২১-২৫. শুধু শিবেন সোমই কেন

শুধু শিবেন সোমই কেন, আমিও যেন বোবা হয়ে যাই। কি বলব বা অতঃপর কি বলা উচিত বুঝে উঠতে পারি না।

হঠাৎ স্তব্ধতা ভঙ্গ করে কিরীটী আবার কথা বললে, কিন্তু একটু আগে না আপনি কি জটিল এক সমস্যার কথা বলছিলেন শিবেনবাবু!

জটিল সমস্যা? হ্যাঁ—সকাল থেকে এদিকে রঞ্জনবাবু—

কি? কি হল তার আবার?

সে উধাও!

বলেন কি? সঙ্গে সঙ্গে কথাটা বলতে বলতে যেন কিরীটী সোফার উপরে সোজা হয়ে বসে।

হ্যাঁ, সকালবেলা থেকেই তার কোন পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না।

কেন—কেন আপনি এতক্ষণ এ-কথাটা আমাকে বলেননি? সঙ্গে সঙ্গে সোফা থেকে উঠে কিরীটী সোজা ঘরের কোণে রক্ষিত ত্রিপয়ের উপরে ফোনের সামনে গিয়ে দাঁড়াল এবং রিসিভারটা তুলে ডায়েল শুরু করে, হ্যালো, ডি. সি. মিঃ সিন্হাকে দিন–

অতঃপর শুনতে লাগলাম ফোনে ডি. সি.-কে রঞ্জনের নিখুঁত চেহারার বর্ণনা দিয়ে সর্বত্র রেলওয়ে স্টেশনে স্টেশনে তাকে খোঁজ করবার জন্য অবিলম্বে জরুরী মেসেজ পাঠাবার ব্যবস্থা এবং ফোন শেষ করে ফিরে এসে বললে, রাত এখন পৌনে দশটা—চলুন, আর দেরি নয় শিবেনবাবু—এখুনি আমাদের একবার বেলগাছিয়ায় অধ্যাপক-ভবনে যেতে হবে!

দশ মিনিটের মধ্যে আমরা শিবেনবাবুর গাড়িতে করেই বেলগাছিয়ার উদ্দেশে বের হয়ে পড়লাম। চলন্ত গাড়িতে বসে কিরীটী আবার বললে, বড্ড দেরি হয়ে গেল শিবেনবাবু। রঞ্জন বোস অনেকটা টাইম পেয়ে গেল—

কিন্তু আমিও চুপ করে বসে ছিলাম না কিরীটীবাবু, আমি দুপুরেই তার সন্ধানে চারিদিকে লোক পাঠিয়েছি—

আপনি পাঠিয়েছিলেন?

পাঠিয়েছি বৈকি!

উঃ, বড় একটা ভুল হয়ে গেল! হঠাৎ বলে কিরীটী।

ভুল?

হ্যাঁ, একটা জরুরী—অত্যন্ত জরুরী ফোন করার প্রয়োজন ছিল একজনকে, তাড়াতাড়িতে ভুল হয়ে গেল।

সামনেই তো সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিস পড়বে, ঐখান থেকেই তো ফোন করতে পারেন!

ঠিক বলেছেন, ওখানে একটু দাঁড়াবেন।

পথেই একটু পরে সেন্ট্রাল টেলিগ্রাফ অফিসে গাড়ি থেকে নেমে কিরীটী ফোন করে মিনিট পনেরো বাদে আবার ফিরে এল গাড়িতে। শিবেনবাবু শুধান, ফোন করলেন?

হ্যাঁ।

কাকে ফোন করলেন?

হত্যাকারীকে।

সে কি!

হ্যাঁ  আমার অনুমান, যাকে আমি ফোন করলাম তিনিই আমাদের বিমল-হত্যারহস্যের মেঘনাদ!

কিন্তু–

আহা ব্যস্ত হচ্ছেন কেন। চক্ষুকর্ণের বিবাদ তো অনতিবিলম্বেই ভঞ্জন হবে—কিন্তু বড় চায়ের পিপাসা পাচ্ছে, কোথাও এক কাপ চা পাওয়া যায় না?

বেন্টিঙ্ক স্ট্রীটের মোড়ে একটা চীনা রেস্টুরেন্ট আছে—সেখানে পেতে পারেন।

তা হলে চলুন সেই দিকেই। তৃষ্ণা নিয়ে কোন মহৎ কাজ করতে যাওয়া ভাল নয়। মনটা তাতে করে উৎক্ষিপ্ত থাকবে।

পথে চা-পান করে আমরা যখন বেলগাছিয়ার অধ্যাপক-ভবনে এসে পৌঁছলাম রাত তখন ঠিক এগারোটা বেজে দশ। যদিও গ্রীষ্মকালের রাত্রি এবং বেলগাছিয়া বৃহত্তর কলকাতারই বিশেষ একটি অংশ, তবু ঐদিকটা ইতিমধ্যে যেন শান্ত হয়ে এসেছে।

পানের দোকান ও ডাক্তারখানাগুলো ছাড়া রাস্তার সব দোকানই প্রায় দু-পাশের বন্ধ হয়ে গিয়েছে। মানুষজনের চলাচলও কমে এসেছে।

লাস্ট ট্রাম চলে গিয়েছে, তবে ডিপোমুখী ট্রামগুলো তখনো এক এক করে ফিরে আসছে এবং সে-সব ট্রামে যাত্রী একপ্রকার নেই বললেও অত্যুক্তি হয় না।

.

কিরীটীর নির্দেশে অধ্যাপক-ভবনের কিছু দূরেই গাড়িটা দাঁড় করানো হয়েছিল। আমরা পায়ে হেঁটে কজন অধ্যাপক-ভবনের দিকে অগ্রসর হলাম। আকাশে সেরাত্রে একফালি চাদ ছিল, তারই মৃদু আলোয় প্রকৃতি যেন স্বপ্নময় মনে হয়।

হঠাৎ নজরে পড়ল অধ্যাপকের বাড়ির দোতলায় আলো জ্বলছে। নীচের তলাটা কিন্তু অন্ধকার।

গেট দিয়ে গিয়ে ভিতরে প্রবেশ করলাম।

বারান্দা বরাবর গিয়েছি, অন্ধকারে প্রশ্ন ভেসে এল, কে?

জবাব দিল কিরীটী, রামচরণ, আমরা!

রায়বাবু? আসুন–রামচরণ এগিয়ে এল।

তুমি তা হলে এখানেই আছ রামচরণ?

আজ্ঞে, সেরাত্রে তো আপনি তাই বলেছিলেন। সকালেই ফিরে এসেছি আপনার আজ্ঞামত–

ঠিক করেছ। তোমার মার খবর কি রামচরণ?

আজ্ঞে তিনি আমার ভাইপোর ওখানেই আছেন।

এঁরা খোঁজেনি তোমার মাকে?

খুঁজেছিলেন। বোধ হয় পুলিসেও ছোটবাবু খবর দিয়েছেন।

রঞ্জনবাবু ফিরেছেন?

এই কিছুক্ষণ হল ফিরে এসেছেন—

ফিরেছেন?

আজ্ঞে।

কোথায়?

বোধ হয় নিজের ঘরে।

কিরীটী অতঃপর মুহূর্তকাল যেন কি ভাবল, তারপর বললে, তোমার দিদিমণি?

আপনি জানেন না, পুলিস তো তাকে ছেড়ে দিয়েছে—তিনিও বাড়িতেই আছেন।

রঞ্জনবাবু শুনেছেন সে-কথা?

বলতে পারি না।

আচ্ছা ঠিক আছে। আমরা একবার ওপরে যাব। তুমি এখানেই থাকো রামচরণ, যেমন তোমাকে আমি নজর রাখতে বলেছিলাম তেমনি নজর রাখো।

যে আজ্ঞে। রামচরণ বিনীত কণ্ঠে সম্মতি জানায়।

আমরা এগুতেই রামচরণ পিছন থেকে শুধায়, আলোটা সিঁড়ির জ্বেলে দেব রায়বাবু?

না না—আলোর দরকার নেই, আমরা অন্ধকারেই যেতে পারব।

রাস্তা থেকে যে আলোটা আমাদের চোখে পড়েছিল, সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে বুঝতে পারলাম সেটা শকুন্তলার ঘরের আলো।

কিরীটী সেই দিকেই অর্থাৎ শকুন্তলার ঘরের দিকেই অগ্রসর হচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল, সঙ্গে সঙ্গে আমরাও দাঁড়াতে বাধ্য হলাম।

ফিস ফিস করে কিরীটী পার্শ্বেই দণ্ডায়মান শিবেন সোমকে শুধাল, চাবিটা সঙ্গে আছে আপনার শিবেনবাবু?

কোন্ চাবি? শিবেন শুধায়।

অধ্যাপকের ঘরে যে তালা লাগিয়েছেন তার চাবি—

আছে।

আমাকে দিন।

শিবেন সোম পকেট থেকে চাবিটা বের করে কিরীটীর হাতে দিলেন।

সঙ্গে পিস্তল আছে আপনার?

আছে।

দিন আমাকে।

কোমরের বেল্ট-সংলগ্ন চামড়ার কেস থেকে পিস্তলটা খুলে অন্ধকারে কিরীটীর দিকে এগিয়ে দিলেন শিবেন সোম।

অতি সন্তর্পণে, প্রায় বলতে গেলে নিঃশব্দেই, কিরীটী হাতের চাবি দিয়ে অন্ধকারেই অধ্যাপকের ঘরের তালাটা খুলে ফেলল এবং ধীরে ধীরে দরজাটা খুলে বাঁ হাত বাড়িয়ে দরজার একেবারে গায়ে সুইচ-বোর্ডের আলোর সুইচটা টিপে দিল।

দপ করে ঘরের আলোটা জ্বলে উঠল এবং কিরীটীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল—বজ্রকঠিন কণ্ঠস্বর, মিঃ সেন আপনার খেলা শেষ হয়েছে! উঁহু, আমি জানি আপনার পকেটে কিপকেটে হাত দেবার চেষ্টা করবেন না, আমার হাতের দিকে চেয়ে দেখুন—আমি প্রস্তুত হয়েই এসেছি।

সত্যি! ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে আমাদের সামনে বিনায়ক সেনই!

কিন্তু মুখে তার আর কোন কথাই নেই। একেবারে যেন বোবা।

নিষ্পলক দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন তখনো মিঃ সেন অর্থাৎ বিনায়ক সেন কিরীটীর মুখের দিকে।

আবার কিরীটী বলে, yes, thats like a good boy! এবং একটু থেমে আমাকে সম্বোধন করে বলে, সুব্রত, মিঃ সেনের পকেট থেকে বস্তুটি নিয়ে এসে তোমার জিম্মায় রাখো। মারাত্মক বস্তুকে সাবধানে রাখাই ভাল

সঙ্গে সঙ্গে আমি এগিয়ে গিয়ে বিনায়ক সেনের পকেট থেকে পিস্তলটা বের করে নিলাম।

দাও সুব্রত, শিবেনবাবুকে এবারে জিম্মা করে দাও ওটা।

পিস্তলটা অতঃপর আমি শিবেন সোমের হাতে তুলে দিলাম।

যাক, নিশ্চিন্ত হওয়া গেল। মনের মধ্যে একটা ধুকপুকুনি নিয়ে কথাবার্তা কি হয়! কিন্তু সত্যি আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি মিঃ সেন, আপনি আমার ফোনের একটু আগের সতর্কবাণীটা সত্যি সত্যিই সিরিয়াসলি নিয়েছেন বলে!

বিনায়ক সেন কিন্তু পূর্ববৎ নির্বাক এবং দণ্ডায়মান।

কিরীটীর যেন সেদিকে কোন খেয়ালই নেই। সে বলেই চলে, বুঝতেই পারছেন মিঃ সেন, নেহাৎ অনন্যোপায় হয়েই শঠে শাঠ্যং নীতি মানে সামান্য ঐ চাতুরির আশ্রয়টুকু আমাকে নিতে হয়েছিল, অন্যথায় আপনার মত মহৎ ব্যক্তিকে এইভাবে রেড-হ্যাণ্ডেড ধরা স্বয়ং কিরীটী রায়েরও দুঃসাধ্য হত—কিন্তু আপনি দাঁড়িয়ে কেন—বসুন, প্লিজ বি সিটেড!

কিন্তু বিনায়ক সেন যেমন দাঁড়িয়ে ছিলেন তেমনিই দাঁড়িয়ে রইলেন। বসবার কোন ইচ্ছাই তার প্রকাশ পেল না।

.

২২.

কিরীটী মৃদু হাসল, বসবেন না? কিন্তু দাঁড়িয়ে থাকবেনই বা কতক্ষণ? আমার যে—

কিরীটীর কথাটা শেষ হল না, মধ্যবর্তী দ্বারপথে রঞ্জন বোস উঁকি দিল।

আরে রঞ্জনবাবু, আসুন আসুন—ঘরে আসুন!

রঞ্জন যেন একটু ইতস্তত করেই ঘরে প্রবেশ করল।

কি ব্যাপার কিরীটীবাবু? এত রাত্রে এসব কি?

কিরীটী রঞ্জনের প্রশ্নের কোন উত্তর না দিয়ে শিবেনের দিকে তাকিয়ে বললে, শিবেনবাবু, রঞ্জনবাবুর পকেটটাও একবার সার্চ করে নিন—নো রঞ্জনবাবু নো—দ্যাটস ব্যাড! আমি প্রস্তুত হয়েই আছি দেখছেন না হাতে আমার এটা কি! হ্যাঁ, দিয়ে দিন—

শিবেনবাবু রঞ্জনবাবুর পকেট থেকেও পিস্তলটা বের করে নিলেন।

ইয়েস, দ্যাটস্ গুড! দ্যাটস্ লাইক এ গুড বয়! নাউ বি সিটেড প্লিজ—কিরীটী হাসতে হাসতে বললে।

আকস্মিক ঘটনা-বিপর্যয়ে রঞ্জন বোসও যে বেশ একটু থতমত খেয়ে গেছে বুঝতে পারি।

রঞ্জনবাবু, কৌতূহল বড় বিশ্রী জিনিস! ধরা পড়লেন আপনি আপনার কৌতূহলের জন্যই—কিন্তু শিবেনবাবুর হাতে ধরা যখন পড়েছেন আর তো উপায় নেই—বসুন, না না—মিঃ সেনের অত কাছে নয়—একটু সরে দাঁড়ান—

রঞ্জন বিনায়ক সেনের কাছে এগিয়ে যাচ্ছিল, থেমে গেল।

মিঃ সেন, রঞ্জনবাবু—আপনারা দুজনেই উপস্থিত, এখন শকুন্তলা দেবী হলেই আমাদের কোরাম পূর্ণ হয়। শিবেনবাবু, পাশের ঘর থেকে শকুন্তলা দেবীকেও ডেকে আনুন।

শিবেন সোম সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

কিরীটী আমার মুখের দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলে, কি ভাবছ সুব্রত, এমন চমৎকার মিলনান্ত নাটক বহুদিন দেখোনি, না? বিধাতা-পুরুষের মত নাট্যকার সত্যিই দুর্লভ হে! কলম তাঁর নিখুঁত—এমন চমৎকার ছন্দ-যতি-মিল, এমন টেম্পো, এমন স্পীড়, এমন আঙ্গিক সত্যিই মানুষের কল্পনারও বুঝি বাইরে! বলতে বলতেই শিবেন সোমের সঙ্গে শকুন্তলা ঘরে ঢুকল।

এই যে মিস চৌধুরী, আসুন—কিরীটীই আহ্বান জানাল ওকে।

কেমন যেন বিহ্বল দৃষ্টিতে ঘরের মধ্যে ঐ মুহূর্তে উপস্থিত সকলের দিকে একবার দৃষ্টিটা বুলিয়ে নিয়ে সর্বশেষে দৃষ্টিপাত করল শকুন্তলা কিরীটীর মুখের উপরে নিঃশব্দে।

বসুন মিস্ চৌধুরী, আমিই আপনাকে ডেকে পাঠিয়েছিলাম—বসুন।

শকুন্তলা আবার ঘরের মধ্যে উপস্থিত সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে উপবেশন করল একটা চেয়ারে।

শকুন্তলার মুখের দিকে চেয়ে মনে হল যেন প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গিয়েছে ওর উপর দিয়ে। সমস্ত মুখে একটা দুঃসহ ক্লান্তি ও বিষণ্ণতার সুস্পষ্ট প্রকাশ। চোখের কোলে কালি, মাথার চুল বিস্ত। পরে অবিশ্যি শিবেনবাবুর মুখেই শুনেছিলাম—তিনি যখন শকুন্তলার ঘরে গিয়ে প্রবেশ করেন, দেখেন সে আলো জ্বেলে ঘরের মধ্যে একটা চেয়ারে স্তব্ধ হয়ে বসেছিল।

.

এই ঘরের মধ্যেই মাত্র কয়েকদিন আগে এক সন্ধ্যারাত্রে অধ্যাপক বিমলবাবু নিহত হয়েছেন নিষ্ঠুরভাবে, কিরীটী বলতে লাগল, এবং যিনি বা যাঁরা তাঁকে হত্যা করেছেন তিনি বা তারা যে কত বড় একটা ভুলের বশবর্তী হয়ে তাঁকে সেদিন হত্যা করেছিলেন সর্বাগ্রে আমি সেই কথাটাই বলব।

ভুল! শিবেনবাবু প্রশ্ন করেন।

হ্যাঁ ভুল, বলতে পারেন ট্র্যাজেডি অফ এররসও ব্যাপারটাকে।

কিরীটীর শেষের কথায় যেন স্পষ্ট মনে হল বিনায়ক সেন ঈষৎ চমকে কিরীটীর মুখের দিকে তাকালেন।

কিরীটীর কিন্তু ব্যাপারটা দৃষ্টি এড়ায়নি। সে মৃদু হেসে বলে, হ্যাঁ  মিঃ সেন, যেগুলোর জন্যে আপনি এত কাণ্ড করেছেন—সেগুলো আসল বা রিয়াল জুয়েল নয়। সিথেটিক প্রডাক্টস্—কেমিক্যালে প্রস্তুত জুয়েস্! এবং আপনি জানেন না, বর্তমানে পুলিসের কর্তৃপক্ষের সেটা আর অগোচর নেই। ব্যাপারটা ধরে ফেলেছে এবং আজই সন্ধ্যায় তারা ইকনমিক জুয়েলার্স রেড করে মালসমেত রাঘব সরকারকে অ্যারেস্ট করেছে। খুব সম্ভবতঃ এতক্ষণে হি ইজ আণ্ডার পুলিস-কাস্টডি! আর তা যদি নাও হয়ে থাকে এখনো, অন্ততঃ কালকের সংবাদপত্রে দেখবেন নিউজটা প্রকাশ হয়েছে—

শিবেন সোমই প্রথমে কথা বললেন, রাঘব সরকারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে মিঃ রায়? কিন্তু আমি তো—

না, আপনি জানেন না। আপনি কেন—একমাত্র এনফোর্সমেন্ট ব্রাঞ্চ-এর ডি. সি. মিঃ সিনহা ও আমি ছাড়া এখনো কেউই ব্যাপারটা জানে না। আমারই ইচ্ছাক্রমে ব্যাপারটা গোপন রাখা হয়েছে। এবং গোপন রাখা হয়েছিল রঞ্জনবাবু ও বিনয়বাবুর জন্যই। যাকগে সে কথা, আমি এবারে আমার আসল কাহিনীতেই আসি।

কিরীটী বলতে লাগল ও হত্যার পশ্চাতে কোন একটি বিশেষ কার্যকরণ বা উদ্দেশ্য না থাকলে কখনই হত্যা সংঘটিত হয় না। অধ্যাপক বিমলবাবুর হত্যার পশ্চাতে তেমনি একটি বিশেষ কারণ ছিল এবং বলতে আমার দ্বিধা নেই যার মূলে—অর্থাৎ এও বলা যেতে পারে ঐ হত্যার বীজ একদিন অধ্যাপক নিজেই বা নিজ হাতেই রোপণ করেছিলেন। অবিশ্যি সেটা তাঁর জ্ঞাতে নয়—অজ্ঞাতেই।

কি রকম? প্রশ্ন করেন শিবেনবাবু কিরীটীকে।

কিরীটী বলে, কোথায় কি ভাবে সঠিক বলতে পারি না তবে এটা ঠিক যে রাঘব সরকার ও অধ্যাপক বিমল চৌধুরীর মধ্যে একটা ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল। কারণ পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক বিমল চৌধুরীকে দিয়ে রাঘব সরকার ঐ সব সিনথেটিক জহরৎ তৈরী করাতেন তার নিজস্ব ল্যাবরেটারিতে। প্রথমটায় হয়তো অধ্যাপক ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পারেননি, কিন্তু যখন পারলেন তখন অনেক দেরি হয়ে গিয়েছে নিজের অজ্ঞাতেই নিজের জালে তখন তিনি জড়িয়ে পড়েছেন। সে জালের বাঁধন ছিঁড়ে তখন তার আর বের হয়ে আসার কোন রাস্তাই নেই। জগতের কাছে তার সম্মান ও পরিচয়টাই তাঁর মুখ বন্ধ করে রেখেছিল, আর তারই পূর্ণ সুযোগ নিল শয়তান রাঘব সরকার। রাঘব সরকারের কনফেসন থেকেই অবিশ্যি এ কথাগুলো আমি বলছি। যাই হোক, সে তো নাটকের প্রথম দৃশ্য—

একটু থেমে কিরীটী আবার বলতে লাগল, এবারে নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যে আসা যাক। বড়লোকের স্পয়ে চাইল্ড আমাদের রঞ্জনবাবু ইতিমধ্যে সর্বস্ব হারিয়ে মালয় থেকে এসে হাজির হলেন এখানে তার মামার আশ্রয়ে। রঞ্জনবাবুর ইচ্ছা ছিল তার মামার ঘাড় ভেঙে আবার ব্যবসার নাম করে কিছুদিন মজা লুটবেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য তার, অধ্যাপকের নিজের ঐ ভাগ্নেটিকে চিনতে দেরি হয় নি ফলে তিনি রঞ্জনের প্রস্তাবে সম্মত হতে পারেন না এবং অবশ্যম্ভাবী যা তাই ঘটে এক্ষেত্রেও। অতঃপর মামা-ভাগ্নের মধ্যে মন-কষাকষি শুরু হল। ইতিমধ্যে আর একটা ব্যাপার এ বাড়িতে ঘটেছিল। শয়তান রাঘব সরকারের নজর পড়েছিল শকুন্তলা দেবীর ওপরে। অধ্যাপক নিশ্চয় রাঘব সরকারের প্রস্তাবে চমকে উঠেছিলেন। এবং যদিচ রাঘব সরকারের প্রতি অধ্যাপক কোনদিনই বিশেষ প্রসন্ন ছিলেন না, যেটা শকুন্তলা দেবীর জবানবন্দী থেকেই আমরা জানতে পারি, অধ্যাপকের পক্ষে তথাপি সরাসরি রাঘব সরকারের প্রস্তাবটা নাকচ করা সম্ভবপর হয় নি হয়ত—অবিশ্যি এটা আমার অনুমান, অন্যথায় রাঘব সরকার অধ্যাপককে বিপদে ফেলতে পারে তার সঙ্গে তার গোপন যোগাযোগের কথাটা অর্থাৎ ঐ সিনথেটিক হীরের ব্যবসার কথাটা প্রকাশ করে দিয়ে। বেচারী অধ্যাপকের সাপের ছুঁচো গেলার মত অবস্থা হয়েছিল—মানে রাঘব সরকারের প্রস্তাবটা যেমন ফেলতে পারছিলেন না মন থেকে, তেমনি তার অশেষ স্নেহের পাত্রী শকুন্তলা দেবীকেও সব জেনেশুনে ঐ শয়তান রাঘবের হাতে তুলে দিতে পারছিলেন না। এদিকে শকুন্তলা দেবীর অবস্থাটাও সঙ্কটজনক হয়ে ওঠে। তার পক্ষেও যেমন অধ্যাপকের দিকটা অবহেলা করা সম্ভবপর ছিল না, তেমনি দুষ্মন্তকেও অস্বীকার করাটা সম্ভবপর ছিল না—তাই না শকুন্তলা দেবী?

হ্যাঁ, শকুন্তলা মৃদুকণ্ঠে এতক্ষণে কথা বললে, রাঘব সরকার কাকাকে আটিমেটাম দিয়েছিল এই মাসের পনেরো তারিখের মধ্যেই অর্থাৎ কাকার জন্মতিথি উৎসবের দশ দিনের মধ্যেই বিবাহের ব্যাপারটা চুকিয়ে না দিলে কাকার পক্ষে ভাল হবে না–

আর তাই আপনি ভয় পেয়ে আমার কাছে ছুটে গিয়েছিলেন, তাই নয় কি?

হ্যাঁ। আমার আর–

অন্য উপায় ছিল না। তা বুঝতে পারছি, কারণ সিথেটিক হীরার ব্যাপারটাও আপনি কোনক্রমে জেনেছিলেন—ঠিক কিনা শকুন্তলা দেবী?

প্রশ্নটা করে কিরীটী শকুন্তলার মুখের দিকে তাকাল।

হ্যাঁ, আমি—

আপনি জানতেন।

হ্যাঁ।

শুধু আপনি কেন, আরো দুজন ইদানীং ব্যাপারটা কিছুদিন ধরে জানতে পেরেছিলেন মিস চৌধুরী।

আরো দুজন?

শকুন্তলা প্রশ্নটা করে কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।

হ্যাঁ  আরো দুজন—মিঃ সেন আর ঐ রঞ্জনবাবু। আর তাইতেই তো গোলমালটা বিশ্রীভাবে সহসা পাকিয়ে উঠল।

কিরীটী বলতে বলতে আবার একটু থামল।

ঘরের মধ্যে সব কটি প্রাণীই যেন অখণ্ড মনোযোগের সঙ্গে কিরীটী-বর্ণিত কাহিনী শুনছিল।

.

২৩.

কিরীটী বলতে লাগল, সেই কথাতেই এবার আসছি—অর্থাৎ বর্তমান নাটকের তৃতীয় দৃশ্যে। ব্যাপারটা অবিশ্যি রঞ্জনবাবুই প্রথমে জানতে পারেন, কারণ তিনি এ বাড়িতে আসা অবধি অধ্যাপকের পাশের ঘরটিতেই স্থান নিয়েছিলেন। রাঘব সরকার মধ্যে মধ্যে রাত্রের দিকে অধ্যাপকের সঙ্গে দেখা করতে আসত এবং অধ্যাপকের ঘরের মধ্যে বসেই তাদের মধ্যে। আলোচনা হতো। কোন একদিন সেই রকম কোন আলোচনাই রাঘব ও অধ্যাপকের মধ্যে তার কানে হয়ত যায় এবং ব্যাপারটা তিনি জানতে পারেন। যাই হোক ইতিমধ্যে আমার ধারণা একটি ঘটনা ঘটে—বিনায়ক সেনের নিতান্ত সঙ্গীন অবস্থা চলছিল, চারিদিকে ধার-দেনা, অনন্যোপায়ে তিনি হয়তো রাঘব সরকারের কাছে গিয়ে কিছু অর্থের জন্য বলেন, যার ফলে। মাত্র মাস-দুই আগে সংবাদপত্রে একটা বিজ্ঞাপন আমার নজরে পড়েছিল—স্বাগতা পিকচার্সের নবতম চিত্ৰাৰ্ঘ জুয়েলার শ্রীরাঘব সরকারের প্রযোজনায় অভিজ্ঞান শকুন্তলম্‌! হ্যাঁ, ঐ অভিজ্ঞান শকুন্তলমের বিজ্ঞপ্তিটিই আমার চোখ খুলে দেয়। যার ফলে আমি বুঝতে পারি রাঘব সরকার বিনায়ক সেনের সঙ্গে হাত মিলিয়েছে। কিন্তু রাঘব সরকারের মত ঝানু। লোক এত সহজে অনিশ্চিত ফিল্ম বিজনেসের কবলিত হবে সম্ভব তো নয়। কথাটা মনে মনে। পর্যালোচনা করতে গিয়েই একটা সম্ভাবনা আমার মনের মধ্যে উঁকি দেয়, নিশ্চয় ঐ যোগাযোগের স্বীকৃতির মধ্যে কোন কার্যকারণ আছে। পরে ভেবে মনে হয়েছে, সেটা ঐ শকুন্তলা দেবী। রাঘব সরকার নিশ্চয়ই মিঃ সেনের প্রস্তাবে রাজী হয়েছিলেন, বিনায়কবাবু অধ্যাপকের বাল্যবন্ধু এবং বিশেষ প্রীতি আছে দুজনের মধ্যে, অতএব বিনায়ক সেন চেষ্টা করলে এই বিবাহ ঘটাতে পারেন, এই আশাতেই বিবাহ ঘটাবার চুক্তিতে কি মিঃ সেন, তাই নয়? প্রশ্নটা করে কিরীটী তাকাল বিনায়ক সেনের দিকে।

বিনায়ক সেন কোন জবাব দিলেন না, মাথা নীচু করেই রইলেন নিঃশব্দে।

বুঝতে পেরেছি আমার অনুমান মিথ্যে নয় মিঃ সেন। আপনার ও রাঘব সরকারের পরস্পরের মধ্যে ঐ চুক্তিই হয়েছিল। যাক, কিন্তু দুর্ভাগ্য বিনায়কবাবু জানতেন না যে সিনথেটিক হীরার ব্যাপারে ইতিমধ্যেই তাঁর বাল্যবন্ধু অধ্যাপক বিমলবাবুকে রাঘব সরকারের কুক্ষিগত হতে হয়েছিল। সেটা বোধ হয় জানতে পারেন সর্বপ্রথম রঞ্জনবাবুর মুখেই। রঞ্জনবাবুর সম্পর্কে আরো কিছু আমার বক্তব্য আছে। রঞ্জনবাবু বিনায়কবাবু ফিল্ম-এর বিজনেস করেন জেনে তার কাছে গিয়েছিলেন হয়তো কোন সময় কাজের জন্য, কিন্তু বিনায়কবাবু হয়তো তাঁকে পাত্তা দেন নি এবং ঐ সময় হীরার ব্যাপারটা তার গোচরীভূত হওয়ায় আবার হয়তো তিনি বিনায়কের কাছে যান এবং বিনায়ক এবারে আর রঞ্জনবাবুকে প্রত্যাখ্যান জানাতে পারেন নি, তাঁর সঙ্গে হাতে হাত মিলান। কি মিঃ সেন, আমার অনুমান কি মিথ্যা?

পূর্ববৎ বিনায়ক সেন চুপ করে রইলেন।

কিরীটী আবার বলতে লাগল, মিথ্যা নয় আমি জানি। যাই হোক এবারে বিনায়কও রাঘব। সরকারের পক্ষ থেকে বেচারী অধ্যাপককে চাপ দিতে শুরু করলেন। অথচ তিনি তখনও জানতেন না শকুন্তলার সত্য পরিচয়টা। অবিশ্যি জানলেও যে উনি পিছপাও হতেন আমার মনে হয় না। ব্যাপারটা তা হলে শেষ পর্যন্ত কিভাবে জটিল হয়ে উঠল আপনারা ভেবে দেখুন এবং সব জটিলতার মূলে ঐ শকুন্তলা দেবীর প্রতি শয়তান রাঘবের শ্যেনদৃষ্টি-হা শকুন্তলা দেবী, আপনিই এই নাটকের মূল। যে নাটক গত কিছুদিন ধরে এই বাড়িতে আপনাকে কেন্দ্র করে সংঘটিত হয়েছে এবং যার চরম ক্লাইমেক্সে অধ্যাপকের শোচনীয় মৃত্যু হল

আমি! অস্ফুট কণ্ঠে বলল শকুন্তলা।

হ্যাঁ, আপনি। কিন্তু সে কাহিনীরও পশ্চাতে রয়েছে আপনাকেই কেন্দ্র করে আর এক কাহিনী–

আর এক কাহিনী!

হ্যাঁ। কিন্তু সে কাহিনীর বিবৃতির আজ আর আপনার কাছে কোন প্রয়োজন নেই।

কিরীটীবাবু-কি যেন বলবার চেষ্টা করে শকুন্তলা।

কিন্তু শকুন্তলাকে থামিয়ে দিয়েই কিরীটী বলে, ব্যস্ত হবেন না শকুন্তলা দেবী, হয়ত সে কাহিনী একদিন আপনা হতেই আপনার কাছে প্রকাশ হয়ে যাবে। কিন্তু যাক সে কথা, মিঃ সেন ও রঞ্জনবাবুর কথা আমি বলছিলাম সেই কথাই শেষ করি। একটু আগে যে কাহিনীর ইঙ্গিত মাত্র আমি দিলাম, সম্ভবতঃ সেটা রঞ্জনবাবু জেনেছিলেন কোন এক সময় অধ্যাপকের পাশের ঘরেই থাকার দরুন-অধ্যাপক ও বিনায়কবাবুর মধ্যে আলোচনা প্রসঙ্গে অথবা অধ্যাপক ও সরমা দেবীর মধ্যে আলোচনা প্রসঙ্গে। এবং যার ফলে নাটকের গতি আবার। মোড় নিল। অর্থাৎ রঞ্জনবাবু বিনায়কবাবুকে সাহায্যই নয়—ঐ সুযোগে নিজের ভবিষ্যৎটাকে নতুন করে গড়ে তোলবারও আবার স্বপ্ন দেখতে লাগলেন আর সেই সঙ্গে নাটকের শেষ দৃশ্যও ঘনিয়ে আসতে লাগল। অধ্যাপক, বিনায়কবাবু, রাঘব সরকার ও রঞ্জন বোসকে নিয়ে নাটক ঘনীভূত হয়ে উঠল। চারজন লোকের পরস্পরের বিচিত্র স্বার্থে লাগল সংঘর্ষ—যে স্বার্থের কথা আমি এইমাত্র আপনাদের বললাম। যদি ভেবে দেখেন আপনারা তো দেখতে পাবেন ওঁদের মধ্যে একজনের অর্থাৎ অধ্যাপক বিমল চৌধুরীর সামাজিক প্রতিষ্ঠা ও সম্মান এবং রাঘব সরকারের শকুন্তলা লাভ ব্যতীত অন্য দুইজনের স্বার্থ ছিল অর্থ। এবং ঠিক সেই সময় ঘটল আর একটি বিচিত্র ব্যাপার নাটকের ঐ সঙ্গীন মুহূর্তেই ঐ বিচিত্র ব্যাপারটি ঘটল— বলতে বলতে কিরীটী থামল যেন হঠাৎ।

তার মুখের দিকে তাকিয়ে সেই মুহূর্তে আমার মনে হল কিরীটী যেন রীতিমত এক সংশয়ে পড়েছে।

অতঃপর কাহিনীর শেষাংশ সে উদঘাটিত করবে কি করবে না এবং কেন যে তার ঐ দ্বিধা তাও আমি বুঝতে পারছিলাম।

সরমা—সরমার কথা ভেবেই সে হঠাৎ চুপ করে গেল।

কিরীটী মনে মনে কি ভাবল সে-ই জানে—তবে মনে হল তার মুখের দিকে তাকিয়ে, অতঃপর বাকিটুকু সে বলবে বলেই মনে মনে স্থির করেছে। এবং আমার অনুমান যে মিথ্যা নয়, পরমুহূর্তেই বুঝলাম।

সে বলতে শুরু করল পুনরায়:

বুদ্ধিমতী সরমা ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল ইতিমধ্যে। কিন্তু দুর্ভাগ্য, সে অধ্যাপককে ভুল বুঝেছিল—সে ভেবেছিল বুঝি ইচ্ছা করেই অধ্যাপক নিজের স্বার্থের জন্য শকুন্তলাকে রাঘব সরকারের হাতে তুলে দিচ্ছেন। এবং শুধু যে সরমাই ভুল বুঝেছিল অধ্যাপককে তাই নয়, বিনায়কবাবুও ভুল বুঝেছিলেন তাঁর বাল্যবন্ধু অধ্যাপক বিমলবাবুকে। তিনি অর্থাৎ মিঃ। সেন ভেবেছিলেন—এই পর্যন্ত বলেই কিরীটী আবার থামল এবং হঠাৎ শকুন্তলার দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, মিস চৌধুরী যদি কিছু মনে না করেন তো-বড্ড পিপাসা পেয়েছে একটানা বকে বকে, যদি একটু চায়ের ব্যবস্থা করতেন–

শকুন্তলা তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে।

কিরীটী ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই বোধ হয় মৃদু হাস্যসহকারে বলে, না, আপনি না ফিরে আসা পর্যন্ত আমি চুপ করেই আছি—তবে একটু তাড়াতাড়ি করবেন।

মনে হল একান্ত যেন অনিচ্ছার সঙ্গেই শকুন্তলা দেবী ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।

.

২৪.

কিরীটী যেন কান পেতেই ছিল, শকুন্তলার পায়ের শব্দটা মিলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটী ইঙ্গিতে দরজাটা ভেজিয়ে দেবার জন্য বলল।

আমি এগিয়ে গিয়ে দরজাটা ভেজিয়ে দিলাম।

শিবেনবাবু, উনি ফিরে আসবার আগেই আমাকে শেষ করতে হবে—আই মাস্ট ফিনিশ ইট বিফোর সি কামস্ ব্যাক্‌! হ্যাঁ, বলছিলাম বিনায়কবাবুও তার বাল্যবন্ধু অধ্যাপককে ভুল বুঝেছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন বিনায়কবাবুর পীড়াপীড়ির হাত থেকে শকুন্তলার রাঘবের সঙ্গে বিবাহের ব্যাপারে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্যই হয়তো শেষ পর্যন্ত অধ্যাপক রাঘবের কাছে। শকুন্তলার সত্যিকারের জন্মবৃত্তান্তটা খুলে বলবেন। রাঘব তা হলে জেনেশুনে সমাজের জন্মপরিচয়হীন এক মেয়েকে নিশ্চয়ই বিবাহ করবে না এবং তার ফলে এক ঢিলে দুই পাখীই। মারা হবে। রাঘবের হাত থেকেও নিষ্কৃতি পাওয়া যাবে এবং শকুন্তলাকেও দুঃখ দেওয়া হবে। কিন্তু বিনায়কবাবু বুঝতে পারেন নি—অধ্যাপকের পক্ষে ঐ কাজ কখনোই সম্ভবপর ছিল না–

সহসা ঐ সময় এতক্ষণে বিনায়ক সেন কথা বলে উঠলেন, ছিল—ইউ ডণ্ট নো হিম—

মিঃ সেন!

হ্যাঁ, হ্যাঁ—অ্যাণ্ড ইন ফ্যাক্ট হি থ্রেটে মি, আমাকে সে শাসিয়েছিল।

তবু আমি বলব তিনি তা করতেন না।

করতেন—আর তা করতেন বলেই দেয়ার ওয়াজ নো আদার অল্টারনেটিভ—

মিঃ সেন!

ইয়েস-হ্যাঁ হ্যাঁ, আই কিল্ড হিম! আমি তাকে হত্যা করেছি ইয়েস—আমি স্বীকার করছি তাকে আমি হত্যা করেছি—

আমি জানতাম মিঃ সেন—আমি জানতে পেরেছিলাম পরের দিনই ব্যাপারটা টেলিফোন অফিসে এনকোয়ারি করে। আপনার বাড়ি থেকেই সেরাত্রে আপনার পূর্ব-নির্দেশমতই এখানে ফোন-কল এসেছিল এবং আপনার ও রঞ্জনবাবুর পূর্ব-প্ল্যানমত সেই ফোন আসা মাত্রই রঞ্জনবাবু ফোনটা অধ্যাপকের ঘরে নিয়ে গিয়ে রেখে তাকে সংবাদ দেন—তাই না রঞ্জনবাবু?

মৃদু কণ্ঠে রঞ্জন বলল, হ্যাঁ।

তারপর—কিরীটী বলতে লাগল, বেচারী যখন ঘরে ঢুকে নিশ্চিন্তে ফোন তুলে নিয়েছেন। —বিনায়কবাবু রঞ্জনবাবুর ঘর থেকে দুই ঘরের মধ্যবর্তী দরজাপথে এসে পশ্চাৎ থেকে অতর্কিতে ক্লোরোফরম নিয়ে আক্রমণ করেন অধ্যাপককে। এবং অজ্ঞান করে পরে ডিজিট্যালিন সম্ভবত হাই ডোজে ইনজেক্ট করে অধ্যাপককে হত্যা করা হয়—তাই নয় কি?

রঞ্জনই আবার মৃদু কণ্ঠে বলে, হ্যাঁ।

দেখুন দুর্ভাগ্য আপনাদের রঞ্জনবাবু ও বিনায়কবাবু, আপনারা ভেবেছিলেন কেউ সে-কথা জানতে পারবে না কিন্তু তা তো হল না—আপনারাই রেখে গিয়েছিলেন হত্যার নিদর্শন পশ্চাতে—

নিদর্শন! শিবেন সোম প্রশ্ন করলেন।

হ্যাঁ, প্রথমতঃ ফোন-কল। দ্বিতীয়তঃ ফোনটাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে। তৃতীয়তঃ ক্লোরোফরমের ভেজা টাওয়েলটা বাথরুমে ফেলে রেখে গিয়ে। চতুর্থ ক্লোরোফরমের গন্ধ ঢাকবার জন্য ট্যাপ খুলে বাথরুমে হাত ধুয়েও ট্যাপটা তাড়াতাড়িতে বন্ধ করতে ভুলে গিয়ে। এবং পঞ্চম সেই রাত্রেই ঐ ঘরটা পুলিস বন্ধ করে চলে যাবার পর আবার রঞ্জনবাবু আপনি বিনায়কবাবুর পরামর্শে তালা ভেঙে ঘরে ঢুকে অধ্যাপকের বসবার চেয়ারটা ভেঙে

কিন্তু আফটার অল, উনি চেয়ারটা ভাঙতে গেলেন কেন? শিবেন সোম প্রশ্ন করেন।

হীরার জন্য।

কি বললেন, হীরার জন্য?

হ্যাঁ, ল্যাবরেটারি থেকে এনে সিনথেটিক হীরাগুলো অধ্যাপক ঐ চেয়ারের পায়ার গুপ্ত কোটরেই লুকিয়ে রাখতেন। বিনায়কবাবুর পরামর্শেই তিনি ঐভাবে হীরাগুলো লুকিয়ে রেখেছিলেন, অবিশ্যি বিনায়কবাবু তখন মরীয়া হয়ে উঠেছেন, রাঘব সরকারকে যদি সহজে কায়দা না করতে পারেন তো ঐ হীরার সাহায্যেই কায়দা করবেন এই বোধ হয় ভেবেছিলেন, তাই নয় কি বিনায়কবাবু?

বলাই বাহুল্য, বিনায়ক সেন কোন জবাব দিলেন না।

বুঝতে পারছি অনুমান আমার মিথ্যে নয়। কিন্তু রঞ্জনবাবু, বিনায়কবাবু যেমন ভুল করেছেন তেমনি আপনিও একটা মারাত্মক ভুল করেছেন।

রঞ্জন সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে যেন তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে।

হ্যাঁ ভুল, আপনি ভেবেছিলেন অধ্যাপকের অর্থাৎ আপনার মামার সঙ্গে মনোমালিন্য হওয়ায় শেষ পর্যন্ত হয়তো তিনি শকুন্তলা দেবীকে তার যাবতীয় সম্পত্তি ও টাকাকড়ি লিখে দিয়ে যাবেন আপনাকে বঞ্চিত করে—

না, ভুল করি নি—তিনি তাই আমাকে স্পষ্ট বলেছিলেন!

কিন্তু তিনি তা করতেন না। আর করলেও তা আইনে টিকত না। কারণ শকুন্তলা দেবীর তো তার সম্পত্তির উপরে আইনতঃ কোন অধিকারই বর্তাতো না!

কি বলছেন।

ঠিকই বলছি, শকুন্তলা তার কেউ নয়।

কেউ নয়?

না, চৌধুরী-বাড়ির কেউ নয় সে–

সহসা ঐ সময় দড়াম করে ঘরের ভেজানো দরজা খুলে গেল এবং উদ্ভ্রান্তের মতই শকুন্তলা ঘরে এসে ঢুকল।

কি–কি বললেন মিঃ রায়?

কিরীটী চুপ।

মিঃ রায়, চুপ করে আছেন কেন, বলুন-তবে কে আমি? কেন এ বাড়িতে আমি– বলুন মিঃ রায় বলুন–

তিনি দয়া করে এখানে আপনাকে স্থান দিয়েছিলেন—

দয়া করে!

হ্যাঁ।

কিন্তু কেন? কেন তার এ দয়া?

যেহেতু তিনি ছিলেন সত্যিকার মহৎ ব্যক্তি। আপনি—সরমা দেবী ও বিনায়কবাবুর সন্তান।

কি—কি বললেন? আমি—আমি—বাকী কথাগুলো আর শকুন্তলা উচ্চারণ করতে পারল না। জ্ঞান হারিয়ে ঘরের মেঝের উপর পড়ে গেল।

কিরীটী তাড়াতাড়ি ছুটে গিয়ে তাকে মাটি থেকে তুলে নিল কোলের উপরে।

.

আরো ঘণ্টা দুই পরে।

থানায় শিবেন সোমের অফিস ঘরে বসেছিলাম আমরা।

শকুন্তলাকে রামচরণের জিম্মায় রেখে চলে এসেছি আমরা রঞ্জন ও বিনায়কবাবুকে অ্যারেস্ট করে সঙ্গে নিয়ে।

কিরীটী বলছিল, তাই আমি বলছিলাম শেষ পর্যন্ত অধ্যাপকের ব্যাপারটা ট্র্যাজেডি অফ এরর এ পর্যবসিত হয়েছিল।

কিন্তু আপনি বিনায়ক সেনকে সাসপেক্ট করলেন কি করে?

সরমার জবানবন্দীর পরই সে-রাত্রে আমি বুঝতে পেরেছিলাম ঐ সরমাকে কেন্দ্র করে কোন একটি গোপন ইতিহাস আছে বিমলবাবুর হত্যার পশ্চাতে। তারপর অকুস্থলের জিওগ্রাফি–অধ্যাপকের পাশের ঘরেই রঞ্জনবাবু থাকতেন, তাতে করে মনে হয়েছিল তিনি অর্থাৎ রঞ্জনবাবু হয়তো অনেক কিছুই জানেন বা জানতে পেরেছেন আড়ি পেতে। আরো রঞ্জনবাবুই অধ্যাপককে ফোনের সংবাদটা সরবরাহ করেছিলেন। স্বাভাবিক ভাবে অবিশ্যি তাতে করে রঞ্জনবাবুর উপরেই সন্দেহ পড়ার কথা, কিন্তু বাড়িতে অত লোকজনের উপস্থিতির মধ্যে রঞ্জনবাবুর একার পক্ষে অত বড় রিস্ক নেওয়া আদৌ সম্ভবপর ছিল না বলেই আমার মনে হয়েছিল, আরো কেউ ওর পিছনে আছে এবং কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গেসঙ্গেই আমি আর কার পক্ষে ঐ ব্যাপারে লিপ্ত থাকা সম্ভবপর ছিল ভেবেছি। ইতিমধ্যে ময়না তদন্তের রিপোর্টটা পেয়ে গেলাম এবং ময়না তদন্ত রিপোর্টে মৃত্যুর কারণ ডিজিট্যালিন জানতে পেরে ঐ সন্দেহটা আমার দৃঢ় হয় যে, রঞ্জনবাবুর সঙ্গে আরো কেউ আছে। কিন্তু কে সে? কার পক্ষে থাকা সম্ভব? এদিকে যেভাবে নিহত হয়েছিলেন অধ্যাপক, তাতে করে একটা সন্দেহ আমার প্রথম থেকেই মনের মধ্যে বদ্ধমূল হয়েছিল—যে-ই অধ্যাপককে হত্যা করুক না কেন সে তার বিশেষ পরিচিত এবং পরিচয়ের ঐ সুযোগটা নিয়েই সে অর্থাৎ হত্যাকারী আকস্মিক আঘাত হেনেছিল অধ্যাপককে। এখন প্রশ্ন, পরিচিতের মধ্যে সে-রাত্রে ঐ সময় অকুস্থানে কে কে উপস্থিত ছিল! দুষ্মন্ত, শকুন্তলা ও সরমাকে আমি আগেই সন্দেহের তালিকা থেকে বাদ দিয়েছিলাম। কারণ দুষ্মন্ত ঐ সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিল না এবং পরে খবর নিয়েও জেনেছিলাম সত্যিই সে হত্যার সময়টা তার কলেজের রিসার্চরুমে ব্যস্ত ছিল। এবং বাকী দুজনকে বাদ দিয়েছিলাম তারা নারী বলে। কোন নারীর পক্ষে ঐভাবে হত্যা করা সম্ভবপর আদৌ ছিল না। তাহলে এখন বাকী থাকে তিনজন—বিনায়ক সেন, রাঘব সরকার ও রঞ্জন বোস। রঞ্জন বোস সম্পর্কে আগেই ভেবেছি—বাকী রইল বিনায়ক সেন। বিনায়ক সেন সম্পর্কে আমি অনুসন্ধান শুরু করি। এবং অনুসন্ধানের ফলে দুটো ব্যাপার আমি জানতে পারি। প্রথম তার বর্তমান আর্থিক অবস্থা শোচনীয় হয়ে উঠেছিল। দ্বিতীয়, একদা ফোর্থ ইয়ার পর্যন্ত সে ডাক্তারী পড়েছিল। কাজেই হত্যার কারণ ও উপায়ের দিক থেকে তারই ওপর গিয়ে আমার সন্দেহ পড়ে। আরো একটা ব্যাপার এর মধ্যে ছিল, সেটা হচ্ছে সরমার উপরে আমার সন্দেহ। আমার কেমন যেন প্রথম থেকেই ধারণা হয়েছিল সরমা হত্যাকারী কে জানতে পেরেছিল—কিন্তু আশ্চর্য লেগেছিল আমার কথাটা ভেবে যে, সরমা হত্যাকারী কে জানা সত্ত্বেও ব্যাপারটা গোপন করে গেল কেন? ভাবতে শুরু করি এবং ভাবতে ভাবতে হঠাৎ আমার মনে হয়, সরমার অতীতের সঙ্গে ঐ বিনায়ক সেন জড়িত নয় তো! কারণ দীর্ঘদিন সরমা অধ্যাপকের গৃহে আছে এবং বিনায়ক অধ্যাপকের বাল্যবন্ধু। ঠিক সেই সংশয়ের মুহূর্তে শকুন্তলাকে আমি অ্যারেস্ট করবার জন্য শিবেনবাবু আপনাকে বলি। সেদিন আপনাকে কোন রিজ দিই নি, কিন্তু আজ বলছি, সরমা ও শকুন্তলার ফটো থেকে উভয়ের মধ্যে অদ্ভুত সৌসাদৃশ্য দেখবার আগেই ওদের দুজনের মুখের বিশেষ তিলটি ও উভয়ের মুখের একই ধরনের গঠন আমার দৃষ্টিকে আকর্ষণ করেছিল সেই কারণেই আমি ফটোর কথা বলেছিলাম এবং সেই সন্দেহের আমার নিরসনের জন্যই শকুন্তলাকে অ্যারেস্ট করতে বলেছিলাম। তীর ছুঁড়েছিলাম আমি সরমার প্রতিই এবং আমার অনুমান যে মিথ্যা নয় তা প্রমাণ হয়ে গেল সেই রাত্রে যে মুহূর্তে সরমা এসে আমার গৃহে উপস্থিত হল শকুন্তলার অ্যারেস্টের পর। সে-রাত্রে নীচে গিয়ে সরমাকে বিদায় দেবার সময় বিনায়ক সেনের প্রতি আমার সন্দেহের কথাটা বলাতেই সরমার। মুখের দিকে তাকিয়ে তার মুখে যে পরিবর্তন দেখেছিলাম, আমার তাতে করে আর কোন সন্দেহই রইল না যে শকুন্তলার বাপই ঐ বিনায়ক সেন। তার পরের ব্যাপার তো আপনারা সকলে জানেনই।

.

২৫.

একটানা অনেকক্ষণ ধরে কথা বলে কিরীটী থামল।

ধীরে ধীরে পকেট থেকে টোবাকো পাউচ ও পাইপটা বের করে পাইপে তামাক ভরে তাতে অগ্নিসংযোগ করল কিরীটী।

এবং কয়েক সেকেণ্ড ধূমপান করে বলল, শুধু মাত্র শকুন্তলাকে তার জন্মবৃত্তান্তের লজ্জা থেকে বাঁচাবার জন্যই সেদিন আমি সরে দাঁড়াতে চেয়েছিলাম শিবেনবাবু। কিন্তু নিয়তি বুঝি কেউ এড়াতে পারে না। নচেৎ এমনি করে শকুন্তলার কাছে শেষ পর্যন্ত সব প্রকাশ হয়ে পড়বেই বা কেন ঘটনাচক্রে!

শিবেন নাম বললেন, সত্যি মেয়েটার জন্য দুঃখ হয়—

হ্যাঁ, দুঃখ হয় বৈকি। আর হয়তো বাকী জীবনটা দুষ্মন্তর স্মৃতি বয়েই বেড়াতে হবে বেচারীকে অতঃপর!

কেন—এ কথা বলছেন কেন?

বলছি ঐ শকুন্তলার আঙুলের অভিজ্ঞানটির জন্য।

অভিজ্ঞান?

মনে পড়ছে না শকুন্তলার হাতের আংটিটা!

সেটা তো রাঘব সরকারের দেওয়া?

না। স্থিরকণ্ঠে কিরীটী বললে।

না মানে? প্রশ্ন করলাম এবারে আমিই, তবে কার দেওয়া আংটি?

দুষ্মন্তর।

দুষ্মন্তর? কি করে জানলে?

সরমা বলেছিল।

তবে–

কি তবে? আংটিই তো কাল হয়েছিল শেষ পর্যন্ত শকুন্তলার পক্ষে, কারণ সেই কথাটা– মানে বিনায়ক সেন আংটির ব্যাপারটা জানতে পারার দরুনই সে আরো হেস্টি স্টেপস্ নিয়েছিল। তাই বলছিলাম ঐ অভিজ্ঞানটিই হয়তো বাকী জীবনটা শকুন্তলার কাছে দুষ্মন্তর স্মৃতি হয়ে থাকবে।

কিন্তু তা নাও তো পারে! দুষ্মন্ত তাকে বিয়েও তো করতে পারে! বললাম আমি।

না বন্ধু না, শকুন্তলার জন্মবৃত্তান্ত শোনার পরই দুষ্মন্তর প্রেম দেখো ঠিক শুকিয়ে যাবে। আর শুধু দুষ্মন্তর কথাই বা বলছি কেন, সামান্য কদিনের পরিচয়ে শকুন্তলাকে যতটুকু চিনেছি—শকুন্তলাই হয়তো দুষ্মন্তর জীবন থেকে সরে দাঁড়াবে।

শেষের দিকে কিরীটীর কণ্ঠস্বরটা যেন কেমন ব্যথায় বিষণ্ণ ও স্রিয়মাণ মনে হল। কিরীটী অন্যদিকে মুখ ফেরাল।

স্তব্ধ কক্ষের মধ্যে যেন একটা নিঃশব্দ ব্যথার সুর করুণ কান্নার মতই গুমরে গুমরে ফিরতে লাগল।