যুলুম অত্যাচার নির্যাতনের কালো মেঘের সেই গম্ভীর পরিবেশে আলোর একটি ঝলক ছিলো হযরত ওমর (রা) এর ইসলাম গ্রহণের ঘটনা। হযরত হামযা (রা) এর ইসলাম গ্রহণের তিনদিন পর নবুয়্যতের ষষ্ঠ বছরের জিলহজ্ব মাসেই এ ঘটনা ঘটেছিল। রসুলুল্লাহ (সা) তাঁর ইসলাম গ্রহণের জন্য দোআ করেছিলেন।
ইমাম তিরমিযি হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর (রা) হতে বর্ণনা করেছে এ ঢ়টনাকে সহীহ বলে আখ্যায়িত করেছেন। ইমাম তিবরানি হযরত ইবনে মাসউদ এবং হযরত আনাস (রা) থেকে এ ঘটনা বর্ণনা করেন।
নবী করিম (সা) দোআ করেছিলেন, হে আল্লাহ, ওমর ইবনে খাত্তাব এবং আবু জাহেলের মধ্যে তোমার কাছে যে ব্যক্তি বেশী পছন্দনীয়, তাকে ইসলাম গ্রহণের সুযোগ দাও এবং তার দ্বারা ইসলামের শক্তি বৃদ্ধি করো।
আল্লাহ তাআলা এ দোআ কবুল করেন এবং হযরত ওমর ইসলাম গ্রহণ করেন। উল্লেখিত দু’জনের মধ্যে আল্লাহর কাছে হযরত ওমর (রা) ছিলেন অধিক প্রিয়।
হযরত ওমর (রা) এর ইসলাম গ্রহন সম্পর্কিত সকল বর্ণনার উপর দৃষ্টি নিক্ষেপ বিচারে প্রমাণিত হয় যে, তাঁর মনে পর্যাক্রমে ইসলাম জায়গা করে নিয়েছিলো। সে বিষয়ে আলোকপাত করার আগে হযরত ওমর (রা) এর মন-মেজাজ ধ্যান-ধারনার প্রতি সংক্ষিপ্ত ইঙ্গিত দেয়া জরুরী মনে করছি।
হযরত ওমর (রা) তাঁর রুক্ষ মেজাজ এবং কঠোর স্বভাবের জন্য পরিচিত ছিলেন। দীর্ঘকাল যাবত মুসলমানরা তাঁর হাতে নানাভাবে নির্যাতন ভোগ করেন। মনে হয়, তাঁর মধ্যে বিপরীতধর্মী স্বভাবের সমন্বয় সাধিত হয়েছিলো। একিদকে তিনি নিজের পিতা-পিতামহের আবিস্কৃত রুসম-রেওয়াজের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন, খেলা-ধুলার প্রতিও তাঁর যথেষ্ঠ আগ্রহ ছিলো, অন্যদিকে ঈমান-আকিদার প্রতি মুসলমানদের দৃঢ়তা এবং অত্যাচার নির্যাতনের মুখেও মুসলমানদের ধৈর্য্য সহিষ্ণৃতা তিনি আগ্রহের দৃষ্টিতে দেখতেন। বুদ্ধি বিবেচনার মাধ্যমে তিনি মাঝে মাঝে ভাবতেন যে, ইসলাম ধর্মে যে বিষয়ে দাওয়াত দেয়া হচ্ছে সম্ভবত সেটাই সত্যি, অধিক পবিত্র, ও উন্নত। এ কারণে হঠাৎ ক্ষেপে গেলেও হঠাৎ শান্ত হয়ে যেতেন।
হযরত ওমর (রা) এর ইসলাম গ্রহন সম্পর্কিত সকল বর্ণনার মূলকথা নিম্ন রুপ।
একবার হযরেত ওমরকে ঘরের বাইরে দিন কাটাতে হয়েছিলো। তিনি হারেম শরীফে গমণ করেন এবং ক্বাবা ঘরের পর্দার ভিতরে প্রবেশ করেন। সবী করিম (সা) সে সময় নামাজ আদায় করছিলেন। তিনি সূরা আল হাক্কা তেলওয়াত করছিলেন। হযরত ওমর (রা) কোরআন শুনতে লাগলনে এবং কোরআনের রচরাশৈলীতে মুগ্ধ ও অভিভূত হলেন। মনে মনে বললেন, এই ব্যক্তি দেখছি কবি, কোরাইশদের কথাই ঠিক। এমন সময় রসুল (সা) তেওয়াত করলেন, “নিশ্চয়ই এই কোরআন এক সম্মানীত রসুলের কাছে বহন করে আনা বার্তা, এটা কোন কবির রচনা নয়, তোমরা অল্পই বিশ্বাস করো, ‘হযরত ওমর (রা) বলেন, আমি মনে মনে বললাম, এই ব্যক্তিতো দেখছি জ্যোতিষী,। এমন সময় রসুলুল্লাহ (সা) তেলওয়াত করলেন, “এটা কোন গণকের কথাও নয়, তোমরা অল্পই অনুধাবন করো। এটা জগত সমূহের প্রতিপালকের কাছ হতে অবতীর্ণ” । রসুল (সা) সুরার শেষ পর্যন্ত তেলওয়াত করলেন।
হযরত ওমর (রা) বলেন, সে সময়েই আমার মনে ইসলাম রেখাপাত করে। কিন্ত তখনো তাঁর মনে পুর্ব-পুরুষদের ধর্মের প্রতি বিশ্বাস ও ভালবাসা ছিল অটুট। এ কারণেই হৃদয়ের গোপন গভীরে ইসলামের ভালোবাসার বীজ রোপিত হলেও ইসলামের বিরোধিতার প্রকাশ্য কাজকর্মে তিনি ছিলেন সোচ্চার।
তাঁর স্বভাবের কঠোরতা এবং রসুলুল্লাহ (সা)’র সাথে শত্রুতার অবস্থা এমন ছিলো যে, একদিন তলোয়ার হাতে নিয়ে রসুল (সা) কে হত্যার উদ্দেশ্যেই বেড়িয়ে পরলেন। পথে নঈম ইবনে আবদুল্লাহ নাহহাম আদবীর বা বনী যোহরা বনি মানজুমের কোন এক লোকের সাথে তাঁর দেখা হলো। সেই লোক তাঁর রুক্ষ চেহারা দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, ওমর, কোথায় যাচ্ছো ? তিনি বললেন, মোহাম্মদকে হত্যা করতে যাচ্ছি। সেই লোক বললেন, মোহাম্মদকে হত্যা করে হনু হাশেম ও বনু যোহরার হাত থেকে কিভাবে রক্ষা পাবে? তিনি বললেন, মনে হয় তুমিও পুর্ব পুরুষদের ধর্ম ত্যাগ করে বেদ্বীন হয়ে পরেছো।, সেই লোক বললেন, ওমর, একটা বিস্ময়কর কথা শুনাচ্ছি। তোমার বোন এবং ভগ্নীপতিও তোমাদের দ্বীন ছেড়ে বেদ্বীন হয়ে গেছে। এ কথা শুনে হযরত ওর ক্রোধে দিশেহারা হয়ে সোজা ভগ্নীপতির বাড়ির দিকে রওয়ানা হলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন তারা হযরত খাব্বার ইবনে আরতে কাছে সূরা ত্বা-হা লিখা একটি সহিফা পাঠ করছেন। কোরআন শিক্ষা দেয়ার জন্য হযরত খাব্বাব (রা) সেই বাড়িতে যেতেন। হযরত ওমরের পায়ের আওয়াজ শুনে সবাই নীরব হয়ে গেলেন। হযরত ওমরের বোন সূরা লিখা পাতাটি লুকিয়ে ফেললেন। কিন্ত ঘরের বাইরে থেকেই হযরত ওমর খাব্বাব (রা) এর কোরআন তেলওয়াতের আওয়াজ শুনছিলেন। তাই তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কিসের আওয়াজ শুনছিলাম ? তারা বললেন, কই কিছু নাতো ! আমরা নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছিলাম। সম্ভবত তোমরা উভয়ে বেদ্বীন হয়ে গেছো। তাঁর ভগ্নীপতি বললেন, আচ্ছা ওমর, ‘সত্য” যদি তোমাদের দ্বীন ছাড়া অন্য কোন ধর্মে থাকে তখন কি হবে ? হযরত ওমর একথা শুনা মাত্র ভগ্নিপতির উপর ঝাপিয়ে পরে, এবং তাকে মারাত্মক প্রহার করলেন। তা২র বোন ছুটে গিয়ে স্বামীকে ভাইয়ের হাত থেকে ছাড়ানোর চেষ্টা করলেন, এক সময় তাকে সরিয়ে দিলেন। হঠাত হযরত ওমর (রা) তাঁর বোনকে এতজোড়ে চড় দিলেন যে, তার চেহারা রক্তাক্ত হয়ে গেল। ইবনে ইসহাকের বর্ণনায় রয়েছে যে, তার মাথায় আঘাত লেগেছিলো। তার বোন ক্রুদ্ধভাবে বললেন, ওমর, যদি তোমাদের ধর্ম ছাড়া অন্য ধর্মে সত্য থাকে তখন কি হবে ? আমি স্বাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া অন্য কোন মা’বুদ নাই এবং মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর রসুল । এ কথা শুনে হযরত ওমর হতাশ হয়ে পরলেন, বোনের চেহারায় রক্ত থেকে তার লজ্জাও হলো। তিনি বললেন, আচ্ছা, তোমরা যা পাঠ করছিলে আমাকে একটু পড়তে দাওতো। তাঁর বোন বললেন, তুমি নাপাক। এই কিতাব শুধু পাক পবিক্র লোকেই স্পর্শ করতে পারে। যাও গোসল করে এসো। হযরত ওমর গিয়ে গোসল করে এলেন। এরপর কেতাবের সেই অংশবিশেষ হাতে নিয়ে বসলেন, এবং পড়লেন। বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম। এরপর বললেন এতো দেখি বড়ই পবিত্র নাম।
হযরত খাব্বাব (রা) হযরত ওমর (রা) এর মুখে একথা শুনে ভেতর থেকে বাইরে এলেন এবং বললেন, ওমর খুশি হও, রসুলুল্লাহ (সা) বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে যে দোয়া করেছিলেন, আমার মনে এটা তারই ফল। এ সময় রসুলুল্লাহ (সা) সাফা পাহাড়ের নিকটবর্তী এক ঘরে অবস্থান করেছিলেন।
একথা শুনে হযরত ওমর (রা) তলোয়ার হাতে সেই ঘরের সামনে এসে দরোজায় করাঘাত করলেন। একজন সাহাবী দরজায় উঁকি দিয়ে দেখলেন যে, তলোয়ার হাতে ওমর। আশে-পাশেই সবাই একত্রিত হলেন। হযরত হামযা (রা) জিজ্ঞাসা করলেন কি ব্যাপার? তাঁকে বলা হলো যে, ওমর এসেছেন। তিনি বললেন, ওমর এসেছে? দরজা খুলে দাও। যদি ভালোর জন্যে এসে থাকে, তবে ভলোই পাবে। আর যদি খারাপ উদ্দেশ্যে এসে থাকে, তবে তার তলোয়ার দিয়েই আমরা তাকে শেষ করে দেবো। এদিকে রসুলুল্লাহ (সা) ভেতরে ছিলেন, তাঁর ওপর ওহী নাযিল হচ্ছিলো। ওহী নাযিল হওয়ার পর তিনি এদিকের কামরায় হযরত ওমরের কাছে এলেন এবং তার পরিধানের পোশাক এবং তলোয়ারের একাংশ ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বললেন, ওমর, তুমি কি ততোক্ষণ পর্যন্ত বিরত হবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তোমার ওপরও ওলীদ ইবনে মুগিরার মতো অবমাননাকর শাস্তি নাযিল না করবেন? হে আল্লাহ, ওমর ইবেন খাত্তাবের দ্বারা দ্বীনের শক্তি ও সম্মান দান করো। একথা বলার সাথে সাথে হযরত ওমর (রা ইসলাম গ্রহণ করে নিলেন, আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নিশ্চয়ই আল্লাহ কোন মাবুদ নেই এবং আপনি আল্লাহর রাসূল। একথা শুনে ঘরে ভেতরে যারা ছিলেন তারা এতো জোরে আল্লাহু আকবার ধ্বনি দিলেন যে, কাবাঘরের মধ্যে যারা ছিলেন, তারাও আওয়ায শুনতে পেলেন। আরবে কেউ তার মোকাবেলা করার সাহস পেতো না। এ কারনে তার ইসলাম গ্রহণের সংবাদে পৌত্তলিকদের মধ্যে হৈ চৈ পড়ে গেলো। তারা মারাত্মক সস্কট এবং অবমাননার সম্মুখীন হলো। অন্য দিকে তাঁর ইসলাম গ্রহণের ফলে মুসলমানদের গৌরব, শক্তি, মর্যাদা, সাফল্য ও আনন্দ বেড়ে গেলো। ইবনে ইসহাক তার সনদে হযরত ওমর(রা) এর বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন যে, আমি যখন মুসলমান হলাম, তখন ভাবলাম, মক্কায় রসুলুল্লাহ (সা)’র সবচেয়ে ব্ড় শক্র কে? এরপর মনে মনে বললাম, সে হচ্ছে আবু জাহেল। এরপর আমি আবু জেহেলের বাড়ী গেলাম। ঘরের দরজায় করাঘাত করলে আবু জেহেল বেরিয়ে এলো। সে আমাকে দেখে বললো, স্বাগতম সুস্বাগতম। কি কাজে এসেছ ওমর? আমি বললাম, তোমাকে একথা জানাতে এসেছি যে, আমি আল্লাহ তায়ালা এবং তার রসুলুল্লাহ (সা)’র ওপর বিশ্বাস স্থাপন করেছি। তিনি যা কিছু নিয়ে এসেছেন, তার উপরও বিশ্বাস পোষন করি, এবং সত্য বলে স্বীকার করেছি। এ কথা শুনে আবু জেহেল দরজা বন্ধ করে দিতে দিতে বললো, আল্লাহ তোমার মন্দ করুন , এবং তুমি যা কিছু নিয়ে এসেছো তারও মন্দ করুন।
ইমাম ইবনে জওজি হযরত ওমর ফারুক (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, কেউ যখন ইসলাম গ্রহণ করতো, তখন কোরাইশ কাফেররা তাদের পিছনে লেগে যেতো। তাকে নিমর্মভাবে প্রহার করতো। প্রহৃত ব্যক্তিও প্রহার করতেন। আমি ইসলাম গ্রহণ করার পর আমার মামা আদী ইবনে হাশেমের কাছে গিয়ে তাকে জানালাম। তিনি কোন কথা না বলে ঘরের ভিতরে প্রবেশ করলেন। এরপর কোরাইশদের একজন বিশিষ্ঠ লোকের কাছে গেলেন। সম্ভবত আবু জেহের দিকে ঈঙ্গিত করেছেন। আমার মামা আদী কোরাইশের সেই লোককে খবর দেয়ার পর সেও ঘরের ভিতর ঢুকে গেল।
ইবনে হিশাম ইবনে জাওযি বর্ণনা করেছেন যে, হযরত ওমর (রা) ইসলাম গ্রহণের পর জামিল ইবনে মোয়াম্মার মাহমির কাছে গেলেন। কোন কথা প্রচারের ক্ষেত্রে কোরাইশদের মধ্যে এ লোক ছিল বিখ্যাত। হযরত ওমর তাকে জানালে যে, আমি ইসলাম গ্রহণ করেছি। একথা শুনার সাথে সাথে সে উচ্স্বরে চিৎকার করে উঠলো যে, খাত্তাবের পুত্র বেদ্বীন হয়ে গেছে। হযরত ওমর (রা) বললেন, তুমি মিথ্যা বলছো, আমি মুসলমান হয়েছি। মোট কথা লোকেরা ওমরের উপর ঝাপিয়ে পরলো এবং তাঁকের প্রহার করতে লাগলো। হযরত ওমর প্রহৃত হচ্ছিলেন আবার নিজেও প্রহার করছিলেন। এক সময় সুর্য্য মাথার উপর এলো। ক্লান্ত হয়ে তিনি বসে পরলেন। এরপর বললনে, যা খুশি করো। আল্লাহর কসম, যদি আমরা সংখ্যায় তিনশজনও হতাম, তাহলে মক্কায় হয় তোমরা থাকতে না হয় আমরা থাকতাম।
পৌত্তলিকরা এর পর হযরত ওমরকে প্রাণে মেরে ফেলার উদ্দশ্যে তার বাড়িতে হামলা করলো। সহীহ বোখারীতে বর্ণিত আছে যে, হযরত ওমর ভীতবিহ্বল হয়ে ঘরের ভিতর ছিলেন। এমন সময় আবু আমর আস ইবনে ওয়ায়েল ছাহমি এলেন। তিনি কারুকাজ করা ইয়েমেনি চাদর এবং রেশমী পোশাক পরিহিত ছিলেন। তিনি ছিলেন ছাহাম গোত্রের অধিবাসী। সেইকালে তিনি ছিলেন আমাদের মিত্র গোত্রের লোক। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার ?এত হল্লা কেন ?? হযরত ওমর বললেন, আমি মুসলমান হয়েছি। একারণে ওরা আমাকে মেরে ফেলতে চায়। আস বললেন, এটা সম্ভব নয়। আস এর এ কথা শুনে আমি স্বস্তিবোধ করলাম। বহু লোক সে সময় আমার বাড়ির আশেপাশে ভীড় করে আছে। আস ভীড় ঠেলে তাদের কাছে গিয়ে জিজ্ঞাস করলেন, তোমরা সবাই কোথায় চলেছো ? সবাই বললো, ওমর বেদ্বীন হয়ে গেছে, তার কাছে যাচ্ছি। আস বললেন, সেদিকে যাওয়ার কোন পথ নেই। এ কথা শুনে সবাই ফিরে চলে গেলো্। ইবনে ইসহাকের একটি বর্ণনায় রয়েছে যে, তারা এমনভাবে সমবেত হয়েছিলো, মনে হচ্ছিলো যেন, তারা একই পোশাকের মধ্যে প্রবেশ করেছে।
হযরত ওমরের ইসলাম গ্রহণের পর পৌত্তলিকদের অবস্থা ছিল এরূপ, যা উপর উল্লেখ করা হয়েছে। মুসলমানদের অবস্থার ধারণা এ ঘটনা থেকেই অনুমান করা যায়। মোজাহেদ হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা) থেকে বর্ণনা করেছেন যে, আমি ওমর ইবনে খাত্তাবকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, কি কারনে আপনার উপাধি ফারুক হয়েছে? তিনি বললেন, আমার ইসলাম গ্রহণের তিন দিন আগে হযরত হামযা (রা) ইসলাম গ্রহণ করেন। এরপর হযরত হযরত ওমর হযরত হামযার ইসলাম গ্রহনের ঘটনা বর্ণনা করার পর বলেন, এরপর আমি ইসলাম গ্রহণ করে প্রিয় নবী রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে বললাম, হে আল্লাহর রাসূল, মরে যাই বেচেঁ থাকি, আমরা কি হক-এর ওপর বিদ্যমান নেই? রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, কেন নয়? সেই সত্বার শপথ, যার হাতে আমার প্রাণ রয়েছে, তোমরা বেচেঁ তাকো বা মরে যাও, নিশ্চয়ই তোমরা হক-এর ওপর রয়েছো। হযরত ওমর (রা) বলেন, এরপর আমি বললাম, তাহলে আমরা কেন পালিয়ে বেড়াবো? সেই সত্বার শপথ, যিনি আপনাকে সত্যসহ প্রেরণ করেছেন, নিশ্চয়ই আমরা বাইরে বের হবো। এরপর আমরা দুই কাতারে বিভক্ত হয়ে মিছিল করে আল্লাহর রসূলকে সঙ্গে নিয়ে বাইরে বের হলাম। এক কাতারে ছিলেন হযরত হামযা, অন্য কাতারে আমি। আমাদের চলার পথে যাঁতার পেষা আটার মতো ধূলো উড়ছিলো। আমরা মসজিদে হারামে প্রবেশ করালাম। হযরত ওমর (রা) বলেন, কোরায়শরা আমাদের দেখে মনে এতোবড় কষ্ট পেলো, যা ইতিপূর্বে পায়নি। সেই দিন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাকে ফারুক উপাধি দিলেন।
হযরত ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, এর আগে আমরা কাবাঘরের কাছে নামায আদায়ে সক্ষম ছিলাম না।
হযরত যোহায়ের ইবনে সেননা রূমী (রা) বলেন, হযরত ওমর ফারুক (রা) মসুলমান হওয়ার পর ইসলাম পর্দার বাইরে এলো এবং ইসলামের দাওয়াত প্রকাশ্যে দেয়া শুরু হলো। আমরা কাবাঘরের সামনে গোল হয়ে বসতে লাগলাম এবং কাবাঘর তওয়াফ করতে লাগলাম।
যারা আমাদের ওপর বাড়াবাড়ি করেছিলো, তাদের ওপর প্রতিশোধ নিলাম এবং অত্যাচারের জবাব দিলাম।
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা) বলেন, হযরত ওমরের ইসলাম গ্রহণের পর থেকে পরবর্তীকালে আমরা শক্তিশালী এবং সম্মানিত ছিলাম।
হযরত হামযা ইবনে আবদুল মোত্তালেব এবং হযরত ওমর ইবনে খাত্তাব(রা) এর ইসলাম গ্রহণের পর মুসলমানদের ওপর পাইকারি নির্যাতন কমে গেলো, বুদ্ধি-বিবেচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্যে পৌত্তলিকরা উদ্যোগী হলো। তারা চিন্তা করেছিলো যে, ইসলামের দাওয়াত দেয়ার মাধ্যমে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা পেতে চান, সেই প্রাপ্তি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে তা পূরনের মাধ্যমে তাঁকে হয়তো তার কাজ থেকে বিরত রাখা যাবে। কিন্তু তারা জানতো না রসূলে খোদার দ্বীনের দাওয়াতের মোকাবেলায় সমগ্র বিশ্বজগতও সম্পর্ণ মূল্যহীন। কাজেই, তাদের চেষ্টায় তারা স্বাভাবিকভাবেই ব্যর্থ হলো।
ইবনে ইসহাক ইয়াজিদ ইবনে যিয়াদের মাধ্যমে মোহাম্মদ ইবনে কা’ব কারাযির এই বর্ণনা উদ্ধৃত করেছেন যে, আমাকে জানানো হয়েছে, কওমের নেতা ওতবা ইবনে রবিয়া স্বজাতীয়দের সামনে একদিন নতুন একটা প্রস্তাব দিলো। সে সময় রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মসজিদে হারামের এক জায়গায় একাকী ছিলেন। ওতবা বলললো, মোহাম্মদের সাথে আলোচনা করে এর ব্যব্স্থা নাও। তার সামনে কয়েকটা প্রস্তাব পেশ করো, হয়তো তিনি কোন একটা প্রস্তাব মেনে নিবেন। তিনি যে দাবী করবেন, সেই দাবী আমরা পূরণ করবো। হামযা (রা)-এর ইসলাম গ্রহনের পর মসুলমানদের শক্তি বৃদ্ধি দেখে তারা নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করলো।
কোরয়শরা বললো, আবুল ওলীদ তুমি যাও, তুমি গিয়ে তাঁর সাথে কথা বলো। এরপর ওতবা উঠে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের কাছে বসলো। ওতবা বললো, ভাতিজা, আমাদের কওমের মধ্যে তোমার যে মর্যাদা রয়েছে, সে কথা সবাই জানে। তুমি উচ্চ বংশের মানুষ। তুমি এমন একটা বিষয় প্রচার করছো যার কারনে কওমের মধ্যে বিভেদ, বিশৃঙ্খলা ও অনৈক্য দেখা দিয়েছে। তুমি কওমের নেতৃস্থানীয় লোকদের বুদ্ধিমত্তাকে নির্বুদ্ধিতা বলে অভিহিত করছো। তাদের উপাস্যকে নানাভাবে সমালোচনা করছো, তাদের ধর্ম বিশ্বাসকে বাতিল করে দিচ্ছো, তাদের পূর্ব-পুরুষদের কাফের বলে অভিহিত করছো। আমার কথা শোনো, আমি তোমাকে কয়েকটি প্রস্তাব দিচ্ছি তুমি এসব প্রস্তাব সম্পর্কে চিন্তা করো। হয়তো যে কোন একটা প্রস্তাব তোমার কাছে গোহণযোগ্য হবে।রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, বলো আবুল ওলীদ, আমি শুনবো।
ওতবা ওরফে ওলীদ বললো,ভাতিজা, তুমি যা প্রচার করছো, যদি এর বিনিময়ে ধন-সম্পদ চাও তবে আমরা তোমাকে এতো ধন-সম্পদ দেবো যে, তুমি হবে আমাদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। যদি তুমি মর্যাদা চাও, তাও বলো, আমরা তোমাকে আমাদের নেতা হিসাব বরণ করে নিবো। তোমাকে ছাড়া কোন ফয়সালা করা হবে না। যদি তুমি বাদশাহ হতে চাও তাও বলো, আমা তোমাকে বাদশাহ হিসাবে মেনে নিবো। যদি তোমার কাছে আসা জিনিস জ্বীন ভূত হয়ে থাকে, তাও বলো, তুমি দেখো, অথচ তাড়াতে পারছো না, আমরা চিকিৎসার ব্যবস্থা করবো। যত টাকা লাগে লাগুক, আমরা তোমাকে চিকিৎসা করবো। কখনো কখনো এমন হয় যে, জ্বিন ভূতেরা মানুষের ওপর প্রভাব বিস্তার করে রাখে, সে অবস্থায় মানুষের চিকিৎসার প্রয়োজন দেখা দেয়।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ওতবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনার পর বললেন, আবুল ওলীদ, তোমার কথা কি শেষ হয়েছে ? আমার কথা শুনো। এরপর রসুলে খোদা (সাঃ) সূরা হা-মীম-সেজদার প্রথম থেকে তেলওয়াত শুরু করলেন। “পরম করুনাময় ও অতি দয়ালু আল্লাহর নামে শুরু করছি” । হা- মীম এই কিতাব দয়াময় আল্লাহর কাছ থেকে অবতীর্ণ। এটি এক কিতাব, বিশদভাবে বিবৃত হয়েছে এর আয়াত সমূহ আরবী ভাষায় কোরআন রুপে জ্ঞানী সম্প্রদায়ের জন্য। সুসংবাদদাতা ও সতর্ককারী রুপে। কিন্তু ওদের অধিকাংশই বিমুখ হয়েছে। কাজেই ওরা শুনবে না। ওরা বলে তুমি যার প্রতি আমাদের আহবান করছো। সে বিষয়ে আমাদের অন্তর আবরণ, আচ্ছাদিত, কানে আছে বধিরতা এবং তোমার ও আমাদের মধ্যে কাজ করে অন্তরাল। সুতরাং তুমি তোমার কাজ করো এবং আমরা আমাদের কাজ করি।
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তেলওয়াত করে যাচ্ছিলেন আর ওতবা দুহাত পিছনের দিকে রেখে আরাম করে বসে শুনছিলো। সেজদার আয়াত তেলওয়াত করার পর রসুল (সা) উঠে সেজদা করলেন। এরপর বললেন, আবু ওলিদ, তুমি কিছু শুনতে চেয়েছিলে, আমি শুনিয়েছি,এবার তুমি জানো,আর তোমার কাজ জানে।
ওতবা উঠল এবং নিজের সঙ্গীদের কাছে গেলো। তাকে দেখে তার সঙ্গীরা বলাবলি করতে লাগলো যে, খোদার কসম,আবুল ওলিদ যে চেহারা নিয়ে গিয়েছিলো, সে চেহারা নিয়ে কিন্তু ফিরে আসছেনা। ওতবা বসার পর সঙ্গীরা জিজ্ঞেস করলো যে, কি খবর নিয়ে এসেছো ? সে বললো, খবর হচ্ছে, আমি এমন কালাম শুনেছি যা অতিতে কোনদিন শুনিনি। খোদার কসম সেটা কবিতাও নয়, যাদুমন্ত্রও নয়। তোমরা আমার কথা শুনো। ওকে তার অবস্থার উপর ছেড়ে দাও। যে কালাম আমি শুনেছি ভবিষ্যতে এর মাধ্যমে বড় ধরণের কোন ঘটনা ঘটবে। এরপর যদি ওকে আরবের লোকেরা মেরে ফেলে, তবে তোমাদের কাজ অন্য কেউ করবে। যদি তিনি আরবের উপর জয়লাভ করেন, তবে তার হবে তোমাদের সম্মান, তাঁর বাদশাহী হবে তোমাদের বাদশাহী। তাঁর অস্তিত্ব তোমাদের জন্য সৌভাগ্যের কারণ হবে।
কোরাইশরা বললো, আবু ওলিদ, সে কালামের যাদু তোমাকেও প্রভাবিত করেছে। ওতবা বললো, তার ব্যাপারে আমি যা বুঝেছি তা বলেছি। এখন তোমরা যা ভাল মনে করো, তা করো।
অপর এক বর্ণনায় রয়েছে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যখন এ আয়াত তেলওয়াত করলেন যে, তবুও যদি ওরা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তবে বলো, আমিতো তোমাদেরকে সতর্ক করছি এক ধ্বংসকর শাস্তির। যা আ’দ ও সামুদের শাস্তির অনুরুপ। এই আয়াদ তেলওয়াতের সাথে সাথে ওতবা উঠে দাড়াল এবং রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম’র মুখে হাত চাপা দিয়ে বললো, আমি আপনাকে আল্লাহ ও নিকটাত্মীয়ের দোহাই দিয়ে বলছি যে, আপনি এরুপ করবেন না। ওতবা আশংখা করছিলো যে, ও রকম শাস্তি তার উপর না এসে পরে।