২১. নীহা কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে

নীহা কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। খানিকক্ষণ বাইরে তাকিয়ে থেকে সে মাথা ঘুরিয়ে ভিতরে অন্যদের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমরা একটা ব্যাপার লক্ষ করেছ?

কী?

এই যে সামনে সুহা আর ক্লদের মৃতদেহ পড়েছিল—

হ্যাঁ। মৃতদেহ দুটি আর নেই।

তাই নাকি? টর জানালার পাশে এসে দাঁড়াল, বাইরে তাকিয়ে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। মৃতদেহগুলো কোথায়?

টুরান বলল, নিশ্চয়ই তেজস্ক্রিয় প্রাণীগুলো নিয়ে গেছে।

নিয়ে কী করবে?

জানি না। টর মাথা নাড়ল, এই প্রাণীগুলো সম্পর্কে কেউ খুব বেশি জানে না। এগুলো সত্যিকার প্রাণী না। হাইব্রিড।

নীহা বলল, আমি আর প্রাণীদের কথা ভাবতে চাই না। ট্রিনিটি বলেছে স্কাউটশিপ পাঠিয়ে আমাদের নিয়ে যাবে, আমি তার জন্যে অপেক্ষা করছি।

আমরা সবাই সেজন্যে অপেক্ষা করছি।

নীহা আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে রইল। সে কী কুগুরাভ সমীকরণের সমাধানের কথা চিন্তা করছে নাকি মঙ্গল গ্রহের নিঃসঙ্গ লাল প্রান্তরের দিকে তাকিয়ে আসছে বোঝা যায় না।

 

ট্রিনিটি স্কাউটশিপটাকে যখন তাদের আবাসস্থলের কাছে নামিয়ে আনে তখন সূর্য ঢলে পড়ছে। ছড়ানো ছিটানো পাথরের লম্বা ছায়া চারদিকে একটি আধিভৌতিক দৃশ্য তৈরি করেছে। আবাসস্থলের ভেতরে সবাই তাদের স্পেসস্যুট পরে নেয় তারপর হাতে অস্ত্রগুলো নিয়ে বের হয়। স্কাউটশিপটি কাছেই, তারপরেও তারা দ্রুত হাঁটতে থাকে। তারা যখন স্কাউটশিপের কাছাকাছি পৌঁছেছে তখন ইহিতার কণ্ঠকর শুনতে পেল, তাড়াতাড়ি হাঁট। প্রাণীগুলো আসছে।

টর বলল, আসতে দাও। আমি এখন আর ভয় পাই না, স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে একেবারে শেষ করে দেব।

ইহিতা বলল, কোনো প্রয়োজন নেই। গোলাগুলি না করে আমরা ছুটে উঠে যাই। চল।

সবাই তখন ছুটতে থাকে। স্কাউটশিপের কাছে এসে প্রথমে টুরান, তারপর ইহিতা, আর টর লাফিয়ে স্কাউটশিপে উঠে গেল। নুট যখন নীহাকে ধাক্কা দিয়ে স্কাউটশিপের ভেতরে উঠিয়ে দিচ্ছে ঠিক তখন চারপাশ থেকে প্রাণীগুলো তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। অবস্থা নিয়ন্ত্রণ করায় জন্যে ওপর থেকে টরকে এক পশলা গুলি করতে হল, প্রাণীগুলো যখন একটু সরে যায় তখন সবাই নীহাকে টেনে ভেতরে তুলে নেয়। প্রাণীগুলো তখন আবার ছুটে তাদের আক্রমণ করার চেষ্টা করে কিন্তু ততক্ষণে স্কাউটশিপের ভারী দরজাটা বন্ধ হয়ে গেছে। তারপরও বাইরে প্রাণীগুলো ছুটোছুটি করতে থাকে।

স্কাউটশিপের ভেতর ইহিতা একটা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, সবাই ঠিকমতোন এসেছ?

নীহা মাথা নাড়ল, বলল, এসেছি। সবাই তাহলে নিজেদের জায়গায় বসে যাও। আমরা এখন রওনা দেব।

সবাই নিজেদের জায়গায় বসতেই সিট থেকে যন্ত্রপতি বের হয়ে এসে তাদেরকে নিরাপত্তা বলয়ের মাঝে আটকে নেয়। নীহা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়েছিল, নুট নিচুস্বরে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী দেখার চেষ্টা করছ নীহা?

নীহা বলল, না। কিছু না।

তুমি কী প্রাণীগুলোকে দেখতে চাইছ?

হ্যাঁ। আমার মনে হল, স্পষ্ট মনে হল–কথা শেষ না করে নীহা থেমে যায়।

নুট মাথা নাড়ল, বলল, তুমি ঠিকই দেখেছ নীহা।

নীহা চমকে উঠে বলল, কী বলছ তুমি?

আমি ঠিকই বলেছি। নুট ফিসফিস করে বলল, আমি নিচে ছিলাম, স্পষ্ট দেখেছি একটা প্রাণীর মাথা সুহার মতো। আরেকটা ক্লদের।

কেমন করে সম্ভব?

এই প্রাণীগুলো মানুষের অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ব্যবহার করতে পারে। সুহা আর ক্লদের শরীরকে এগুলো ভাগাভাগি করে নিয়েছে।

কী ভয়ংকর!

হ্যাঁ ভয়ংকর।

স্কাউটশিপটা গর্জন করে ওপরে উঠতে শুরু করতেই প্রাণীগুলো চিৎকার করতে করতে সরে গেল, নীহা প্রাণীগুলোকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখে। সেও এবারে স্পস্ট সুহা আর ক্লদকে দেখতে পায়। তাদের সত্যিকার চেহারার সাথে খুব বেশি মিল নেই, কিন্তু বুঝতে কোনো সমস্যা হয় না।

ইহিতা জানতে চাইল, নীহা! তোমাকে কি কিছু উৎকণ্ঠার মাঝ ফেলে দিল?

হ্যাঁ।

কী?

আমরা আগে এই গ্রহটা ছেড়ে চলে যাই, তখন তোমার সাথে কথা বলব। এখন বলতে চাই না।

ইহিতা মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে নীহা।

স্কাউটশিপটা তখন গর্জন করে লাল ধূলি উড়িয়ে আকাশে উঠতে থাকে। বহুঁ দূরে তখন মঙ্গলগ্রহের কুৎসিত চাঁদ ডিমোস আকাশে উঠতে শুরু করেছে।

মহাকাশযানের গোল জানালা দিয়ে মহাকাশযানে ঢোকার সাথে সাথে তারা ট্রিনিটির কণ্ঠস্বর শুনতে পায়, আমাদের মহাকাশযানে তোমাদের সাদর আমন্ত্রণ।

টর দাঁত কিড়মিড় করে বলল, খবরদার, বাজে কথা বলবে না ট্রিনিটি। তোমার মানুষকে আমন্ত্রণ জানানোর ক্ষমতা নেই, অধিকারও নেই।

ইহিতা শব্দ করে হাসল, বলল, টর! আমার মনে হয় ট্রিনিটির সাথে তোমার এই সংঘাতটুকু মিটিয়ে ফেল। বিষয়টা অর্থহীন। অনেকটা জুতো মোজা বা একটা স্ক্রু ড্রাইভারের সাথে ঝগড়া করার মতো। ট্রিনিটি একটা যন্ত্র ছাড়া আর কিছু না একটু গুছিয়ে মানুষের মতো কথা বলতে পারে—এই হচ্ছে পার্থক্য!

ট্রিনিটি বলল, ইহিতা, আমাকে তুমি যতোটুকু তাচ্ছিল্য সহকারে দেখছ আমি ঠিক ততোটুকু তাচ্ছিল্যের পাত্র নই। আমার হিসেব করার ক্ষমতা প্রায় মানুষের সমান। কয়েকটি বিশেষ বিষয়ে মানুষ থেকে বেশি।

ঐটুকুই। হিসাব করার ক্ষমতা! ইহিতা বলল, মানুষকে কখনো তার হিসাব করার ক্ষমতা দিয়ে বিচার করা হয় না।

ট্রিনিটি বলল, এই তর্ক সহজে শেষ হবে না। তোমরা নিশ্চয়ই ক্লান্ত। উষ্ণ পানিতে স্নান করে নতুন পোশাক পরে এসো, আমি তোমাদের খাবারের ব্যবস্থা করছি।

টর জিজ্ঞেস করল, খাবারের জন্য কী আছে?

তোমাদের নিরাপদ প্রত্যাবর্তনটুকু উদ্যাপন করার জন্যে আজকের মেনুতে থাকবে, বিশুদ্ধ প্রাকৃতিক যবের রুটি, তিতির পাখির মাংস, সামুদ্রিক মাছ এবং আঙুরের রস।

টর কিছুক্ষণ শূন্যের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, ট্রিনিটি, তুমি যদি সত্যি সত্যিকারের তিতির পাখির মাংস জোগাড় করতে পার তাহলে আমি তোমাকে ক্ষমা করে দেব।

ট্রিনিটি বলল, আমি সত্যিই তিতির পাখির মাংস জোগাড় করব।

 

পাশাপাশি পাঁচটি ক্যাপুসলের ওপর একটা সবুজ বাতি জ্বলছে এবং নিভছে। পাঁচজন নিজেদের ক্যাপসুলটি বের করে তার পাশে এসে দাঁড়াল। টুরান বলল, তাহলে আবার তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নিই।

টর বলল, কততদিন পর আবার আমাদের দেখা হবে?

ইহিতা বলল, সেই প্রশ্নটির কোনো অর্থ নেই। আমাদের কাছে মনে হবে আমরা চোখ বন্ধ করেছি এবং চোখ খুলেছি। কাজেই তোমাদের সাথে দেখা হবে এক পলক পরে!

নীহা বলল, তাহলে আমাদের খুব আনুষ্ঠানিক বিদায় নেবারও প্রয়োজন নেই? আমরা ঝটপট ক্যাপসুলে শুয়ে পড়তে পারি?

ইহিতা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। ঝটপট শুয়ে পড়তে পারি।

টুরান বলল, শুধু পৃথিবীতে কী হচ্ছে সেই খবরটা জানতে পারলাম না।

ট্রিনিটি বলল, পৃথিবীর নেটওয়ার্ক বন্ধ হয়ে আছে। তার খবর পাবার কোনো উপায় নেই।

ইহিতা বলল, এক দিক দিয়ে সেটি হয়তো আমাদের জন্যে ভালো। পৃথিবীকে পিছনে ফেলে আমরা সামনে নতুন আরেকটা পৃথিবী খুঁজে বের করতে যাব।

নীহা বলল, ঠিক আছে তাহলে চল আমরা ক্যাপসুলে ঢুকি।

সবাই বলল, চল।

নুট বলল, এবারে আমি অনেক প্রশান্তি নিয়ে ঘুমুতে যাচ্ছি। তোমাদের সবার সাথে নতুন পৃথিবীতে দেখা হবে!

সবাই মাথা নাড়ল, তারপর ক্যাপসুলে ঢুকে গেল। ক্যাপসুলের ঢাকনাটা খুব ধীরে ধীরে নিচে নেমে আসে। ক্যাপসুলের ভেতর শীতল সুগন্ধি একটা বাতাস ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বাতাসে নিশ্চয়ই কিছু একটা আছে, তারা কেউ চোখ খোলা রাখতে পারে না। একজন একজন করে তারা গভীর ঘুমে ঢলে পড়ল। তখন মৃদু কম্পন তুলে ক্রায়োজেনিক মডিউলটি চালু হয়ে যায়, সাথে সাথে পাঁচজন মহাকাশচারীর দেহ শীতল হতে থাকে। খুব ধীরে ধীরে জীবনের স্পন্দন থেমে যায়, পাঁচজন মানুষ পুরোপুরি পাঁচটি জড় পদার্থের মতো ক্যাপসুলের ভেতর শুয়ে থাকে।

মহাকাশযানটির ইঞ্জিনগুলো একটা একটা করে চালু হতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মাঝেই পুরো মহাকাশযানটি থর থর করে কাঁপতে থাকে। সেটি খুব ধীরে ধীরে তার কক্ষপথ থেকে মুক্ত হয়ে মহাকাশের দিকে ছুটে যেতে থাকে। সৌরজগৎ পার হয়ে সেটি ছায়াপথের কেন্দ্রের দিকে ছুটে যেতে থাকবে। চারশ বিলিয়ন নক্ষত্রের কোথাও না কোথাও একটি চমৎকার গ্রহ খুঁজে পাওয়া যাবে যেখানে পৃথিবীর মানুষ নতুন করে তাদের সভ্যতা শুরু করতে পারবে।