২১. বিনয় অপেক্ষা করেছিল

বিনয় অপেক্ষা করেছিল। আজকেও আবার ঠিক সেই সময় লাল আলোর সঙ্কেত দেখা গেল নীচের অন্ধকারে।

বিনয় জানালার সামনে সতর্ক হয়েই দাঁড়িয়েছিল। সে আর মহুর্ত বিলম্ব করে না। টৰ্চটা নিয়ে দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নীচে নামে যায়।

গতরাত্রের মত আজও দরজাটা খোলা। কিন্তু নজর দেবার মত যেন বিনয়ের ফুরসত নেই।

দ্রুতপদে বিনয় বাগানের দিকে চলে।

কিন্তু নির্দিষ্ট জায়গায় পৌছবার আগেই কার সঙ্গে যেন তার অন্ধকারেই ধাক্কা লাগে।

কে?

কিন্তু যার সঙ্গে বিনয়ের অন্ধকারে ধাক্কা লেগেছিল সে বিনয়ের প্রশ্নের কোন জবাব না দিয়ে বিনয়ের হাতটা চেপে ধরে চাপাকণ্ঠে কেবল বলে, চুপ! আস্তে!

কে?

বিনয়বাবু, আমি কিরীটী।

বিস্ময়ে একটা প্রচণ্ড ধাক্কা খায় বিনয়। কয়েকটা মুহূর্ত তার মুখ দিয়ে কথাই সরে না।

কিরীটী রায়! এই মধ্যরাত্রে রত্নমঞ্জিলের বাগানের মধ্যে অন্ধকারে!

অদূরে এমন সময় একটা দ্রুতপলায়নপর পদশব্দ শোনা গেল। শুকনো ঝরা পাতার ওপর দিয়ে মচমচেয়ে কে যেন দ্রুত পালিয়ে গেল।

সব মাটি করে দিলেন। পালিয়ে গেল লোকটা। কিরীটী বললে।

কিরীটীর কথায় বিনয়ের বিস্ময় যেন উত্তরোত্তর বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়। তবু প্রশ্ন করে, কে? কে পালাল?

তা আর জেনে কি হবে! কিন্তু আপনাকে কলকাতা থেকে আসবার সময় বার বার বলে। দিয়েছিলাম না, দিনেরাত্রে সর্বদা সাবধানে থাকবেন! অন্ধকারে রাত্রে একা এক নিরস্ত্ৰ ঐ জঙ্গলের মধ্যে এক লাল আলোর নিশানা দেখে ছুটছিলেন, যদি আচমকা বিপদে পড়তেন কে রক্ষণ করত আপনাকে! ছিঃ আপনি, একেবার ছেলেমানুষ!

কিন্তু—

পরশু রাত্রের ব্যাপারেও আপনার শিক্ষা হয়নি! আবার ঐ জঙ্গলের মধ্যে ছুটছিলেন!

আপনি—আপনি পরশু রাত্রের ব্যাপার জানেন?

জানি। কেন ভিচের সিগারের টুকরো পাননি?

Oh! It was then you? তা কবে এলেন আপনি?

চারদিন হল। যাক, এখন চলুন দেখা যাক মনোহর কি করছে।

দুজনে ফিরে এল রত্নমঞ্জিলে। দে

খা গেল মনোহরের ঘরের দরজা খোলা। আগে বিনয় ও পশ্চাতে কিরীটী মনোহরের ঘরের মধ্যে প্রবেশ করে।

মাটির শয্যায় শুয়ে মনোহর নাক ডাকাচ্ছে।

ভদ্রলোক ঘুমোচ্ছেন যখন, আপাতত আর ওঁকে বিরক্ত করে প্রয়োজন নেই। চলুন বাইরে যাওয়া যাক।

বেশ একটু জোরে জোরেই কথাগুলো উচ্চারণ করে কিরীটী বিনয়কে নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে এল এবং নিঃশব্দে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়িয়ে দরজার কবাট দুটো বাইরে থেকে টেনে শিকল তুলে দিল।

ও কি!

এতকাল এ বাড়ির কেয়ারটেকার ছিল, তাই ওর সম্পর্কে একটু কেয়ার নেওয়া হল। এখন চলুন ওপরে যাওয়া যাক। কিরাটী মৃদু হেসে বললে।

দুজনে সবে ওপরের বারান্দায় পা দিয়েছে, সুজাতার শঙ্কিত কণ্ঠস্বর শোনা গেল, বিনয়! বিনয়!

সুজাতা হন্তদন্ত হয়ে বিনয়ের ঘরের দিকেই আসছিল।

কি-কি হয়েছে সুজাতা? বলতে বলতে উৎকণ্ঠিত বিনয় এগিয়ে যায়!

বাবা–বাবাকে তার ঘরে দেখছি না! ঘরের দরজা খোলা!

সে কি! চল তো?

সুজাতা, বিনয় ও কিরীটী তিনজনেই এগিয়ে যায় বামদেবের শয়নকক্ষের দিকে।

সত্যি ঘর খালি।

বিনয় থমকে দাঁড়িয়ে যায়। কিরীটী কিন্তু ঘরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ঘরের মধ্যে একটি মিষ্টি উগ্ৰ গন্ধ পেয়েছিল।

বার দুই জোরে জোরে ভ্ৰাণ নিয়ে কিরীটী বললে, হুঁ, ক্লোরোফরম!

সুজাতার মুখে যা শোনা গেল তার মর্মার্থ এই, হঠাৎ ঘুম ভেঙে সুজাতা বাইরে এসে বামদেবের শয়নঘরের দরজা খোলা দেখতে পেয়ে চমকে ওঠে। বামদেবের চিরদিন শয়ন ঘরের দরজা বন্ধ করে যেমন শোওয়া অভ্যাস তেমনি রাত্ৰেও কখনও তিনি ওঠেন। না। বহুকাল থেকেই তিনি রাত নটায় শয্যাগ্রহণ ও ভোর পাঁচটায় শয্যাত্যাগ করেন।

তবু সুজাতা বাথরুমটা একবার দেখে এসেছে। কিন্তু সেখানেও বামদেব নেই।

কি হল কিছুই তো বুঝতে পারছি না কিরীটীবাবু! উৎকণ্ঠিত বিনয় বলে।

কিরীটীর চিন্তাশক্তি তখন অত্যন্ত সক্রিয়। ঘরের মধ্যে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গেই তার নাসারান্ধে, যে মিষ্টি গন্ধের ঢেউ প্রবেশ করেছিল, সেটা যে ক্লোরোফরম ছাড়া আর কিছুই নয় এবং বামদেবের অদৃশ্য হওয়ার রহস্যটা যে সেইখানেই দানা বেঁধে আছে, কিরীটীর পক্ষে সেটা বুঝতে কষ্ট হয়নি।

 

আবার আজ রাত্রে সুযোগ পেয়েছে বাণী।

ঘুম আসছিল না চোখে কিছুতেই। চোখ বুজে একপ্রকার বাধ্য হয়েই শয্যার ওপরে শুয়েছিল, কেননা ঘরের মধ্যে তার বাবাও শুয়ে আছে।

বাবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে ঘর থেকে বের হওয়া সোজা নয়।

কখনো দু চোখের পাতা বুজিয়ে, কখনো অন্ধকারে তাকিয়ে ক্লান্ত হয়ে বাণী হঠাৎ একসময় দেখতে পেল ধীরে ধীরে তার বাপ শয্যা ছেড়ে উঠে বসল।

কিছুক্ষণ অন্ধকারেই তার শয্যার দিকে তাকিয়ে থেকে উঠে দাঁড়াল। ধীরে ধীরে নিঃশব্দ পায়ে অনিল ঘর থেকে বের হয়ে গেল।

বাণী তথাপি কিছুক্ষণ শয্যার ওপরে শুয়ে রইল। তারপর উঠে বসে দেশলাইটা দিয়ে প্রদীপটা জ্বালল। গতকাল বাণী একসময় লক্ষ্য করেছিল। হঠাৎ মধ্যরাত্রে ঘুম ভেঙে গিয়ে, ঘরের দেওয়ালে একটা ফোকরের মধ্যে বাবা তার পুঁটিলিটা রাখে আর সেই লাল মলাটের নোটবইটা রাখে ঘরের মেঝেতে একটা গর্তে ইট চাপা দিয়ে। নোটবইটা রাখবার জায়গাটার সন্ধান এতদিন বাণী পায়নি।

প্রদীপের আলোয় গতরাত্রের দেখা দেওয়ালের একটা ইট সরিয়ে ফোকরটার মধ্যে হাত গলিয়ে পুঁটলিটা টেনে বের করল।

পুরাতন লাল রংয়ের শালুতে বাঁধা একটা ছোট পুঁটলি।

প্রদীপের স্নান আলোর সামনে বসে কম্পিত হাতে বাণী পুঁটলিটা খুলে ফেলল।

পুঁটলিটা খুলতেই একটা ছোট চৌকো সাইজের কারুকার্য করা হাতীর দাঁতের তৈরী কৌটো বের হল। বিস্ময়ে কিছুক্ষণ কৌটোটার দিকে তাকিয়ে থাকে বাণী।

ধীরে ধীরে কৌটোর ঢাকনিটা খুলতেই স্নান প্রদীপের আলোয় তার বিস্মিত দৃষ্টির সামনে প্রকাশিত হল সযত্নে তুলোর ওপরে রাখা একটি সুবর্ণকিঙ্কন।

সেকেলে জড়োয়া একেবারে খাঁটি পাকা সোনার তৈরী কঙ্কনটি।

হাঙ্গরমুখী কঙ্কন। দু’পাশ হতে দুটো হাঙ্গরের হিংস্র মুখ যেন পরস্পরের সঙ্গে এসে ঠেকেছে।

কঙ্কনের গায়ে যে সুক্ষ্ম ছিলার কাজ তাও দেখবার মত।

নারীমনের সহজাত কৌতূহলেই বাণী কঙ্কনটা একবার হাতে নিয়ে দেখে।

বাইরে একটা মৃদু পত্রমর্মর শোনা গেল।

চমকে উঠে তাড়াতাড়ি কঙ্কনটি কৌটোয় ভরে পুঁটলির মধ্যে রেখে যথাস্থানে গিয়ে রেখে দিল।

সুবৰ্ণকিঙ্কন! লাল মলাটের নোটবই তার পিতামহ শশাঙ্কমোহন চৌধুরীর রোজনামচা–ডায়েরী!

নিশ্চয়ই ঐ নোটবইয়ের মধ্যে তাহলে ঐ কঙ্কন সম্পর্কে কোন কথা আছে। কার ঐ কঙ্কন?

অদম্য কৌতূহলকে নিবৃত্ত করে রাখতে পারে না আর বাণী। ঘরের মেঝে থেকে ইট তুলে গর্তের মধ্যে যেখানে লাল মলাটের নোটবইটা লুকোনো থাকে তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে বাণী নোটবইটা বের করে আনলে।

প্রদীপের আলোয় বসে দ্রুত একটার পর একটা ডায়েরীর পাতা উল্টে যেতে লাগল।

হঠাৎ মাঝামাঝি এক জায়গায় এসে তার চোখের দৃষ্টি আবদ্ধ হল।

মৃন্ময়ী জানে না যে ঐ সুবর্ণকিঙ্কনের কথা অনেকদিন আগেই আমি শ্বশুর মশাইয়ের কাছে শুনেছি। অনিলের জন্মের বছর দেড়েক আগে তিনি একদিন হঠাৎ সন্ধ্যেবেলায় বহিমহলে আমার ঘরে এসে হাজির হলেন। একথা সেকথার পর একসময় আমাকে বললেন, দেখ বাবা, তোমাকে আজ একটা কথা বলব। আমাদের পূর্বপুরুষদের কিছু সঞ্চিত হীরা জহরৎ ও বাদশাহী মোহর আছে। বাবা মৃত্যুর সময় আমাকে বলে গিয়েছিলেন, ঐ ধনরত্ন রত্নমঞ্জিলের ঐ নৈঋত কোণে যে শিংশপা বৃক্ষটি আছে, তার গোড়া থেকে পূব কোণে এক জায়গায় মাটির নীচে একটি শিলাখণ্ড প্রোথিত আছে, সেই শিলাখণ্ডের নীচে একটি ছোট লোহার সিন্দুকে সেই ধনরত্ন লুকানো আছে, সিন্দুকটির কোন চাবি নেই। সিন্দুকের ওপরে পাশাপাশি অনেকটা দুটি বলয়ের আকারে খাঁজ কাটা আছে। ঐ বলয়াকার খাঁজের মধ্যে দুটি কঙ্কন বসিয়ে চাপ দিলেই আপনা হতেই তখন সিন্দুকের ডালাটি নাকি খুলে যাবে। মীনুর হাতে যে দুটি সুবর্ণকিঙ্কন দেখেছ, যা তোমার শ্বাশুড়ি তাকে দিয়েছেন, একমাত্র ঐ দুটি কঙ্কনের সাহায্যেই খোলা যায়। অন্য কোন কঙ্কন দিয়েই সিন্দুক খোলা যাবে না। শরীর আমার ইদানীং খারাপ যাচ্ছে। কবে আছি কবে নেই—তই তোমাকে এই গোপন তথ্যটি বলে গেলাম। যদিচ এই বংশের জ্যেষ্ঠ পুত্রেরই একমাত্র অধিকার আছে। ঐ ধনরত্নে, তবু তোমাকে বলে রাখলাম এইজন্য যে আর তো পুত্র আমাদের হবে না, তোমরাই হবে সম্পত্তির একমাত্র উত্তরাধিকারী।

কথাটা শুনে আমি চুপ করেই রইলাম।

শ্বশুরমশাই একটু থেমে আবার বলতে লাগলেন, মীনুকেই আমি একথা বলে যেতাম, কিন্তু ইচ্ছা করেই তাকে বলিনি, কারণ সে আমার নিজের সন্তান হলেও সে অস্থির চপল ও উগ্র প্রকৃতির। বিলাসব্যসনই দেখেছি তার জীবনের একমাত্ৰ কাম্য। সে হয়তো ঐ ধনরত্নের লোভ সামাতে পারবে না। পূর্ব-পুরুষের নির্দেশ আছে, অত্যন্ত প্রয়োজন ছাড়া নিতান্ত অভাব না হলে কোন মতেই যেন ঐ সঞ্চিত গুপ্তধনে না হাত দেওয়া হয়। তুমি নির্লোভ, নীতিপরায়ণ। তুমি সে লোভকে জয় করতে পারবে, তাই তোমাকে আরো বলে গেলাম।

এতক্ষণে বাণীর কাছে সব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

পিতার এই জঙ্গলের মধ্যে এসে পড়ে থাকার উদ্দেশ্য তার সামনে পরিষ্কার হয়ে যায়।

পিতা তার তাহলে সেই গুপ্ত ধনৈস্বর্যের লোভেই এখানে এসেছে, তাই সে দিবারাত্র জঙ্গলের মধ্যে এখানে ওখানে মাটি খোঁড়ে, জঙ্গল সাফ করে।

বাণী আবার ডায়েরী পাতা ওল্টাতে লাগল। আর এক পাতায় লেখা আছে :

মৃন্ময়ীকে স্পষ্টই আজ বলে দিয়েছি, বামদেবের ভাবী স্ত্রীই ঐ কঙ্কনের যখন একমাত্র উত্তরাধিকারিণী তখন কঙ্কন তাকে এ বাড়ি ছেড়ে যাবার আগে একটি ফিরত দিয়ে যেতেই হবে। মৃন্ময়ী শেষ পর্যন্ত স্বীকৃত হয়েছে।