২২৪তম অধ্যায়
কার্ত্তিকেয় উৎপত্তি
মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “হে রাজন! দক্ষদুহিতা স্বাহা দেবী প্রথমে অঙ্গিরার সহধর্ম্মিণী-মূর্ত্তি পরিগ্রহ করিয়া পাবক-সন্নিধানে গমনপূর্ব্বক কহিলেন, “হে হুতাশন! আমি অঙ্গিরার ভার্য্যা, আমার নাম শিবা, আমি কামশরে সাতিশয় কাতর হইয়া তোমার নিকট আগমন করিয়াছি, আমার কামনা পরিপূর্ণ কর, নতুবা প্ৰাণ পরিত্যাগ করিব। অবশিষ্ট সপ্তর্ষিপত্নীগণ মন্ত্রণা করিয়া আমাকে তোমার নিকট প্রেরণ করিয়াছেন।”
“অগ্নি কহিলেন, “আমি যে সাতিশয় কামসন্তপ্ত হইয়াছি, তাহা তুমি কি প্রকারে অবগত হইয়াছ? যে-সকল ঋষিপত্নীগণের কথা উল্লেখ করিলে, তাহারাই বা কি প্রকারে অবগত হইলেন?” “স্বাহা কহিলেন, “তুমি চিরকাল আমাদের অনুরাগভাজন ছিলে, কিন্তু আমরা তোমার নিকটে ভীত হইয়া থাকিতাম। সম্প্রতি ইঙ্গিতদ্বারা তোমার অভিপ্ৰায় অবগত হইয়া আগমন করিয়াছি, তুমি শীঘ্র আমার মনোরথ পূর্ণ কর। আমার ভগিনীগণ প্রতীক্ষা করিতেছেন; আমি ত্বরায় প্রস্থান করিব।”
“তখন হুতাশন হৰ্ষতিশয়সহকারে প্রীতিপ্ৰফুল্লমূর্ত্তি স্বাহার পাণিগ্রহণ করিলেন। স্বাহা দেবী পরমপ্রীতিসহকারে পাণিকমলে আগ্নেয় তেজ গ্রহণপূর্ব্বক চিন্তা করিতে লাগিলেন, যদ্যপি কাননস্থ লোকেরা আমার এতাদৃশ রূপ সন্দর্শন করে, তাহা হইলে তাহারা অবশ্যই ব্রাহ্মণীদিগের দোষ পাবকের কর্ণগোচর করিবে; অতএব এ স্থানে আর অবস্থান করা উচিত হয় না; এক্ষণে তেজ রক্ষা করিয়া গরুড়ী হইয়া অবিলম্বে এই বন হইতে প্ৰস্থান করাই শ্ৰেয়াঃ।
“অনন্তর তিনি সুপণীরূপ ধারণপূর্ব্বক সেই মহাবন হইতে প্ৰস্থান করিয়া পথিমধ্যে শরস্তম্বাচ্ছাদিত শ্বেতপর্ব্বত অবলোকন করলেন। সেই পর্ব্বত অসংখ্য দৃষ্টিবিষ [দৃষ্টিমাত্ৰে—বিনা দংশনে যাহাদের বিষের কার্য হয়] সপ্তশীর্ষ সর্পদ্বারা পরিরক্ষিত, ভয়ঙ্কর রাক্ষস, রাক্ষসী, পিশাচ এবং ভূতগণে পরিবৃত ও নানাবিধ মৃগপক্ষিগণে সমাকুল ছিল। সুপর্ণরূপিণী স্বাহা সহসা দুৰ্গম শ্বেত-ভূধরে উপনীত হইয়া সেই আগ্নেয় তেজ কাঞ্চনকুণ্ডে নিক্ষেপ করিলেন। তিনি মহাতেজাঃ সপ্তর্ষিগণের পত্নীদিগের রূপ ধারণপূর্ব্বক অগ্নির মনোরথ সফল করিয়াছিলেন। কিন্তু তিনি অরুন্ধতীর অসামান্য তপঃপ্রভাব ও অকৃত্রিম স্বামীশুশ্রূষা নিবন্ধন তদীয় দিব্যরূপধারণে অসমর্থ হইলেন। এইরূপে তিনি ছয়জন মহর্ষির পত্নীর রূপধারণ করিয়া প্রতিপদ তিথিতে সেই অগ্নিরেতঃ কাঞ্চনকুণ্ডে ছয়বার নিক্ষেপ করেন; সেই তেজোময় স্কন্ন [ক্ষরিত]-রেতঃ হইতে এক পুত্র উৎপন্ন হইলেন, এই নিমিত্ত তাঁহার নাম স্কন্ধ হইল এবং তিনি ঋষিগণকর্ত্তৃক পূজিত ও বিখ্যাত হইলেন।
“তাঁহার ছয় মস্তক, দ্বাদশ চক্ষু, দ্বাদশ কর্ণ, দ্বাদশ হস্ত, এক গ্ৰীবা ও এক জঠর। তিনি দ্বিতীয়াতে অপেক্ষাকৃত কিঞ্চিৎ সুব্যক্ত, তৃতীয়াতে সুস্পষ্ট শিশুর ন্যায় প্রতীত এবং চতুর্থীতে সমুদয় অঙ্গ প্রত্যঙ্গসম্পন্ন হইয়া উঠিলেন। লোহিতবর্ণ মেঘমালায় আচ্ছাদিত গগনমণ্ডলে নবোদিত সূৰ্য্যের যেরূপ শোভা হয়, তদ্রূপ সুকুমার কুমার অতীব দীপ্তি পাইতে লাগিলেন। ত্রিপুরাসুরনিহন্তা মহাদেব দানবকুলবিনাশন যে শরাশন রক্ষা করিয়াছিলেন, মহাবলপরাক্রান্ত কুমার সেই শরাসন গ্রহণপূর্ব্বক নিনাদ করিলে সচরাচর ত্ৰৈলোক্য যেন মূর্চ্ছিতপ্রায় হইল।
“চিত্র ও ঐরাবতনামে নাগেন্দ্রযুগল সেই জলদগম্ভীর কুমারনিনাদ কর্ণগোচর করিবামাত্র তদাভিমুখে ধাবমান হইল। সূর্য্যসমপ্রভ কুমার তাহাদিগকে অবলোকন করিয়া দুই হন্তদ্বারা শক্তি, অপর এক হস্ত দ্বারা তাম্রচূড় ও ভুজান্তরদ্বারা প্ৰকাণ্ড কুক্কুটাস্ত্র গ্রহণপূর্ব্বক ভীমনিনাদ করিতে করিতে ক্রীড়া করিতে লাগিলেন। তিনি অপর হস্তযুগল দ্বারা সর্ব্বভূতভয়ঙ্কর শঙ্খ ধ্বনিত করিলেন এবং ভুজন্দ্বয়দ্বারা আকাশের নানা স্থানে অভিঘাত করিতে লাগিলেন। দেখিলে বোধ হয় যেন, তিনি যুগপৎ ত্ৰিলোকী গ্রাস করিতে উদ্যত হইয়াছেন। অপ্রমেয়াত্মা ষড়ানন। সেই ভূধরশিখরে এইরূপে ক্রীড়া করিয়া উদয়াচলসন্নিবিষ্ট সহস্ররশ্মির ন্যায় দীপ্তি পাইতে লাগিলেন।
“তিনি শৈলশিখরে সমাসীন হইয়া ইতস্ততঃ দৃষ্টিনিক্ষেপপূর্ব্বক দিগ্দিগন্তসকল সন্দর্শন করিয়া পুনর্ব্বার নিনাদ করিলেন। তাঁহার সেই ভয়ঙ্কর শব্দ শ্রবণগোচর করিয়া নানাজাতীয়লোকসকল ভীত ও উদ্বিগ্নমনাঃ হইয়া তথায় আগমনপূর্ব্বক তাহার শরণাগত হইল। যে-সকল বর্ণ তাঁহার আশ্রয় গ্রহণ করিয়াছিল, তাহারা পারিষদ ব্ৰাহ্মণ বলিয়া উক্ত হইয়াছে।
“সেই মহাবাহু স্কন্দ গাত্ৰোত্থানপূর্ব্বক শরণাগত ব্যক্তিসকলকে সাত্ত্বনাপূর্ব্বক ধনুরাকর্ষণ করিয়া শ্বেত-পর্ব্বতে বাণবর্ষণ করিতে লাগিলেন; পরে শরাঘাতে হিমাচলসূত ক্ৰৌঞ্চ মহীধর বিদারিত করিলেন; তদবধি হংস ও গৃধ্রগণ সেই পথদ্বারা মেরুতে গমনাগমন করিয়া থাকে। ক্ৰৌঞ্চ-ভূধর শরাঘাতে বিশীর্ণ হইয়া আর্ত্তস্বরে রোদন করিতে করিতে নিপতিত হইল। ক্রৌঞ্চের নিপাত-সন্দর্শনে অন্যান্য শৈলগণ সাতিশয় আর্ত্তনাদ করিতে লাগিল। মহাবল পরাক্রান্ত ষড়ানন তাহাদের কারুণ্য-বিলাপ শ্রবণ করিয়া কিঞ্চিম্মাত্র ব্যথিত হইলেন না।
“অনন্তর তিনি সিংহনাদপূর্ব্বক শক্তি-বিক্ষেপ করিয়া তৎক্ষণাৎ শ্বেতাচলের শিখরদেশ বিদীর্ণ করিলেন। ভূধর ভীত ও শরাঘাতে জর্জ্জরিত হইয়া পৃথিবী পরিত্যাগপূর্ব্বক অন্যান্য অচলগণসমভিব্যাহারে উৎপতিত হইল। বসুন্ধরা পর্ব্বতগণের উৎপতনে সর্ব্বাঙ্গব্যাপিনী বেদনায় নিতান্ত অধীরা হইয়া স্কন্দের নিকট গমন করিলেন এবং তঁহার প্রসাদে পুনরায় পূর্ব্বের ন্যায় বলবতী হইয়া উঠিলেন। পর্ব্বতেরাও স্কন্দকে নমস্কার করিয়া পুনর্ব্বার পৃথিবীতে গমন করিল। অনন্তর সকল লোক শুক্ল পঞ্চমীতে অবিচলিত ভক্তিসহকারে স্কন্দের উপাসনা করিতে লাগিল।”