কলকাতা অবধি সময় লাগে পৌনে দু’ঘণ্টার মতো। এই পৌনে দু’ঘণ্টায় কী কী ঘটতে পারে তার সম্ভাবনা নিয়ে গম্ভীরভাবে চিন্তা করার চেষ্টা করছিল গোপীনাথ। কিন্তু মানসিক চঞ্চলতা তাকে নিবিষ্ট হতে দিচ্ছে কই?
প্লেন আকাশে উঠল বেশ কিছুক্ষণ পর। গোপীনাথ তার অ্যাটাচি আঁকড়ে বসে রইল সিটে। কিন্তু শক্ত হয়ে। প্রতিটি মিনিট কাটছে যেন ঘণ্টার লয়ে।
শীতের মেঘমুক্ত আকাশে প্লেনের গতি অতি মসৃণ। কোনও ঝাঁকুনি নেই, হেলদোল নেই। ছোট একটা পরদায় দেখানো হচ্ছে একটা ডকুমেন্টারি। গোপীনাথ সেদিকে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকেও বুঝতে পারল না, ডকুমেন্টারিটা কী বিষয়ে। বাইরে উজ্জ্বল রোদ, নীল আকাশ, নীচে সবুজের বিস্তার। কিন্তু গোপীনাথ কিছুই উপভোগ করছে না। তার শ্যেনদৃষ্টি সামনের দিকে। একজিকিউটিভ এনক্লোজারে দু’জন সম্ভাব্য আততায়ী ওত পেতে আছে। তার একদা প্রভু কর্মকর্তারা ওদের নিয়োগ করেছে তাকে সস্নেহে দুনিয়া থেকে মুছে দিতে।
কিন্তু কী লাভ তাতে সাক্কির? কয়েক কোটি টাকার অত বড় প্রোজেক্টের সর্বময় কর্তা গোপীনাথকে সরিয়ে দিলে যে প্রোজেক্টটাই অনেক পিছিয়ে যাবে। গোপীনাথ এও জানে, তার বিকল্প বিশেষজ্ঞ চট করে খুঁজে পাওয়া খুব শক্ত। সাক্কি তা হলে তার বিরুদ্ধতা করছে কেন? সত্য বটে, কোম্পানিগুলোর কোনও নীতিবোধ থাকে না। সামান্য স্বার্থে ঘা লাগলেই তারা যে-কোনও মানুষকে সরিয়ে দেয়। কিন্তু গোপীনাথ তো তাদের স্বার্থই দেখছিল। আদ্রেঁর কাগজপত্র সরিয়ে ফেলে সে কোম্পানির উপকারই করতে চেয়েছে। কিন্তু কথাটা বোর্ডকর্তাদের বোঝাতে পারেনি সে। তারা গম্ভীর মুখে শুনেছে, কিন্তু বিশ্বাস করেনি। তাই এতদিন বিশ্বস্ততার সঙ্গে চাকরি করার পর তার বরাতে জুটল এই শত্রুতা। কিন্তু গোপীনাথ কোম্পানির এই বিশ্বাসঘাতকতা হজম করতে পারছে না। রাগে তার ভিতরটা জ্বলছে।
রাগের একটা উপকারী দিকও আছে। রাগটা গনগনে হয়ে তার ভয়ডর কিছু কমিয়ে দিচ্ছে। রাগ তার ভিতরে কিছু শক্তিরও সঞ্চার ঘটাচ্ছে কি? হয়তো তাই।
আবার নতুন করে ব্রেকফাস্ট দেওয়া হচ্ছে এই বিমানেও। সবিনয়ে ট্রে-টা প্রত্যাখ্যান করল গোপীনাথ। শুধু কফি খেল এক কাপ। বারবার ঘড়ি দেখছিল সে। সময় কাটছে না কিছুতেই। দিল্লি থেকে খবরের কাগজ বোঝাই হয় প্লেনে। যাত্রীরা খবরের কাগজ খুলে মন দিয়ে পড়ছে। গোপীনাথের সে ইচ্ছেটা অবধি হল না। দাতা বলেছে, এই দু’জন অনুসরণকারীর চোখে ধুলো দিতে হবে। সেটা কীভাবে সম্ভব তাই ভাবছিল সে। এসব কাজে তার কোনও অভিজ্ঞতা নেই। ভরসা এই যে, মাফিয়া গুন্ডারা কলকাতায় নতুন। সুতরাং গোপীনাথ হয়তো পারবে।
ক্রমে ক্রমে কলকাতা কাছে আসছে। বড্ড ধীর গতিতে অবশ্য। কিন্তু অমোঘভাবেই আসছে।
গৌরাঙ্গ গাঙ্গুলি সামনের সিট থেকে উঁকি দিয়ে বলল, কী মশাই, সব ঠিক আছে তো! গোপীনাথ একটু হেসে বলল, ঠিক আছে।
গৌরাঙ্গ একটা ভিজিটিং কার্ড বের করে তার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এটা রাখুন। দরকার হলে যোগাযোগ করবেন কলকাতায়।
গোপীনাথ কার্ডটা পকেটে রাখল।
ভাল কথা, এয়ারপোর্টে আমার গাড়ি থাকবে, যদি চান তো আপনাকে গ্র্যান্ড হোটেলে নামিয়ে দিয়ে যেতে পারি। আমি গলফ ক্লাব রোডে থাকি। ওদিক দিয়েই যাব।
গোপীনাথ অম্লানবদনে মিথ্যে কথা বলল, আমাকে রিসিভ করতে আমার এক বন্ধু গাড়ি নিয়ে আসবে। তবু আপনাকে ধন্যবাদ।
ঠিক আছে। তবে যোগাযোগ করলে খুশি হব। একদিন ডিনার বা লাঞ্চে আমার বাড়িতে এলে আরও খুশি হব।
বিমান নামবার ঘোষণা হল। বিশাল বিমানটি হেলতে দুলতে শুরু করে ক্রমে ক্রমে উচ্চতা হারাতে লাগল। গোপীনাথ দেখল, এখনও কেউ তার দিকে আসছে না। দুই মাফিয়া এখনও চোখের আড়ালে।
প্লেন নেমে পড়ল। গোপীনাথ একটা স্বস্তির শ্বাস ছাড়ল। এটা কলকাতা, রোম নয়। গোপীনাথ আর তেমন অসহায় বোধ করছে না।
এবার সে আর ভুল করল না। দাতা তাকে বলেছিল সবার শেষে নামতে। আর সেটা করতে গিয়েই দিল্লিতে বিপদে পড়েছিল সে। এবার তা করবে না। সিঁড়ি লাগবার পর সে সকলের সঙ্গেই দরজার কাছে গিয়ে হাজির হয়ে গেল।
আশ্চর্যের বিষয়, মাফিয়া দু’জনের দেখা নেই।
গোপীনাথ নামল। প্রথম গাঙ্গুলি দম্পতি এবং তার পরেই সে ইমিগ্রেশন পার হল। গাঙ্গুলিরা লাগেজের জন্য অপেক্ষা করবে। সুতরাং সে বেশ তাড়াহুড়ো করে বিদায় নিয়ে সোজা প্রি-পেইড ট্যাক্সির কাউন্টারে চলে গেল। কেউ তাকে অনুসরণ করছে না। লক্ষ অবধি করছে না।
ট্যাক্সিতে বসে সে যখন বালিগঞ্জের দিকে ছুটছে তখনও ভাল করে লক্ষ করল, কেউ তার পিছু নেয়নি। হতে পারে, মাফিয়ারা তার কলকাতার ঠিকানা জানে। তাই অকারণে কোনও অ্যাডভেঞ্চার করার ঝুঁকি নিচ্ছে না।
বিশাল ফ্ল্যাটবাড়িটার সামনে নেমে খুব একটা নিরাপদ বোধ করল না গোপীনাথ। কারণ, দাতা তাকে বলেছে, তার ফ্ল্যাটে তারা একটা কম্পিউটার বসিয়ে দিয়েছে। এটা যদি সম্ভব, তা হলে ফ্ল্যাটের মধ্যে গোপীনাথের নিরাপত্তা বলতে আর কী থাকল?
লিফটে ছ’তলায় উঠে সে নিজের ফ্ল্যাটের দরজা খুলল। বিশাল তিন হাজার স্কোয়ার ফুটের ফ্ল্যাট। দক্ষিণ আর পুবে চমৎকার ব্যালকনি। বিশাল হলঘর এবং তিনটে শোয়ার ঘর। সবগুলিই বড়। এ ছাড়া আলাদা সারভেন্টস রুম আছে।
ফ্ল্যাটে গোপীনাথ বড় একটা থাকে না। কচিৎ কখনও কলকাতায় এলে হোটেলেই থাকে। এমনকী সুব্ৰতর বাড়িতেও থাকে না। তবে বিবাহিত জীবনে বার দুই শ্বশুরবাড়িতে থেকেছিল। এতদিনকার বন্ধ ফ্ল্যাটে আশ্চর্যের বিষয়–ধুলোময়লা তেমন জমেনি। বেশ চকচক ঝকঝক করছে সবকিছু। যেন কেউ সদ্য ঝটপাট দিয়ে ডাস্টিং করে গেছে।
হলঘরটা সোফাসেটে সাজিয়েছিল তার প্রাক্তন স্ত্রী। ফ্ল্যাটের সব আসবাবই তার পছন্দ করে কেনা বা বানিয়ে নেওয়া।
গোপীনাথ কিছুক্ষণ গা এলিয়ে একটা নরম সোফায় বসে রইল। জিরিয়ে নিয়ে সে হলঘরের এক কোণে রাখা টেলিফোনটা গিয়ে তুলল। হ্যাঁ, ডায়ালটোন আছে। টেলিফোনের রেন্টাল চার্জ থেকে শুরু করে ফ্ল্যাটের মেনটেনেন্স বা ট্যাক্স সবই সুব্রতই দেয়। তাকে টাকা পাঠিয়ে দেয় গোপীনাথ।
সুব্ৰতর বাড়ির নম্বরে ডায়াল করে তাকে পাওয়া গেল না। অফিসে পাওয়া গেল।
তার গলা পেয়ে সুব্রত গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, গোপীদা! আপনি বেঁচে আছেন। কোথা থেকে কথা বলছেন?
গোপীনাথ মৃদু স্বরে বলল, ওরে চেঁচাসনি, বেঁচে আছি বটে, কিন্তু কত দিন বেঁচে থাকব বলা যায় না। তবে এখনও বেঁচে আছি বটে। শোন, আমি এখন কলকাতায়।
কলকাতায়! মাই গড! সত্যি কলকাতায়?
হ্যাঁ রে, সত্যিই। নিজের ফ্ল্যাটে।
বলেন কী? রোম থেকে বেরোলেন কী করে? শুনলাম সেখানে নাকি গুন্ডারা আপনাকে ঘিরে রেখেছিল।
এত খবর তোকে কে দিল?
আমাদের বসের এক ইতালিয়ান বন্ধু আছে সাক্কিতে। সে-ই নাকি বলেছে।
তোর বস আমাকে চেনে?
খুব চেনে, আপনাকে তার ভীষণ দরকার। খুব চেষ্টা করছিল যোগাযোগ করতে।
খবরদার, আমার খবর কাউকে দিবি না। কাকপক্ষীও যেন জানতে না পারে।
কেন গোপীদা, এখন তো আপনি কলকাতায়। আর ভয় কীসের?
গোপীনাথ একটু হেসে বলল, তুই নিতান্ত ছেলেমানুষ। আন্তর্জাতিক গুন্ডাদের চিনিস না তো!
তার মানে কি এখানেও আপনার কিছু হতে পারে।
খুব পারে। ইন ফ্যাক্ট আমার পিছু পিছু দুটি গুন্ডা রোম থেকে কলকাতায় এসেছে। তাদের গতিবিধি এখনও বুঝতে পারছি না।
তা হলে আপনি আমার বাড়িতে চলে আসুন। ফ্যামিলির মধ্যে থাকলে কিছু করতে পারবে না।
না, তা হয় না। আমার বিপদের চেয়েও তখন তোদের ফ্যামিলির বিপদ বেশি।
কিছু হবে না গোপীদা।
কথা বাড়াস না সুব্রত। শোন, আমার এখন খিদে পেয়েছে। ধারেকাছে কোনও এমন দোকান আছে কি, যেখান থেকে বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা আছে?
ওসব নিয়ে আপনাকে ভাবতে হবে না। আমি এখনই ব্যবস্থা করছি। আর ঘণ্টাখানেকের মধ্যে আপনার ফ্ল্যাটে খাবার পৌঁছে যাবে। কী খাবেন বলুন।
ভাত খাব, ডাল খাব। আর যা হয়।
আর কিছু?
না, আপাতত আর কিছু নয়। অফিসের পর চলে আয়, একটু আড্ডা মারা যাবে।
বউদির সঙ্গে কথা বলবেন? লাইন ট্রান্সফার করতে পারি।
উঃ, তোকে নিয়ে আর পারি না। ওরে গবেট, আমি যে কলকাতায় আছি এ খবরটা তোর বউদিকেও দেওয়া বারণ।
আচ্ছা, ঠিক আছে।
শুধুই তুই জানলি, আর যেন কেউ না জানে। এমনকী তোর বাড়ির লোকও নয়। বুঝেছিস?
বুঝেছি। নিশ্চিন্ত থাকুন।
ঘরগুলো ঘুরে দেখতে গিয়ে স্টাডিতে কম্পিউটারটা আবিষ্কার করল গোপীনাথ। একটা স্টিলের টেবিলের ওপর বসানো। দামি জিনিস। বেশ কয়েক বাক্স ফ্লপি রয়েছে।
অ্যাটাচি কেসটা শোয়ার ঘরের স্টিলের আলমারিতে রেখে চাবি দিল সে। তারপর বাথরুমে গিয়ে গিজার অন করল। ভাল করে স্নান করা দরকার।
সারা ফ্ল্যাটটা ঘুরে ঘুরে লক্ষ করল সে। এ ব্যাপারে সন্দেহ নেই যে, কেউ এটা খুব সম্প্রতি ঝাড়পোঁছ করেছে। শোয়ার ঘরের প্রত্যেকটা খাটের পাশে ছোট্ট কাশ্মীরি টুলের ওপর ফ্লাওয়ার ভাসে টাটকা ফুল। এরকমটা তো স্বাভাবিকভাবে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু এসব করল কে? ভিকিজ মব-এর লোকেরা?
বাথটাবে জল ভরতি করে বেশ কিছুক্ষণ ঈষদুষ্ণ জলে বসে রইল গোপীনাথ। কলকাতায় এখনও বেশ শীত আছে। আবহাওয়া চমৎকার।
স্নান করে উঠে গোপীনাথ গিয়ে ওয়ার্ডরোব খুলে দেখল। অনেক দিন আগে ব্যবহৃত জামাকাপড় এখনও রয়েছে কিছু। গোপীনাথ মোটা হয়নি। সুতরাং মাপেও হয়ে গেল। পাজামার ওপর একটা খদ্দরের পাঞ্জাবি চাপিয়ে একটা শাল জড়িয়ে নিল গায়ে।
সুব্রতকে ফোন করার ঠিক পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাদে ডোরবেল বাজল। গোপীনাথ দরজা খুলে দেখল দু’জন লোক ঢাকা ট্রে হাতে দাঁড়িয়ে।
গোপীনাথের সত্যিই খিদে পেয়েছে। লোক দুটো সযত্নে তার ডাইনিং টেবিলে খাবার সাজিয়ে দিল। অন্তত দশ রকমের আইটেম। দই-মিষ্টি অবধি।
খাওয়ার পর বাসনপত্র গুছিয়ে নিয়ে রাতে ক’টার সময় কী কী খাবার দিয়ে যাবে তা জিজ্ঞেস করে নোট করে নিয়ে গেল। চমৎকার ব্যবস্থা। দাম নিল না। বলল, ওসব পরে হবে।
গোপীনাথ দরজা লক করে একটু শুয়ে রইল। শরীর ক্লান্ত, মন অবসন্ন। রোমে যেরকম বিপদ আর অনিশ্চয়তার মধ্যে ছিল এখন পরিস্থিতি তেমন নয়। কিন্তু উদ্বেগ রয়েই গেল।
গোপীনাথের চোখ জড়িয়ে আসছিল ঘুমে।
বিকেল চারটে নাগাদ টেলিফোন বাজল।
একটা পরিচিত গলা বলে উঠল, এই যে! পৌঁছে গেছেন?
গম্ভীর গোপীনাথ বলল, হ্যাঁ।
কোনও ঘটনা ঘটেনি তো?
ঘটেছে।
কী বলুন তো! ওই যে একটা লোককে আপনি প্লেনে লাথি মেরেছিলেন।
অবাক গোপীনাথ বলল, হ্যাঁ, কিন্তু
আরে অবাক হওয়ার কিছু নেই। ওরা দু’জন আমার লোক।
গোপীনাথের এক গাল মাছি। সে বলল, আপনার লোক। আপনার লোকেরা আমাকে অ্যাটাক করবে কেন?
আক্রমণ নয়। আসলে ওরা আপনাকে অ্যালার্ট রাখতে চাইছিল। যাতে আপনি অসতর্ক না হয়ে পড়েন।
তা হলে মাফিয়ারা কোথায়?
তারাও আছে।
আপনি কি বলতে চান একগাদা টাকা খরচ করে আপনার দু’জন লোককে আপনি আমাকে পাহারা দেওয়ার জন্য বা অ্যালার্ট রাখার জন্য পাঠিয়েছেন।
না না। ওদের অন্য কাজ আছে। দে আর অন স্পেশাল ডিউটি, ঘাবড়াবেন না, ওরা আপনাকে ডিস্টার্ব করবে না।
গোপীনাথ একটা শ্বাস ছেড়ে বলল, আপনি আসলে কে বলবেন?
আমি হলাম দাতা।
সে তো জানি। কিন্তু আপনার আসল পরিচয়টা আমার জানা দরকার।
সবকিছু জানা কি ভাল? এসব পরিস্থিতিতে যত না জানবেন ততই মঙ্গল।
গোপীনাথ গম্ভীর গলায় বলল, অন্তত এটুকু কি বলবেন যে, হোয়েদার ইউ আর অন দি রাইট সাইড অব দি ল?
রাইট সাইডে থাকলেও রং সাইডেও মাঝে মাঝে যেতে হয়। আই অ্যাম অন বোথ দি সাইডস।
ব্যাপারটা পরিষ্কার হল না। প্লেনে এয়ার হোস্টেস বলেছিল, ইন্টারপোল থেকে আমাকে চাইছে। আপনি কি ইন্টারপোল?
তাও বলতে পারেন। কিন্তু ফরগেট মাই আইডেন্টিটি। এবার কাজের কথা বলি।
বলুন।
আজকের দিনটা আপনি বিশ্রাম নিন। কিন্তু কাল থেকে একটু কাজ শুরু করুন।
কী কাজ?
আদ্রেঁর কাজ। যেখানে আদ্রেঁ শেষ করেছিল সেখান থেকে শুরু করা দরকার। ইটস এ ম্যাটার অফ ভাইটাল ইম্পট্যান্স।
জানি। সলিড ফুয়েল।
হ্যাঁ। এ কাজ আপনি ছাড়া আর কেউ পারবে না।
আপনি কি তেল দিচ্ছেন নাকি মশাই?
আরে না। আপনি তেল দেওয়ার পাত্র নন।
তবে বলছেন কেন? আদ্রেঁর লাইন আমার লাইন এক নয়। আমি ছিলাম প্রোজেক্ট কো অর্ডিনেটর। আদ্রেঁ ছিল স্পেশালিস্ট।
সব জানি।
জানেন না। ইউ আর নট এ সায়েন্টিস্ট।
তাও ঠিক। তবু আমি জানি আদ্রেঁকে এ কাজে লাগিয়েছেন আপনিই।
তাতে কিছু যায়-আসে না।
মানছি। তবু আদ্রেঁর কাজ আর কে শেষ করতে পারে বলুন!
গোপীনাথ একটা শ্বাস ফেলে বলল, হয়তো কেউই পারে না। ঠিক আছে, আগে ঠান্ডা মাথায় ওর পেপারওয়ার্কগুলো দেখি। তারপর ভাবা যাবে।
দয়া করে তাই করুন।
মুশকিল হল, একটা আধুনিক ল্যাবরেটরি তে চাই। এদেশে সেটা কোথায় পাব?
ভেবে দেখছি। কিছু একটা উপায় হবেই। একটা কথা, দরজাটা লক করে শোবেন।
কেন?
বিপদ।
২২.
সন্ধেবেলা টেলিফোনটা এল। খুবই অপ্রত্যাশিতভাবে। রোজমারি জরুরি একটা মিটিং সেরে গুরুতর কিছু কাজ নিয়ে বসেছিল নিজের একটেরে অফিস ঘরে। মৈত্রেয়ী তাকে সাহায্য করছিল।
ঠিক এই সময়ে রিং বাজল। ফোন ধরল মৈত্রেয়ী।
ম্যাডাম, কে একজন আপনাকে চাইছে। বলে মৈত্রেয়ী ফোনটা এগিয়ে দিল রোজমারির দিকে।
রোজমারি এত অবাক হল যে কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। পৃথিবীতে জো ক্লাইন নামের লোক হয়তো আরও আছে। কিন্তু এ লোকটার ফ্যাসফ্যাসে চাপা গলা এবং একটু বিদেশি অ্যাকসেন্টের জার্মান উচ্চারণ রোজমারির ভুল হওয়ার নয়।
রোজমারি গলার বিস্ময় আর বিরক্তিটা চেপে রাখতে পারল না, জো, তুমি কী চাও? তোমার সঙ্গে আমার সম্পর্ক তো চুকেবুকে গেছে।
সম্পর্কের জন্য ব্যস্ত হয়ো না। আমরা স্বামী-স্ত্রী আর নই ঠিকই, কিন্তু হয়তো পুরনো বন্ধুত্ব তুমি সবটা ভুলে যাওনি।
কে বলল ভুলে যাইনি? আমি তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব স্বীকার করি না।
ঠিক আছে রোজমারি, সেটাও মেনে নিলাম। কিন্তু আমি যদি তোমার কাছে একটু সাহায্য চাই, পাব কি?
কী ধরনের সাহায্য?
বলছি। কিন্তু তার আগে তোমার গলার কাঠিন্য একটু কমানো দরকার। মনে হচ্ছে তুমি খুব রেগে কথা বলছ।
হয়তো তাই। আমি ব্যস্ত মানুষ। একদম সময় নেই।
জানি। শুধু ব্যস্ত নও, এখন তুমি বেশ গুরুতর মানুষও।
বাজে কথা রাখো জো, যা বলার চটপট বলে ফেলল।
অত তাড়াহুড়োয় বলার মলোকথায়। একটুসময় লাগবে। তাছাড়া কথাটা টেলিফোনেও বলা যাবে না। আমি তোমার সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই। আমি কলকাতাতেই আছি।
অসম্ভব। তোমার সঙ্গে দেখা করার কোনও ইচ্ছেই আমার নেই।
শোনো রোজমারি, দরকারটা জরুরি।
যত জরুরিই হোক, আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
রোজমারি, ব্যক্তিগত পছন্দ অপছন্দটা বড় কথা নয়। আমি তোমার অপছন্দের মানুষ হতে পারি, কিন্তু আমি তোমার ক্ষতি করার জন্য আসিনি।
আমাকে ভুলে যাচ্ছ না কেন জো? আমি তো ভুলতে চাই।
ভাবাবেগের দ্বারা চালিত হওয়ার বয়স আমি পেরিয়ে এসেছি রোজমারি। দুনিয়াটা কঠিন জায়গা। আমাকেও কষ্ট করেই বেঁচে থাকতে হয়। তোমারও বয়স বসে নেই। আমরা নিশ্চয়ই আর ছেলেমানুষ নই।
তোমার দরকারটা কী ধরনের?
সেটা দেখা হলে বলা যাবে।
দেখা করতেই হবে তা হলে?
হ্যাঁ, এবং গোপনে।
যদি তা সম্ভব না হয়?
রোজমারি, তুমি আমাকে স্বেচ্ছায় সময় না দিলে আমি যেমন করেই হোক তোমার সঙ্গে দেখা করবই। এ ব্যাপারে কোনও বাধাই মানব না। কিন্তু সেই সাক্ষাৎকারটা তোমার আরও অপছন্দের হতে পারে।
এটা কি হুমকি?
রোজমারি, আমাকে খামোখা জেদি করে তুলছ কেন? আমি অনেক কিছুই ভুলিনি।
কী ভোলোনি?
ভিয়েনা।
রোজমারি চুপ করে রইল। কিন্তু তার মুখ যে ফ্যাকাশে হয়ে গেল তা লক্ষ করছিল মৈত্রেয়ী। রোজমারি মাউথপিসটা হাত দিয়ে চেপে রেখে মৈত্রেয়ীকে বলল, তুমি একটু বাইরে যাবে মৈত্রেয়ী?
মৈত্রেয়ী চলে গেলে রোজমারি ক্লান্ত গলায় বলল, জো, তুমি কি আমাকে ব্ল্যাকমেল করছ?
না রোজমারি। শুধু বলছি, অতীতকে সম্পূর্ণ বিস্মৃত হওয়া ভাল নয়।
জো, আজ একটা সত্যি কথা বলবে?
শপথ করতে পারি না। তবে সম্ভব হলে চেষ্টা করব।
তুমি কী কাজ করো?
যখন তোমার সঙ্গে আমার বিয়ে হয়েছিল তখন যা করতাম এখনও তাই করি।
তুমি বলেছিলে তুমি একটা কোম্পানির রোভিং সেলসম্যান।
হ্যাঁ।
কথাটা মিথ্যে।
হতে পারে।
তুমি সত্যিই কী করো?
আমি যা করি তা বলার মতো নয়। আমার চাকরিটা এমনই যে ভাল কাজ করলে কেউ পিঠ চাপড়ায় না, কিন্তু ভূল করলে প্রাণ যায়।
তুমি কি পেশাদার খুনি বা গুন্ডা?
এরকম সন্দেহের কারণ কী?
আমার মনে পড়ছে একটা লোক মাসখানেক আগে আমাকে বলেছিল, জোসেফ ক্লাইন আমার জীবনে ফিরে আসবে, তবে অন্য ভূমিকায়।
লোকটা খুবই জ্ঞানী। কিন্তু সে কে?
তার নাম সুধাকর দত্ত। সে ইন্টারপোলের অফিসার বলে নিজের পরিচয় দিয়েছিল।
জো একটু চুপ করে থেকে বলল, তুমি আজকাল বিপজ্জনক লোকেদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করো নাকি?
কেন, সুধাকর কি বিপজ্জনক লোক?
হা রোজমারি, খুব সাংঘাতিক বিপজ্জনক লোক। সে হয়তো তোমার অতীতের কথাও জানে।
কী করে জানলে?
সুধাকর দত্তকে গোটা ইউরোপের পাপীতাপীরা চেনে। প্যারিসে তার নামে অনেকে বুকে ক্রুশচিহ্ন আঁকে।
কিন্তু আমি তো পাপীতাপী নই। ভিয়েনায় যা ঘটেছিল তা একটা আপতন মাত্র।
জানি রোজমারি। কিন্তু অনেকে হয়তো ততটা আপতন বলে মনে করবে না। সেই ঘটনাটার জন্য আজ আর তোমাকে কেউ দায়ীও করবে না। তবে বদনামের ভয় আছে, ব্যাবসার সুনাম নষ্ট হতে পারে।
জোসেফ ক্লাইন, তুমি অতীতের ভূত। কী চাও বলো!
আপাতত একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট?
তুমি আগামী কাল ঠিক এসময়ে আমাকে একটা টেলিফোন কোরো।
করব। কিন্তু তারপর?
তোমার সঙ্গে দেখা করব জো।
বুদ্ধিমতী মেয়ে। এই তো চাই। একটা কথা।
কী কথা?
আমাদের এই সাক্ষাৎকারের কথা কাউকে জানাবে না।
কেন?
সেটা তোমার ভালর জন্যই। যদি বলো তা হলে কিছু জটিলতা দেখা দিতে পারে।
কিন্তু জো, আমার নিরাপত্তার জন্য কথাটা কাউকে জানানো দরকার বলেই আমার মনে হয়।
জো একটু হেসে বলল, তুমি সত্যিই বুদ্ধিমতী। আমাকে বিশ্বাস করা যে ঠিক নয় তা আমরা দুজনেই জানি। তুমি কি তোমার স্বামীকে জানাতে চাও?
না। মনোজ একটু ভিতু গোছের মানুষ। হয়তো উদ্বেগে ভুগবে।
তবে কাকে?
সেটাও কি তোমাকে বলতে হবে?
বললে বলতে পারো। না বললেও ক্ষতি নেই। তবে ব্যাপারটা যত গোপন রাখবে ততই ভাল।
কেন?
আমি একজন সন্দেহজনক লোক, তোমার ভূতপূর্ব স্বামী। আমার সঙ্গে তোমার যোগাযোগ ঘটাটা খুব স্বাভাবিকভাবে লোকে নেবে না হয়তো।
তুমি কতদূর সন্দেহজনক?
এক-একজনের কাছে এক-একরকম।
তার মানে তুমি ভাল জীবন যাপন করো না জো।
আমার মতো আরও অনেকেই তাই।
আমার একটা শর্ত আছে।
কী শর্ত রোজমারি?
আমি তোমার সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানি না। আমাকে তোমার সম্পর্কে সব জানাতে হবে।
জো একটু চুপ করে থেকে বলল, তাতে কী লাভ?
আমি জানতে চাই আমাদের রোমান্সের সময়ে তোমাকে আমার কেন খুব ভাল লোক বলে মনে হয়েছিল।
অদ্ভুত তোমার কৌতূহল। তবু বলি, হয়তো তখন আমি খুব খারাপ লোক ছিলাম না।
এখন কি খারাপ হয়েছ?
তা কি জো ক্লাইন নিজে বলতে পারে?
ঠিক আছে, কাল ফোন কোরো।
.
রোজমারি ফোনটা রেখে অনেকক্ষণ চুপ করে বসে রইল। তার মন এমনিতেই ভাল নেই। তার ওপর অতীত থেকে জো ক্লাইনের এই ফিরে আসা এই ঘটনার মধ্যে নিয়তির কোন মার লুকিয়ে আছে কে জানে!
রোজমারি মৈত্রেয়ীকে ইন্টারকমে ডেকে নিল। তারপর ডুবে গেল কাজে।
সন্ধের পরও সে আর মনোজ অনেকক্ষণ অফিসে থাকে। বিস্তর কাজ তাদের। মাঝে মাঝে অফিস থেকেই তারা একসঙ্গে কোনও পার্টিতে যায়। পার্টি তাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আজও এক পার্টি ছিল। কিন্তু রোজমারির মনে ছিল না।
মনোজের ফোন এল সাতটার পর।
রোজি, হল? সাতটা বাজে যে!
সাতটা! কেন, আজ কি কোনও অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে?
বাঃ, আজ যে সিং সাহেবের পার্টি।
ওঃ, আমি ভুলেই গিয়েছিলাম।
এখনই বেরিয়ে পড়া যাক।
রোজমারি বলল, শোনো, আমি যাব না।
সে কী? কেন?
আমার শরীরটা ভাল নেই। তুমি আজ একাই যাও।
হয়তো ওরা কিছু মনে করবে। একটু ছুঁয়ে গেলে পারতে।
না। আমি আরও একটু কাজ করে সোজা বাড়ি যাব।
মনোজ আর ঝোলাঝুলি করল না। রোজমারি খুব সহজে নিজের সিদ্ধান্ত থেকে সরে না। সে হতাশ গলায় শুধু বলল, আচ্ছা।
রোজমারি ফোনটা রেখে দিয়ে মৈত্রেয়ীর দিকে চেয়ে বলল, আজ আর কাজ করব না। কাগজপত্র গুছিয়ে রাখো। আমি যাচ্ছি।
রোজমারি বেরিয়ে এল। গাড়িতে উঠল। বাড়ি ফিরে একটা ছোট মাপের ওয়াইন খেয়ে বাথটবে গরম জলে পড়ে রইল অনেকক্ষণ। মাথায় চিন্তা আর চিন্তা। স্মৃতি আর স্মৃতি।
গা মুছে সে একটা ঢিলা পোশাক পরে লিভিং রুমে এসে কিছুক্ষণ আনমনে একটা ম্যাগাজিনের পাতা উলটে ছবি দেখে গেল।
তাজু খুব বিনীতভাবে এসে বলল, মেমসাব, ডিনার করবেন কি?
না তাজু। আজ কিছু নয়।
একটু স্যুপ?
না। বরং একটা ড্রিঙ্ক দাও। পোর্ট।
ঠিক আছে।
রোজমারি পোর্টটা খুব উপভোগ করল। আবার নিল। এবং আবার। তারপর ঘুমিয়ে পড়ল।
.
পরের দিনটা গেল একটু মন্থর গতিতে। সন্ধে ঠিক ছ’টার সময় ফোন এল।
রোজমারি, আমি জো।
হা জো, আর এক ঘণ্টা পর তুমি আমার দেখা পাবে।
কোথায়?
জায়গাটা তুমি ঠিক করো।
আমি?
হ্যাঁ তুমি।
রোজমারি, তুমি আমাকে ক্রমশ বেশি অবাক করে দিচ্ছ।
এতে অবাক হওয়ার কী আছে?
তা হলে এক কাজ করো। তুমি একটা গাড়ি নিয়ে চলে এসো ভিক্টোরিয়ার সামনে। আমি দাঁড়িয়ে থাকব।
তারপর?
কোথাও যাওয়া যাবে।
আমার গাড়ি চালায় ড্রাইভার। সে থাকলে আপত্তি নেই তো?
আছে। তুমি নিজে ড্রাইভ করলে ভাল।
তাই হবে।
তা হলে এক ঘণ্টা পরে?
হ্যাঁ।
এক ঘণ্টার একটু আগেই সময় হিসেব করে উঠে পড়ল রোজমারি। ড্রাইভার ছেড়ে দিয়ে নিজেই গাড়ি চালাতে লাগল। আজ কলকাতায় মিছিল নেই। জ্যামও তেমন নয়।
ভিক্টোরিয়ার বড় ফটকের সামনে জো দাঁড়িয়ে ছিল। গায়ে একটা জিনসের জ্যাকেট, পরনেও জিম্স। কাঁধে একটা ঝোলা।
দরজাটা খুলে দিয়ে রোজমারি বলল, উঠে পড়ো।
জো উঠল।
এবার কোথায় যাব জো?
খিদিরপুর চেনো?
চিনি। কিন্তু সেটা তো ঘিঞ্জি জায়গা।
তা হোক। চলো।
রোজমারি গাড়ি চালাতে চালাতে বলল, তোমার দিক থেকে আমার সত্যিই কোনও ভয় নেই তো?
জো একটু হাসল, বলা যায় না রোজমারি। তোমার চেহারা এখন এত সুন্দর হয়েছে যে, আমার মতো বুড়োরও লোভ হতে পারে।
তেল দিয়ো না। তুমি কি বুড়ো হয়েছ নাকি?
চল্লিশের ওপর তো বুড়োই।
তোমাকে অন্তত সেরকম দেখাচ্ছে না। এখনও গুন্ডাদের মতোই চেহারা আছে তোমার।
বাইরেটাই সব নয়। ভিতরে অনেক ভাঙন।
কীরকম ভাঙন?
বলে লাভ নেই। শুনতে চেয়ো না।
তোমার কথা কি লম্বা?
না না। সেরকম কিছু নয়।
এত ঢাকঢাক গুড়গুড় কেন বলো তো। কী এমন গোপন কথা?
কথার আগে তোমাকে আরও একটু তেল দিয়ে নিই। তুমি একা আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছ বলে খুব খুশি হয়েছি। আমাকে বিশ্বাস করেছ বলে ধন্যবাদ।
কেন তোমাকে কি আজকাল কেউ বিশ্বাস করে না?
না।
কেন করে না?
হয়তো বিশ্বাসযোগ্য নই বলেই।
জো, তুমি কী কাজ করো?
শুনবে?
হ্যাঁ।
আমি সেলসম্যান।
সেটা তো মিথ্যে কথা।
জো দু’পাশে মাথা নেড়ে বলল, না, মিথ্যে নয়। আমি ফিরি করি। তবে কী ফিরি করি তা জানতে চেয়ো না।
কলকাতায় কেন এসেছ?
কাজে।
কী কাজ সেটাই জানতে চাই।
কাজটা তোমার কাছে।
আমার কাছে? আমি কী করব?
তোমার কারখানায় একটা অ্যালয় তৈরি হয়।
হয়।
তোমার কারখানায় তৈরি অ্যালয়ের হঠাৎ চাহিদা খুব বেড়ে গেছে।
হ্যাঁ।
কেন বেড়েছে রোজমারি?
তা জানি না।
আমাকে তোমাদের কারখানা একটু দেখতে দেবে?
কেন? এটাই কাজ। খুব জরুরি।
২৩.
জো-কে বিশ্বাস হয় না রোজমারির। কিন্তু কয়েক বছর আগে মিউনিখে এই জোসেফ তাকে পাগল করে দিয়েছিল। এমন আকর্ষক দুরন্ত পুরুষ সে তার আগে আর দেখেনি। জোসেফ আমেরিকান, পয়সাওয়ালা মানুষ শুধু নয়, চমৎকার ভদ্র ও নম্র ছিল তার স্বভাব। তারপর সামান্য কোর্টশিপের পরই তাদের বিয়ে। এবং সামান্য বিবাহিত জীবনের পরেই ছাড়াছাড়ি। তবু আজও জো ক্লাইন যেন সমান আকর্ষক। জোর ভিতরে একটা চুম্বক আছে হয়তো।
জো তার কারখানা দেখতে চায়। এটা নিশ্চয়ই কোনও গুরুতর গোপন কথা হতে পারে না যার জন্য রোজমারিকে এভাবে টেনে আনতে হবে। রোজমারি মৃদুস্বরে বলল, জো ক্লাইন, আমার কারখানা রোজই বাইরের লোক এসে দেখে যায়। গোপন কিছু নেই। তোমার এই নাটকের তো দরকার ছিল না।
জো সামনের দিকে চেয়ে থেকে বলল, আমি পর্যটকের মতো দেখব না। আমি দেখব বিশেষজ্ঞের মতো।
তার মানে কি স্ক্রুটিনি?
হ্যাঁ রোজমারি। রোজমারি মাথা নেড়ে বলল, সেটা সম্ভব নয়।
কেন নয়?
তুমি নিশ্চয়ই জানো সেরকমভাবে পরীক্ষা করতে গেলে আমাদের কারখানার প্রোডাকশন মার খাবে, পাঁচটা কথা উঠবে। তা ছাড়া হঠাৎ তোমার এরকমই ইচ্ছেই বা হচ্ছে কেন?
জো কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তুমি যতটা নিরাপদ জীবনযাপন করছ বলে ভাবো, তোমার জীবন হয়তো ততটা নিরাপদ নয়।
তার মানে?
রোজমারি, তুমি হয়তো অজান্তে কোনও বিপুল ঐশ্বর্যের ওপর বসে আছ। আর সেই কারণেই তোমার নিরাপত্তা সুতোয় ঝুলছে।
রোজমারি একটা শ্বাস ফেলে বলল, জো, কিছুদিন আগে আমাকে কে যেন ভুল জন্মদিনে একগোছা রক্তগোলাপ পাঠায়। তার ট্যাগে লেখা ছিল, আর আই পি। তোমার কথা তাই আমার বাজে কথা বলে মনে হচ্ছে না। কিন্তু কী সে ঐশ্বর্য জো? বলবে আমাকে?
জো নেতিবাচক মাথা নেড়ে বলল, জানি না। তোমার আশ্চর্য অ্যালয় সম্পর্কেও কিছু জানা নেই আমার। তোমার কারখানা খুঁটিয়ে দেখার জন্য আমার সঙ্গে দু’জন লোক এসেছে। একজন বিশেষজ্ঞ, অন্যজন খুনি।
তার মানে?
জো সামান্য ধরাগলায় বলল, আমি স্বাধীন নই রোজমারি। আমাকে কাজ করতে হচ্ছে ভয় ও হুমকির মধ্যে।
তোমাকে কেউ বাধ্য করছে বলতে চাও?
হ্যাঁ।
কে বাধ্য করছে জো?
একটা করপোরেট বডি।
তারা কারা?
জো আবার কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, তোমাকে কিছু কথা বলার দরকার। শুনবে?
বলো।
যখন তোমাকে বিয়ে করি তখন আমি ছিলাম গুপ্তচর।
রোজমারি চমকে ওঠে, গুপ্তচর!
আমেরিকান সরকারের ফেডারেল ব্যুরোর।
আশ্চর্য!
কিন্তু পরে আমাকে চাকরি ছাড়তে হয়। ব্রুকলিনে আমি একটা দোকান চালাতে শুরু করি। আনা নামে একটি মেয়েকে বিয়ে করি। আনার দুটো বাচ্চা। নিরাপদ জীবন।
আনা কেমন মেয়ে?
ভাল। খুবই ভাল। জন্মসূত্রে রাশিয়ান।
তারপর বলো।
চিরকাল সমান যায় না। আমি নানাভাবে জড়িয়ে পড়ি অপরাধ জগতের সঙ্গে।
কীভাবে?
অত বলবার সময় নেই।
তা হলে বলে যাও।
নানা সূত্রে আমার আয় হত। মোটা আয়। আনা দোকান নিয়ে পড়ে আছে।
আর তুমি?
আমাকে যে কাজটা করতে হয় তা ভাড়াটে সৈন্যের মতো।
খুনখারাপি কি?
ঠিক তা নয়। তবে অবশ্যই আমি যা করে বেড়াই তার অনেক পরিণতি ঘটে মৃত্যুতে। এসব ঠিক বোঝানো যাবে না।
এখন কারা তোমার বস?
অত্যন্ত শক্তিশালী একটি সংগঠন।
তারা কী চায় জো?
তারা জানতে চায় তোমার কারখানায় আসলে সত্যিই কী জিনিস তৈরি হয়।
আজকাল অনেকেই বোধহয় তা জানতে চাইছে। কিন্তু আমি নিজেই তো জানি না। পৃথিবীতে এই অ্যালয় তৈরির আর কিছু কারখানা আছে। আমি তো একা নই।
তাও জানি। সেসব কারখানাতেও ঘটনা ঘটছে।
জো, আমি কি অজান্তে বিজ্ঞানের বিস্ময় কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছি?
জো গম্ভীর হয়ে বলল, সেটা বলতে পারত আদ্রেঁ।
আদ্রেঁ।
হ্যাঁ। যাকে কলকাতায় খুন করা হয়।
আদ্রেঁর কথাও তুমি জানো?
জানি। আদ্রেঁ প্রায় ব্যাপারটা ধরে ফেলেছিল। কিন্তু নিজেই বাঁচল না। কিন্তু সেখানে থেমে গেলেই তো চলবে না।
বুঝেছি।
আমাকে বন্ধুর মতো সাহায্য করো রোজমারি। আমি তোমার শত্রু নই।
কিন্তু এটা তো শত্রুতাই।
হয়তো তাই। তুমি সাহায্য করলে কোনওভাবে আমি তোমাকে রক্ষা করতে পারব। না করলে আমারও কিছুই করার থাকবে না।
অর্থাৎ খুন?
হয়তো তাই।
তুমি আমাকে খুন করবে জো?
আমি করব না। ওসব করার লোক আছে।
রোজমারি মাথা নেড়ে বলে, হ্যাঁ, তুমি তো খুনি সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছ।
জো একটা সিগারেট ধরাল। কিছুক্ষণ নিবিড়ভাবে সিগারেট টেনে সে নিজেকে একটু সংযত করে নিল হয়তো। তারপর বলল, আমাদের সঙ্গে পাল্লা দিতে আরও একজন এসে গেছে।
সে কে?
গোপীনাথ বসু নামে একজন ইন্ডিয়ান। বিশেষজ্ঞ।
গোপীনাথ বসু। সাক্কির?
হ্যাঁ। চেনো?
নামটা শুনেছি।
আদ্রেঁ তার অধীনে কাজ করত।
সে কী চায়?
আমরা যা চাই সেও তাই চায়।
রোজমারি ভ্রু কুঁচকে চুপ করে রইল। মনোজ কিছুদিন যাবৎ খুব গোপীনাথ বসুর কথা বলছে। এমন কথাও বলছে গোপীনাথ বসুকে সে মাসে পাঁচ লক্ষ টাকা বেতন দিয়েও রাখবে। কথাটা রোজমারি বলল না।
জো বলল, গোপীনাথের কপাল খারাপ।
কেন?
তাকে মরতেই হচ্ছে।
তোমরা মারবে?
আমরা নিমিত্ত মাত্র। ভাড়াটে খুনি পয়সা নিয়ে লাশ নামিয়ে দেয়, ভ্রুক্ষেপও করে না। কিন্তু খুনটা কি সে করে? না রোজমারি। আপাতদৃষ্টিতে খুনিই খুন করে বটে, কিন্তু পিছনে অন্য ছায়া থাকে।
গোপীনাথ বসু এখন কলকাতায় আছে, তুমি ঠিক জানো?
জানি। কালই এসেছে।
ও। কিন্তু তাকে মারবে কেন, আমাদের কারখানার রহস্য সে তো জানে না।
তার কাছে আদ্রেঁর সব কাগজপত্র আছে। গোপীনাথ মস্তিষ্কবান লোক। সে ঠিক ব্যাপারটা ধরে ফেলবে।
তবে তাকেই কেন তোমরা ভাড়া করছ না?
উপায় নেই। সুধাকর দত্ত তার পিছনে আছে।
তার মতলব কী?
সেও আমাদের মতো অ্যালয়ের রহস্য ভেদ করতে চায়।
আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে জো।
গাড়িটা ডানদিকে ঘোরাও রোজমারি।
কোথায় যাচ্ছ জো?
কোথাও না। আমি গলির মধ্যে নেমে যাব।
আর আমি?
তুমি ফিরে যাও। আমার কথা শেষ হয়েছে।
তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে তুমি খুব স্বস্তিতে নেই। ঠিক বলছি জো?
হ্যাঁ। ঠিকই বলছ।
যারা তোমার মতো বিপজ্জনক জীবনযাপন করে তারা স্বস্তিতে থাকে না জো।
তা তো বটেই। কিন্তু আমি যখন সরকারি চাকরি করতাম তখনও বিপজ্জনক ভাবেই বেঁচে ছিলাম রোজমারি। তবে তখন কোনও গ্লানি ছিল না।
এখন আছে?
হ্যাঁ। এখন মাঝে মাঝে মনে হচ্ছে, একটা পিছল পথ দিয়ে হড়হড় করে একটা অন্ধকার গুহায় নেমে যাচ্ছি। ফেরার উপায় নেই।
কেন নেই জো?
এ হচ্ছে এমন একটা সিস্টেম যেখানে একবার ঢুকে পড়লে আর বেরোনো যায় না। অপরাধ সংগঠনগুলি ভাল টাকা দেয় নোজমারি, কিন্তু তার বদলে তারা চায় শতকরা একশোভাগ আনুগত্য এবং মন্ত্রগুপ্তি। তোমার কাছে আজ যে এসব কথা বলে ফেললাম এর শাস্তি কী জানো?
অনুমান করতে পারছি। কিন্তু বললে কেন জো? না বললেই পারতে।
ওইটেই তো বুড়োবয়সের লক্ষণ। আনাকে তো কিছুই বলি না। বললে ওকে বিপদে ফেলা হবে। বড্ড সরল সোজা স্নেহপ্রবণ মেয়ে। কিন্তু তোমার মতো বুদ্ধিমতী এবং স্বনির্ভর নয়। আজও যদি তুমি আমার বউ থাকতে রোজমারি তা হলে হয়তো জীবনে কয়েকটা ভুল সিদ্ধান্ত আমাকে নিতে হত না। পুরুষের জীবনে বউ একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর। আজ তোমাকে যে এসব কথা বললাম তার আর একটা কারণ, তুমি আমার সম্পর্কে জানতে চেয়েছিলে।
রোজমারি একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, কিন্তু এতে বিপদ আছে জানলে জানতে চাইতাম না।
বিপদ আর বিপদ। সারা জীবন তো বিপদের মধ্যেই কাটিয়ে দিলাম। জীবন যে কত ক্ষণস্থায়ী তা সংসারী সুখী মানুষরা জানে না। মরতে মরতে বেঁচে গিয়ে, বারবার মৃত্যুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলতে খেলতে ভয়ডর কেটে গেছে। কিন্তু নিজের জন্য ভয় না পেলেও অন্যদের জন্য ভয় হয়।
সেটা কেমন?
আনার জন্য, বাচ্চাদের জন্য, এই এখন তোমার জন্যও একটা অশান্তি ভোগ করছি। ভাগ্যক্রমে তোমার বিপদ ডেকে এনেছি আমিই। কিন্তু কিছু করার ছিল না। ওদের পরিকল্পনা ছিল, তোমার কারখানা সাবোটাজ করবে। সেটা আমি আটকেছি। এমনকী নিজেই এসেছি, যাতে তোমাকে অন্তত প্রাণে বাঁচানো যায়।
রোজমারি গলির মুখে গাড়িটা দাঁড় করিয়ে শুনছিল চুপ করে। তার হৃদয় দ্রব হয়েছে, চোখ একটু ছলছলে। বলল, আমার জন্য এখনও কি তোমার একটু আবেগ আছে?
আছে রোজমারি।
তা হলে ভিয়েনার কথা তুললে কেন?
তুললাম তোমাকে ভড়কে দেওয়ার জন্য। যাতে আমার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে না পারো।
ভিয়েনায় যা ঘটেছিল তা দুর্ভাগ্যজনক। তার বেশি কিছু নয়।
জো একটু হাসল। মৃদুস্বরে বলল, রোজমারি, আমি কিন্তু গোয়েন্দা। গোয়েন্দাদের চোখ একটু বেশি তীক্ষ্ণ।
কী বলতে চাইছ জো?
জো রোজমারির দিকে একটু চেয়ে থেকে মৃদুস্বরে বলল, তোমার বয়স এখন মধ্য তিরিশ, তবু এখনও কী সুন্দরীই যে আছ।
এসব কথা তুলছ কেন?
আমাদের বিয়ের সময়ে তুমি আরও সুন্দরী ছিলে। আগুনে চেহারা। সেই সময়ে পুরুষ পতঙ্গেরা তোমার দিকে কম আকৃষ্ট হত না। রোজমারি, তুমিও সেটা পছন্দ করতে। শক্তসমর্থ পুরুষদের প্রতি তোমার আকর্ষণ ছিল।
রোজমারি একটু রক্তাভ হয়ে গিয়ে বলল, তুমি কি আমার নৈতিক চরিত্রের পাহারাদার নাকি?
না রোজমারি। তা কেন? তুমি তোমার জীবনকে উপভোগ তো করবেই। কিন্তু গডার্ডকে বেশি প্রশ্রয় দিয়ে তুমি একটু ভুল করেছিলে। আমাদের সদ্য বিয়ে হয়েছে, আমরা মধুচন্দ্রিমায় গেছি, সেই সময়ে একটা জরুরি কাজে ডাক পেয়ে আমি তোমাকে হোটেলে রেখে মাদ্রিদে গিয়েছিলাম। তোমাকে ফোন করে জানিয়েছিলাম ফিরতে আমার দু’দিন দেরি হবে। ঠিক তো?
রোজমারি মুখটা নামিয়ে বলল, হ্যাঁ। কিন্তু তখন আমার খুব একা লেগেছিল।
একা লেগেছিল বলেই কি গডার্ডকে একেবারে শোওয়ার ঘর পর্যন্ত আসতে দিলে?
ওসব পুরনো কথা তুলছ কেন?
কারণ গডার্ডকে খুনের দায়টা আমাকে ঘাড়ে নিতে হয়েছিল রোজমারি।
সেজন্য তোমাকে ধন্যবাদ।
আর সেই ঘটনা থেকেই আমাদের পারস্পরিক অবিশ্বাস ও ছাড়াছাড়িরও সূত্রপাত।
তুমি ব্যাপারটা উপেক্ষা করতে পারতে। যৌবন বয়সে সকলেরই ওরকম ঘটনা ঘটতে পারে। খুব বড় অপরাধ তো নয়।
জো হাসল, দেশটা যদি ভারতবর্ষ হত বা তুমি আমি যদি ভারতীয় হতাম তা হলে কিন্তু ওই ঘটনা মস্ত নৈতিক অপরাধ। সেটা আমি বলছি না। তুমি ভুল করেছিলে, কারণ গডার্ড তোমার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে আমার গোপন তথ্যাবলি হাতানোর চেষ্টা করেছিল।
সেটা আমি জানতাম না।
জানতে না, তাও জানি। কিন্তু ক্ষতি তো হয়েই গিয়েছিল।
তুমি আমাকে খুনের দায় থেকে বাঁচিয়েছিলে বলে আমি যথেষ্ট কৃতজ্ঞ জো।
সেই কৃতজ্ঞতার খানিকটা ঋণ আজ শোধ দাও রোজমারি।
কী চাও জো?
পরশু দিন তোমার কারখানায় আমরা যাব। আমাকে অবাধ প্রবেশ ও পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা করে দাও।
রোজমারি একটু ভাবল, মনোজেরও একটা অনুমতি চাই।
তুমিই সব, আমি জানি। মনোজ তো একটা ভেড়া। শোনো রোজমারি, ব্যবস্থা করতে তোমাকে হবেই। নইলে ঘটনাবলি আমার নিয়ন্ত্রণে থাকবে না।
তুমি কি এখনও আমার শুভাকাঙ্ক্ষী?
শতকরা একশো ভাগ।
কেন জো?
কে জানে কেন। জীবন বড় রহস্যময়, বড় জটিল। মানুষের মন আরও গূঢ়।
২৪.
ক্লান্ত, অন্যমনস্ক, বিষণ্ণ রোজমারি যখন বাড়িতে ফিরল তখন রাত ন’টা। মনোজ ফেরেনি। রোজমারি গরম জলে অনেকক্ষণ গা ডুবিয়ে বসে রইল তার শ্বেতপাথরের বাথটাবে। তারপর ঘরোয়া পোশাকে লিভিং রুমে বসে ওয়াইন খেল অনেকটা। সে সাধারণত উত্তেজক পানীয় খায় না। আজ তার মাথাটা গরম, মনটাও খারাপ।
রাত দশটায় সে খানিকটা সুপ আর এক টুকরো মাংস খেয়ে নিজের শোয়ার ঘরে এসে আধশোয়া হয়ে কিছু কাগজপত্র দেখতে লাগল। অফিসের কিছু জরুরি চিঠিপত্র।
মনোজ ফিরল এগারোটায়। রোজমারি এত রাত অবধি জেগে থাকে না। আজ নিঃশব্দে উঠে বাইরের ঘরে গিয়ে মনোজের ঢোকার মুখে দাঁড়িয়ে বলল, জামাকাপড় ছেড়ে আমার ঘরে এসো। কথা আছে।
মনোজ অবাক হয়ে বলল, কথা!
হ্যাঁ, মাতাল হওনি তো?
আরে না। সামান্য দু’পেগ
তা হলে ঠিক আছে।
মনোজের বেশি সময় লাগল না। মিনিট পনেরোর মাথায় রোজমারির ঘরে ঢুকে একটা চেয়ার টেনে বসল। সামান্য উদ্বেগের সঙ্গে বলল, খারাপ খবর নাকি?
আমি খুব বিশ্বস্ত সূত্রে জানতে পেরেছি গোপীনাথ বসু এখন কলকাতায়।
মনোজ প্রচণ্ড অবাক হয়ে বলল, কলকাতায়। মাই গড! তার তো বেঁচে থাকারই কথা নয়!
কিন্তু সে বেঁচে আছে।
দু’দুটো ইন্টারন্যাশনাল গ্যাং তাকে হন্যে হয়ে খুঁজছিল যে। আটকেও রেখেছিল কারা যেন। ভুল খবর নয় তো!
না, খবরটা যে দিয়েছে সে ভুল খবর দেওয়ার লোক নয়।
কলকাতায় কোথায় আছে গোপীনাথ?
তা জানি না। খোঁজ করলেই জানা যাবে। এখানে তার আত্মীয়স্বজন আছে।
সোনালি বা সুব্রতকে ট্যাপ করব নাকি?
করতে পারো। কিন্তু তাড়াতাড়ি করতে হবে।
কেন বলো তো?
গোপীনাথের বিপদ এখনও কাটেনি। তাকে মারবার জন্য একজন খুনিও কলকাতায় এসেছে।
সর্বনাশ! এসব খবর তোমাকে দিল কে?
দিয়েছে একজন। এখন আমি জানতে চাই গোপীনাথকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানোর জন্য আমরা কী করতে পারি।
মনোজ একটু ভাবল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, পুলিশ প্রোটেকশন ছাড়া আর কিছুই বোধহয় পারি না।
পুলিশকে মোবিলাইজ করা সহজ কাজ নয়। অন্য কিছু ভাবো।
ভাববার সময় কি আছে রোজমারি?
বুঝতে পারছি না। তবে অনুমান করছি গোপীনাথকে প্রোটেকশন দিচ্ছে সুধাকর দত্ত।
সে কে? সেই ইন্টারপোল এজেন্ট নাকি?
সে আসলে কে জানি না। তবে সেই লোকটাই।
তা হলে আমরা তাকে অতিরিক্ত কী সিকিউরিটি দিতে পারি? ইন্টারপোলই তো তাকে পাহারা দিচ্ছে।
রোজমারি বিরক্ত হয়ে ভ্রু কোঁচকাল, বলল, তুমি তো বোকা নও।
এ কথায় অপ্রস্তুত হয়ে মনোজ বলল, কী বলতে চাইছ?
গোপীনাথ বসুকে আমাদের দরকার, ঠিক তো?
হ্যাঁ, ভীষণ দরকার।
তাকে সকলেরই দরকার। সাক্কি তাকে খুঁজছে, ভিকিজ মব তাকে খুঁজছে, আরও লোক তাকে মারার জন্য বা ধরার জন্য ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের এখন তার পাশে দাঁড়াতে হবে বন্ধুর মতো। ইন্টরপোল তার বন্ধু হলেও তাকে দিয়ে কাজ করাতে পারবে না। আমরা পারব।
কিন্তু সিকিউরিটির ব্যবস্থা করা যাবে কী করে? আমাদের তো ওসব অভিজ্ঞতা নেই। তাকে রাখব কোথায়? পাহারা দেব কীভাবে? সবচেয়ে বড় কথা গোপীনাথ আমাদের বিশ্বাস করবে কেন?
রোজমারি মুখখানা কঠিন করে বলল, মনোজ, তোমাকে নিয়ে মুশকিল কী জানো? তুমি ঠান্ডা মাথায় যুক্তিনির্ভর পরম্পরায় কিছু ভাবতে পারো না।
ওকথা কেন বলছ?
তুমি সুব্রতর কথা ভুলে যাচ্ছ কেন?
সুব্রত! ও হ্যাঁ, সুব্রত গোপীনাথের বন্ধু বটে।
খুব রিলায়েবল বন্ধু। তুমি সুব্রতকে ম্যানুপুলেট করতে না পারলে আমি করব।
লজ্জিত মনোজ বলল, সুব্রতর কথা আমার মনে ছিল না।
আরও একজনকে ভুলে যাচ্ছ।
কে বলল তো!
সোনালি।
সোনালি! সে তো গোপীনাথের প্রসঙ্গই সহ্য করতে পারে না।
হতে পারে। কিন্তু গোপীনাথের বিপদ শুনলে সে হয়তো তাকে রক্ষা করার ব্যাপারে আমাদের সাহায্য করবে।
সবই তো বুঝলাম, কিন্তু গোপীনাথের পিছনে যেরকম ষণ্ডাগুন্ডা লেগেছে তাতে তাকে বাঁচানোর দায়িত্ব নিতে পারি না।
আমি পারি।
কীভাবে পারো?
সেটা তোমাকে এখন বলতে পারছি না। তবে ব্যবস্থা করা যাবে। শু
নেছি মাফিয়ারা ভয়ংকর লোক। সহজে রেহাই দেয় না।
তুমি এখন ঘুমোও গে। কাল সকালে আমাদের এ ব্যাপারে কাজে লাগতে হবে।
মনোজ চলে গেলে রোজমারি ফোন তুলে নিল।
ফোন চারবার বাজবার পর একট ভারী গলা বলল, লুলু হিয়ার।
রোজমারি জার্মান ভাষায় বলল, আমি রোজমারি।
বলো রোজমারি।
একটা কাজ আছে।
কাজ ছাড়া এত রাতে আমাকে তোমার মনে পড়ার কথা নয়।
কাজ ছাড়াও আমি তোমাকে প্রশ্রয় দিই। দিই না?
রোজমারি, আজ রাতে তোমাকে একটা প্রস্তাব দেব?
কী প্রস্তাব।
কাজ ছাড়ো, ব্যাবসায় গুলি মারো, স্বামীটাকে ভুলে যাও, তারপর চলো হাওয়াই দ্বীপে পাকাপাকি বাস করি দু’জনে। সেখানে আমার বাড়ি আছে।
সব জানি লুলু, তোমার মতো ফুর্তির জীবন কাটাতে আমার রুচি হয় না।
কাজ আর কাজের টেনশনে তুমি শুকিয়ে যাচ্ছ রোজমারি।
তাই কী? মাঝে মাঝে সিঙ্গাপুরেও তো যাচ্ছি তোমার সঙ্গে।
সিঙ্গাপুরটা কোনও জায়গা নয়। হাওয়াই হল সেই জায়গা যাকে মর্তের স্বর্গ বললে ভুল হয় না। ঠিক কি না?
নিষ্কর্মাদের স্বর্গ। কাজের লোকের স্বর্গ অন্যরকম।
তা অবশ্য ঠিক। কাজের লোকদের প্রিয় হল তেলকালির গন্ধ, মেশিনের শব্দ, শ্রমিক আন্দোলন আর টেনশন, ওটাই কি স্বর্গ?
ঠিক তাই।
জীবনটা এভাবে নষ্ট করবে রোজমারি?
নষ্ট হচ্ছে না।
হচ্ছে। ওই মনোজ ক্যাবলাকেই বা তুমি কীভাবে সহ্য করো?
মনোজ ভাল লোক। সৎ, পরিশ্রমী, মস্তিষ্কবান।
শেষ কথাটা কী বললে? মস্তিষ্কবান! হাঃ হাঃ
মনোজ প্রতিভাবান। নিজের কাজটা ভালই বোঝে।
সেটা হতে পারে। মেটালার্জি বুঝলেই কি আর মস্তিষ্কবান হওয়া যায়? তুমি তো ওকে ভালওবাসো না রোজমারি!
নাই বা বাসলাম। আমরা ক’টা মানুষ এ জীবনে সত্যিকারের কাউকে ভালবাসতে পারি বলো তো! হয়তো একজনকেও নয়। কিন্তু তবু কিছু লোকের সঙ্গে পার্টনারশিপে আসতেই হয়। বিবাহিত জীবনও তো একটা করপোরেশন। একটা কোম্পানি পার্টনারশিপ।
ব্যাবসা ছাড়া তুমি কিছু বোঝো না?
তুমি যেমন ফুর্তি ছাড়া কিছু বুঝতে চাও না।
ডার্লিং রোজমারি, আমার বাবা ব্যাবসা করত জানোত।
জানিই তো।
আমার বাবা কত কোটি টাকা করে গেছে তাও তো জানো।
জানি।
আমি মন দিয়ে ব্যাবসা করলে টাকাটা দ্বিগুণ বা দশগুণ হবে।
এবং তুমি সেটা চাও না তাও জানি।
কেন চাই না তাও তোমাকে বলেছি। ওই টাকা ডবল করতে গিয়ে একদিন দেখব আয়ুটাই ফুড়ুত হয়ে গেছে, দুনিয়া হয়ে গেছে ফ্যাকাশে, মন গেছে মরে।
তাও বলেছ, তোমার জীবনদর্শন আমি মানিনি।
মানলে ভাল করতে। আমার বাবা শেষ জীবনে বুড়ো শকুনের মতো হয়ে গিয়েছিলেন। বড়বাজারের গদিতে হাঁটু উঁচু করে বসে দুই হাঁটুর ফাঁক দিয়ে মুন্ডু বের করে জুলজুল করে চেয়ে থাকতেন। আমার এত হাসি পেত।
এতে হাসি পাওয়ার কী আছে?
দৃশ্যটা দেখলে তোমারও পেত। মানুষের শকুনাকৃতি কতটা নিখুঁত হতে পারে তা দৃশ্যটা দেখলে তুমি আন্দাজও করতে পারবে না। সেই দৃশ্যটাই আমাকে শিখিয়ে দিল, ও জীবন আমার হবে না কখনও।
লুলু, এবার কাজের কথায় এসো।
এগুলো কাজের কথা, রোজমারি। এদেশ আমার ভাল লাগে না, তোমারও ভাল লাগার কথা নয়।
লাগে না।
তা হলে পড়ে আছ কেন?
আমার কারখানা?
বেচে দাও। আমি খদ্দের ঠিক করে দিচ্ছি। না হলে ওই ভেড়া মনোজকে গছিয়ে দিয়ে চলো কেটে পড়ি। হাওয়াই।
লুলু, তোমার অনেক মেয়ে-বন্ধু, আমি জানি।
রোজমারি, নিষ্ঠুর হয়ো না। মেয়ে-বন্ধু থাকা কি দোষের?
তা বলি না। কিন্তু এত সুন্দরী থাকতে আমাকেই বা কেন দরকার হয় তোমার বলো তো!
এর কি কোনও জবাব হয়? আমার বাবা বিয়ে করেছিল একজন সুইডিশ মহিলাকে। তিনি আমার জন্ম দেওয়ার এক বছরের মধ্যে কেটে পড়েন। বাবা আমাকে গভর্নেসের হাতে ফেলে দিয়ে ব্যাবসায় ঝাঁপিয়ে পড়লেন, যেন ওটাই তাঁর স্ত্রীর ওপর প্রতিশোধ। স্কুলে পড়াতে তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন লন্ডন। তারপর ব্যাবসা শিখতে আমেরিকা। আমি শিখলাম অনেক, কিন্তু কোনওটারই স্বাদ পেলাম না। আমার মা চলে যাওয়ার পর আমার বাবা নারী-হীন একটা জীবন কাটিয়েছিলেন। বোধহয় প্রকৃতি সেই প্রতিশোধটা আমার ওপর দিয়ে তুলছে। আমার জীবনে অনেক নারী। তবু তুমি আলাদা রোজমারি। তুমি অন্যরকম।
আমি কি এখনও আকর্ষণীয়া?
বটেই তো।
আজ আরও একজন একথা বলেছে।
সে কে? আমার প্রতিদ্বন্দ্বী?
না, তার নাম জো। জোসেফ ক্লাইন।
ঈশ্বর! সে তোমার প্রাক্তন স্বামী!
হ্যাঁ, তার সঙ্গে আজ দেখা হয়েছিল।
কী চায় সে?
আমাকে চায় না। তবে অন্য কিছু চায়। আর সেজন্যই তোমাকে এত রাতে বিরক্ত করা।
বিরক্ত নই। বলো।
ঘরে কেউ আছে?
লুলু একটু হাসল, আছেও বটে, নেইও বটে।
তার মানে আছে।
আছে। তবে মেয়েটা বুরবক। কোনও ভয় নেই, বলল। জার্মান সে জন্মেও শোনেনি। হ করে আমার দিকে চেয়ে আছে।
শোনো লুলু। আমার একজন অতিথি আসছে। তাকে একটু ভালরকম প্রোটেকশন দিতে হবে।
কে অতিথি।
আছে একজন।
বিশেষ কেউ?
খুব বিশেষ।
কী ধরনের প্রোটেকশন?
ফুল প্রুফ।
তার কি জীবন সংশয়?
হ্যাঁ। তার পিছনে তিনটে ইন্টারন্যাশনাল গুন্ডার দল লেগে আছে।
ঈশ্বর! সে এখন কোথায়?
কলকাতায়।
নাম-ঠিকানা বলল।
নাম গোপীনাথ বসু। ঠিকানাটা কাল দেব।
লুলু হঠাৎ একটু চুপ করে গেল। তারপর বলল, ঠিক আছে।
পারবে?
পারতেই হবে। তোমার হুকুম।
আমরা তোমার ফি দেব। কিন্তু তোমাকে গ্যারান্টি দিতে হবে।
মানুষ কোনও গ্যারান্টি দিতে পারে না, রোজমারি। তবে আমি যথাসাধ্য করব।
তা হলেই হবে। তোমার ওপর আমার অনেক নির্ভরতা।
ধন্যবাদ রোজমারি। ঠিকানাটা কখন পাব?
কাল বেলা বারোটা নাগাদ। ঠিকানাটা ট্রেস করতে হবে।
ঠিক আছে। আমি অপেক্ষা করব।
ফোনটা রেখে রোজমারি বাতি নেভাল। কিন্তু অনেকক্ষণ তার ঘুম এল না। গোপীনাথকে কাল থেকে হয়তো নিরাপত্তা দেওয়া যাবে, কিন্তু আজ রাতে সে কতটা নিরাপদ? তার চেয়েও বড় কথা, গোপীনাথকে শুধু নিরাপত্তা দিলেই হবে না, সুধাকর দত্তর থাবা থেকে ওকে বের করতে আনতে হবে। সুধাকর দত্ত নামটা মনে হলেই রোজমারি শক্ত হয়ে যায়। ওরকম ঠান্ডা মাথার রোবট-মানুষ সে আগে কখনও দেখেনি।
রোজমারি দুটো ট্রাঙ্কুলাইজার খেয়ে আবার শুল। ধীরে ধীরে ঘুমিয়ে পড়ল।
.
রাত দুটো অবধি জেগে গোপীনাথ তার কম্পিউটারের হার্ড ডিস্কে যাবতীয় তথ্যাবলি ভরে ফেলছিল। গত তিনদিন ধরে একটানা কাজ। এ সবই পেপার ওয়ার্ক। এতে কাজ ততটা হবে যতক্ষণ না হাতেকলমে করা যায়।
আদ্রেঁর কাগজপত্রের মধ্যে সে বারবার একটা ব্যক্তিগত ডায়েরির উল্লেখ পাচ্ছে। আদ্রেঁ হয়তো ডায়েরি রাখত। কিন্তু ডায়েরিটা কোথায় তা জানে না সে। সেই ডায়েরিতে কি আদ্রেঁ কিছু গুরুত্বপূর্ণ জিনিস লিখে রেখে গেছে? চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত বা সমাধান?
রাত দুটোয় হেলানো চেয়ারে বসে গোপীনাথ চোখ বুজে ভাবতে লাগল। যতদূর মনে পড়ে, আরে ডায়েরি লেখার অভ্যাস ছিল না, অবকাশও পেত না। উদয়াস্ত পড়ে থাকত সাক্কির অফিসে নিজের ঘরখানায়। কাজ আর কাজ। তবু ডায়েরির উল্লেখ যখন আছে তখন সেখানে কিছু থাকবেই। কিন্তু সে ডায়েরি কোথায় কে বলবে?
গোপীনাথ চুপ করে বসে ভাবছিল। ভাবতে ভাবতে তার একটু ঝিমুনি এল।
ঝিমোতে ঝিমোতে যখন বড় ঘুম এসে যাচ্ছিল প্রায়, তখনই সে হঠাৎ চমকে উঠল। মৃদু, খুব মৃদু একটা শব্দ হল না? কেউ যেন সন্তর্পণে লিফটের দরজা খুলল এবং বন্ধ করল?
সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা গোপীনাথকে অনেক সতর্ক ও তৎপর করেছে। সে টপ করে উঠল পড়ল এবং দ্রুত পায়ে দরজার স্পাই হোলে গিয়ে চোখ লাগাল।
বাইরের ল্যান্ডিং-এ আলো জ্বলছে না। কেন জ্বলছে না? কেউ কি আলো নিভিয়ে দিল?
গোপীনাথও নিজের ঘরের আলো নিভিয়ে দিল। দরজা লক করা আছে। বিপদ এলেও সময় পাবে গোপীনাথ।
সে রান্নাঘরে গিয়ে একটা বড় মাংস-কাটা ছুরি তুলে নিয়ে এল। আগ্নেয়াস্ত্রের সামনে এটা কোনও প্রতিরোধ নয়, সে জানে। তবু মরার আগে একটা চেষ্টা করা যাবে। ঘটনাটা একতরফা ঘটতে দেওয়া যায় না।
স্পাই হোলে চোখ রাখল গোপীনাথ। ল্যান্ডিং অন্ধকার। কিন্তু সেই অন্ধকার যেন অনেক ঘটনার সম্ভাবনায় ভরা।
২৫.
গোপীনাথ বিপজ্জনক জীবন কখনও যাপন করেনি। তার জীবন গবেষণা আর লেখাপড়া নিয়ে। সেখানে মারদাঙ্গা, বিপদআপদ ইত্যাদির উকিঝুঁকি নেই। অন্তত এতকাল ছিল না। এই পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একটু নতুন অ্যাডজাস্টমেন্ট প্রয়োজন। গোপীনাথ ভীত নয় তেমন, কিন্তু উদ্বিগ্ন। কারণ রণকৌশল তার জানা নেই।
স্পাই হোল-এ চোখ রেখে ল্যান্ডিং-এর অন্ধকারে কিছুই দেখতে না পেয়ে সে একটু ভাবল। পৃথিবীর যে-কোনও দরজাই ভঙ্গুর। অভেদ্য দরজা বলে কিছু নেই। সেই দরজাই সবচেয়ে মজবুত যা ভাঙতে বা খুলতে সবচেয়ে বেশি সময় লাগে। ফ্ল্যাটের দরজাটা সাধারণ। এর লক-ও কিছু ভল্টের মতো নয়। কোনও আততায়ী এসে থাকলে এবং সেই আততায়ী প্রশিক্ষিত হয়ে থাকলে দরজাটা ভেদ করতে দশ মিনিটের বেশি লাগবে না। আজকাল প্লাস্টিক চার্জও পাওয়া যায়। প্রায় নীরব বিস্ফোরণে যে-কোনও তালা উড়িয়ে দেওয়া যায় চোখের পলকে।
গোপীনাথ একটু ভেবে একটা অদ্ভুত সিদ্ধান্ত নিল। সে খুব সন্তর্পণে দরজার লকটা খুলে ল্যাচ ঘুরিয়ে একটু ফাঁক করে দিল পাল্লাটা। তারপর নিঃশব্দে ঘরের অন্যপ্রান্তে গিয়ে স্টিলের আলমারিটার পাশে দাঁড়াল। যে-ই এসে থাকুক দরজাটা খোলা দেখে খুবই অবাক হবে এবং একটু ঘাবড়েও যেতে পারে। গোপীনাথের ডান হাতে ধরা ছুরি। চোখ ঈগলের মতো দরজায় নিবদ্ধ।
প্রথমটায় অনেকক্ষণ কিছুই ঘটল না। ঘরের বাতি নেভানো থাকলেও কাঁচের শার্সি দিয়ে নাগরিক আলোর আভা আসছে। তাতে ঘরটা ভালই দেখা যাচ্ছে, একটু আবছা এই যা।
মিনিট পাঁচেক অপেক্ষা করার পর দরজার পাল্লাটা খুব ধীরে ধীরে ফাঁক হতে লাগল।
প্রায় মিলিমিটারের মাপে। একটা জোরালো টর্চের আলো ঘরটাকে যেন চমকে দিল হঠাৎ। তলোয়ারের মতো এদিক আর ওদিকে দু’-তিনবার চালিত হয়ে অন্ধকারকে যেন ফালা ফালা করে ফেলল।
ঘরে ঢুকল দু’জন। সামনে একজন, দু’পা পিছনে আর-একজন। একটু কুঁজো হয়ে, সতর্ক পায়ে।
গোপীনাথের মনে হল, এবার একটু ডাইভারশন দরকার। সে ছোরাটা তুলল। ভাবল ঘরের অন্য প্রান্তে ছুঁড়ে মারবে, যাতে শব্দ শুনে খুনিরা ওই দিকে যায়। ছোরাটা তুলেও হঠাৎ থেমে গেল সে। বোধহয় ভুল করবে সে এ কাজ করলে। বরং অপেক্ষা করা যাক।
দু’জনের একজন টর্চটা চারদিকে নিক্ষেপ করল। কিন্তু গোপীনাথ আলমারির আড়ালে থাকায় তাকে দেখতে পেল না।
ঘরটা পেরিয়ে শোয়ার ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে ফের টর্চ জ্বালল লোকটা। তারপর চাপা গলায় বলল, ব্যাপারটা কী?
অন্য জন বলল, কী?
মালটি তো নেই দেখছি।
বাথরুমটা দেখ।
আরে দূর, সদর দরজা খোলা ছিল না?
তা ছিল।
শালা ভেগেছে।
তবু খুঁজে দেখা যাক।
দু’জনে ঘরে ঢুকে গেল।
কয়েক সেকেন্ড অপেক্ষা করে গোপীনাথ নিঃশব্দে দ্রুতগতিতে ফ্ল্যাটের বাইরে বেরিয়ে এল। সিঁড়িতে ওপরের দিকে মাঝামাঝি উঠে ল্যান্ডিং-এ দাঁড়িয়ে নীচে চেয়ে রইল।
পাঁচ-দশ মিনিট বাদে লোকদুটো বেরিয়ে এল। চারদিকে টর্চটা বারকয়েক ঘুরিয়ে দেখল। তারপর লিফটে উঠে চলে গেল।
দরজাটা খোলাই রেখে গেছে ওরা। গোপীনাথ এসে ফ্ল্যাটে ঢুকে দরজাটা ফের লক করে আলো জ্বালল। শোয়ার ঘরে এসে দেখল তার সুটকেস হাতড়ানো, মানিব্যাগটা টেবিলের ওপর থেকে হাওয়া, একটা ক্যালকুলেটর, একটা ওয়াকম্যান ইত্যাদি রাখা ছিল বিছানার পাশের টেবিলে। সেগুলো নেই। প্রাণের চেয়ে অবশ্যই এগুলোর দাম বেশি নয়।
কিন্তু সে কতটা নিরাপদ তা গোপীনাথ বুঝতে পারছে না। ওরা কি ফিরে আসবে? এলে কখন, বা কবে? ওদের উদ্দেশ্যই বা কী?
কিছু জিনিস চুরি করলেও ওরা কম্পিউটারটা স্পর্শও করেনি। তাতেই বোঝা যায় ওরা গোপীনাথের গবেষণায় আগ্রহী নয়। সুতরাং খুন ছাড়া আর কী-ই বা হতে পারে।
গোপীনাথ ফ্রিজের ঠান্ডা জল খেল খানিকটা। তারপর ঘরের বাতি নিভিয়ে দরজার মুখোমুখি একটা চেয়ারে বসে রইল। ডান হাতে ছুরিটা, যেটা কোনও কাজে লাগেনি। লাগবেও না বোধহয়। তবে গোপীনাথকে হয়তো এক চিমটি আত্মবিশ্বাস ছুরিটা দিচ্ছে।
বাকি রাতটা কোনও উৎপাত হল না। ভোরের দিকে গোপীনাথ একটু তন্দ্রাচ্ছন্নও হয়ে পড়েছিল। তবু সূর্যোদয়ের আগেই সে উঠল এবং নীচে নামল। ফ্ল্যাটবাড়ির দারোয়ানদের সঙ্গে কথা বলা দরকার।
রাত-ডিউটি যার ছিল সে ফটক খুলে একটা টুলের ওপর বসে হাই তুলছিল।
গোপীনাথ তাকে জিজ্ঞেস করল, রাতে আপনার ডিউটি ছিল?
লোকটা উঠে দাঁড়িয়ে সসম্ভ্রমে বলল, জি।
কাল অনেক রাতে দুটো নাগাদ দু’জন লোক এ বাড়িতে ঢুকেছিল কি?
লোকটা একটু ভেবে বলল, বাবুলোগ তো অনেকেই বেশি রাতে ফেরেন।
এ দু’জন বাইরের লোক।
লোকটা আরও একটু ভেবে বলল, হ্যাঁ, এসেছিল।
কার কাছে যেতে চেয়েছিল।
চারতলার থ্রি ডি ফ্ল্যাটে।
আপনারা কি না জেনেই ছেড়ে দেন?
না, ফোন করতে হয়।
ফোন করেছিলেন?
করেছিলাম।
থ্রি ডি ফ্ল্যাট থেকে কেউ কিছু বলেছিল?
দারোয়ান লোকটা এই জেরায় ভয় পেয়ে গিয়ে বলল, কিছু গড়বড় হয়েছে কি সাহেব?
সেটা পরে বলছি। আগে আমার কথার জবাব দিন। থ্রি
ডি ফ্ল্যাটে মল্লিকজি থাকেন। খুব ড্রিঙ্ক করেন। ওঁর ঘরে বহোৎ আড্ডা হয়। খানাপিনা হয়। কাল রাতেও পার্টি ছিল। আমি ফোন করতেই মল্লিকজির ঘর থেকে কে একজন বলল, পাঠিয়ে দাও। আরও দুটো পাপী এসেছে।
আপনি তাই ছেড়ে দিলেন?
জি।
লোক দুটোকে চলে যেতে দেখেছেন?
হ্যাঁ। এক ঘণ্টা পরে তারা চলে যায়।
ঠিক আছে। মল্লিকবাবুর ফ্ল্যাটে কে কে থাকে?
মল্লিকবাবু একাই থাকতেন। আজকাল একজন লেডিও থাকেন।
ওঁর কে হন উনি?
তা জানি না।
ওঁর স্ত্রী নেই?
ডিভোর্স করেছেন।
ও
গোপীনাথ আর কথা বাড়াল। লিফটে চারতলায় উঠে এল। থ্রি ডি ফ্ল্যাটের ডোরবেলটা বেশ কয়েকবার বাজাতে হল তাকে।
দরজা খুললেন একজন মহিলা। নাইটি পরা, চোখে ঘুম, মুখে বিরক্তি।
কী চাই? বেশ ঝাঝালো গলা।
গোপীনাথ ভদ্রমহিলাকে কয়েক সেকেন্ডে জরিপ করে নিল। বয়স মধ্য ত্রিশ। একসময়ে বেশ সুন্দরী ছিলেন। রং টকটকে ফরসা, মুখশ্রী চমৎকার। শুধু অনভিপ্রেত কিছু চর্বি শরীরকে অনেকটাই বেঢপ করে দিয়েছে।
আমি এই ফ্ল্যাটবাড়িতেই থাকি। ওপরে। আমি একটা কথা জানতে এলাম।
ভদ্রমহিলা চোখ কুঁচকে বললেন, কী কথা?
রাত দুটোর সময় আপনাদের ফ্ল্যাটে কোনও গেস্ট এসেছিল কি?
মনে নেই।
প্লিজ, একটু ভেবে বলুন। দেয়ার কুড হ্যাভ বিন এ মার্ডার।
ভদ্রমহিলা হঠাৎ বিস্ফারিত চোখে বললেন, মার্ডার! কে মার্ডার হল?
হয়নি। হতে পারত। রাত দুটো নাগাদ দু’জন লোক এসে এ বাড়িতে ঢুকেছিল। তারা আপনাদের ফ্ল্যাটে আসতে চেয়েছিল। আপনাদের ঘর থেকে কেউ তাদের ওপরে পাঠিয়ে দিতে বলে।
ভদ্রমহিলা বড় বড় চোখে চেয়েই ছিলেন। বললেন, তারা দু’জন তো আসেনি।
সেটাই স্বাভাবিক। তারা আমার ফ্ল্যাটে হানা দিয়েছিল।
সর্বনাশ! কেন?
বোধহয় উদ্দেশ্য ছিল আমাকে খুন করা।
ভদ্রমহিলা ঘরের দরজাটা আরও খুলে দিয়ে দু’পা পিছিয়ে গিয়ে বললেন, আপনি ভিতরে আসুন, প্লিজ।
গোপীনাথ মৃদু হেসে বলল, না, সেটা আপনাদের ডিস্টার্ব করা হবে। পার্টির পরের সকালটা বিশ্রামই নেয় লোকে।
ওঃ, পার্টি আমাদের রোজই হয়। আসুন, ভাল করে শুনি
গোপীনাথ ভিতরে ঢুকল। সব ফ্ল্যাটই প্রায় একরকম। বিশাল হলঘর, মুখোমুখি শোয়ার ঘর, ডান ধারে রান্নাঘর। এদের ফ্ল্যাটটা অবশ্য খুবই মহার্ঘ আসবাবে সাজানো। কালো টাকার গন্ধ আসছে। সামনের ঘরটা ভুক্তাবশেষ বা বোতল-গেলাসে অগোছালো হবে বলে আশঙ্কা ছিল তার। দেখল, সবই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং গোছানো। পার্টির রেশ নেই। তবে লম্বা সোফায় একজন উপুড় হয়ে পড়ে ঘুমোচ্ছে।
ভদ্রমহিলা বললেন, ডোন্ট মাইন্ড হিম। বসুন।
গোপীনাথ একটু অস্বস্তি নিয়ে বসল।
একটু কফি খাবেন?
না, ঝামেলার দরকার নেই।
ঝামেলা হবে কেন? আমাদের কাজের লোক আছে। এক মিনিট লাগবে। জাস্ট রিল্যাক্স।
ভদ্রমহিলা কফির কথা বলতে গেলেন। এসেই মুখোমুখি বসে বললেন, এবার একটু বলুন তো, কী হয়েছে।
গোপীনাথ সবটা বলল না। রেখেঢেকে বলল। কাল রাতে তার ফ্ল্যাটে ঢোকার চেষ্টা করেছিল দুটো লোক। শেষ অবধি পারেনি, ইত্যাদি।
ভদ্রমহিলা বিস্ফারিত চোখে সব শুনে বললেন, আজকাল কলকাতার ফ্ল্যাটবাড়িগুলোতে এসব খুব হচ্ছে। আমি তো সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকি।
কফির ট্রে ঠেলে নিয়ে এল উর্দিপরা একটা লোক। ঠাটবাট এদের ভালই।
গোপীনাথ কালো কফি পছন্দ করে। এক কাপ ঢেলে নিয়ে চুমুক দিয়ে বলল, ডিস্টার্ব করলাম বলে দুঃখিত।
কিছু ডিস্টার্ব করেননি। আমাকে সকালে উঠতেই হয়। ন’টায় আমার অফিস। আপনি কোথায় কাজ করেন?
গোপীনাথ আনমনে বলল, সাক্কি ইনকরপোরেটেডে।
ভদ্রমহিলা একটু অবাক হয়ে বললেন, সাক্কি? সেই বিখ্যাত সাক্কি কি? কিন্তু তার তো কোনও অফিস এখানে নেই।
না। আমি কাজ করি রোমে।
রোম! ওঃ, আপনি তা হলে এনআরআই?
হ্যাঁ। অনেকদিন।
ভদ্রমহিলা গুছিয়ে বসে বললেন, রোম চমৎকার শহর, না?
হ্যাঁ। ভালই।
আমি দু’বার গেছি।
তাই বুঝি।
আমিও এনআরআই। আমেরিকায় ছিলাম। বছর পাঁচেক চলে এসেছি। ডিভোর্সও হয়ে গেল।
গোপীনাথ বলল, স্যাড।
না আমার কোনও দুঃখ নেই। বেশ আছি। ফ্রি।
তাও বটে। আমি এবার উঠি? আপনি তো অফিসে যাবেন।
হ্যাঁ। এনি ওয়ে, মাঝে মাঝে আসবেন। আমি মানুষ ভালবাসি। এই ফ্ল্যাটে সপ্তাহে দু’দিন পার্টি থাকেই।
গোপীনাথ হাসে, আর বাকি পাঁচ দিন?
পাঁচ দিন আমরা অন্যদের পার্টিতে যাই।
ভদ্রমহিলাও হাসলেন। তারপর ফের বললেন, পার্টিই বাঁচিয়ে রেখেছে, জানেন! একা হলে হাঁফ ধরে যায়।
পার্টির নেশা যে সাংঘাতিক তা গোপীনাথ জানে। বিশেষ করে একা মানুষদের কাছে পার্টি একটা পালানোর জায়গা। একটা আশ্রয়। নিঃসঙ্গতাকে ভুলে থাকবার উপায়।
মাঝে মাঝে আসবেন। কাম নেক্সট স্যাটার ডে।
পার্টি?
হ্যাঁ। প্লিজ।
চেষ্টা করব।
কাম উইথ ইয়োর ওয়াইফ।
সেটা সম্ভব নয়।
ও মা, কেন? উনি বুঝি কনজারভেটিভ?
না। আমরা ডিভোর্স করেছি।
ওঃ, সরি। তা হলে একাই আসবেন।
গোপীনাথ বিদায় নিয়ে চলে এল। এসেই ফোন করল সুব্রতকে।
ঘুম ভেঙেছে?
হ্যাঁ গোপীদা। কী খবর?
খবর ভাল নয়।
কী হয়েছে?
বডিগার্ড দরকার হবে কি না বুঝতে পারছি না।
কেন, কী হল আবার?
আজ একবার আসতে পারবি?
আরে, আজ তো আপনার ওখানে যাওয়ারই প্রোগ্রাম আমার, ভুলে গেছেন?
ওঃ, হ্যাঁ, আজ শনিবার, না?
হ্যাঁ। আজ আমার ছুটি।
তা হলে চলে আয়।
যাচ্ছি। একটু তৈরি হয়ে নিই।
গোপীনাথ ফোন রেখে দিল। ঘণ্টাখানেক বাদে হঠাৎ আবার সুব্রতর ফোন, গোপীদা, আমাদের বস রোজমারি আমাকে ফোন করে আপনার ঠিকানা চাইছে।
কেন?
তা জানি না। বলছে জরুরি দরকার। দেব? না। কিছুতেই না।