২২১তম অধ্যায়
অথর্ব্ব অগ্নিশাপে মৎস্যগণের সর্ব্বভক্ষ্যত্ব
মার্কণ্ডেয় কহিলেন, “ভূলোক-ভুবর্লোকাধিপতি বরুণলোকে বিখ্যাত সহনামা অগ্নির দুহিতনামে এক পরমপ্ৰিয়তমা ভাৰ্য্যা ছিলেন। তিনি তাঁহার গর্ভে অদ্ভূতনামে পাবকের উৎপাদন করেন। ব্রাহ্মণের পুরুষপরম্পরাগত যে অদ্ভুতাখ্য পাবককে আত্মা ও ভুবনভর্ত্তা বলিয়া নির্দেশ করেন, সামান্য ও মহৎ প্রভৃতি সর্ব্বভূতের অধীশ্বর সেই মহাতেজাঃ ভগবান পাবক নিত্য বিচরণ করিতেছেন। গৃহপতিনামে অগ্নি যজ্ঞে নিত্য পূজিত হয়েন ও লোকের হুতহব্য-সকল বহন করেন। যে মহাভাগ লোকত্ৰয়সংহর্ত্তা এবং ভূলোক, ভুবর্লোক ও মহলোকের অধীশ্বর, অগ্নিষ্টোমে নিয়ত পূজিত, যিনি মৃত প্ৰাণীসকলকে দগ্ধ করেন, সেই ভরত অগ্নিসহের পৌত্র ও অদ্ভুতের পুত্র।
“একদা দেবতারা হব্য-বহনাৰ্থ ভরতকে অন্বেষণ করিতেছেন, ইত্যবসরে তিনি দেবতাদিগকে সমাগত দেখিয়া ভয়ে অর্ণবমধ্যে প্রবেশ করিলেন। দেবতারাও তাঁহার অন্বেষণার্থ সমুদ্রে প্রবিষ্ট হইলেন। অনন্তর ভরতাগ্নি অথর্ব্বা হুতাশনকে অবলোকন করিয়া কহিলেন, “হে বীর! সম্প্রতি আমি অদৃশ্য হইলাম; তুমি দেবগণের হব্যবহনকাৰ্য্যে নিযুক্ত হইয়া আমার প্রিয়কাৰ্য্য সম্পাদন কর। তাহা হইলে তুমি অগ্নিত্ব প্রাপ্ত হইবে, সন্দেহ নাই।” ভারত-অগ্নি অথর্ব্বাকে এই আদেশ করিয়া স্বয়ং স্থানান্তরে প্রস্থান করিলে মৎস্যেরা তাঁহার নিকট উপস্থিত হইয়া অথর্ব্বা অগ্নির বৃত্তান্ত-সকল নিবেদন করিল। তখন সেই অনল ক্ৰোধে প্রজ্বলিত হইয়া মৎস্যদিগকে কহিলেন, “তোরা বিবিধ প্রকারে শরীরীর ভক্ষ্য হইবি।”
“অনন্তর তিনি দেবগণের আজ্ঞাক্ৰমে হব্যবহন করিবার নিমিত্ত অথর্ব্বাকে পুনরায় নানাপ্রকার অনুনয় করিতে লাগিলেন। অথর্ব্ব কোনক্রমেই তাহাতে সম্মত না হইয়া কলেবর পরিত্যাগপূর্ব্বক ধরাপ্রবিষ্ট হইলেন। তাঁহার অঙ্গসংস্পর্শে নীললোহিতাদি ধাতুসকল, পূয় হইতে গন্ধ ও তেজ, অস্থি হইতে দেবদারু, শ্লেষ্মা হইতে স্ফটিক, পিত্ত হইতে মরকত, যকৃৎ হইতে কৃষ্ণায়স, কাষ্ঠ ও পাষাণ এবং রুধির হইতে প্ৰজাসকল উৎপন্ন হইল। তাঁহার নখর-সকল অভ্ৰধাতু ও শিরাজাল বিদ্রুম হইল এবং সুবর্ণ, পারদ প্রভৃতি অন্যান্য ধাতু-সকলও তাঁহার শরীর হইতে সমুৎপন্ন হইল।
“অথর্ব্বা অনল এইরূপে কলেবর পরিত্যাগানন্তর নিরুপাধিক ধ্যানে চিত্ত নিবিষ্ট করিয়া তপানুষ্ঠান করিতে লাগিলেন। এদিকে ভৃগু, অঙ্গিরাঃ প্রভৃতি মুনিগণের তপোবলে উত্থাপিত হইয়া নিরন্তনামে বহি সাতিশয় দেদীপ্যমান হইয়া উঠিলেন। তিনি তখন অথর্ব্বাকে তপস্যা করিতে দেখিয়া ভয়ে পুনর্ব্বার মহার্ণবে প্ৰবেশ করিলেন। এইরূপে অগ্নি বিনষ্ট হইলে সমস্ত জগৎ সাতিশয় ভীত হইয়া অথর্ব্বার শরণাপন্ন হইল, সুরাসুর প্রভৃতি লোকসকল তৎসন্নিধানে উপনীত হইয়া অথর্ব্বার অর্চনা করিতে লাগিলেন। অথর্ব্বা পাবককে এইরূপ অবলোকন করিয়া স্বয়ং সকল লোকের সৃষ্টি করিলেন এবং সর্ব্বভূতের সমক্ষে মহার্ণবকে উন্মথিত করিলেন। এইরূপে পূর্ব্ববিনষ্ট পাবক ভগবান অথর্ব্বাকর্ত্তৃক আহূত হইয়া সর্ব্বভূতের হব্য বহন করিতে আরম্ভ করিলেন।
“তিনি বেদোক্ত বিবিধ বহ্নির সৃষ্টি করিয়া নানা স্থান ভ্ৰমণ করিতে লাগিলেন। তথায় সিন্ধুনদ, পঞ্চনদ, শোণ, দেবিকা, সরস্বতী, গঙ্গা, শতকুম্ভা, সরযূ, গণ্ডকী, চর্ম্মণ্বতী, মহী, মেধ্যা, মেধাতিথি, তাম্রাবতী, বেত্ৰবতী, কৌশিকী, তমসা, নর্ম্মদা, গোদাবরী, বেণা, উপবেণা, ভীমা, বড়বা, ভারতী, সুপ্রয়োগা, কাবেরী, মুৰ্ম্মূরা, তুঙ্গবেণা, কৃষ্ণবেণা ও কপিলা এই সকল নদী অগ্নিদিগের মাতা বলিয়া কীর্ত্তিত হইয়াছে। অদ্ভুতের ভাৰ্য্যা প্রিয়া, তাঁহার পুত্র বিভূরসি। যত প্রকার পাবক উক্ত হইল, সোমও ততসংখ্যক আছে। ভগবান অত্ৰি অপত্যকামনায় স্ৰষ্টুকাম অগ্নিদিগের ধ্যান করাতে তাঁহারা তদীয় শরীর হইতে নিঃসৃত হইলেন। এইরূপে হুতাশনগণ অত্রির বংশে সঞ্জাত হয়েন।
“আমি মহাত্মা অগ্নিদিগের বিষয় কীর্ত্তন করিলাম; ইঁহারা এইরূপে অপ্রমেয় শ্ৰীমান ও তিমিরাপহ হইয়া উঠিলেন। বেদে অদ্ভুতাখ্য অগ্নির যেরূপ মাহাত্ম্য কীর্ত্তন করিয়াছেন, সেইরূপ সকল অগ্নিরই মাহাত্ম্য জানিবে। যেমন জ্যোতিষ্টোম-যজ্ঞ হইতে বহুবিধ ক্ৰতু নিঃসৃত হইয়াছে, সেইরূপ প্রথম অগ্নি ভগবান অঙ্গিরা হইতে সকল অগ্নি সম্ভূত হইয়াছে।”