২২৩. কর্ম্মের প্রভাব—বলি-বাসবসংবাদ

২২৩তম অধ্যায়

কর্ম্মের প্রভাব—বলি-বাসবসংবাদ

যুধিষ্ঠির কহিলেন, “পিতামহ! নরপতিগণ রাজ্যভ্রষ্ট ও বিষম বিপদগ্রস্ত হইয়াও যে বুদ্ধি অবলম্বনপূৰ্ব্বক সুস্থচিত্তে পৃথিবী পর্য্যটন করেন, আপনি তাহার বিষয় কীৰ্ত্তন করুন।”

ভীষ্ম কহিলেন, “মহারাজ! এই স্থলে বলি-বাসবসংবাদ নামে এক পুরাতন ইতিহাস কীর্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। পূর্ব্বে দেবরাজ ইন্দ্র সমুদয় অসুরকে পরাজিত করিয়া সৰ্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মার নিকট আগমনপূৰ্ব্বক কৃতাঞ্জলিপুটে তাঁহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, পিতামহ! অনবরত দান করিলেও যাহার ধনক্ষয় হয় না; যে বায়ু, বরুণ, সূৰ্য্য, চন্দ্র, অনল ও সলিলস্বরূপ; যাহার প্রভাবে দিক্‌সকল তিমিরাবৃত এবং উদ্ভাসিত হইত; যে আলস্য পরিত্যাগপূৰ্ব্বক যথাকালে বারিবর্ষণ করিত; এক্ষণে সেই বলিরাজ কোন্ স্থানে অবস্থান করিতেছেন, তাহা কীৰ্ত্তন করুন।’

“ব্রহ্মা কহিলেন, ‘দেবরাজ! বলিরাজের বৃত্তান্ত জিজ্ঞাসা করা তোমার উচিত হয় না। কিন্তু কেহ জিজ্ঞাসা করিলে তাঁহাকে মিথ্যা উত্তর প্রদান করা নিষিদ্ধ, এই নিমিত্ত আমি তোমার নিকট বলির বৃত্তান্ত কীৰ্ত্তন করিতেছি, শ্রবণ কর। বলিরাজ উষ্ট্র, বৃষভ, গর্দ্দভ বা অশ্ব হইয়া শুন্যগৃহে অবস্থান করিতেছে।

“ইন্দ্র কহিলেন, ‘ভগবন্! যদি আমি কোন স্থানে শূন্যগৃহে বলিরাজের সন্দর্শনলাভে সমর্থ হই, তাহা হইলে তাহাকে বিনাশ করিব কি না, আপনি তদ্বিষয়ে অনুমতি প্রদান করুন।’

“ব্রহ্মা কহিলেন, “তুমি বলিকে বিনাশ করিও না। সে বধ্য নহে। তুমি তাহার নিকট গমনপূর্ব্বক স্বেচ্ছানুসারে ন্যায়ানুগত বিষয় জিজ্ঞাসা করিবে।’

গর্দ্দভরূপী বলির সহিত ইন্দ্রের সাক্ষাৎকার

“সৰ্ব্বলোকপিতামহ ব্রহ্মা এই কথা কহিলে দেবরাজ দিব্যভূষণধারণপূর্ব্বক ঐরাবতে আরূঢ় হইয়া পৃথিবী পর্য্যটন করিতে লাগিলেন এবং কিয়ৎক্ষণ ইতস্ততঃ ভ্রমণ করিয়া পরিশেষে দেখিলেন যে, বলিরাজ খর[১]বেশধারণপূৰ্ব্বক এক শূন্যগৃহে অবস্থান করিতেছেন, তখন তিনি তাঁহাকে সম্বোধন করিয়া কহিলেন, ‘দানবরাজ! এক্ষণে এইরূপ তুষভক্ষক অধম খরযোনি প্রাপ্ত হইয়াছ। পূৰ্ব্বে তুমি জ্ঞাতিবর্গে পরিবেষ্টিত হইয়া দিব্যযানে আরোহণপূর্ব্বক আমাদিগকে অবজ্ঞাপূৰ্ব্বক সমুদয় লোক প্রতাপিত করিয়া বিচরণ করিতে; তোমার ঐশ্বৰ্য্যপ্রভাবে অন্যান্য দানবগণ তোমায় আজ্ঞানুবর্তী এবং পৃথিবী অকৃষ্টপচ্যা [বিনা কর্ষণে শস্যোৎপাদিকা] ছিল; কিন্তু আজ তুমি শত্রুর বশবর্তী শ্রীভ্রষ্ট, বন্ধুবান্ধববিহীন, পরাক্রমপরিশূন্য ও দারুণ দুর্দ্দশাগ্রস্ত হইয়াছ। অতএব বল দেখি, ইহাতে তোমার অনুতাপ হইতেছে কি না?

যখন তুমি সমুদ্রের পূৰ্ব্বকূলে অবস্থান করিয়া জ্ঞাতিগণকে ধন বিভাগ করিয়া দিতে, যখন দ্বিচত্বারিংশৎ [বিয়াল্লিশ] সহস্র গন্ধৰ্ব্ব ও দিব্যমাল্যধারিণী সহস্র সহস্র দেবাঙ্গনা তোমার বিহারকালে নৃত্য করিত, যখন তোমার বিবিধ রত্নভূষিত সুবর্ণময় ছত্র ছিল, যখন নিখাত করিয়া সহস্র সহস্র গোদান এবং সাম্যাক্ষেপবিধি অনুসারে সমুদয় পৃথিবী দান করিয়াছিলে, বল দেখি, তখন তোমার চিত্তবৃত্তি কিরূপ ছিল আর এখনই বা কিরূপ হইতেছে? ওহে দানবরাজ! এখন তোমার সে ভৃঙ্গার, শ্বেতচ্ছত্র, চামরদ্বয়া ও ব্রহ্মদত্তমালা কোথায়?

“তখন বলিরাজ কহিলেন, ‘পুরন্দর! এক্ষণে তুমি আমার ভৃঙ্গার, ছত্র, চামরদ্বয় ও ব্রহ্মদত্তমালা অবলোকন করিতে সমর্থ হইতেছ না। আমার সেসমুদয় এক্ষণে অন্তর্হিত হইয়াছে; কিন্তু যখন আমার সৌভাগ্য সমুদিত হইবে, তখন তুমি পুনরায় তৎসমুদয় দর্শন করিবে। যাহা হউক, এক্ষণে আপনাকে সৌভাগ্যশালী মনে করিয়া আমাকে এরূপ নিন্দা করা তোমার কীৰ্ত্তি বা কুলের অনুরূপ কাৰ্য্য হইতেছে না। জ্ঞানতৃপ্ত ক্ষমাশীল মনীষীরা কখন দুঃখে অনুতাপ বা সম্পদে আহ্লাদ প্রকাশ করেন না। এক্ষণে তুমি সামান্য বুদ্ধি অবলম্বন করিয়া আমার নিন্দা করিতেছ, কিন্তু যখন স্বয়ং আমার মত হইবে, তখন আর এরূপ বলিতে পারিবে না।’ ”