প্রথম খণ্ড
দ্বিতীয় খণ্ড
তৃতীয় খণ্ড

২১. লোকন্যায়মূলক ও স্মৃতিমূলক আইন – ট্রাইব্যাল-সমাজের অসম্পূর্ণ বিলোপ

২১. লোকন্যায়মূলক ও স্মৃতিমূলক আইন – ট্রাইব্যাল-সমাজের অসম্পূর্ণ বিলোপ

সাবেকি ভারতীয়-সমাজের দুটি প্রধান বৈশিষ্ট্য—গ্রাম-সমবায় ও জাতিভেদ-প্রথা—নিয়ে কিছুটা আলোচনা তুলতে হলো। বলাই বাহুল্য, আমাদের এই আলোচনা উভয়-সমস্যার কোনোটিরই পূর্ণাঙ্গ সমাধান হবার মতো কোনো বড়ো দাবি করে না। কেননা, দুটি সমস্যাই অত্যন্ত জটিল—এ-নিয়ে বহু গবেষণা হয়েছে এবং আরো বহু গবেষণা হওয়ার অবকাশ ও আবশ্যকতা আছে। তবুও আমাদের মূক যুক্তির দিক থেকে এই প্রসঙ্গগুলির অবতারণা করবার প্রয়োজন ছিলো। তার কারণ, যে-প্রকল্প বা হাইপোথেসিসের উপর নির্ভর করে আমরা লোকায়ত ধ্যানধারণাকে বোঝবার চেষ্টা করছি সেই প্রকল্পটির পক্ষে কিছুটা নজির না দেখালে প্রকল্পটির গুরুত্ব স্বীকৃত হবে না। আমাদের ওই প্রকল্প বা হাইপথেসিস্‌ হলো ট্রাইব্যাল-সমাজের অসমাপ্ত বিলোপ—এই প্রকল্পের দৃষ্টান্ত হিসাবেই আমরা গ্রাম-সমবায় ও জাতিভেদ-প্রথার উল্লেখ করেছি। কিন্তু এগুলির কথা উল্লেখ করতে গিয়ে আময়াদের আলোচনা অনেকখানিই বিক্ষিপ্ত হয়েছে। তাই এইখানে আমাদের যুক্তির মূল সূত্রটির পুনরুল্লেখ বাঞ্ছনীয় হবে।
ট্রাইব্যাল-সমাজের অসমাপ্ত বিলোপ সংক্রান্ত ওই প্রকল্পটি আমাদের কাছে লোকায়তিক ধ্যানধারণার আলোচনায় এতোখানি গুরুত্বপূর্ণ কেন মনে হয়েছে?
লোকায়ত-দর্শনের মূল সমস্যা হিসেবে আমরা শুরুতেই কয়েকটি কথার উল্লেখ করেছি।
প্রথমত, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী দেখাচ্ছেন, লোকায়তিক বলতে শুধুমাত্র প্রাচীনকালের কোনো একটি নির্দিষ্ট মতবাদকেই সনাক্ত করবার চেষ্টাটা ভুল হবে। কেননা, এমন কি আজকের দিনেও লোকায়তিক ধ্যানধারণা আমাদের দেশ থেকে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়নি, মরে যায়নি। লিখিত পুঁথিপত্রগুলিতে লোকায়তিকদের বিদ্রুপ করবার উৎসাহে তাঁদের বিপক্ষেরা যে-সব টুকরো-টাকরা খবর লিপিবদ্ধ করে গিয়েছেন লোকায়তিক চেতনাকে বোঝবার আশায় সেইগুলিকেই একমাত্র সম্বল মনে না করে আমরা যদি দেশের বাস্তব পরিস্থিতির দিকে চেয়ে দেখতে রাজি হয়,—যদি বিশেষ করে আমরা লক্ষ্য করি দেশের পিছিয়ে-পড়া অঞ্চল ও সমাজের নিচুস্তরের মানুষগুলির দিকে,—তাহলে আমরা স্পষ্টই দেখতে পাবো যে বৈষ্ণব, সহজিয়া প্রভৃতি বিবিধ নামের আড়ালে ওই লোকায়তিক ধ্যানধারণাগুলি আজো আমাদের দেশে সত্যিই বেঁচে রয়েছে।
দ্বিতীয়ত, মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রীই আমাদের দেখালেন, লোকায়ত বলতে সংকীর্ণ অর্থে শুধুমাত্র মাধবাচার্য বর্ণিত অনুমান-বিরোধী বস্তুবাদী সম্প্রদায়টির কথা বুঝলে চলবে না। লোকায়ত-কে বুঝতে হবে অনেক ব্যাপক অর্থে। কেননা, এই লোকায়তিক চেতনারই আর একটি মৌলিক দিক হলো বামাচার বা কামাচার। পুরোনো পুঁথিপত্রেই এ-কথার নজির পাওয়া যায়; সহজিয়া প্রভৃতি নামান্তরের আড়ালে ওই লোকায়তিক চেতনাই আজো আমাদের দেশে যে-ভাবে টিকে রয়েছে তাকে পরীক্ষা করলেও একই বিষয়ের দিকে দৃষ্টি পড়ে। অবশ্যই, আধুনিক রুচিত দিক থেকে এই বামাচার সম্বন্ধে—এবং ব্যাপক অর্থে তান্ত্রিক ধ্যানধারণাগুলি সম্বন্ধে—আমাদের মনে স্বভাবতই তীব্র ঘৃণা ও বিদ্বেষের ভাব জাগে; এগুলিকে বীভৎস কামবিকার ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না। বস্তুত, তান্ত্রিক সাহিত্যের লিখিত পুঁথিপত্রগুলির মধ্যে বামাচারের যে-পরিচয় পাওয়া যায় সেগুলি বিকৃত মনোভাবের অত্যন্ত প্রকট নিদর্শন। কিন্তু লোকায়তিক মতবাদকে ঠিকমতো বুঝতে হলে যেহেতু ওই বামাচারের কথা আলোচনা না-করলেই নয় সেইহেতু আমরা সে-বিষয়েও অনুসন্ধান শুরু করতে বাধ্য হয়েছিলাম। এবং এই অনুসন্ধান আমাদের সামনে একটি বিস্ময়কর ঘটনা প্রকাশ করলো : উত্তরকালে বৈদিক ঐতিহ্য ও বামাচারী ঐতিহ্যের মধ্যে বিরোধ যতো প্রকটই হোক না কেন, ওই বৈদিক সাহিত্যের মধ্যেই এমন অনেক স্মারক টিকে রয়েছে যা বামাচারের নিদর্শন ছাড়া আর কিছুই নয়। তাই এমন কথা সন্দেহ করা অস্বাভাবিক হয়নি যে, উত্তরকালে বামাচারী চেতনা আমাদের রুচির কাছে যতোই অর্থহীন ও বীভৎস মনে হোক না কেন, এমনটা হওয়া অসম্ভব নয় যে, মানব-অগ্রগতির কোনো এক প্রাকৃত পর্যায়ের পটভূমিতে এ-জাতীয় চেতনা স্বাভাবিকভাবেই স্ফূর্ত হয়েছিলো—বৈদিক ঐতিহ্যের বাহকেরা সেই পর্যায়কে পেরিয়ে এসেছিলেন এবং অতএব এই বামাচারকে ঘৃণা করতে শিখেছিলেন; কিন্তু যে-কোনো কারণেই হোক না কেন দেশের পিছিয়ে-পড়ে থাকা মানুষগুলি আটকে থেকেছিলো সেই পর্যায়েরই কাছাকাছি। অর্থাত, উত্তরযুগে বৈদিক ঐতিহ্যের বাহকরা যে-ধ্যানধারণগুলিকে অমন ঘৃণার চোখে দেখতে চেয়েছিলেন সেগুলিকেই এককালে তাঁদের পূর্বপুরুষেরা, অর্থাত বৈদিক ঐতিহ্যের প্রবর্তকেরা, মনে করেছিলেন সত্যগর্ভ ও জ্ঞানগর্ভ।
ফলে, লোকায়তিক ধ্যানধারণার আলোচনা-প্রসঙ্গেই আমরা মানুষের অগ্রগতি-পথের ওই প্রাকৃত পর্যায়টির কথা অনুসন্ধান করতে বাধ্য হলাম। প্রশ্ন উঠলো, ওই পর্যায়টির সংবাদ কেমন করে পাওয়া সম্ভব?

পুরো পৃথিবীর বুক-জুড়ে সব মানুষই সমান তালে এগিয়ে চলেনি। অথচ, এগিয়ে-চলার পথটা সব মানুষের পক্ষেই সমান। যে-পথে পরের পর কয়েকটি নির্দিষ্ট ও অনিবার্য পর্যায় আছে। তাই পৃথিবীর আনাচে-কানাচে আজো যে-সব মানবদল অগ্রগতি-পথের প্রাকৃত পর্যায়ে পড়ে আছে, তাদের অবস্থা পরীক্ষা কুরলে আজকের এগিয়ে-আসা মানুষদের ভুলে-যাওয়া অতীতটার কথাও অনুমান করবার সুযোগ থাকে। এবং এই অনুমানের ভিত্তিতেই প্রাচীন পুঁথিপত্রের কোনোকোনো অত্যন্ত দুর্বোধ্য উক্তিও বুঝতে পারা হয়তো অসম্ভব নয়; কেননা, এগুলি সেই আদিম পর্যায়ের চেতনার স্মারকচিহ্ন হতে পারে। বৈদিক সাহিত্যে বামাচারের চিহ্নগুলিকে আপাতদৃষ্টিতে ভয়ংকর ও অর্থহীন মনে হলেও আমাদের এই পদ্ধতির সাহায্যে সেগুলির আদি-তাৎপর্য অনুসন্ধান করবার চেষ্টা করা যেতে পারে।
এই পদ্ধতি অনুসারে অগ্রসর হয়েই আমরা ট্রাইব্যাল-সমাজের আলোচনায় গিয়ে পড়েছি। কেননা, মানুষের অগ্রগতির প্রাকৃত পর্যায়ের সমাজ-সংগঠন বলতে ওই ট্রাইব্যাল-সমাজের সংগঠনই। কিন্তু আজকের দিনে আমাদের পক্ষে এই ট্রাইব্যাল-সমাজের মূল লক্ষণটিকে সম্যকভাবে বুঝতে পারা সহজসাধ্য নয়। কেননা, আমাদের সমাজ-জীবনের সঙ্গে এর একেবারে গুণগত পার্থক্য আছে। আমরা বাস করি শ্রেণীবিভক্ত সমাজে, আমাদের চিন্তার কাঠামোটি শ্রেণীবিভক্ত সমাজের বৈশিষ্ট্য দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত হয়। ট্রাইব্যাল-সমাজের আদি ও অকৃত্রিম রূপটির মধ্যে শ্রেণীবিভাগের চিহ্ন ফুটে ওঠেনি; সে-সমাজের মানবজীবন একান্তভাবেই যৌথজীবন। তাই রাষ্ট্র-ব্যবস্থা নেই, শাসক-শাসিতে তফাত নেই, ব্যক্তিগত-সম্পত্তি নেই, আধুনিক এক-বিবাহমূলক নরনারী-সম্পর্ক বা পরিবার-জীবন নেই। ফলে শ্রেণীসমাজ-লালিত আমাদের চিন্তা-চেতনার সাহায্যে আমরা ওই প্রাক্‌-বিভক্ত সমাজের বৈশিষ্ট্যকে সহজে উপলব্ধি করতে পারি না।
অবশ্যই, এই প্রাক্‌-বিভক্ত সমাজেরও একটা ইতিহাস আছে। ট্রাইব্যাল-সমাজের সমস্ত মানুষই এক-পর্যায়ে বাস করে না। জীবন ধারণের উপকরণগুলিকে সংগ্রহ ও উৎপাদন করবার দিক থেকে ট্রাইব্যাল-সমাজকেও বিভিন্ন পর্যায়ে ভাগ করা হয়। ওই পর্যায়গুলির কোনোটির মধ্যেই বামাচারী, তথা লোকায়তিক চিন্তা-চেতনার উৎস। সেই পর্যায়টি ঠিক কী,
এবং সে-পর্যায়ে কেন এই জাতীয় চিন্তাচেওনার জন্ম হয়েছিলো,—অর্থাৎ, এই ধ্যানধারণাগুলি সে-পর্যায়ে কোন ধরনের উদ্দেশ্য সাধন করতে চেয়েছে,—এই প্রশ্নটির আলোচনা এখনো বাকি আছে। কিন্তু সে-আলোচনা তোলবার আগে আর একটি প্রশ্ন ওঠে এবং উক্ত-প্রশ্নের মীমাংসা হিসেবেই আমরা ট্রাইব্যাল-সমাজের অসম্পূর্ণ বিলোপ সংক্রান্ত প্রকল্প বা হাইপোথেসিসের উল্লেখ করেছি—যদিও তা করতে গিয়ে আমাদের মূল যুক্তি থেকে অনেক দূর বিক্ষিপ্ত হতে হয়েছে।
প্রশ্নটা ঠিক কী?
ব্যাপক অর্থে আমরা যাকে তান্ত্রিক ধ্যানধারণা বলি আমাদের দেশে আজো তা প্রভাব অনেকাংশেই অক্ষুণ্ণ রয়েছে। আজকের দিনে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকেরা অদ্বৈতবাদ নিয়ে যতোই উৎসাহ দেখান না কেন, তান্ত্রিক মতবাদের তুলনায় বৈদান্তিক মতবাদের প্রভাব ভারতীয় চিন্তাধারার ইতিহাসে সত্যিই ব্যাপকতর বা গভীরতর কি না তা ভালো করে ভেবে দেখবার দরকার আছে (২৬৭)। আবার, আধুনিক পণ্ডিতমহলেই কখনো কখনো চোখে পড়ে তন্ত্রের সঙ্গে বেদান্তের সমন্বয় খোঁজবার চেষ্টা করা হয়েছে (২৬৮)। এই চেষ্টা অবশ্যই কৃত্রিম। কেন কৃত্রিম,—সে আলোচনা পরে তোলা হবে। আপাতত আমাদের বক্তব্য হলো, বিশেষ করে দেশের পিছিয়ে-পড়া অঞ্চলগুলিতে এবং সমাজের নিচুস্তরের মানুষদের মধ্যে নানান সম্প্রদায় হিসেবে নানা রকম নামের অন্তরালে ওই তান্ত্রিক ধ্যানধারণারই বিকাশ চোখে পড়ে এবং সেগুলিকে পরীক্ষা করলে বোঝা যায় আমাদের দেশে এ-জাতীয় ধ্যানধারণার প্রভাব কতো ব্যাপক ও গভীর।
কিন্তু এইখানে একটা সমস্যা ওঠে। কেননা, মানুষের চিন্তা-চেতনা স্বয়ম্ভূ নয়, স্বাবলম্বী নয়, স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়। তার উৎসে আছে মানুষের মূর্ত সমাজ-জীবন। এই কারণেই মানুষের ধ্যানধারণাকে খিলানের সঙ্গে তুলনা করা হয়, সে-খিলানের ভিত্তি-স্তম্ভ বলতে বাস্তব সমাজ-জীবন।
তাই প্রশ্ন ওঠে, প্রাচীন সমাজ যদি দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়ে থাকে তাহলে সে-সমাজেরই কোনো এক পর্যায়-প্রসূত চিন্তাচেতনার প্রভাব আজো এদেশে এতো ব্যাপক ও গভীরভাবে কী করে টিকে থাকতে পারলো? প্রশ্নটা বিশেষ করে প্রাসঙ্গিক এই কারণে যে,—আমরা একটু পরেই দেখতে পাবো,—আলোচ্য ধ্যানধারণার আদিরূপটি শুধুমাত্র আমাদের দেশের চেতনাতেই প্রতিভাত হয়নি; অন্যান্য দেশের মানুষেরাও ক্রমোন্নতির কোনো এক পর্যায়ে মূলত এই রকম ধ্যানধারণাকেই সত্য বলে মনে করেছিলো। তার কারণ, অন্যান্য দেশের মানুষরাও একটা সময়ে প্রাচীন-সমাজের ওই একই পর্যায়ে জীবন-যাপন করেছে।
কিন্তু উত্তরযুগে তাদের চেতনা থেকে উক্ত ধ্যানধারণার প্রভাব মুছে গিয়েছে। কেননা, তারা ট্রাইব্যাল-সমাজকে পিছনে ফেলে এগিয়ে এসেছে, তাদের মূর্ত সমাজ-জীবন থেকে বিলুপ্ত হয়েছে ট্রাইব্যাল-সমাজের চিহ্ন।
আমাদের দেশে যদি দেখা যায় ট্রাইব্যাল-সমাজ প্রসূত ওই ধ্যানধারণাগুলির প্রভাব সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়নি তাহলে সন্দেহ করবার অবকাশ থাকে যে, আমাদের দেশের সমাজ ব্যবস্থারও একটি বৈশিষ্ট্য হলো, ট্রাইব্যাল-সংগঠনের প্রকৃতি এদেশ থেকে মাত্র অসম্পূর্নভাবে বিলুপ্ত হয়েছে।
তাই আমরা ট্রাইব্যাল-সমাজের অসম্পূর্ণ বিলোপ সংক্রান্ত ওই প্রকল্পটির আশ্রয় গ্রহণ করেছি। এবং এই প্রকল্প যে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন নয় তা দেখাবার আশাতেই আমরা গ্রাম-সমবায় ও জাতিভেদ-প্রথার বহিঃরেখা নিয়ে কিহচুটা আলোচনা তুলতে বাধ্য হলাম। সে-কারণে আমাদের আলোচনা অবশ্যই অনেকখানি বিক্ষিপ্ত হলো; কিন্তু আমাদের মূল যুক্তির দিক থেকে তার প্রয়োজন ছিলো। কেননা, সাবেকী ভারতবর্ষের সমাজ-সংগঠনের মূল বৈশিষ্ট্য বলতে ওই গ্রাম-সমবায় ও জাতিভেদ-প্রথাই।
এই দুটি বিষয়ের আলোচনা করতে গিয়েই আমাদের চোখে পড়েছে,উৎপাদন-কৌশলের উন্নতির দরুন স্বাভাবিকভাবে ট্রাইব্যাল-সমাজ ভেঙে নতুন সমাজ গড়ে ওঠবার বদলে, বাইরের আক্রমণে ট্রাইব্যাল-সমাজের গণবন্ধন ভেঙে ও স্বাধীনতা অপহরণ করে, কৃত্রিমভাবে সেই সমাজের মানুষগুলিকে নিয়েই ছোটোছোটো স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রাম-সমবায় প্রতিষ্ঠা করবার ফলে, একদিকে যেমন আমাদের দেশে উত্তরকালেও ট্রাইব্যাল-সমাজের ভগ্নাবশেষ বহুল পরিমাণেই টিকে থেকেছে, আবার অপর দিকে তেমনিই এই চিহ্নগুলির আদি-তাৎপর্য ট্রাইব্যাল-সমাজের মূল প্রাণশক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পর্যবসিত হয়েছে নিজেদের বিপরীতে : ট্রাইব্যাল-সমাজের পটভূমিতে যা ছিলো বাঁচবার সহায়, ট্রাইব্যাল-সমাজের থেকে উৎপাটিত হয়ে নতুন পরিবেশে স্থানান্তরিত হবার পর, ট্রাইব্যাল-সমাজের প্রাণশক্তি দ্বারা সেগুলি আর লালিত হতে পারেনি। ফলে, সেগুলির আদিতাৎপর্য বিপরীতে পর্যবসিত হলো! যা ছিলো উদ্দেশ্যমূলক,—জীবনের সহায়,—নতুন পরিস্থিতিতে তাই হয়ে দাঁড়ালো উদ্দেশ্য-বিরুদ্ধ বিকৃতি,—জীবনের পরিপন্থী।
ধ্যানধারণাগুলিকে খিলানের সঙ্গে তুলনা করা হয়—যে-খিলানের ভিত্তিস্তম্ভ হলো সমাজ-বাস্তব।
অতএব, ভিত্তিস্তম্ভের বেলায় যে-কথা, খিলানের বেলাতেও তাই। অর্থাৎ, ধ্যানধারণার ক্ষেত্রেও ট্রাইব্যাল-সমাজের অসম্পূর্ণ বিলোপের একই পরিণাম দেখতে পাওয়া যায়। ট্রাইব্যাল-সমাজের যে-পর্যায়ে ওই বামাচারী চেতনার উৎস সেই পর্যায়ের পটভূমিতে এগুলিকে উদ্দেশ্যহীন কামবিকার বা ব্যভিচারমাত্র মনে করবার কারণ নেই। বস্তুত, আমরা একটু পরেই দেখতে পাবো, সমাজ-বিকাশের সেই পর্যায় থেকে উৎপাটিত হয়ে নতুন পরিস্থিতিতে টিকে থাকতে গিয়ে এগুলিই হয়ে দাঁড়ালো অর্থহীন, উদ্দেশ্যহীন, বিকৃত, বীভৎসতামাত্র। সেই বীভৎসতারই পরিচয় পাওয়া যায় তান্ত্রিক সম্প্রদায়গুলির লিখিত দলিলে, অর্থাৎ তন্ত্রসাহিত্যে। তান্ত্রিক পুঁথিগুলি সম্বন্ধে আধুনিক শিক্ষিত সম্প্রদায়ের মনোভাব যে কী রকম তার উল্লেখ আমরা ইতিপূর্বেই করেছি, এবং এ-বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নিশ্চয়ই আছে যে, তন্ত্রসাহিত্যে,—অর্থাত, তান্ত্রিক সম্প্রদায়ের লিখিত অভিব্যক্তির মধ্যে,—ওই ধ্যানধারণাগুলির আদি-তাৎপর্য অক্ষুণ্ণ অবস্থায় দেখতে পাওয়া যায় কি না। আমরা দেখাবার চেষ্টা করবো, তা পাওয়া যায় না। কিন্তু তার আগে আমাদের যুক্তির দিক থেকে সাধারণভাবে এ-কথা দেখানো দরকার, ট্রাইব্যাল-সমাজের বিলোপ অম্পূর্ণ হবার দরুন আমাদের দেশের ইতিহাসে ধ্যানধারণার ক্ষেত্রেও ট্রাইব্যাল-সমাজের স্পষ্ট স্মারক টিকে থেকেছে।
প্রধানত দুটি দৃষ্টান্তের সাহায্যে আমরা এই বিষয়টি ব্যাখ্যা করয়াব্র চেষ্টা করবো : ১) দেশের আইনকানুনের কথা, ২) ব্রতকথা।

সাবেকী ভারতবর্ষের আইনকানুন বলতে সমাজের সদরমহলে যদিও প্রধানত স্মৃতি-শাস্ত্রগুলিরই উল্লেখ করবার প্রথা ছিলো তবুও ইংরেজশাসকেরা এসে দেখলো, দেশের বিশেষ করে পিছিয়ে-পড়া অঞ্চলগুলিতে আইনকানুন বলতে স্মৃতিশাস্ত্রের প্রভাব প্রায় নেই বললেই চলে। এ বিষয়ে স্যর হেনরি মেইন্‌-এর (২৬৯) মন্তব্য উল্লেখ করাই সবচেয়ে প্রাসঙ্গিক হবে। তিনি বলেছেন, স্মৃতিশাস্ত্রগুলিতে দেশের আইনকানুন হিসেবে যেটুকুর পরিচয় পাওয়া যায় তার সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রেই দেশের বাস্তব আইনকানুনগুলির মিল নেই। কেননা, বাস্তবভাবে দেখা যায় একজাতীয় অলিখিত আইনেরই ব্যাপকতম প্রসার। এই অলিখিত আইনের দুটি সুস্পষ্ট ধারা রয়েছে : এক, স্মৃতিমূলক আইন, বা codified laws; দুই, লোকাচারমূলক আইন, বা customary laws. আমাদের যুক্তি অনুসারে দেশের আইনের ক্ষেত্রে এই দ্বিতীয় ধারাটির মধ্যে ট্রাইব্যাল-সমাজের ধ্বংসাবশেষ খুঁজে পাওয়া যায়, এবং অতএব এর ব্যাখ্যা হিসেবে ট্রাইব্যাল-সমাজের অসম্পূর্ণ বিলোপ সংক্রান্ত আমাদের প্রকল্পটিকেই মানা দরকার : ট্রাইব্যাল-সমাজের স্মারক এই লোকাচারমূলক আইনগুলির প্রভাব ব্যাপক এবং গভীরভাবে দেশে টিকে থেকেছে, তার কারণ এ-দেশে ট্রাইব্যাল-সমাজের বিলোপ পরিপূর্ণ হয়নি। দেশের আইনকানুন এবং দেশের দার্শনিক ধ্যানধারণা—দুই-ই সমপর্যায়ের। তাই, যে-কারণে আমাদের দেশে ওই লোকায়তিক ও তান্ত্রিক ধ্যানধারণার প্রভাব আজো এতো প্রবল সেই কারণেই আইনের ক্ষেত্রেও লোকাচারমূলক বিধিব্যবস্থাগুলি অত্যন্ত সাম্প্রতিক যুগেও দেশ থেকে বিলুপ্ত হয়নি। প্রথমে দেখা যাক, স্মৃতিমূলক ও লোকাচার-মূলক আইনের তফাতটা কী রকম। স্যর হেনরি মেইন (২৭০) বলছেন :

The whole of the codified law of the country—that is, he law contained in the codes of Manu, and in the treatises of the various schools of commentators who have written on that Code and greatly extended it—is theoretically connected together by certain ideas definite of a sacerdotal nature. But the most recent observation goes to prove that the portion of the law codified and the influence of this law are much less than once supposed, and that large bodies of indigenous customs have grown up independently of the codified law. But on comparing the written and the unwritten law, it appears clearly that the sacerdotal motives which permeate the first have invaded it from without, and are of Brahminical origin.
দেশের লিখিত আইনের (codified laws = স্মৃতিমূলক আইনের) সবটুকুই,—অর্থাৎ মনুস্মৃতি এবং তার উপর টীকারচনা প্রসঙ্গে বিভিন্ন সম্প্রদায় এই স্মৃতিকে যে-ভাবে ব্যাপকতর করেছে সেগুলি—পৌরোহিত্যমূলক কয়েকটি ধারণার দ্বারা একত্র গ্রথিত। কিন্তু অতি আধুনিক পরিদর্শনের ফলে দেখা গিয়েছে এককালে এই আইনগুলির প্রভাব যতোখানি মনে হয়েছিলো আসলে এগুলির প্রভাব তার চেয়েও ঢের কম এবং স্মৃতিমূলক আইন-নিরপেক্ষভাবেই বিস্তর স্থানীয় লোকাচারের উদ্ভব হয়েছে। এই লিখিত ও অলিখিত আইনগুলির তুলনা করলে স্পষ্টই দেখা যায় যে, পৌরহিত্য-অভিপ্রায় প্রণোদিত স্মৃতিমূলক আইনগুলির মূল প্রেরণা বাইরে থেকে এসেছে এবং ব্রাহ্মণ্যমূলক সেগুলির উৎস।

কিংবা (২৭১)

Complete and consistent in appearance as is the codified law of India, the law enunciated by Manu and the Brahminical commentators on him, it embraces a far smaller portion of the whole law of India than was once supposed, and penetrates far less deeply among the people. What an Oriental is really attached to, is his local custom.
যদিও স্মৃতিমূলক (লিখিত) আইনগুলিকে—অর্থাৎ মনু ও তাঁর টীকাকারদের লেখা আইনগুলিকে—আপাত দৃষ্টিতে সুসম্পর্ণ ও সামঞ্জস্যময় মনে হয় তবুও এককালে এগুলিকে ভারতবর্ষীয় আইনকানুনের যতো বড় অংশ মনে করা হয়েছিলো এগুলি আসলে ভারতবর্ষীয় আইনের তার চেয়ে ঢের ছোটো অংশ এবং জনসাধারণের মধ্যে এগুলির প্রভাব অনেক অগভীর। প্রাচ্যদেশবাসীর আসল আকর্ষণটা তার স্থানীয় লোকাচারের প্রতিই।

কিংবা (২৭২)

…the more exclusively an Anglo-Indian functionary has been employed in ‘revenue’ administration, and the further removed from great cities has been the scene of his labour, the greater is his hesitation in admitting that the law assumed to begin with Manu is, or ever has been, of universal application.
…ফিরিঙ্গি চাকুরে যতোই একান্তভাবে খাজনা-সংক্রান্ত শাসনকাজে লিপ্ত হয়েছে এবং তার কর্মস্থল বড়ো বড়ো শহর থেকে যতোই দূরে হয়েছে ততোই এ-কথা স্বীকার করতে তার দ্বিধা হয়েছে যে, যে-আইনগুলিকে মনু-লিখিত বলা হয় সেগুলির প্রয়োগ একালে, বা এমন কি কোনো কালেই, সার্বভৌম ছিলো।

আমরা আগেই বলেছি, যে-কারণেই হোক আমাদের দেশের রাষ্ট্রশক্তির অধিনায়কেরা ব্রাহ্মণ্য-ঐতিহ্যের গরিমা খুঁজেছিলেন। এবং স্যর হেনরি মেইন যে-আইনকানুনকে পৌরহিত্য-অভিপ্রায়-প্রণোদিত বলে উল্লেখ করছেন,—অর্থাৎ স্মৃতিশাস্ত্র বা দেশের লিখিত আইনকানুন,—সেগুলি এই রাষ্ট্রশক্তির মুখপাত্রদেরই রচনা। কিন্তু রাষ্ট্রশক্তির অধিনায়কদের সঙ্গে দেশের সাধারণ মানুষদের যোগসূত্র ছিলো নেহাতই ক্ষীণ : গ্রাম-সমবায়গুলিতে উৎপাদিত মোট দ্রব্যের একটি অংশমাত্রকে রাজস্ব হিসেবে কেড়ে নিতে পেরেই রাজারাজড়ারা খুশি ছিলেন,—এই গ্রাম-সমবায়গুলির আভ্যন্তরীণ ব্যাপারের সঙ্গে তাদের বিশেষ কোনো সম্পর্ক ছিলো না বললেই হয়। এবং গ্রাম-সমবায়গুলির মানুষেরাও ছিলো রাজারাজড়াদের ব্যাপার একান্ত উদাসীন। মেগাস্থিনিসের বর্ণনায় (২৭৩) দেখা যায়, আশেপাশে রাজায়-রাজায় যখন ঘোর যুদ্ধ চলছে তখনো গ্রামবাসীরা সে-সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নির্লিপ্তভাবেই নিজেদের গ্রাম্যজীবন যাপন করছে। হেগেল এবং মার্ক্‌স্‌ও বলছেন, এ-দেশের কৃষকদের জীবনের সঙ্গে বড়ো বড়ো সাম্রাজ্যের উত্থান-পতনের কোনো সম্পর্ক ছিলো না (২৭৪)।
তাই রাষ্ট্রশক্তির মুখপাত্ররা স্মৃতিশাস্ত্র নামে যে-আইনকানুন প্রবর্তন করেছিলেন তার সঙ্গে জনসাধারণের জীবনে বাস্তবভাবে প্রযোজ্য আইনকানুনের বিশেষ কোনো সম্পর্ক থাকাই অস্বাভাবিক। ফলে সাবেকী ভারতবর্ষে আইনকানুনের দুটি স্বতন্ত্র ধারা দেখতে পাওয়া যায়, এই দুটিকেই বলা হয় স্মৃতিমূলক এবং লোকাচারমূলক আইন।
প্রশ্ন ওঠে, লোকন্যায়মূল ওই আইনগুলির জন্মাদি রহস্য নিয়ে। এগুলি এলো কোথা থেকে? এগুলির প্রভাব এমন গভীর হয়ে থাকলো কী করে? স্যর হেন্‌রি মেইন (২৭৫) বলছেন :

The great instrumentality through which this body of customary law is preserved is the perpetual discussion by the people; and that it could be so preserved is accounted for by the fast that the social constitution of India is extreme ancient.
অর্থাৎ, যে-ব্যবস্থার সাহাযেয়ে লোকন্যায়মূলক এই আইনগুলি টিকে থেকেছে তা হলো জনসাধারণের মধ্যে অবিরাম আলোচনা এবং এগুলি যে ওইভাবে টিকে থাকতে পারলো তার কারণ ভারতবর্ষের সামাজিক সংগঠনটা অত্যন্ত প্রাচীন।

কিন্তু, প্রশ্ন হলো, ‘ভারতবর্ষীয় সমাজ-সংগঠন অত্যন্ত প্রাচীন’—এ-কথা বলতে ঠিক কী বোঝায়? স্যর হেনরি মেইন কি বলতে চাইছেন, ভারতবর্ষের সমাজসংগঠনের কোনো প্রাচীন পর্যায় উত্তর যুগেও টিকে থেকেছিলো, সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়নি? যদি তাই হয় তাহলে তাঁর মন্তব্যটিও ট্রাইব্যাল সমাজের অম্পূর্ণ বিলোপ সংক্রান্ত আমাদের প্রকল্পের সঙ্গে অভিন্ন হবে। এবং আমাদের ধারণায়, মেইন যদিও এখানে সোজাসুজি ‘ট্রাইব্যাল’ শব্দটি ব্যবহার করছেন না তবুও তাঁর মূল বক্তব্যটি ওই ট্রাইব্যাল সমাজ সংগঠনেরই ইংগিত দেয়। এখানে তাঁর রচনা থেকে দীর্ঘ উদ্ধৃতি তুল সে-কথা প্রমাণ করবার চেষ্টা করলে আমাদের আলোচনা ভারাক্রান্ত হবে; তাই সে-চেষ্টা পাদটীকায় (২৭৬) করাই ভালো।
তাহলে, ট্রাইব্যাল-সমাজের ওই অসম্পূর্ণ-বিলোপের প্রতিচ্ছবি পাওয়া যাচ্ছে সাবেক ভারতবর্ষের আইনকানুন সংক্রান্ত দুটি স্বতন্ত্র ধারার মধ্যে। একদিকে, রাষ্ট্রশক্তির যে-অধিনায়কেরা বাইরে থেকে আক্রমণ করে গণসমাজকে ধ্বংস করেছিলো এবং ওই গণসমাজের মানুষগুলিকে নিয়েই ছোটোছোটো স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামসমবায় গড়ে তোলবার চেষ্টা করেছিলো,—তাদেরই মুখপাত্র আইনকার্তাদের আইনকানুন। কিন্তু গ্রামসমবায়গুলির সঙ্গে রাষ্ট্রশক্তির যোগাযোগ অত্যন্ত ক্ষীণ ছিলো বলেই এই সব আইনকানুন দেশের জনসাধারণের মধ্যে পরিব্যাপ্ত হতে পারেনি। অপরপক্ষে, গ্রামসমবায়গুলির মধ্যে উৎপাদন পদ্ধতির কোনো মৌলিক পরিবর্তন দেখা দেয়নি, তাই পরিপূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়নি ওই গ্রামসমবায়গুলির মধ্যে থেকে ট্রাইব্যাল-সমাজের চিহ্ন। ফলে, আইনকানুন বলতে এই-গ্রামসমবায়গুলির মধ্যে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি ধারা প্রবর্তিত ছিলো এবং এই ধারাটিতে স্পষ্টভাবে চোখে পড়ে ট্রাইব্যাল সমাজের শাসন ব্যবস্থারই ধ্বংসাবশেষ। স্যর মেইন (২৭৭) বলছেন, বিলেতের চাষীদের সঙ্গে ভারতবর্ষের মানুষদের জীবনে মৌলিক তফাত আছে :

But the smaller organic groups of Indian society are very differently situated. They are constantly dwelling on tradition of a certain sort, they are so constituted that one man’s interests and impressions correct those of another, and some of theme have in their council of elders a permanent machinery for declaring traditional usages, and solving doubtful points.
অর্থাত, ভারতীয় সমাজের ছোটোছোটো অঙ্গাঙ্গী-সম্পর্ক-আবদ্ধ গোষ্ঠীগুলির বেলায় একেবারে অন্য রকম। এগুলি সর্বদাই কোনো-না-কোনো ঐতিহ্যের উপর নির্ভর করছে, এগুলির সংগঠন এমনই যে, একজনের স্বার্থ ও ধারণা অপরজনের স্বার্থ ও ধারণা দ্বারা সংশোধিত হয়, এবং বহু ক্ষেত্রে মাতব্বরদের পঞ্চায়েৎ বলে একটি ব্যবস্থার সাহায্যে নির্ণয় করবার প্রথা আছে, কোনটা সাবেক কালের আসল ঐতিহ্য এবং সংশয়ের ক্ষেত্রে কী বিধান হবে।

এরই দরুন ভারতবর্ষে লোকাচার-মূলক আইনকানুনের প্রভাব অতো প্রবল এবং এই ব্যবস্থাটির মধ্যে ট্রাইব্যাল-সমাজের চিহ্ন অত্যন্ত স্পষ্ট।
স্মৃতিমূলক আইনকানুন এবং লোকচার-মূলক আইনকানুন—স্যর হেনরি মেইন-এর পরিভাষায় codified law এবং customary laws—এই দুয়ের মধ্যে স্মৃতিমূলক আইনকানুনগুলি নিশ্চয়ই চূড়ান্তভাবে কৃত্রিম এবং অর্থহীন হবার কথা। কেননা, জনসাধারণের বাস্তব জীবনের সঙ্গে এগুলির সম্পর্ক প্রায় শূন্য বললেই হয়। স্যর হেনরি মেইনও (২৭৮) সেই কথা বলছেন, এবং স্মৃতিমূলক আইনকানুনগুলি যে কী অসম্ভব রকমের কৃত্রিম হয়ে দাঁড়িয়েছিলো তার নমুনা হিসেবে তিনি দেখাচ্ছেন এই আইন অনুসারে মানুষ সারা জীবন ধরে অর্থোপায়ের চেষ্টা করবে শেষ পর্যন্ত মৃত্যুর (শ্রাদ্ধের) খরচ যোগাবার জন্যেই! এই রকমের আরো কিছু কিছু দৃষ্টান্ত তিনি দিচ্ছেন। এবং এর তুলনায় নিশ্চয়ই লোকাচারমূলক আইনকানুনগুলির আভ্যন্তরীণ প্রাণশক্তি একেবারে সম্পূর্ণভাবে মুছে যায়নি। তার দৃষ্টান্ত হিসেবে স্যর হেনরি মেইন (২৭৯) দেখাচ্ছেন, সম্পত্তিতে বিধবার অধিকার ইত্যাদি নানা ব্যাপারে এই লোকাচার-মূলক আইনগুলির মধ্যে কিছুটা বেশি পরিমাণ সহজবুদ্ধির পরিচয় (‘a greater dose of commonsense’) পাওয়া যায়।
কিন্তু সেইসঙ্গেই মনে রাখতে হবে, ট্রাইব্যাল-সমাজের প্রাণশক্তি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে নতুন পরিবেশের মধ্যে গ্রথিত হবার পর একান্তভাবে অতীত-আশ্রয়ী এই লোকাচার-মূলক আইনকানুনগুলি মানুষের জীবনে এক অদ্ভুত বোঝার মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। এগুলি মানুষকে ভবিষ্যৎ দেখতে দেয়নি, বেঁধে রাখতে চেয়েছে ‘হাজার বছরের পুরানো অচল খোঁটায়’। ট্রাইব্যাল-সমাজের পটভূমিতে যে-পঞ্চায়েৎশাসন দলের সব মানুষকেই স্বাধীনতার ও সাম্যের মর্যাদা দিয়েছিলো, গ্রাম-সমবায়গুলির মধ্যে টিকে থাকতে গিয়ে সেই পঞ্চায়েৎশাসনই মানুষকে করে তুলেছিলো প্রাচীন প্রথার ক্রীতদাস। মার্ক্‌স তাই বলেছেন, এই গ্রাম-সমবায়গুলি মানবমনকে আবদ্ধ রেখেছিলো সংকীর্ণতম পরিধির মধ্যে, করে তুলেছিলো কুসংস্কারের সামনে প্রতিরোধহীন যন্ত্রের মতো, সাবেক নিয়মকানুনের ক্রীতদাস-বিশেষ। এবং স্মৃতিমূলক আইনের তুলনায় ওই লোকাচার-মূলক আইনগুলির মধ্যে আপেক্ষিকভাবে সাধারণ বুদ্ধির পরিচয় বেশি দেখতে পেলেও স্যর হেনরি মেইন (২৮০) এ-কথা বলতে ভুলছেন না যে,

Such individual in India is a slave to the customs of the group to which be belongs; and the customer of the several groups, various as they are, do not differ from one another with that practically infinite variety of difference which is found in the habits and practices of the individual men and women who make up the modern societies of the civilized West.
অর্থাৎ, ভারতবর্ষে ব্যক্তিবিশেষ হলো নিজের গোষ্ঠীর লোকাচারের দাস; এবং বিভিন্ন গোষ্ঠীর লোকাচারের মধ্যে যদিও বৈশিষ্ঠ্য আছে তবুও পশ্চিম দেশের আধুনিক সভ্য সমাজে নরনারীর অভ্যাস ও আচার ব্যবহারের মধ্যে যে-রকম প্রায় অসীম বৈচিত্র দেখা যায়, (এই গোষ্ঠীগুলির ব্যাপারে) তা নেই।

ট্রাইব্যাল-সমাজের বৈশিষ্ট্যগুলি ট্রাইব্যাল-সমাজের পটভূমি থেকে উৎপাটিত হয়ে নতুন পরিবেশে স্থানাস্তরিত হবার পর সেগুলির আদি-তাৎপর্য কী ভাবে বিপরীতে পর্যবসিত হয়, এই লোকাচার-মূলক আইনগুলি তারও দৃষ্টান্ত : ট্রাইব্যাল-সমাজের পটভূমিতেও ব্যক্তিবিশেষের স্বাতন্ত্র্য নেই, একের সঙ্গে দশের সম্পর্ক অঙ্গাঙ্গী। এবং ট্রাইব্যাল-সমাজের পটভূমিতে এই সম্পর্কের দরুনই মানুষগুলির মধ্যে সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতার স্বাভাবিক বিকাশ। অথচ গ্রামসমবায়গুলির মধ্যে সেই বৈশিষ্ট্যের ধ্বংসাবশেষই মানুষগুলিকে করে তুললো দাসের সামিল—অনড়, অচল কয়েকটি প্রাচীন প্রথার ক্রীতদাস।
আমাদের যুক্তি হলো, একদিক থেকে আইনকানুন এবং দর্শন, উভয়ই সমগোত্রীয়। উভয়কেই superstructure—এর বা খিলানের সঙ্গে তুলনা করা হয়, এবং উভয়েরই ভিত্তি হলো মানুষের বাস্তব-জীবনধারণ প্রণালী। তাই, লোকাচার-মূলক আইনকানুন, এবং ব্যাপক অর্থে, লোকায়তিক ধ্যানধারণা—উভয়ের স্বরূপই এক ধরনের হওয়া সম্ভব। অর্থাৎ, এগুলিও ট্রাইব্যাল-পর্যায়েরই স্মৃতিচিহ্ন বহন করছে, যদিও কিনা ট্রাইব্যাল-সমাজ থেকে উৎপাটিত হয়ে নতুন পরিস্থিতিতে এসে পড়বার পর এগুলির আদি-তাৎপর্য বিপরীতে পর্যবসিত হতে বাধ্য হয়েছে। তাই, এ-জাতীয় ধ্যানধারণা আজো আমাদের দেশে কী করে এমন ব্যাপকভাবে টিকে থাকলো, সে-প্রশ্নের জবাব পাওয়া যেতে পারে ট্রাইব্যাল-সমাজের অসম্পূর্ণ বিলোপ সংক্রান্ত প্রকল্পটির দিক থেকেই।

ট্রাইব্যাল সমাজের অসম্পূর্ণ বিলোপ সংক্রান্ত আমাদের ওই প্রকল্পটির পক্ষে আরো একটি আনুষঙ্গিক নজির হলো, আমাদের দেশের ব্রতগুলি। অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৮১) বলেছেন, যোষিৎ-প্রচলিত বা মেয়েলি ব্রতগুলি পুরাণের চেয়ে পুরোনো এবং এগুলি যে আজো আমাদের দেশে টিকে রয়েছে তার কারণ, আমাদের দেশের সদর-মহলের চেহারায় যাই পরিবর্তন হোক না কেন, অন্দরমহলের চেহারায় তেমন পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু এ-কথার তাৎপর্য ঠিক কী? অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর (২৮২) যখন এই ব্রতগুলির তাৎপর্য খুঁজতে গিয়ে আমেরিকার হুইচল জাতি বা মেক্সিকোর অনার্য জাতিদের আচার-আচরণ থেকে মূলসূত্র অনুসন্ধান করেন তখন আর সন্দেহের অবকাশ থাকে না যে, ‘পুরাণের চেয়ে পুরোনো’ কথার বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য হলো সমাজবিকাশের কোনো এক পুরোনো পর্যায়—আমেরিকার হুইচল বা মেক্সিকোর অনার্যরা আজো যে-পর্যায়ে আটকে থেকেছে। তার তাই, আমাদের অন্দরমহলটা এখনো তেমন বদলায়নি—এ-কথার বৈজ্ঞানিক তাৎপর্য হবে, সমাজবিকাশের সে-পর্যায়ের চিহ্ন আমাদের দেশ থেকে পরিপূর্ণভাবে বিলুপ্ত হয়নি। অর্থাৎ, ট্রাইব্যাল-সমাজের অসম্পূর্ণ-বিলোপ সংক্রান্ত আমাদের ওই প্রকল্পই। অবশ্যই, ট্রাইব্যাল-সমাজ সম্বন্ধে সাধারণভাবে জানতে পারা বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের উপর নির্ভর করে ব্রতগুলির আদি-তাৎপর্য উদ্ধারের চেষ্টা অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর সচেতনভাবে নিশ্চয়ই করেননি। তাই ব্রত সম্বন্ধে তাঁর মূল ইঙ্গিতগুলি দুর্মূল্য হলেও এ-বিষয়ে ভবিষ্যত-গবেষকদের পক্ষে গবেষণা করবার প্রচুর অবকাশ থেকে গিয়েছে। অর্থাৎ, ট্রাইব্যাল-সমাজ সম্বন্ধে সাধারণভাবে জানতে পারা বৈজ্ঞানিক তথ্যের উপর নির্ভর করে অগ্রসর হলে ব্রতগুলির উপর স্পষ্টতর আলোকপাত হবার সম্ভাবনা আছে। আমরা আগেই (২৮৩) আলোচনা করেছি, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ-বিষয়ে একটি মূল্যবান ইঙ্গিতকে স্বেচ্ছায় উপেক্ষা করেছেন। তিনি বলেছেন, ব্রতের একটি বৈশিষ্ট্য হলো, এ-জাতের আচরণ একা-একা করা যায় না—ব্রত তখনই, যখন দশে মিলে এক হয়ে একই কামনা করছে, একই আচরণে অংশ গ্রহণ করছে। কিন্তু এই বৈশিষ্ট্য ঠিক কেন? অবনীন্দ্রনাথ বললেন, সে-আলোচনা স্বতন্ত্র—সে আলোচনা তাঁর নয়। কিন্তু তাঁরই স্বীকৃতি অনুসারে যদি এই বিষয়টি ব্রতের একটি মূল লক্ষণ হয়ে থাকে তাহলে একে অগ্রাহ্য করে ব্রতের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে কী করে? আমরা দেখেছি, সমাজ-বিকাশের প্রাচীন পর্যায়ের দিক থেকে এই লক্ষণটি দুর্বোধ্য নয়। বরং, কল্পনায় কামনা-চরিতার্থ করে বাস্তবভাবে কামনা সফল করা,—প্রকৃতিকে জয় করা,—ততোদিনই সম্ভব যতোদিন পর্যন্ত দশের সঙ্গে একের অঙ্গাঙ্গী সম্পর্ক বিলুপ্ত না হয়। এদিক থেকে ব্রতগুলিও একটা আদি-তাৎপর্য নিশ্চয়ই ছিলো। সমাজ-বিকাশের পিছিয়ে-পড়া পর্যায়ে ব্রতগুলি মানুষকে বাঁচতে সাহায্য করেছে। কিন্তু সে-পর্যায় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই ব্রতগুলি মানুষকে বাঁচতে সাহায্য করেছে। কিন্তু সে-পর্যায় থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে এই ব্রতগুলিই আজ যে-ভাবে আমাদের দেশে বেঁচে আছে তা বিচার করে শিল্পের উৎপত্তি প্রভৃতি সমস্যার উপর যতো মূল্যবান আলোকপাতই সম্ভব হোক না কেন, বাস্তব আচার-অনুষ্ঠান হিসেবে—বাস্তব বিশ্বাস হিসেবে—এগুলি আজ দেশবাসীর জীবনে অন্ধ ও অর্থহীন কুসংস্কারের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

———————
২৬৭. অন্তত বাংলা দেশের ক্ষেত্রে নিশ্চয়ই তা নয়। এই গ্রন্থের পৃষ্ঠা ৪০০-৪০১ দ্রষ্টব্য।
২৬৮. এ-বিষয়ে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক দৃষ্টান্ত বোধহয় মহামহোমাধ্যায় পঞ্চানন তর্করত্ন প্রণীত ব্রহ্মসূত্রের শক্তিভাষ্য।
২৬৯. H. S. Maine VCEW Lectures 1 and 2.
২৭০. Ibid. 20.
২৭১. Ibid. 39.
২৭২. Ibid. 52.
২৭৩. Quoted in LPI 131.
২৭৪. K. Marx C 358.
২৭৫. H. S. Maine op. cit. 55-6
২৭৬. Ibid. 21-2. মেইন অবশ্যই ট্রাইব্যাল শব্দ ব্যবহার করছেন না; তার বদলে বলছেন, “India, because it is the great repository of verifiable phenomena of ancient usage and ancient judicial thought…”
২৭৭. Ibid. 57-8.
২৭৮. Ibid. 53-4.
২৭৯. Ibid.
২৮০. Ibid. 13-4.
২৮১. অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর : বাংলার ব্রত ৩ এবং ৯।
২৮২. ঐ ১৮-২৩।
২৮৩. ঐ ৮।