২১. পত্রাবলী ৩১৫-৩২৪

৩১৫*

[মিঃ গুডউইনকে লিখিত]

৩৯, ভিক্টোরিয়া ষ্ট্রীট, লণ্ডন
২০ নভেম্বর, ১৮৯৬

প্রিয় আলাসিঙ্গা,
আগামী ১৬ ডিসেম্বর আমি ইংলণ্ড থেকে যাত্রা করছি। ইতালীতে কয়েকটি জায়গা দেখে নেপল‍্‍সে জার্মান লয়েড লাইনের ‘S. S. Prinz Regent Leopold’ নামক জাহাজ ধরব। আগামী ১৪ জানুআরী ষ্টীমার কলম্বো গিয়ে লাগবার কথা। সিংহলে অল্পস্বল্প দেখবার ইচ্ছা আছে, তারপর মান্দ্রাজ যাব।

আমার সঙ্গে যাচ্ছেন আমার ইংরেজ বন্ধু সেভিয়ার দম্পতি ও গুডউইন। মিঃ সেভিয়ার ও তাঁর সহধর্মিণী হিমালয়ে আলমোড়ার কাছে আশ্রয় স্থাপন করতে যাচ্ছেন। ঐ হবে আমার হিমালয়ের কেন্দ্র, আর পাশ্চাত্য শিষ্যেরা সেখানে এসে ব্রহ্মচারী ও সন্ন্যাসীরূপে বাস করতে পারবে। গুডউইন একজন অবিবাহিত যুবক, সে আমার সঙ্গে থাকবে এবং ভ্রমণ করবে। সে ঠিক সন্ন্যাসীরই মত।

শ্রীরামকৃষ্ণের জন্মোৎসবের সময় আমার কলিকাতায় থাকার ভারি ইচ্ছা। সুতরাং খবর নিয়ে উৎসবের তারিখটি জেনে রেখো, যাতে আমায় মান্দ্রাজে বলতে পার।কলিকাতা আর মান্দ্রাজে দুটি কেন্দ্র খুলব—এই হচ্ছে আমার বর্তমান পরিকল্পনা; সেখানে যুবক প্রচারক তৈরী করা হবে। কলিকাতায় কেন্দ্র খোলবার মত অর্থ আমার হাতে আছে। শ্রীরামকৃষ্ণ আজীবন সেখানেই কাজ করে গেছেন, সুতরাং কলিকাতার উপরেই আমাকে প্রথম নজর দিতে হবে। মান্দ্রাজে কেন্দ্র খোলবার মত টাকাপয়সা, আশা করি ভারতবর্ষ থেকেই উঠবে।

এই তিনটি কেন্দ্র নিয়েই এখন আমরা কাজ আরম্ভ করব; পরে বোম্বাই ও এলাহাবাদে যাব। প্রভুর ইচ্ছা হলে এ-সকল কেন্দ্র হতে আমরা যে শুধু ভারতকেই আক্রমণ করব তা নয়, আমরা পৃথিবীর সমস্ত দেশেই দলে দলে প্রচারক পাঠাব। প্রাণ দিয়ে কাজ করে যাব। মনে রেখো, আমাদিগকে এক সময় একটিমাত্র কাজ নিয়ে পড়ে থাকতে হবে। কিছুদিনের জন্য ৩৯, ভিক্টোরিয়া ষ্ট্রীট আমার প্রধান ঠিকানা, কারণ ওখান থেকেই কাজ চালান হবে। স্টার্ডি প্রকাণ্ড এক বাক্স ‘ব্রহ্মবাদিন্’ পত্রিকা পেয়েছে। আমি আগে জানতাম না, সে এখন ঐ জন্য গ্রাহক সংগ্রহ করছে।

এখন তো আমাদের ইংরেজী পত্রিকাখানি দাঁড়িয়ে গেছে; অতঃপর ভারতীয় বিভিন্ন ভাষায় কয়েকখানি আরম্ভ করতে পারি। উইম্বল‍্‍ডনের মিস নোব্‌ল্‌ একজন ভাল কর্মী। তিনিও মান্দ্রাজের দুইটি পত্রিকার জন্য গ্রাহক সংগ্রহ করতে চেষ্টা করবেন। তিনি তোমায় পত্র লিখবেন। এই সব কাজ ধীরে ধীরে, কিন্তু সুনিশ্চিতভাবে গড়ে উঠবে। অল্পসংখ্যক অনুগামীরাই এই-জাতীয় কাগজের পৃষ্ঠপোষক হয়। এখন কথা এই—এরূপ আশা করা চলে না যে, তারা একসঙ্গে অত্যধিক কাজের ভার নেবে। ইংলণ্ডের কাজের জন্য তাদের অর্থ সংগ্রহ করতে হবে, বই কিনতে হবে, এখানকার পত্রিকার জন্য গ্রাহক যোগাড় করতে হবে এবং সর্বশেষে ভারতের পত্রিকার চাঁদা দিতে হবে! এতটা করা চলে না। এরূপ করলে তা ধর্মপ্রচার না হয়ে বরং ব্যবসার মতই দেখাবে। সুতরাং তোমাদের অপেক্ষা করতে হবে। তবে আমার মনে হয়, এখানে জনকয়েক গ্রাহক পাওয়া যাবে। ভারতের লোকেরাই ভারতের কাগজগুলির পৃষ্ঠপোষক হবে। সব জাতির নিকট সমানভাবে গ্রহণীয় কোন কাগজ প্রকাশ করতে হলে সব জাতিরই লেখক সংগ্রহ করতে হবে; আর তার মানে হচ্ছে—বছরে অন্ততঃ লক্ষ টাকা খরচ করতে হবে। তা ছাড়া আমার অনুপস্থিতিতে এখানকার লোকদের কাজ থাকা চাই; তা না হলে সব ভেঙেচুরে যাবে। অতএব এখানে একখানি পত্রিকা চাই; ক্রমে আমেরিকাতেও চাই।

এ-কথা ভুলে যেও না যে, সব দেশের লোকের প্রতিই আমার টান রয়েছে, শুধু ভারতের প্রতি নয়। আমার শরীর ভাল আছে, অভেদানন্দেরও তাই। তোমরা সকলে আমার আন্তরিক ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানবে। ইতি

তোমাদের
বিবেকানন্দ

৩০৬*

[শ্রীযুক্ত লালা বদ্রী শাহকে লিখিত]

৩৯, ভিক্টোরিয়া ষ্ট্রীট, লণ্ডন
২১ নভেম্বর, ১৮৯৬

প্রিয় লালাজী,
৭ জানুআরী নাগাদ আমি মান্দ্রাজে পৌঁছব; কয়েক দিন সমতলে থেকে আমার আলমোড়া যাবার ইচ্ছা।

আমার সঙ্গে তিনজন ইংরেজ বন্ধু আছেন; তাঁদের মধ্যে দুজন—সেভিয়ার-দম্পতি—আলমোড়ায় বসবাস করবেন। আপনি হয়তো জানেন, তাঁরা আমার শিষ্য এবং আমার জন্য হিমালয়ে আশ্রম তৈরী করবেন। এই কারণেই একটি উপযুক্ত স্থানের সন্ধান করতে আপনাকে বলেছিলাম। একটি সমগ্র পাহাড় আমাদের নিজেদের জন্য চাই, যেখান থেকে হিমালয়ের তুষারশ্রেণী দেখতে পাওয়া যায়। অবশ্য উপযুক্ত স্থান নির্বাচন করে আশ্রম প্রস্তুত করতে সময় লাগবে। ইতোমধ্যে অনুগ্রহপূর্বক আমার বন্ধুদের জন্য একটি বাড়ী ভাড়া করবেন। বাংলোটিতে তিনজনের স্থান-সঙ্কুলান হওয়া চাই। বড় বাড়ীর কোন প্রয়োজন নেই, আপাততঃ একটি ছোট বাড়ী হলেই চলবে। আমার বন্ধুগণ সেই বাড়ীতে থেকে আশ্রমের জন্য উপযুক্ত স্থান ও বাড়ীর অন্বেষণ করবেন।

এই চিঠির উত্তর দেবার প্রয়োজন নেই। কারণ উত্তর আমার হাতে আসার পূর্বেই আমি ভারতবর্ষের পথে যাত্রা করব। মান্দ্রাজে পৌঁছেই আপনাকে তার করে জানাব।

আপনারা সকলে আমার ভালবাসা ও শুভেচ্ছা জানবেন। ইতি

আপনাদের
বিবেকানন্দ

৩১৭*

[মিস মেরী ও মিস হ্যারিয়েট হেলকে লিখিত]

৩৯, ভিক্টোরিয়া ষ্ট্রীট, লণ্ডন
৭ ২৮ নভেম্বর, ১৮৯৬

প্রিয় ভগিনীগণ,
আমার মনে হয়, যে-কোন কারণেই হোক, তোমাদের চারজনকেই আমি সবচেয়ে বেশী ভালবাসি এবং আমি সগর্বে বিশ্বাস করি যে, তোমরা চারজনও আমাকে সেই রকম ভালবাস। এইজন্য ভারতবর্ষে যাবার আগে স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই তোমাদের কয়েক ছত্র লিখছি। লণ্ডনের প্রচারকার্যে খুব সাফল্য হয়েছে। ইংরেজরা আমেরিকানদের মত অত বুদ্ধিমান নয়; কিন্তু একবার যদি কেউ তাদের হৃদয় অধিকার করতে পারে, তাহলে তারা চিরকালের জন্য তার গোলাম হয়ে যাবে। ধীরে ধীরে আমি তাদের হৃদয় অধিকার করেছি। আশ্চর্যের বিষয়, এই ছ-মাসের কাজেই জনসভায় বক্তৃতার কথা ছেড়ে দিলেও আমার ক্লাসে বরাবর ১২০ জন উপস্থিত হচ্ছে। ইংরেজ কাজের লোক, সুতরাং এখানকার প্রত্যেকেই কাজে কিছু করতে চায়। ক্যাপ্টেন ও মিসেস সেভিয়ার এবং মিঃ গুডউইন কাজ করবার জন্য আমার সঙ্গে ভারতে যাচ্ছেন এবং এই কাজে তাঁরা নিজেদের অর্থ ব্যয় করবেন। এখানে আরও বহুলোক ঐরূপ করতে প্রস্তুত। সম্ভ্রান্ত বংশের স্ত্রীপুরুষদের মাথায় একবার একটা ভাব ঢুকিয়ে দিতে পারলে, সেটা কার্যে পরিণত করবার জন্য তাঁরা যথাসর্বস্ব ত্যাগ করতেও বদ্ধপরিকর। আনন্দের সংবাদ এই (আর এটা বড় কম কথা নয়) যে, ভারতের কাজ আরম্ভ করবার জন্য অর্থ-সাহায্য পাওয়া গেছে এবং পরে আরও পাওয়া যাবে। ইংরেজ জাতি সম্বন্ধে আমার যে ধারণা ছিল, তার আমূল পরিবর্তন হয়েছে। এখন আমি বুঝতে পারছি, অন্য সব জাতের চেয়ে প্রভু তাদের কেন অধিক কৃপা করেছেন। তারা অটল, অকপটতা তাদের অস্থিমজ্জাগত, তাদের অন্তর গভীর অনুভূতিতে পূর্ণ—কেবল বাইরে একটা কঠোরতার আবরণ মাত্র রয়েছে। ঐটে ভেঙে দিতে পারলেই হল—বস্, তোমার মনের মানুষ খুঁজে পাবে।

সম্প্রতি আমি কলিকাতায় একটি ও হিমালয়ে আর একটি কেন্দ্র স্থাপন করতে যাচ্ছি। প্রায় ৭০০০ ফুট উচ্চতার এলটি গোটা পাহাড়ের উপর এই কেন্দ্রটি স্থাপিত হবে। ঐ পাহাড়টি গ্রীষ্মকালে বেশ শীতল থাকবে, আর শীতকালে খুব ঠাণ্ডা হবে। ক্যাপ্টেন ও মিসেস সেভিয়ার ঐখানে থাকবেন এবং ঐটি ইওরোপীয় কর্মিগণের কেন্দ্র হবে। আমি তাদের জোর করে ভারতীয় জীবন-প্রণালী অনুসারে চালিয়ে এবং ভারতের উত্তপ্ত সমতলভূমিতে বাস করিয়ে মেরে ফেলতে চাই না। আমাদের কার্যপ্রণালী হচ্ছে এই যে, শত শত হিন্দু যুবক প্রত্যেক সভ্যদেশে গিয়ে [বেদান্ত] প্রচার করুক, আর সে-সব দেশ থেকে নরনারী পাঠাক ভারতবর্ষে কাজ করতে। এতে পরস্পরের মধ্যে বেশ একটা আদানপ্রদান হবে। কেন্দ্রগুলি প্রতিষ্ঠা করে আমি ‘জবের গ্রন্থে’ বর্ণিত ভদ্রলোকটির মত১১৩ উপরে নীচে চারিদিক ঘুরে বেড়াব।

ডাক ধরতে হবে, আজ এখানেই শেষ। সব দিকেই আমার কাজের সুবিধা হয়ে আসছে—এতে আমি খুশী এবং জানি তোমরাও আমার মত খুশী হবে। তোমরা অশেষ কল্যাণ ও সুখশান্তি লাভ কর। ইতি

তোমাদের চিরস্নেহবদ্ধ
বিবেকানন্দ

পুঃ—ধর্মপালের খবর কি? তিনি কি করছেন? তাঁর সঙ্গে দেখা হলে আমার ভালবাসা জানিও।

—বি

৩১৮*

১৪, গ্রেকোট গার্ডেন্‌স্
ওয়েষ্টমিনষ্টার, লণ্ডন
৩ ডিসেম্বর, ১৮৯৬

প্রিয় এলবার্টা,
‘জো জো’কে লেখা ম্যাবেল (Mabel)-এর একটি চিঠি একসঙ্গে তোমাকে পাঠিয়ে দিচ্ছি। আমি এর মধ্যেকার সংবাদটি খুব উপভোগ করেছি এবং তুমিও নিশ্চয়ই করবে।

এখান থেকে ১৬ যাত্রা করে নেপল‍্‍স্-এ গিয়ে আমাকে ষ্টীমার ধরতে হবে। দিনকয়েক আমি ইতালীতে থাকব—চার পাঁচদিন রোমে। বিদায় নেবার আগে তোমার সঙ্গে একবার দেখা হলে খুব খুশী হব।

ইংলণ্ড থেকে ক্যাপ্টেন ও মিসেস সেভিয়ার আমার সঙ্গে ভারতে যাচ্ছেন, তাঁরা অবশ্য আমার সঙ্গে ইতালীতেও থাকবেন। গত গ্রীষ্মে তুমি তাঁদের দেখেছ। বছরখানেকের মধ্যে আমেরিকা, তারপর ইওরোপে ফিরে আসব, ইচ্ছা করি।

প্রীতি ও আশীর্বাদসহ
বিবেকানন্দ

৩১৯*

[মিস ম্যাকলাউডকে লিখিত]

দি গ্রেকোট গার্ডেন্‌স্
ওয়েষ্টমিনষ্টার, লণ্ডন
৩ ডিসেম্বর, ১৮৯৬

প্রিয় জো,
তোমার সহৃদয় আমন্ত্রণের জন্য অনেক অনেক ধন্যবাদ, প্রিয় জো জো কিন্তু বিধি বাম। ক্যাপ্টেন ও মিসেস সেভিয়ার এবং মিঃ গুডউইনের সঙ্গে ১৬ তারিখ ভারতের দিকে যাত্রা করছি। সেভিয়ার-দম্পতি ও আমি নেপল‍্‍স্-এ জাহাজ ধরব। রোমে চারদিন সময় পাওয়া যাবে, তার মধ্যে এলবার্টার সঙ্গে দেখা করে বিদায় নেব।

এই মুহূর্তে ব্যাপার খুব জমজমাটি; ৩৯, নং ভিক্টোরিয়া ষ্ট্রীটে বড় হলঘরটি লোকে পরিপূর্ণ এবং এখনও আরও লোক আসছে।

হ্যাঁ আমার সেই পুরাতন প্রিয় দেশটি এখন আমায় ডাকছে; যেতেই হবে আমাকে। সুতরাং এই এপ্রিলে রাশিয়ায় যাবার সকল পরিকল্পনা বিদায়। ভারতে কাজকর্ম কিছুটা গোছগাছ করে দিয়েই আমি চিরসুন্দর আমেরিকা ইংলণ্ড প্রভৃতি স্থানে আবার ফিরে আসছি।

ম্যাবেলের চিঠিখানা পাঠিয়েছ, তোমার সহৃদয়তা—বাস্তবিকই সুসংবাদ। বেচারী ফক্সের জন্য শুধু আমার একটু দুঃখ হয়। যা হোক ম্যাবেল যে তার কবল থেকে মুক্তি পেয়েছে—এটা ভালই হয়েছে।

নিউ ইয়র্কে কাজকর্ম কি রকম চলছে—কিছু লেখনি। আশা করি সেখানকার খবর সব ভালই। বেচারী কোলা! সে কি এখন কিছু রোজকারের ব্যবস্থা করতে পেরেছে?

গুডউইনের আসাটা একটা সৌভাগ্য, কারণ তার ফলে এখানকার বক্তৃতাগুলি লিপিবদ্ধ হয়ে পর্যায়ক্রমে প্রকাশিত হচ্ছে। ইতোমধ্যেই খরচা পোষাবার মত যথেষ্ট গ্রাহক জুটে গিয়েছে।

আগামী সপ্তাহে তিনটি বক্তৃতা, বস্, তারপর এই মরসুমের মত আমার লণ্ডনের কাজ শেষ। অবশ্য এখানকার সকলেই ভাবছেন, এই সাফল্যের মুখে কাজটা ছেড়ে যাওয়া বোকামি, কিন্তু আমার প্রিয় প্রভু বলছেন, ‘প্রাচীন ভারতের অভিমুখে যাত্রা কর’। আমি তাঁর আদেশ পালন করব।

ফ্র্যাঙ্কিনসেন্স, মা, হলিস্টার এবং প্রত্যেককে আমার চিরন্তন ভালবাসা ও আশীর্বাদ জানাবে এবং তোমার জন্যও তাই।

চির আন্তরিকভাবে তোমার
বিবেকানন্দ

৩২০*

৩৯, ভিক্টোরিয়া ষ্ট্রীট, লণ্ডন
৯ ডিসেম্বর, ১৮৯৬

প্রিয় মিসেস বুল,
আপনার অতি উদার দানের প্রতিশ্রুতির জন্য কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা নিষ্প্রয়োজন। কার্যারম্ভেই অনেক অর্থ হাতে নিয়ে আমি নিজেকে বিব্রত করতে চাই না; তবে কাজের প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ঐ অর্থকে খাটাতে পারলেই আমি সুখী হব। খুব সামান্যভাবে কাজ আরম্ভ করাই আমার ইচ্ছা। এখনও আমার কোন সঠিক পরিকল্পনা নেই। ভারতবর্ষে কার্যক্ষেত্রে পৌঁছে আমার পবিত্র দায়িত্বের স্বরূপ জানতে পারব। ভারত থেকে আমার পরিকল্পনা এবং উহা কার্যে পরিণত করার উপায় আপনাকে আরও বিশদভাবে জানাব।

আমি ১৬ তারিখে রওনা হব এবং ইতালীতে কয়েকদিন কাটিয়ে নেপল‍্‍সে জাহাজ ধরব।

অনুগ্রহ করে মিসেস—, সারদানন্দ এবং ওখানকার অন্যান্য বন্ধুবান্ধবকে আমার ভালবাসা জানাবেন। আপনার সম্বন্ধে এইটুকু বলতে পারি যে, আপনাকে আমি সর্বদাই সবচেয়ে বড় বন্ধু বলে মনে করে এসেছি এবং আজীবন তাই করব। আমার আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছাদি জানবেন। ইতি

ভবদীয়
বিবেকানন্দ

৩২১*

[জনৈক আমেরিকান মহিলাকে লিখিত]

লণ্ডন
১৩ ডিসেম্বর, ১৮৯৬

প্রিয় মহাশয়া,
নীতির ব্যাপারেও ক্রমোন্নতির মাত্রা আছে, এই ভাবটি ধরতে পারলেই আর সব স্পষ্ট হয়ে যাবে। একটু কম সংসারিত্ব, একটু কম প্রতিকার, একটু কম হিংসার মধ্য দিয়ে আমাদিগকে ক্রমে ক্রমে বৈরাগ্য, অপ্রতিকার, অহিংসা প্রভৃতি আদর্শে উপনীত হতে হবে। এই আদর্শকে সর্বদা চোখের সামনে রেখে তার দিকে একটু একটু করে এগিয়ে যান। প্রতিকার ছাড়া, হিংসা ছাড়া, বাসনা ছাড়া কেউ সংসারে বাস করতে পারে না। জগৎ এখনও সে অবস্থায় আসেনি, যখন ঐ আদর্শকে সমাজে রূপায়িত করতে পারা যায়। অশুভের মধ্য দিয়ে জগতের অগ্রগতি তাকে ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে আদর্শের উপযুক্ত করে তুলছে।অধিকাংশ লোককেই এই মন্থর উন্নতির পথে অগ্রসর হতে হবে। বিশেষ শক্তিমান্‌ পুরুষদের বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যেই আদর্শ লাভ করতে হলে এই পরিবেশ থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। সময়োপযোগী কর্তব্যসাধনই শ্রেষ্ঠ পন্থা এবং শুধু কর্তব্যবোধে অনুষ্ঠিত হলে ওতে বন্ধন আসে না।

সঙ্গীত সর্বশ্রেষ্ঠ ললিত কলা এবং যাঁরা বোঝেন, তাঁদের কাছে ওটি সবচেয়ে বড় উপাসনা।

অজ্ঞান ও অশুভ নাশ করবার জন্য আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। আমাদের শুধু লিখতে হবে যে, শুভ বুদ্ধি দ্বারাই অশুভের নাশ হয়।

আপনার বিশ্বস্ত
বিবেকানন্দ

৩২২*

১৩ ডিসেম্বর, ১৮৯৬

প্রিয় ফ্র্যাঙ্কিনসেন্স,,
তাহলে গোপাল১১৪ মেয়ের রূপ পরিগ্রহ করেছে! এটা হওয়া সঙ্গতই হয়েছে—স্থান-কাল-বিবেচনায়। তার জীবন সকল আশীর্বাদে বিধৃত হোক। সে গভীর আকাঙ্ক্ষা ও প্রার্থনার ধন, আপনার ও আপনার গৃহিণীর জীবনের আশীর্বাদরূপে সে আপনাদের কাছে এসেছে—এতে আমার বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই।

‘প্রাচ্যদেশের জ্ঞানী পুরুষেরা পাশ্চাত্য শিশুর জন্য প্রীতি-উপহার নিয়ে আসছেন’—সেই প্রচলিত প্রথাটি পালন করবার জন্য যদি এখন আমি আমেরিকায় যেতে পারতাম! তবে আমার অন্তরাত্মা সকল প্রার্থনা ও আশীর্বাদ নিয়ে সেখানে বিরাজ করছে; দেহের চাইতে মনের শক্তি ঢের বেশী।

আমি এ-মাসের ১৬ তারিখে রওনা হব এবং নেপল‍্‍স‍্-এ গিয়ে জাহাজ ধরব। রোমে এলবার্টার সঙ্গে নিশ্চয়ই দেখা করব। পবিত্র পরিবারটির জন্য সর্ববিধ ভালবাসা। ইতি

আপনাদের সদাপ্রভুপদাশ্রিত
বিবেকানন্দ

৩২৩*

হোটেল মিনার্ভা, ফ্লোরেন্স
২০ ডিসেম্বর, ১৮৯৬

প্রিয় এলবার্টা,
আগামীকাল আমরা রোমে পৌঁছব। খুব সম্ভব আগামী পরশু আমি তোমার সঙ্গে দেখা করতে যাব, কারণ রোমে যখন পৌঁছব, তখন রাত হয়ে যাবে। আমরা হোটেল কণ্টিনেণ্টাল-এ উঠছি।

সর্ববিধ ভালবাসা ও আশীর্বাদসহ
বিবেকানন্দ

৩২৪*

হোটেল মিনার্ভা, ফ্লোরেন্স
২০ ডিসেম্বর, ১৮৯৬

প্রিয় রাখাল,
এই পত্র দেখেই বুঝতে পারছ যে, আমি এখনও রাস্তায়। লণ্ডন ছাড়বার আগেই আমি তোমার পত্র ও পুস্তিকাখানি পেয়েছিলাম। মজুমদারের পাগলামির দিকে দৃক‍্‍পাত করো না। ঈর্ষাবশতঃ তাঁর নিশ্চয়ই মাথা খারাপ হয়েছে। তিনি যেরূপ ভাষা ব্যবহার করেছেন, তা শুনলে সভ্য দেশের লোকে তাঁকে বিদ্রূপ করবে। এরূপ অশিষ্ট ভাষা প্রয়োগ করে তিনি নিজের উদ্দেশ্য নিজেই বিফল করেছেন।

সে যাই হোক, আমরা কখনও আমাদের নাম করে হরমোহন বা অপর কাকেও ব্রাহ্মদের সঙ্গে লড়াই করতে দিতে পারি না। জনসাধারণ জানুক যে, কোন সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমাদের বিবাদ নেই। যদি কেউ কলহ সৃষ্টি করে, তার জন্য সে নিজেই দায়ী। পরস্পরের সহিত বিবাদ ও পরস্পরকে নিন্দা করা আমাদের জাতীয় বৈশিষ্ট্য। অলস, অকর্মণ্য, মন্দভাষী, ঈর্ষাপরায়ণ, ভীরু এবং কলহপ্রিয়—এই তো আমরা বাঙালী জাতি! আমার বন্ধু বলে পরিচয় দিতে গেলে এগুলি ত্যাগ করতে হবে। তা ছাড়া হরমোহনকে আমার বই ছাপতে দিও না। সে যেভাবে ছাপে তাতে লোক ঠকান হয়।

কলিকাতায় কমলানেবু থাকলে আলাসিঙ্গার ঠিকানায় মান্দ্রাজে এক-শ পাঠিয়ে দিও, যাতে আমি মান্দ্রাজে পৌঁছে পেতে পারি।

মজুমদার নাকি লিখেছেন যে, ‘ব্রহ্মবাদিন্’ পত্রিকায় প্রকাশিত শ্রীরামকৃষ্ণ-উপদেশ খাঁটি নয়, মিথ্যা। তা যদি হয় তো সুরেশ দত্ত ও রামবাবুকে ‘ইণ্ডিয়ান মিররে’ এর প্রতিবাদ করতে বলবে। ঐ উপদেশ কিভাবে সংগৃহীত হয়েছে, তা তো আমি জানি না; সেজন্য এ বিষয়ে কিছু বলতে পারি না। ইতি

তোমার প্রেমাবদ্ধ
বিবেকানন্দ

পুঃ— … বেকুবদের কথা মোটেই ভেবো না; কথায় বলে, ‘বুড়ো বেকুবের মত আর বেকুব নেই।’ ওরা একটু চেঁচাক না।