রামু নিরুদ্দেশ, কাকাতুয়া বেহাত, নয়নকাজল হাওয়া। বাড়িতে প্রচণ্ড ডামাডোল। এরই মধ্যে সকলের চোখের আড়ালে একটা নতুন কাজের লোক বহাল হয়ে গেল।
উদ্ধববাবুর প্রেশার বেড়ে গেছে, তিনি শয্যা নিয়েছে। ডাক্তার এসে দেখে নড়াচড়া বারণ করে গেছেন। কিন্তু উদ্ধববাবু কেবল এপাশ-ওপাশ করেন। তাঁর ছোট ছেলেটা দুষ্ট ছিল বটে, তিনি শাসনও করতেন তাকে, কিন্তু এখন তার জন্য বুক ফেটে যাচ্ছে কষ্টে। ছেলেটাকে কি ওরা জ্যান্ত রাখবে?
রাত বেশ গম্ভীর হয়েছে। ঘরে মৃদু আলো জ্বলছে। উদ্ধববাবু ঘুমোনোর বৃথা চেষ্টা ত্যাগ করে উঠে বসে অন্যমনস্কভাবে চেয়ে রইলেন। কিঠ সেই সময়ে ভিতরবাড়ির দিককার দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল। উদ্ধববাবু হাঁ করে চেয়ে রইলেন।
ঘরে ঢুকল নতুন কাজের লোকটা।
“কী চাও” উদ্ধববাবু জিজ্ঞেস করলেন।
“আজ্ঞে আমি একটা কথা বলতে এসেছিলাম।”
“এত রাতে কথা কিসের?”
“আজ্ঞে টের পাচ্ছি রামুর চিন্তায় আপনার ঘুম হচ্ছে না। শরীরও ভাল যাচ্ছে না আপনার। তাই বলতে এসেছিলাম গুপ্তধনের হদিস যতক্ষণ না পাচ্ছে ততক্ষণ ওরা রামুর ক্ষতি করবে না। তাতে ওদের লাভ নেই।”
“কিন্তু হদিস পেতে আর বাকি কী? কাকাতুয়া তো ওদের হাতে।”
“তা বটে। কিন্তু মজা হল, কাকাতুয়াকে ঠিক-প্রশ্নটি না করা গেলে সে কিছুতেই হদিস বলবে না। এই কাকাতুয়াটাকে নিয়ে আমি বহুকাল ধরে চিন্তা করেছি। হরিহর পাড়ুই পারেনি, বিশু পারেনি, আপনারাও পারেননি। অনেক ভেবে দেখেছি, পাখিটাকে ঠিক প্রশ্নটি যতক্ষণ করা না হচ্ছে, ততক্ষণ তার মুখ থেকে আসল কথাটি বেরোবে না।”
“প্রশ্নটা তুমি জানো?”
“আন্দাজ করতে পারি। কিন্তু যারা পাখিটা চুরি করেছে তাদের মাথা অত সাফ নয়। পাখির কাছ থেকে তারা কথা বের করতে পারবে না। আপনি নিশ্চিন্তে ঘুমোন। যা করার আমি আর গবাদা মিলে করব?”
“গবা বলছিল, তুমি নাকি সারকাসের খেলোয়াড়।”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। কিন্তু কথাটা পাঁচকান করবেন না।”
উদ্ধববাবু চোখ বুজে বলেন, “সব বড় গোলমাল ঠেকছে হে। এক সারকাসের খেলোয়াড় বাড়ির চাকর হয়ে ঢুকল। বাড়ির পুরনো চাকর ডাকাতের দলে গিয়ে ভিড়ল। ছেলেটা গুম হয়ে গেল। সব বড় গোলমাল ঠেকছে।”
নতুন লোকটা মাথা চুলকে বলল, “আজ্ঞে তা আর বলতে। তবে কিনা আমি লোক খারাপ নই।”
“তা কে জানে বাপু। আমার আর কাউকে বিশ্বাস হয় না। তবু তুমি যখন বলছ তখন একটু নির্ভর করেই দেখি।”
“আমি বলি কি বাবু, আপনি বরং শুয়ে শুয়ে দরবারি কানাড়ার সুরটা গুনগুন করতে থাকুন। ঘুমের সবচেয়ে বড় ওষুধ হল গান।”
উদ্ধববাবু কটমট করে লোকটার দিকে চাইলেন। ভাল করে দেখে তার মনে হল লোকটা ঠাট্টা করছে না। তখন খুশি হয়ে বললেন, “আমার গানের কথা তোমায় কে বলল?”
“কেউ বলেনি। ভাল গাইয়ের গলা কথাবার্তায়ও ফুটে ওঠে। কালে খাঁ সাহেব যখন চাকরকে বকতেন বা রান্নার নিন্দে করতেন, তখনো সমঝদার লোক ‘কেয়াবাত, কেয়াবাত’ করে উঠত। তাছাড়া বড় গাইয়ের বাড়ির গোরু কুকুর কি পোষা পাখির গলায় পর্যন্ত সুর এসে যায়। আপনার নেড়ি কুকুরটার গলায় আজ সন্ধেবেলাতেই আমি একটা সাপটা শুনেছি।”
“বলো কী?” উদ্ধববাবু খুবই অবাক ও উত্তেজিত হল।
লোকটা বিনয়ে হেসে হাত কচলে বলল, “সুর এমনই জিনিস যে, চেপে রাখা যায় না। যার গলায় সুর আছে, সে শত চেষ্টা করেও কোনোদিন বেসুর বের করতে পারবে না গলা থেকে। আপনার যেমন, একটু আগে শুয়ে শুয়ে ‘আঃ উঃ করছিলেন, আমি দরজার বাইরে থেকে শুনতে পাচ্ছিলাম। শুনলাম তার মধ্যেও সুর আছে।”
উদ্ধববাবু এত দুঃখেও হাসলেন। মাথা নেড়ে বললেন, “সমঝদারই নেই হে দেশে, সমঝদার থাকলে কি আজ আমাকে ওকালতি করে খেতে হত? তা তুমি আমার বাড়িতেই থেকে যাও। সারকাসের সমান মাইনে দেব। কাজকর্ম কিছুই করতে হবে না। শুধু আমার একটু সেবা-টেবা করবে আর কি।”
“সে হবে’খন বাবু। এখন আমি বিদেয় হই। অনেক কাজ বাকি।”
উদ্ধববাবু শুয়ে পড়লেন। সিলিং-এর দিকে চেয়ে খুব সাবধানে গলা ঝেড়ে নিয়ে আবার উঠে বসলেন। বাঁ হাতে কান চেপে ধরে নিখুত দরবারির সুর ধরলেন। তারপর আর বাইরের শোক-দুঃখ তাকে স্পর্শ করল না।
নতুন চাকরটা নিঃশব্দে বাইরে বেরিয়ে এল। তারপর মৃদু একটা শিস দিল সে। অন্ধকারে আর একটা মূর্তি এগিয়ে এল কাছে। তার দুহাতে ধরা দুটো সাইকেল। দুজনে সাইকেলে চেপে এত জোরে ছুটতে লাগল যে, মোটরগাড়িও পাল্লা দিতে পারবে না।
প্রায় ত্রিশ মাইল রাস্তা একনাগাড়ের সাইকেল চালিয়ে দুজনে যখন কাশিমের চরের কাছাকাছি পৌঁছল তখন এই দুর্দান্ত শীতের রাতেও তারা ঘেমে নেয়ে গেছে। কিন্তু বিশ্রামের সময় নেই। সামনেই একটা জঙ্গল। মরা নদীর খাত। তারপর আবার জঙ্গল।
ঘন ঝোঁপঝাড়ে মধ্যে সাইকেল লুকিয়ে রেখে দুজনে এবার পায়ে হেঁটে চলতে লাগল। দুজনের মধ্যেই চমৎকার বোঝাঁপড়া। কেউ কারো সঙ্গে কথা বলছে না, কিছু জিজ্ঞেস করছে না। যেন আগে থেকে প্ল্যান করা আছে এই অভিযান।
দ্বিতীয় জঙ্গলটায় খানিকদূর ঢুকে দুজনে থামল। জিরোতে নয়। অন্ধকার কুয়াশামাখা এই রাতে চারদিকে কিছুই দেখা যায় না। দুজনে তাই পাথরের মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রাতের শব্দগুলিকে চিনবার চেষ্টা করল। কোন্ শব্দটা প্রাকৃতিক, কোষ্টা নয়। সন্দেহজনক কিছুই অবশ্য শুনতে পেল না তারা। তবে এরপর সাবধানে এগোতে লাগল।
সামনেই একটা দুর্গের মতো মস্ত বাড়ির কালো ভুতুড়ে আকারটা জেগে উঠছিল কুয়াশার মধ্যেও। একটা জায়গায় সামনের জন থামল। তারপর আস্তে ডাকল, “গবাদা।”
“হুঁ।”
“এই হল সেই জায়গা, যেখানে হরিহর খুন হয়। মনে আছে?”
“খুব মনে আছে।”
“আর সামনে ঐ সেই বাড়ি।”
“জানি।” দুজনে চুপ করে চেয়ে রইল খানিকক্ষণ। এবার গবা ডাকল, “গোবিন্দ।”
“বলো।”
“হরিহরকে খুন হতে আমি দেখেছি। তবে খুনিকে দেখিনি। আর দেখিনি
বলেই সাক্ষ্যও দিইনি। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভুল করেছি। সাক্ষ্য দিলে তুই নির্দোষ মানুষ হয়তো খালাস পেসি।”
গোবিন্দ মাথা নেড়ে বলল, “না, গবাদা। খালাস হলেও ওরা আমাকে ছাড়ত না। জেলখানাতেও ওদের লোক আছে। বিরাট দল। ফাঁসিতে না ঝুললেও খুন হতাম।”
দুজনে বাতাসের মতো ফিসফিস করে কথা বলছিল। এত আস্তে যে, চার হাত দূর থেকেও শোনা যায় না।
গবা আর গোবিন্দ আর একটু এগিয়ে গেল। তারপর গোবিন্দ বলল, “গবাদা, এইবার।”
গবা গলাটা সাফ করে নিল একটু। তারপর হঠাৎ বেশ চেঁচিয়ে গান ধরল, আজ মনটা করে উড়ন খুড়ন গা করে আইঢাই। কাশিমের চবে দেখি জনমানব নাই। আছে শুধু বিজ্ঞপক্ষী আর যতেক ভক্তজন। ইংগিতে কয় কথা পাখি, তা বুঝেছেন কজন। আয় রে যত নন্দীভৃঙ্গী, তোদের ডাকে হরিহর। পাখির পেটে কথা করে খচরমচর। আছে গুরু আছে জ্ঞান কিন্তু শিষ্য নাই। বিজ্ঞপক্ষী গোমড়া মুখে বসে থাকেন তাই।
গান শেষ হলে দুজনে উৎকর্ণ হয়ে বসে থাকে। অনেকক্ষণ কেটে যায়।
গোবিন্দ বলে, “ওরা বোধহয় এদিকে আসেনি গবাদা।”
গবা হঠাৎ ঠোঁটে আঙুল তোলে।
কাছে-পিঠে জঙ্গলের মধ্যে সড়সড় শব্দ হয় একটু। নিঃশব্দ পদসঞ্চারে কে বা কারা আসছে।
.
২২.
দুজনে নিঃসাড়ে বসে আছে। অপেক্ষা করছে। টের পাচ্ছে, আড়াল থেকে কেউ নজর করছে তাদের দিকে। কিন্তু বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পরও একদম সামনে কেউই এগিয়ে এল না।
“গবাদা।”
গোবিন্দ ফিসফিস করে বলল। “বলে ফ্যাল।”
“ওরা আমাদের মাপজোখ করছে। কাছে আসছে না।”
“তাই তো দেখছি। কিন্তু এই কুয়াসা আর অন্ধকারে মাপজোখটা কীভাবে?”
“সেও তো কথা। আর আমরাই বা উজবুকের মতো লুকিয়ে আছি কেন? ওরা যে খুঁজে পাবে না আমাদের।” বলে গোবিন্দ উঠতে যাচ্ছিল।
গবা হাতটা টেনে ধরে বলল, “দূর পাগল। অতটা বেপরোয়া হোসনে। বিপদ ঘটতে কতক্ষণ?”
“তুমি গানটা তাহলে আর একবার ধরো! ওরা জবাব দেয় কিনা।”
গবা গলা খাকারি দিয়ে গান ধরল, “দানাপানি খায় রে পক্ষী, উড়াল দিতে চায়। তার শিকল করে ঠিনিন বেন্ধে রাখা দায়। এইবার উড়িলে পক্ষী আর না পাবে তারে। ধনরত্নের হদিস রবে চির অন্ধকারে। তাই শুন শুন বুদ্ধিমন্ত যতেক ভক্তজন। পাখিরে কওয়াতে কথা এসেছেন দুজন। অতি শিষ্ট ভদ্র নখদন্ত নাই। দুধুভাতু খাই মোরা ধর্মেরে ডরাই।”
“গবাদা।” এবার বেশ একটু হেঁকেই ডাকল গোবিন্দ।
“বলে ফ্যাল।”
“কই, কারো তো টিকি দেখছি না।”
“এখনো বোধহয় মাপজোখ করছে।”
“দাঁড়াও। ওদিকে এক বাঁশঝাড়ের কাছে একটা ছায়া মতো দেখছি। বলে উঠে দাঁড়াল।
সঙ্গে-সঙ্গে বাতাসে একটা মৃদু শিসের মত শব্দ হল। অন্ধকারেও ঝিকিয়ে উঠল একটা বিদ্যগতি বল্লম।
“বাপ রে!” বলে গোবিন্দ বসে পড়ল।
বল্লমটা খচ করে বসে গেল পিছনের একটা গাছে।
“জোর বেঁচে গেছিস।” গবা গোবিন্দকে কাটাঝোঁপ থেকে টেনে তুলতে তুলতে বলে।
“অন্ধকারেও নিশানা দেখেছ? এই টিপ যার-তার হাতের নয়।”
“বকবক করিসনি। এখন চল, উঠে লম্বা দিই।”
গোবিন্দও কথাটায় সায় দিয়ে বলল, “তাই চলো। কিন্তু ওরা আমাদের বিশ্বাস করল না কেন বলো তো?”
“সেটাই বুদ্ধির কাজ।”
দুজনে জঙ্গলের মধ্যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হামাগুড়ি দিয়ে ফিরে আসতে থাকে।
জঙ্গলের বাইরে এসে গবা একটু হাঁপ ছেড়ে বলে “আর যাহোক, হোক, আমাদের গান ওদের কানে তো পৌঁছেছে। যদি কাজ হয় তো ওতেই হবে।”
“আমরা কারা তা জানবে কী করে?”
“খোঁজ নেবে। জানা কিছু শক্ত না। একটু বুদ্ধি চাই। সেটা ওদের ভালই আছে।”
বাড়ির দিকে ফিরতে ফিরতে গোবিন্দ জিজ্ঞেস করে, “কিন্তু সাতনার দল আমাকে খড়ের গাদায় পুড়িয়ে মারতে চেয়েছিল কেন বলো তো!”
“সে আর বলা শক্ত কী? তোকে মারলে হরিহরের সত্যিকারের খুনি বেঁচে যাবে। তুই যে নির্দোষ তা আর প্রমাণ হবে না।”
“আমাকে হাতে পেলে কি ওরা মেরে ফেলবে গবাদা?”
“চেষ্টা তো করবেই।” গোবিন্দ আর কিছু বলল না।
গবা বলল, “রামুটার কথা ভাবছি। কীভাবে রেখেছে ওকে কে জানে! উদ্ধববাবুকে শাসিয়ে গেছে, পাখিচুরির কথা পাঁচকান হলে রামুকে জ্যান্ত রাখবে না। তা সে-কথা তো দুনিয়া-সুষ্ঠু লোক জেনে গেছে।
এ-কথায় গোবিন্দ থমকে দাঁড়িয়ে গবার হাত চেপে ধরে বলল, “গবাদা, ফিরে যাই চলে। আমরা দুজন হলেও দশজনের মহড়া নিতে পারি। চলো গিয়ে ওদের ডেরা হুটোপাট করে দিয়ে রামুকে নিয়ে আসি।
গবা মাথা নেড়ে একটু দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, “উদ্ধববাবু রামুকে খুব শাসন করে বটে, কিন্তু আমি জানি, ওই দুষ্টু ছেলেটাই ওঁর সবচেয়ে প্রিয়পুত্র। যদি কোন খারাপ খবর পান তাহলে আর বাঁচবেন না।”
“তাহলে?”
“তাহলেও মাথা ঠাণ্ডা রেখে কাজ করা চাই। সব কাজেই যে বুক চিতিয়ে বোকা-সাহস দেখাতে হবে তার কোন মানে নেই। উঁচ হয়ে ঢুকবি, বোমা হয়ে বেরোবি।”
“ঢুকতে দিচ্ছে কোথায়! যা একখানা বল্লম ঝেড়েছিল আজ।”
“রোস না দুদিন। পাখির মুখ থেকে তো আর আসল কথাটি বেরোচ্ছে!”
কাশিমের চর নিঃঝুম। হাড় কাঁপানো শীতে কুয়াশায় কম্বল জড়িয়ে গোটা জায়গাটাই ঘুমিয়ে আছে যেন। মাঝে-মাঝে শেয়ালের ডাক আর পাছার ভুতুড়ে শব্দ ওঠে ঝোপেঝাড়ে। রাতপাখি ডেকে ওঠে হঠাৎ-হঠাৎ। বাঁশবনে ঝিঝির ঝিনঝিন। কিন্তু এইসব শব্দ যেন কাশিমের চরের নির্জনতাকেই আরো গাড় করে তোলে।
দোতলার একটা ছোট্ট কুঠুরির মধ্যে মেঝের ওপর চটের বিছানায় রামু শুয়ে আছে। গায়ে একটা কুটকুটে কম্বল, এরকম শুয়ে তার অভ্যাস নেই। মেঝে থেকে চট ভেদ করে পাথুরে ঠাণ্ডা আসছে। কুটকুটে কম্বল দিয়ে ঢুকছে বাইরের শীত। বারবার তাই ঘুম ভেঙে যাচ্ছে রামুর। দুষ্টুমি করতে গিয়ে বহুবার বহুরকম বিপদে পড়েছে। দুষ্টু ছেলেরা পড়েই। কিন্তু এরকম বিপদে সে কোনো কালে পড়েনি।
ডাকাতদের এই দলটা বেশ বড়সড়। চেহারাগুলো একদম ভদ্রলোকের মতো নয়। হাতে সবসময়ে লাঠি, বল্লম, টাঙ্গি, বন্দুক-টকও আছে। কারো কোনো মায়া দয়া নেই। খেলার মাঠ থেকে ফেরার সময় সন্ধ্যাবেলা হঠাৎ এসে খবর দিল, “তোমার বাবাকে কারা যেন পূর্বলির মাঠে মারধোর করে ফেলে রেখে গেছে। শিগগির এসো।”
খবরটা পেয়েই রামু লোকটার পিছু-পিছু ছুটল। কদিন আগেই উদ্ধববাবুকে আদালত থেকে ফেরার পথে কারা বোমা মেরেছিল। এই সেদিনও বাড়িতে
ডাকাত পড়েছে। সুতরাং লোকটার কথায় রামুর অবিশ্বাস হয়নি। উদ্ধববাবুকে ওরা মারতেও পারে।
পূর্বস্থলির মাঠ শহরের বাইরে। ভারী নির্জন জায়গা। সাঁঝের আবছায়া ঘন হয়ে উঠেছে। রামু সেখানে পৌঁছে এদিক-ওদিক তাকানোরও সময় পেল না। শিমুল গাছের পেছন থেকে জনাচারেক লোক বেরিয়ে এসে একটা গামছায় তার মুখ বেঁধে ফেলল। তারপর একটা গোরুর গাড়িতে তুলে ফেলল চটপট। অনেক রাতে তারা এসে পৌঁছায় এই জায়গায়। রামু পরে তাদের কথাবার্তা থেকে জানতে পেরেছে এই জায়গারই নাম কাশিমের চর।
প্রথম রাত্রিটা সারাক্ষণ বাড়ির কথা ভেবে কেঁদেছে রামু। এরা রুটি আর একটা আলুর ঝোল খেতে দিয়েছিল। তা ছোঁয়নি সে। কিন্তু সকাল থেকে রামুর চোখের জল শুকিয়ে গেল। একটা দৈত্যের মতো লম্বা-চওড়া লোক এসে তাকে প্রথমেই বলল, “শোনো রামু, তোমার এই দশা। উদ্ধব-উকিল। বোকাও বটে, জেদিও বটে। কিন্তু সে জানে না, আমার সঙ্গে বিবাদ করলে তাকে নির্বংশ হতে হবে। সে-কাজ শুরু হবে তোমাকে দিয়েই। একটু যদি বেচাল দেখি তবে রামদা দিয়ে দুখানা করে কেটে ফেলব। এখন যা জিজ্ঞেস করছি তার ঠিকঠাক জবাব দাও। প্রথমে বলল, গবা পাগলা আসলে কে!”
রামু ভয়ে হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল। অতি কষ্টে বলল, “গবাদা তো পাগল।”
“ওর পাগলামিটা চালাকি ছাড়া কিছুই নয়। সেটা আমরা জানি। কিন্তু ওর আসল পরিচয়টা আমাদের দরকার।”
“গবাদা কারো কোন ক্ষতি করে না তো।”
“ক্ষতি যাতে করতে না পারে তার জন্য সাবধান হওয়া ভাল।”
“গবাদার আর কোনো পরিচয় আমি জানি না।”
লোকটা অবশ্য রামুকে এ নিয়ে আর খোঁচাখুঁচি করেনি। কিন্তু কয়েক ঘণ্টা বাদে আবার লোকটা এল। কিন্তু তার সঙ্গে নয়নকাজলকে দেখে রামু হাঁ। সে চেঁচিয়ে উঠল, “নয়নদা।” কিন্তু সঙ্গের লোকটা রামুকে একটি ধমক মেরে বলল, “চাপ!” রামু ভয়ে চুপ করে গেল! নয়নকাজলও রামুর দিকে ভাল করে চাইতে পারছিল না। অন্য দিকে চেয়ে রইল। তার হাতে রামুদের কাকাতুয়ার দাঁড়টা।
দৈত্য লোকটা বলল, “এই পাখিটা কিছু গোপন খবর জানে। কিন্তু কিছুতেই বলছে না। তোমাদের পোষা পাখি, তোমরা নিশ্চয়ই এর গোপন কথা জানো!”
রামু মাথা নেড়ে বলল, “জানি না। পাখিটা গুপ্তধনের কথা বলে বটে, কিন্তু কোথায় তা আছে তা কখনো বলেনি।”
লোকটা বলল, “ঠিক আছে। কিন্তু তোমার কাজ হল পাখিটার পেট থেকে কথা বের করা। চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিচ্ছি। যদি তার মধ্যে পারো ভাল,
যদি না পারো তবে পাঁচ ঘা করে বেত খাবে রোজ। এই নয়নকাজলও থাকবে পাশের ঘরে। সে নজর রাখবে তুমি কী করছ না-করছ।”
রামু আর নিজেকে সামলাতে না-পেরে জোরে চেঁচিয়ে উঠল, “নয়নদা! তুমিও এদের দলে?”
নয়নকাজল তাড়াতাড়ি ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
.
২৩.
ঘুম বারবার ভাঙছে রামুর। বড় শী; বিছানাটাও বড় শক্ত, তেইশ।
কম্বল কুটকুট করছে। জেগে উঠলে সে জঙ্গলের গভীর নিস্তব্ধতা টের পায় আর গা ছমছম করে ওঠে তার। যে-বাড়িটায় তাকে আটকে রাখা হয়েছে, সেটা বিশাল। তবে প্রায় সবটাই ভেঙে পড়ে গেছে। এখানে-সেখানে এক-আধটা ঘর দাঁড়িয়ে আছে কোনক্রমে। বাদবাকিটা হঁট আর চুন-সুরকির ভূপ। ডাকাতরা যথাসম্ভব বাড়িটাকে নিজেদের থাকার মতো করে নিয়েছে। তবে রামু জানে এটা ওদের স্থায়ী আড়ডা নয়। একসঙ্গে বেশি লোক এখানে থাকে না। প্রায় সব সময়েই আনাগোনা করে। ঘরের দরজা বাইরে থেকে বন্ধ। সে-দরজাও পেল্লায় ভারী কাঠের। ঘরখানাও খুবই বড়-সড়। মেঝেয় আর দেওয়ালে পঙ্কের কাজ করা। তবে সবই অস্পষ্ট হয়ে এসেছে। মেঝেয় ফাটল, দেয়ালের পলেস্তারা খসে পড়েছে। দিনের বেলা ঘরটা খুব ভাল করে দেখে নিয়েছে রামু। পালানোর কোন পথ নেই। আর পালিয়ে যাবেই বা কোথায়? চারদিকে জঙ্গল। ডাকাতরা চারদিকে নজর রাখছে। ঘুম ভেঙে অন্ধকারে চুপচাপ তাকিয়ে ছিল রামু। শীতে একটু থরথরানি উঠছে শরীরে। কম্বলটা ভাল করে মুড়ি দিয়েও শীত যাচ্ছে না।
হঠাৎ দরজায় একটু শব্দ হল। খুব মৃদু টোকা দেওয়ার মতো শব্দ। রামু কান খাড়া করল। না, ভুল নয়। আবার গোটা দুটি টোকা পড়ল।
স্বাভাবিক বুদ্ধিতেই রামু বুঝল, এই টোকা ডাকাতদের নয়। অন্য কারও কোনো কাণ্ড। বিছানা ছেড়ে উঠে পড়ল। কম্বল মুড়ি দিয়ে দরজার কাছটায় এসে হাঁটু গেড়ে বসে রইল সে চুপচাপ। খানিকক্ষণ বাদে একটু জোরে টোকা দেওয়ার শব্দ। কে যেন চাপা গলায় ডাকল, “রাম!”
গলাটা চিনল রামু। বিশ্বাসঘাতক নয়নদা। কিন্তু বিশ্বাসঘাতক হলেও এই শত্ৰুপুরীতে নয়নকাজলই তার একমাত্র চেনা লোক। এমনিতে একসময়ে নয়নদা রামুকে ভালও বাসত খুব। পেয়ারার ডাল দিয়ে গুলতি বানিয়ে দিয়েছে, চাবি পটকা বানাতে শিখিয়েছে, তার টাইফয়েডের সময় এই নয়নকাজলই লুকিয়ে লুকিয়ে তাকে সন্দেশ এনে খাইয়েছে।
রামু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে দরজার কাছে মুখ নিয়ে বলল, “কে, নয়নদা?”
“হ্যাঁ। পাহারাদারটা একটু তফাতে গেছে। বোধহয় ঘুমিয়ে পড়েছে। সেই ফাঁকে এলাম।”
“কী চাও?”
“শোনো, এই দরজায় বাঁ দিকের পাল্লায় একটা ফোকর আছে। এমনিতে বোঝা যায় না। হাতড়ে-হাতড়ে খুঁজলে একটা ছোট্ট আলপিনের ডগার মতো জিনিস পাবে। সেটা টানলেই গোলমতো একটা ঢাকনা খোলা যায়।”
“তা দিয়ে বেরোতে পারব?”
“না। বেরোনোর কথা এখন ভেবো না। এরা অত কঁচা ছেলে নয়।”
“তাহলে ফোকর দিয়ে কী হবে?”
“তোমার জন্য এক গেলাস দুধ এনেছি।”
“তুমি তো জানোই দুধ খেতে আমার ভাল লাগে না।”
“সে জানি। কিন্তু এদের দেওয়া খাবার যে তোমার মুখে রুচছে না, তাও তো দেখছি। এরকম আধপেটা খেয়ে থাকলে দুর্বল হয়ে পড়বে যে। আর ও ট্যালটেলে দুধ নয়। একদম ক্ষীরকরা দুধ, সরে ভর্তি।”
রামু দরজা হাতড়ে ফোকরটা খুলতে পারল। নয়নদার দেওয়া দুধটা হাত বাড়িয়ে নিল। মুখে দিয়ে দেখল সত্যিই চমৎকার ক্ষীরের গন্ধ। পুরু সর।
“কী, ভাল?”
“ভাল কিন্তু তুমি তো এদের দলে। তবে আমার জন্য ভাবছ কেন?”
নয়নকাজল একটু চুপ করে রইল। তারপর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, “কপালের ফের রে ভাই। লোভে পড়ে এদের দলে ভিড়েছিলাম। কিন্তু এখন দেখছি প্রাণসংশয়।”
“তার মানে?”
“মানে এরা আমাকে এক বিন্দু বিশ্বাস করে না। তোমার মতো আমাকে ঘরে আটকে রাখেনি বটে, কিন্তু এদের চোখে ধুলো দিয়ে পালানোরও উপায় নেই। সব গাঁয়ে-গঞ্জে এদের লোক আছে। যেখানে যাব, সেখানেই গিয়ে খুন করে আসবে।”
রামু বলল, “এরা কি মাফিয়াদের মতো?”
“কে জানে বাপু কাঁদের মতো। তবে বিরাট দল। শুনেছি জেলখানাতেও নাকি এদের চর আছে। এদের কোনো লোককে পুলিশ ধরলে সে তিনদিনের মধ্যে জেল ভেঙে পালিয়ে আসে।”
“কিন্তু তোমাকে খুন করবে কেন?”
“সেইই তো হয়েছে মুশকিল। একবার এদের দলে ভিড়লে তার আর ছাড়ান-কাটান নেই। তাকে আর এরা কিছুতেই ফিরে যেতে দেয় না। সে ছিল একরকম। কিন্তু ওদিকে আমাকে ডাকাত বলেও স্বীকার করছে না। কোনো বখরা দেবে না, মাইনে দেবে না, চাকরের মতো খাটাচ্ছে।”
“তা তুমি এখন কী করতে চাও?”
নয়নকাজল করুণ স্বরে বলল, “এ আমারই পাপের প্রায়শ্চিত্ত রে ভাই। তাই ভাবছি আমার যা গতি হওয়ার হবে। খামোকা তুমি কষ্ট পাবে কেন? ঠিক করেছি, তোমাকে সুযোগ পেলেই পালানোর পথ করে দেব।”
“পারবে?”
“চেষ্টা তো করব। মুশকিল হয়েছে পাখিটাকে নিয়ে।”
“কী মুশকিল?”
“পাখিটা আসল কথা বলতে চাইছে না। সাতনা তোমাকে বলেছে, পাখিটার পেট থেকে কথা বের করতে না পারলে মেরে ফেলবে। আমি জানি, তুমি ত পারবে না। আর সাতনা সত্যিই তোমাকে খুন করবে।”
“ঐ বিশাল চেহারার লোকটার নাম কি সাতনা?”
“হ্যাঁ। ওর দয়ামায়া বলতে কিছু নেই।”
“ও কি দলের সর্দার?”
“আরে না। দলের সর্দার কে, তা আজ পর্যন্ত বুঝতে পারলাম না। মক্ত দল, চারদিকে অনেক ডালপালা ছড়ানো।”
“আমার বাবাকে একটা খবর দিতে পারো না নয়নদা?”
“খবর দেওয়ার দরকার নেই। খবর পেলে তোমার বাবা তোমাকে উদ্ধার করার জন্য চেষ্টা করবেন। তাতে তোমার বিপদ বাড়বে।”
“অন্তত গবাদাকে যদি একটা খবর দিতে পারো।”
“গবা পাগল! সে খবর পেয়ে গেছে। একটু আগে জঙ্গলে একটা লোক গান গাইছিল শুনলে না?”
“না তো!”
“আমি শুনেছি। গবারই গলা। তুমি ওসব নিয়ে ভেবো না। শুধু মনে রেখো, আমি আছি। মরলে মরব, কিন্তু ধড়ে যতক্ষণ প্রাণ আছে ততক্ষণ তোমার ক্ষতি হতে দেব না। গেলাসটা দাও, এবার যাই।”
গোলাস নিয়ে নয়নকাজল নিঃশব্দে চলে গেল।
দুধটা খাওয়ার পর শীত একটু কম লাগতে লাগল রামুর। কুটকুটে কম্বল মুড়ি দিয়ে ভরা পেটে সে ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালবেলায় দরজা খুলে প্রথম যে ঘরে ঢুকল সে সাতনা।
ক্ষুরধার চোখে রামুর দিকে খানিকক্ষণ চেয়ে থেকে সে বলল, “কাল রাতে গবা পাগলা এখানে হানা দিয়েছিল, কে তাকে এ-জায়গার হদিস দিল জানো?
“আমি কী করে জানব? রামু অবাক হয়ে বলে।”
“তোমাদের চাকর নয়নকাজলকে কঁটাওলা বেত দিয়ে মার দেওয়া হচ্ছে। এখন। আমাদের মনে হচ্ছে, হদিসটা সে-ই দিয়ে এসেছে।”
রামু একটু কেঁপে উঠল ভয়ে। বলল, “নয়নদা? নয়নদা কী করে খবর দেবে? সেও তো তোমাদের দলে!”
“আমাদের দলে কিনা তা এখনো আমরা জানি না। তোমার বাবার উঁকিলের বুদ্ধি তো কম নয়। হয়তো ওকে চর করে, আমাদের দলে ভিড়িয়েছে। যাকগে, সে-সব ভেবে লাভ হবে না। এখন একটা কথা বলোতো!”
“কী কথা?”
“গোবিন্দ কোথায়?”
“কে গোবিন্দ?”
“গোবিন্দকে তুমি ভালই চেনো সারকাসের গোবিন্দ মাস্টার।”
“সে কোথায়, তা আমি কী করে জানব?”
“আমাদের সন্দেহ, গোবিন্দ তোমাদের বাড়িতে লুকিয়ে আছে। তাকে অন্য কোথাও আমরা খুঁজে পাচ্ছি না।”
রামু কঁপা স্বরে জিজ্ঞেস করে, “তাকে, তোমরা খুঁজছ কেন?”
“তার মুণ্ডুটা ধড় থেকে আলাদা করা দরকার। তাই খুঁজছি।”
“তুমি এরকম নিষ্ঠুর লোক কেন?
সাতনা কটমট করে রামুর দিকে চেয়ে রইল। কিন্তু তারপর হঠাৎ যেন কেমন ছাইমারা হয়ে গেল তার মুখ। যেমন হঠাৎ এসেছিল, তেমনি হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল।
দরজাটা আঁট করে বন্ধ করে দিল পাহারাদার।
.
২৪.
যুধিষ্ঠিরবাবুর কামাই নেই, রোজ যেমন আসেন তেমনই আজও পড়াতে এসেছেন। কিন্তু যাদের পড়াচ্ছেন তাদের পড়ায় মন নেই। রামুর দুই
দাদা আর তিন দিদির মুখ ভার, চোখ ছলছল গোঁজ হয়ে তারা বসে থাকে।
যুধিষ্ঠিরবাবু আজ বইপত্র খুললেন না, টাস্কও দেখলেন না। রামুর সবচেয়ে বড় দাদা সোমনাথকে জিজ্ঞেস করলেন, “রামুর কোনো খবর এখনো পাওয়া যায়নি, না?”
সোমনাথ মাথা নেড়ে বলল, “না আমাদের মা জল পর্যন্ত মুখে তুলছে।, বাবার চেহারা অর্ধেক হয়ে গেছে।”
যুধিষ্ঠিরবাবু গম্ভীরমুখে মাথা নেড়ে বললেন, “, তা তোমার বাবার সঙ্গে একটু দেখা করা যাবে?”
“হ্যাঁ। বাবা তো ঘরেই শুয়ে আছেন।”
“আমাকে একটু তাঁর কাছে নিয়ে চলো তো!
উদ্ধববাবু আর একটা বিনিদ্র রাত কাটিয়ে সকালে উঠেছেন। যন্ত্রের মতো পূজো-আচ্চা সেরে এসে ঘরে শুয়ে পড়েছেন। বুকটা বড় কঁপে আজকাল। মাথায় কত যে চিন্তা!
যুধিষ্ঠিরবাবুকে নিয়ে সোমনাথ ঘরে ঢোকার পর তিনি আস্তে আস্তে উঠে বসলেন। একটা চেয়ার দেখিয়ে দিয়ে বললেন, “বসুন যুধিষ্ঠিরবাবু।”
যুধিষ্ঠির বসে বললেন, “রামুর খবরটা আমি বাইরের লোকের মুখে শুনেছি।”
উদ্ধববাবু কাতর স্বরে বললেন, “হ্যাঁ, বড় পাঁচকান হয়ে গেছে। এখন ভয়, খবরটা জানাজানি হয়ে যাওয়ার ওরা আমার ছেলেটাকে মেরে-টেরে ফেলে।”
যুধিষ্ঠির গম্ভীর হয়ে বললেন, “আপনি পুলিশকে কি সবকথা জানিয়েছেন?”
উদ্ধববাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “হ্যাঁ কুন্দকুসুম সবই জানে, বিচক্ষণ লোক। কিন্তু সেও তো কিছু করতে পারল না।”
যুধিষ্ঠির একটু হেসে বললেন, “আশ্চর্যের ব্যাপার কি জানেন উদ্ধববাবু, সবাই সবকিছু জানে। কিন্তু কাজের বেলা কেউই কিছু করতে পারছে না।”
উদ্ধববাবু বুক কাঁপিয়ে আর একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “করা হয়তো যেত কিন্তু রামুখে আটকে রেখে ওরা আমাদের একেবারে জব্দ করে দিয়েছে। কাল রাতে এসে কুন্দকুসুম বলে গেল কিছু করা সম্ভব নয়। তাহলেই ছেলেটার বিপদ। এই অবস্থায় আমারও মাথায় কিছু খেলছে না।”
যুধিষ্ঠির ভ্রুকুটিকুটিল মুখে বসে রইলেন চুপচাপ। হঠাৎ কুঁজোয় জল নিয়ে বাড়ির চাকরটা ঘরে ঢুকল। যুধিষ্ঠির আনমনে তার দিকে তাকালেন। তারপর হঠাৎ অন্যমনস্কতা ঝেড়ে ফেলে ভাল করে তীক্ষ্ণ নজরে দেখলেন
লোকটাকে, খুব লম্বা নয়, মজবুত গড়ন, গালে কিছু দাড়ি। তবু তাঁর স্মৃতি চমকে উঠল। যুধিষ্ঠির সোজা হয়ে বসলেন। উদ্বববাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, “এ বুঝি আপনাদের নতুন কাজের লোক?”
“হ্যাঁ। এই তো তিন দিন হল কাজে লেগেছে।”
যুধিষ্ঠির আর কিছু বললেন না। তবে চাকরটা চলে যাওয়ার পরও অনেকক্ষণ দরজার দিকে চেয়ে রইলেন, হুঁ।”
উদ্ধববাবু যুধিষ্ঠিরের মুখের দিকে চেয়ে ছিলেন। লোকটা কেমন তা বুঝতে পারছিলেন না। তবে গোপনে শ্রীধরবাবুর কাছে খোঁজ নিয়েছিলেন। শ্রীধরবাবুর ভাঙা পা এখনো সারেনি। তিনি অবশ্য ভরসা দিয়ে বলেছে, যুধিষ্ঠির সম্পর্কে চিন্তা করবেন না। অতি উত্তম ছেলে। আমি বহুকাল ধরে চিনি।
উদ্বববাবু অবশ্য নিশ্চিন্ত হতে পারেন না। আজকাল তার সকলেকেই সন্দেহ হয়। তিনি যুধিষ্ঠিরের মুখের ভাবসাব দেখে সন্দিহান হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ওকে চেনেন নাকি?”
যুধিষ্ঠির মাথা নেড়ে মৃদু হেসে বললেন, “না বোধ হয়। চেনা-চেনা লাগছিল বটে, তবে কত মানুষের সঙ্গে কত মানুষের চেহারার মিল থাকে।”
এই বলে যুধিষ্ঠির উঠলেন। বললেন, “রামুর ব্যাপারে আমার যদি কিছু করার থাকে তবে আমাকে বলবেন। শত হলেও সে আমার ছাত্র। বলতে কী আমার অমন উজ্জ্বল বুদ্ধিমান ছেলে কমই দেখেছি।”
“বলেন কী?”
উদ্ধববাবু অবাক হয়ে বলেন, “রামু উজ্জ্বল বুদ্ধিমান?”
“ঠিক তাই। দুষ্টুমির স্টেজটা কেটে গেলেই সেটা বোঝা যাবে।”
উদ্ধববাবু একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন।
যুধিষ্ঠিরবাবু সন্তর্পণে বেরিয়ে এলেন। উঠোনের দিকটায় চাকরটা ভেজা কাপড়জামা মেলছে রোদ্দুরে, যুধিষ্টির চাপা স্বরে ডাকলেন, “ওহে, ও গোবিন্দ মাস্টার।”
গোবিন্দ চমকে চিতাবাঘের মতো ঘুরে দাঁড়াল। চোখ ধকধক করে জ্বলছে।
যুধিষ্ঠির একটু হাসলেন। তারপর কাছে গিয়ে বললেন, “ভয় পেও না। একটু বাইরে নিরিবিলিতে চলো। তোমার সঙ্গে একটু কথা আছে।”
গোবিন্দর চোখের আগুনটা নিভে গেল। বলল, “আজ্ঞে।”
যুধিষ্ঠির গোবিন্দকে নিয়ে বাইরে এলেন। নিরিবিলি বকুলগাছটার তলায় দাঁড়িয়ে মৃদুস্বরে বললেন, “আমাকে চিনতে পারো?”
গোবন্দ মুখোনা ভাল করে দেখল। তারপর চাপা স্বরে বলল, “চিনি। হরিহর পাড়ুইয়ের ছেলে না তুমি?”
যুধিষ্ঠির মৃদু হেসে মাথা নাড়লেন, “ধরেছ ঠিক। আমার বাবা বড় ভাল লোক ছিল না। পদবীটা আজকাল আর ব্যবহার করি না? এখন আমি যুধিষ্ঠির রায়।”
গোবিন্দ কঠিন স্বরে বলল, “কী চাও? বাপের খুনীকে পুলিশে ধরিয়ে দেবে?”
যুধিষ্ঠির গম্ভীর হয়ে বললেন, “না। আমার বাবা যেসব পাপ করেছিলেন তাতে তাঁর খুন হওয়া কিছু বিচিত্র ছিল না। তার খুনীর ব্যবস্থা সরকার করবে। আমার তা নিয়ে মাথাব্যথা নেই। কিন্তু আমি জানতে চাই তুমি কোন দলে? কেনই বা এ-বাড়িতে চাকর সেজে আছ?”
গোবিন্দ খুব তীব্র দৃষ্টিতে যুধিষ্ঠিরকে দেখছিল। হরিহরের ছেলে লেখাপড়া শিখেছে বলে জানে। হরিহরও বলত তার ছেলে নাকি তার মতো নয়। গোবিন্দ একটা শ্বাস ফেলে বলল, “তোমার হয়তো বিশ্বাস হবে না, হরিহরকে আমি খুন করিনি।”
“হতে পারে। এখন আসল কথা বলো। তুমি এখানে কী করছ? চাকর সেজে থাকলেই তো ১লবে না। যদি বুঝি তোমার মতলব খারাপ তাহলে উদ্ধববাবুকে তোমার আসল পরিচয়টা আমাকেই দিতে হবে।”
গোবিন্দ একটু হেসে বলল, “উনি জানেন। আমি রামুর দলে। সাতনার দলে নেই।”
যুধিষ্ঠির একটু অবাক হয়ে বললেন, “সাতনা? সে আবার এর মধ্যে আছে নাকি?”
“আছে। দলের সর্দার না হলেও সে বেশ পাণ্ডা গোছের লোক। আমার ধার হরিহরকে সে-ই খুন করেছিল।”
যুধিষ্ঠির একটু আনমনা হয়ে যান। অনেকক্ষণ দূরের দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলেন, “সাতনা!”
“সাতনাকে আমিও চিনতাম। সে লোক খারাপ ছিল না।”
যুধিষ্ঠির ব্যথিত মুখে মাথা নেড়ে বলেন, “তার মেয়েটা চুরি যাওয়ার পর থেকেই সে মানুষ থেকে জানোয়ার হয়ে গেল। তা শোনো গোবিন্দ মাস্টার, যদি সাতনার দলই রামুকে চুরি করে থাকে তাহলে একটা উপায় হয়তো করা যাবে।”
“তার মানে?”
যুধিষ্ঠির ব্যথিত মুখে বললেন, “সাতনার মেয়েটাকে চুরি করেছিলেন আমার বাবাই। গবার কী মতলব ছিল জানি না। হয়তো সাতনার কাছ থেকে কিছু আদায় করা। কিন্তু চুরি করলেও মেয়েটাকে বাবা মেরে ফেলেননি। আমার এক নিঃসন্তান মাসির কাছে রেখে এসেছিলেন। যতদূর জানি মেয়েটা এখনো সেখানেই আছে। যত্নে আছে। সাতনাকে বহুবার খবরটা দেওয়ার চেষ্টা করেছি। পারিনি।”
“বলো কী!” গোবিন্দর চোখ কপালে উঠল।
“ঠিকই বলছি। তুমি যদি খবরটা সাতনার কাছে পৌঁছে দিতে পারো তাহলে হয়তো কাজ হবে। বলবে রামুকে ফেরত দিলে সে তার মেয়েকে ফেরত পাবে।”
উত্তেজিত গোবিন্দ কঁপতে কাঁপতে বলল, তোমার মাসির ঠিকানাটা?”
যুধিষ্ঠির মৃদু হেসে বললেন, “ওটা এখন গোপন থাক। তবে নিশ্চিন্ত থাকো, মেয়েটা আছে। আগে খবরটা সাতনার কানে পৌঁছে দাও। তারপর যা করার আমিই করব।”
“তোমার কথা কি সাতনাকে বলব?”
“না বলাই ভাল।” যুধিষ্ঠির মাথা নেড়ে বলেন, “কারণ যে-গুপ্তধনের জন্য তোমরা সবাই হন্যে হয়ে গেছ তার আসল উত্তরাধিকারী আমিই। কিন্তু আমি ওসব দাবি করব না। আমি চাই গুপ্তধনের উদ্ধার হলে তা সরকারের তহবিলে জমা হোক। সাতনা জানে যে আমিই ওই গুপ্তধনের ওয়ারিশ। কাজেই আমি বেঁচে আছি জানলে সে আমাকে খুন করতে চাইবে।”
গোবিন্দ বলে, “তাহলে কী বলব? সাতনা কি আমাদের কথা বিশ্বাস করবে?”
“করবে। মেয়েটার একটা ছবি আমার কাছে। সেটা ওকে দিও। তাহলে বিশ্বাস করবে।”
.
২৫.
পরের রাতেও নয়নকাজল এল। রামু ভেবেছিল, বেত খেয়ে নয়নকাজলের বুঝি হয়ে গেছে। কে দরজায় শব্দ করল। রামু উঠে গিয়ে দরজায় মুখ লাগিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কে?”
–”আমি নয়নদা।”
“ডঃ নয়নদা! তুমি ভাল আছ?”
“ভাল কি আর থাকি? সারা গায়ে কালশিটে, কঁকালে ব্যাথা, চলতে গেলে মাথা ঘোরে।”
“তোমাকে খুব মেরেছে নয়নদা?”
“খুব। মেরেই ফেলত। কিন্তু পাখিটার মুখ থেকে এখনো কথা বেরোয়নি বলে প্রাণটা আমার রেয়াত করেছে।”
“তুমি পালিয়ে যাচ্ছ না কেন নয়নদা? গিয়ে পুলিশে খবর দাও।”
নয়ন একটু দুঃখের হাসি হেসে বলল, “পালালে যদি বাঁচতুম রে ভাই, তবে, তবে কি আর চেষ্টা করতুম না! আর পুলিশের কথা কি বলব! আমার মতো গরিব-দুঃখী মানুষের কথায় তারা গা করবে না।”
“তাহলে উপায়?”
“উপায় কিছু দেখছি না। যদি নিতান্ত চুনোপুঁটি ভেবে যদি ছেড়ে-টেড়ে দেয়। ভগবান ভরসা। তোমার জন্য আজ আর দুধটুকু আনতে পারিনি।”
“দুধ গবে না। শোনো নয়নদা, এদের সর্দার যখন আবার আমার কাছে আসবে, তখন আমি তাকে বলে দেব যেন আর কখনো তোমার গায়ে হাত দেয়। দিলে আমি পাখির মুখ দিয়ে কথা বলানোর চেষ্টা করব না।” নয়ন একটু অবাক হয়ে বলে, “সর্দার! সর্দারকে তুমি কোথায় দেখলে? “কেন ঐ দানবের মতো লোকটা। সাতনা না কী যেন নাম।”
নয়ন একটা শ্বাস ফেলে বলল, “সাতনা সর্দার টর্দার নয়। তবে মোড়ল গোছের একজন বটে। আসল সর্দার যে কে, তা এরা নিজেরাও ভাল জানে। যেই হোক তার অনেক ক্ষমতা। তাকে সবাই যমের মতো ডরায়।”
“তুমি সর্দারকে দেখনি?”
“আমি কেন, এরাও অনেকে দেখেনি। ওসব নিয়ে ভেবো না। সাতনাকে আমার কথা বললে হিতে বিপরীত হবে। এখন ছেড়ে রেখেছে, তুমি কিছু বললে হাতে-পায়ে শিকল পরিয়ে রাখবে।”
“তাহলে বলব না, কিন্তু এই যে তুমি আমার কাছে এসেছ, যদি ধরা পড়ে যাও?”
“সে ভয় খুব একটা নেই। তোমার ওপর এরা তেমন কড়া নজর রাখছে। তুমি ছোট ছেলে, দরজা ভেঙে পালাতে তো পারবে না, আর পালালেই বা যাবে কোথায়? চারদিকে জঙ্গল।”
“এখানে ওরা কজন আছে?”
“বেশি নয়। তবে সব সময়েই তোক আনাগোনা করে। বিরাট কাণ্ড। বিরাট কাণ্ড। কোদাল গাঁইতি দিয়ে চারদিকে খুব খোঁড়াখুঁড়িও হচ্ছে গুপ্তধনের জন্য।”
“কিছু পেয়েছে?”
“না, পাওয়া বড় সহজ নয়।”
“পাখিটা কোথায়?”
“সে খুব ভাল জায়গায় আছে। আমাদের নাগালের বাইরে।”
রামু উত্তেজিত গলায় বলল, “শোনো নয়নদা, আমাদের যেমন করে হোক, পালাতেই হবে। এখানে থাকলে তুমি বা আমি কেউই হয়তো বেঁচে থাকব না।”
“পালাবে? ও বাবা!”
“ভয় পাচ্ছ কেন? মরার চেয়ে তো পালানোই ভাল।”
“ ভাল কিন্তু…”
“কিন্তু টিন্তু নয়। ভাল করে দ্যাখো, এ-ঘর থেকে বেরোনোর কোনো উপায় আছে কিনা।”
“দেখেছি। নেই।”
“ছাদে উঠতে পারো?”
“তা পারি।”
“আর-একটা দড়ি লাগবে।”
“তাও জোগাড় হবে। কিন্তু অত সাহস ভাল নয়। শুনেই আমার হাত পা কঁপছে।”
“শোনো নয়নদা, না পালালেও এরা রেহাই দেবে না। আমাকে যদি নাও মারে, তোমাকে মারবে। কারণ তুমি বড় মানুষ, ওদের অনেক গোপন খবর জেনে গেছ। কাজেই তোমার না পালিয়ে উপায় নেই। যদি দুজনে পালাতে পারি, তবে আমি বাবাকে গিয়ে সব বলল। বাবা পুলিশের কাছে। গেলে পুলিশ কিছু না-করে পারবে না। তা ছাড়া গোবিন্দদা আর গবাদা আছে। ওরা ঠিক একটা বুদ্ধি বের করবে।”
নয়ন কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, “কিন্তু পালানোর উপায়টা কী ভেবেছ?”
“খুব সোজা। দক্ষিণ দিকে ছাদের কাছে একটা বড় ঘুলঘুলি আছে। অবশ্য অনেক উঁচুতে। ঘুলঘুলিতে পাতলা তারের জাল দেওয়া জালটা পুরনো হয়ে মচকে পড়ে পচে গেছে। তুমি ছাদে উঠে কার্নিশে ভর দিয়ে ওই ঘুলগুলির ভিতর দিয়ে দড়ি নামিয়ে দেবে। আমি দড়ি ধরে উঠে যাব।”
“পারবে? পড়ে যাবে না তো?”
“না না। আমি গোবিন্দ-মাস্টারের কাছে অনেক মিল নিয়েছি। কিন্তু তুমি খুব সাবধান।”
“আজ রাতেই পালাবে নাকি?”
“আজ, এক্ষুনি। কাল আবার কী হয় কে জানে?”
“আমার বড় ভয় করছে রামু। পুরনো কার্নিশ ভেঙে যদি পড়ে যাই?”
“কার্নিশ যদি পুরনো হয় তাহলে ছাদের রেলিং বা শক্ত কিছুতে দড়িটা বেঁধে নিজে কোমরে জড়িয়ে নিও। পড়বে না কিন্তু সাবধান। শব্দটব্দ কোরো না।”
“আচ্ছা। কিন্তু পারবে তো রামু?”
“আমি পারব। তোমাকেও পারতে হবে।”
“দেখি তাহলে।” মিনমিন করে এ কথা বলে চলে গেল নয়ন।
রামু শীত তাড়ানোর জন্য কয়েকটা ডন-বৈঠক করল। স্কিপিং-এর ভঙ্গিতে নেচে মাংসপেশীর আড় ভেঙে নিল। গা গরম করে না নিলে হঠাৎ কঠিন পরিশ্রম করতে গিয়ে পেশীতে টান ধরে যায়। গোবিন্দদা তাকে অনেক কটা কসরত শিখিয়েছে। সবই ফ্লোর একসাইজ। তার কয়েকটা করে নিল রামু।
তারপর কম্বল মুড়ি দিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। অন্ধকার ঘরে ঘুলঘুলিটা খুব আবছা দেখা যায়। অনেকটা উঁচুতে। খুব বড় ঘুলঘুলি নয় বটে, তবে রামু গলে যেতে পারবে। কিন্তু কথা হল, নয়নকাজল পারবে কি না কার্নিশে নামতে। একে ভীতু মানুষ, তার ওপর নয়ন তো আর খেলাধুলো করে না।
ওদিকে নয়ন পড়েছে মুশকিলে। একতলার একটা ঘরে মেলা দড়িদড়া শাবল খন্তা মজুত থাকে। দরজায় তালা-ও নেই। সে নিঃশব্দে গিয়ে একটা দড়ি বের করে এনেছে বটে, কিন্তু বাকি কাজ করতে ডরে ভয়ে হাত-পা অসাড় হয়ে যাচ্ছে।
দালানের মধ্যে তেমন পাহারা নেই। পাহারা আছে বাড়ির চারধারে। কোনো দরজা বা ফটক দিয়ে বেরোনোর উপায় নেই। আর নীচের তলার দোর দিয়ে অনেক লোক ঘুমোচ্ছে। দোতলাতে গোটা দুই-তিনঘরে লোক আছে। সাড়াশব্দ হলে তারা জেগে যেতে পারে।
নয়ন পা টিপে টিপে ছাদে উঠল। আজও কুয়াশা আছে, শীতও সাংঘাতিক। তবে মাঝরাতে একটু চাঁদের উদয় হয়ে থাকবে। অন্ধকারটা তেমন জমাট নয়। একটু ফিকে ভাব। মস্ত ছাদখানা অনেকটা দেখা যাচ্ছে। বিস্তর আজে বাজে জিনিস, পড়ে আছে ছাদে। পুরনো পিপে, পাথরের মূর্তি, ইট, ভাঙা দরজা-জানালার কাঠ।
নয়ন ঠাহর করে রামুর ঘরটা কোথায় তা আন্দাজ করল। রেলিং দিয়ে ফুঁকতে নীচের দিকে মাথাটা বোঁ করে ঘুরে গেল তার। এই এত উঁচু থেকে যদি পড়ে যায় তো মাথাটি আস্ত থাকবে না। অনেকক্ষণ চোখ বুজে একটু ধাতস্থ হওয়ার চেষ্টা করল সে।
তারপর চোখ খুলতেই বুকের মধ্যে একটা চড়াই পাখি উড়াল দিল যেন।
সামনে তোক দাঁড়িয়ে।
দাঁতে-দাঁতে কত্তাল বাজছিল নয়নের। সে বাবা-গো’ বলে ফের চোখ বুজে ফেলল।
লোকটা জিজ্ঞেস করল, “কে তুই?”
“আজ্ঞে আমি দলের লোক।”
“এখানে কী করছিস?”
“আজ্ঞে পাহারা দিচ্ছিলাম।”
লোকটা অবাক হয়ে বলল। “ছাদে তো আমার ডিউটি তুই এলি কোত্থেকে? হাতে দড়িই বা কেন?”
নয়ন একটু সাহস করে বলল, “যদি কাউকে ধরে ফেলি তে বাঁধতে হবে না?”
“ওঃ, তাই বল!” বলে হঠাৎ লোকটা হাসতে হাসতেই ঠাস করে একটা চড় কষাল নয়নের গালে। সেই চড়ে চোখে ফুলঝুরি দেখতে লাগল নয়ন। বাপ রে, কী চড়!