইন্দ্রিয়বৃত্তির অধীন হইয়া বারংবার অনুতাপ করিতে হয়। আমি কখন অর্থ, অনর্থ, জীবন, মৃত্যু ও সুখদুঃখে দ্বেষ বা অনুতাপ প্রকাশ করি না। লোকে কালকর্ত্তৃক নিহত ব্যক্তিকেই বিনষ্ট করে। আর যে অপরকে বিনষ্ট করে, সেও কালকর্ত্তৃক নিহত; সুতরাং যে ব্যক্তি “আমি অন্যকে বিনষ্ট করিতেছি” বলিয়া বিবেচনা করে এবং যে “আমি অন্যকর্ত্তৃক নিহত হইতেছি” মনে করিয়া বিষণ্ন হয়, তাহারা উভয়েই অজ্ঞ। অতএব যে ব্যক্তি অন্যকে বিনাশ বা পরাজয় করিয়া ‘আমি ইহা করিলাম’ বলিয়া অভিমান করিয়া থাকে, তাহার এই বিবেচনা করা উচিত যে, সে বস্তুতঃ তাহার কর্ত্তা নহে। তাহার কৰ্ত্তা স্বতন্ত্র।
কালকর্ত্তৃক সম্পত্তি বিপত্তির সংঘটনা
‘ইহলোকে কোন ব্যক্তি কি কাহারও বিনাশ বা উৎপত্তির কারণ হইতে পারে? লোকে ঈশ্বরকৃত কর্ম্মের অনুষ্ঠান করিয়াই আপনাকে কৰ্ত্তা বলিয়া অভিমান করে। আমি যখন পৃথিবী, বায়ু, আকাশ, জল ও তেজ এই পঞ্চ মহাভূতকে সমুদয় প্রাণীর উৎপত্তির কারণ বলিয়া অবগত হইয়াছি এবং যখন কাল কি কৃতবিদ্য, কি অল্পবিদ্য, কি বলবান, কি দুর্ব্বল, কি রূপবান, কি কুৎসিত, কি সৌভাগ্যশালী, কি সৌভাগ্যবিহীন—সকলকেই যখন সমভাবে গ্রহণ করিতেছে বলিয়া আমার স্পষ্ট প্রতীতি হইতেছে, তখন আর আমার বেদনার বিষয় কি? কাল যে-যে বস্তুর দাহ, যাহার বিনাশ এবং যাহা লোকের লাভ হইবে বলিয়া নির্দ্দেশ করিয়া দিয়াছে, সেই-সেই পদার্থই দগ্ধ, সেই-সেই ব্যক্তিই বিনষ্ট এবং সেই-সেই দ্রব্যই লোকের লব্ধ হইয়া থাকে। আমি ঐ কালরূপী মহাসমুদ্রের বিষয় চিন্তা করিয়া উহার মধ্যে দ্বীপ বা উহার পরপর অবগত হইতে সমর্থ হই নাই। ফলতঃ কাল। যেসমুদয় প্রাণীকে বিনষ্ট করিতেছে, ইহা যদি আমার বোধগম্য না হইত, তাহা হইলে আমি হর্ষ, দর্প বা ক্রোধে অভিভূত হইতাম।
‘যাহা হউক আমি এক্ষণে গর্দ্দভশরীর ধারণ করিয়া নির্জ্জনগৃহে অবস্থান করিতেছি দেখিয়া তুমি আমাকে নিন্দা করিতেছ; কিন্তু আমি অভিলাষ করিলে এই মুহূর্তেই অনায়াসে এরূপ নানাবিধ ভীষণ মূৰ্ত্তি ধারণ করিতে পারি যে, তৎসমুদয় দর্শন করিবামাত্র তোমাকে ভয়ে পলায়ন করিতে হয়। কাল সমুদয় পদার্থই প্রদান ও পুনরায় গ্রহণ করিয়া থাকে। কালপ্রভাবেই সমুদয় কার্য্য সম্পন্ন হইতেছে; অতএব তুমি আর বৃথা পৌরুষ প্রকাশ করিও না। পূর্ব্বে আমি রোষাবিষ্ট হইলে সমুদয় জগৎ ব্যথিত হইত। লোকের কখন হ্রাস কখন বৃদ্ধি হইয়া থাকে, ইহাই জগতের চিরপ্রচলিত প্রথা। সম্পত্তিলাভ হওয়া আর না হওয়া কখনও আপনার আয়ত্ত নহে। তুমি এইটি বিশেষ বিবেচনা করিয়া সমুদয় পরিত্যাগ কর। বালকের ন্যায় তোমার চিত্তবৃত্তি অদ্যাপি অজ্ঞানে সমাচ্ছন্ন রহিয়াছে। অতএব স্থিরভাব অবলম্বন কর। তুমি ত’ ইহা বিলক্ষণ অবগত আছ যে, দেবতা, মনুষ্য, পিতৃলোক, গন্ধৰ্ব্ব, উরগ ও রাক্ষসগণ ইহারা সকলেই আমার বশীভূত ছিলেন এবং আমি যে দিকে থাকিতাম, তাঁহারা সে দিকে নমস্কার করিতেন; কিন্তু এক্ষণে আমি সেই পূর্ব্বতন উন্নতি ও অধুনাতম অবনতির বিষয় স্মরণ করিয়া অণুমাত্রও অনুতাপ করি না; অতঃপর নিরন্তর কেবল ঈশ্বরের অধীনে থাকিব বলিয়া কৃতনিশ্চয় হইয়াছি। যখন সদ্বংশসম্ভূত প্রবলপ্রতাপ নরপতিকে অমাত্যগণের সহিত দুঃখে নিপতিত এবং দুষ্কুলপ্রসূত মূঢ় ব্যক্তিকেও অমাত্যগণের সহিত সুখে অবস্থিত দেখা যাইতেছে, যখন সুলক্ষণা পরমরূপবতী রমণী দুর্দ্দশাপন্না ও অলক্ষণা কুরূপা কামিনীও সৌভাগ্যশালিনী হইতেছে, তখন ভবিতব্যই সকল কার্য্যের বলবান্ হেতু।
‘আমার অপরাধে তোমার ইন্দ্ৰত্বলাভ বা তোমার প্রতাপে আমার এরূপ দুরবস্থাপ্রাপ্তি হয় নাই। সম্পত্তি ও বিপত্তির সংঘটন কালবশতঃই হইয়া থাকে । আজ আমি তোমাকে আমার সমক্ষে মহা আহ্লাদে তর্জ্জন-গর্জ্জন করিতে দেখিতেছি, যদি কাল আমাকে এরূপ আক্রমণ না করিত, তাহা হইলে তুমি বজ্রধারী হইলেও আমি এই দণ্ডে তোমাকে মুষ্টিপ্রহারেই নিপাতিত করিতাম। কিন্তু কি করি, এক্ষণে বিক্রমপ্রকাশের উপযুক্ত সময় নহে; এখন শান্তির সময়ই সমুপস্থিত হইয়াছে। কাল সকলকেই উচ্চপদে প্রতিষ্ঠাপিত আবার সকলকেই নিপাতিত করিয়া থাকে। আমি সমুদয় দানবের অধিপতি, মহাবলপরাক্রান্ত ও মহাগৰ্ব্বিত ছিলাম। অতএব কাল যখন আমাকেও আক্রমণ করিয়াছে, তখন সকলকেই আক্রমণ করিবে, সন্দেহ নাই। আমি একাকী দ্বাদশ আদিত্যের তেজোরাশি ধারণ করিয়াছিলাম। আমি সলিলবহনপূৰ্ব্বক উহা বর্ষণ এবং ত্রিলোকে তাপপ্রদানপূৰ্ব্বক উহার উদ্ভাসন [উত্তাপ আনয়ন] করিতাম। আমি মনে করিলেই লোকদিগকে রক্ষা ও সংহার, দান ও গ্রহণ এবং বন্ধন ও মোচন করিতে পারিতাম। ফলতঃ, ত্রৈলোকে আমার একাধিপত্য ছিল; কিন্তু কালবশতঃ এক্ষণে আমার আর সেরূপ প্রভুত্ব নাই।
কালরূপী মহাপুরুষের পরিচয়
‘তুমি, আমি বা অন্য কোন ব্যক্তি পালন বা সংহারের কর্ত্তা নহে। কালই পৰ্য্যায়ক্রমে লেকদিগকে পালন ও সংহার করিয়া থাকে। বেদজ্ঞ ব্যক্তিরা কালকে পরমেশ্বর বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকেন। মাস ও পক্ষ ঐ কালরূপী ঈশ্বরের শরীর; ঐ শরীর দিবারাত্রিদ্বারা সমাবৃত, গ্রীষ্মাদি ঋতুসমুদয় উহার ইন্দ্রিয় এবং বৎসর উহার মুখ। কোন কোন মহাত্মা স্বীয় ধীশক্তিপ্রভাবে এই দৃশ্যপদার্থসমুদয়কেই ব্রহ্ম বলিয়া চিন্তা করিতে উপদেশ প্রদান করিয়া থাকেন। কিন্তু বেদে অন্নময়াদি পঞ্চকোষকেই ব্রহ্মরূপে চিন্তা করিতে হইবে বলিয়া নির্দ্দিষ্ট আছে। ব্রহ্ম মহাসমুদ্রের ন্যায় অগম্য ও দুরবগাহ। তিনি জড় ও চৈতন্যস্বরূপ; তাঁহার আদি ও অন্ত নাই। তিনি লিঙ্গশরীরবিহীন হইয়াও প্রাণীগণের লিঙ্গশরীরে অবস্থান করিতেছেন। তত্ত্বদর্শী ব্যক্তিরা উঁহাকে নিত্য বলিয়া অবগত আছেন। তিনি অবিদ্যাপ্রভাবে চৈতন্যস্বরূপ জীবের জড়ত্ব, সম্পাদন করিয়া থাকেন; কিন্তু বস্তুতঃ ঐ জড়ত্ব জীবের স্বরূপ নহে। কারণ, তত্ত্বজ্ঞানের পর আর উহার উদ্ভব হয় না। অতএব তুমি সেই জীবের একমাত্র গতি কালরূপী পরমব্রহ্মকে অতিক্রম করিয়া কোথায় পলায়ন করিবে? পুরুষ মহাবেগে ধাবমান বা দণ্ডায়মান হইলেও তাঁহাকে অতিক্রম করিতে পারে না। পঞ্চ জ্ঞানেন্দ্রিয় তাঁহার সাক্ষাৎকারলাভে সমর্থ নহে। তাঁহাকে কেহ অগ্নি, কেহ কেহ প্রজাপতি, কেহ কেহ ঋতু, কেহ কেহ মাস, কেহ কেহ পক্ষ, কেহ কেহ দিবস, কেহ কেহ ক্ষণ, কেহ কেহ পূর্বাহ্ণ, কেহ কেহ মধ্যাহ্ণ, কেহ কেহ অপরাহ্ণ এবং কেহ কেহ মুহূর্ত্ত বলিয়া কীৰ্ত্তন করিয়া থাকে। লোকে সেই একমাত্র ব্রহ্মকে নানারূপে নির্দ্দেশ করে, কিন্তু তিনি কালস্বরূপ। তাঁহার অধীনে সমুদয়ই অবস্থান করিতেছে। সেই কালের প্রভাবে তোমার সদৃশ বলবীৰ্য্যসম্পন্ন কত শত ইন্দ্র অতীত হইয়া গিয়াছে। উঁহার প্রভাবে তোমাকেও অতীত হইতে হইবে! কালই সমুদয় পদার্থের সংহার করিতেছে; অতএব তুমি সমুদয় পরিত্যাগপূৰ্ব্বক সুস্থির হও। কি তুমি, কি আমি, কি পূর্ব্বর্ত্তন লোকসমুদয়, কেহই কালকে নিবারণ করিতে সমর্থ নহে। তুমি যে রাজশ্রীকে সর্ব্বোকৃষ্ট ও চিরস্থায়ী বলিয়া বিবেচনা করিতেছ, উহা নিতান্ত অকিঞ্চিৎকর ও অচিরস্থায়ী। লক্ষ্মী কখনই এক স্থানে অবস্থান করেন না। উনি তোমার মত সহস্র সহস্র ইন্দ্রে অবস্থান করিয়াছিলেন। এক্ষণে আমাকে পরিত্যাগপূর্ব্বক তোমাকে আশ্রয় করিলেন। আবার অচিরাৎ তোমাকেও পরিত্যাগ করিয়া স্থানান্তরে গমন করিবেন। অতএব তুমি বৃথা গর্ব্বিত হইয়া আর আমার নিন্দা করিও না। অতঃপর শান্তভাব অবলম্বন কর।”