গল্প
উপন্যাস
পরিশিষ্ট

২১. নরক

একবিংশ পরিচ্ছেদ – নরক

রাজপুরীতে প্রবেশ করিবার সময় বজ্রের পা কাঁপিয়া গেল, চোখের দৃষ্টি ঝাপ্‌সা হইল, কণ্ঠের নিকট বাষ্পপিণ্ড উঠিয়া কণ্ঠ রুদ্ধ করিয়া দিল। পিতৃপুরুষের ভবনে এই তাহার প্রথম পদার্পণ।

রাজপুরীতে দীপ জ্বলিয়াছে, কিন্তু পুরীর পিছন দিকে বেশি আলো নাই। কুহু আলো-আঁধারির ভিতর দিয়া এক সঙ্কীর্ণ সোপানের সম্মুখীন হইল। রাজ-অবরোধের দাসী-কিঙ্করীদের ব্যবহারের জন্য এরূপ সোপান অনেক আছে। কুহু বজ্রের হাত ধরিয়া উপরে চলিল।

দ্বিতলের এক কোণে কুহুর কক্ষ। দূরে একটা প্রদীপ জ্বলিতেছে। কুহু নিজ দ্বারের সম্মুখে উপস্থিত হইয়া দেখিল তাহার দাসী মালতী দ্বারের পাশে দুই পা ছড়াইয়া বসিয়া আছে। বজ্রকে পিছনে রাখিয়া কুহু আগাইয়া গেল।

মালতী উঠিয়া কুহুর পিছনে চোখ বাঁকাইয়া চাহিল। অবরোধে পুরুষের আবির্ভাব মালতীর চোখে নূতন নয়, তবে এ মানুষটা নূতন বটে; আবছায়া আলোতে দেখিয়াও চাহিয়া থাকিতে হয়। কুহু বজ্রকে যথাসম্ভব আড়াল করিয়া বলিল— ‘মালতী, তোকে আর দরকার নেই। তুই যা।’

মালতী চোখ ঘুরাইল, অঙ্গভঙ্গি করিল, তারপর দুষ্টামি-ভরা সুরে বলিল— ‘এত রাত্তিরে কোথায় যাব গো ঠাকরুন?’

কুহু ফিস্‌ফিস্ করিয়া বলিল— ‘তোর মনের মানুষ নেই? তার কাছে যা। আজ আর ফিরতে হবে না, একেবারে কাল সকালে ফিরিস।’

মালতী একগাল হাসিল। তাহাকে আর দ্বিতীয়বার বলিতে হইল না, অঞ্চলপ্রান্ত উড়াইয়া সে নিমেষমধ্যে অন্তর্হিত হইল।

কুহু বজ্রকে লইয়া ঘরে প্রবেশ করিল, ভিতর হইতে দ্বারের খিল আঁটিয়া দিল।

ঘরটি খুব বড় নয়, ছোটও নয়। চারি কোণে দীপদণ্ডে চারিটি প্রদীপ, মসৃণ মণিহর্ম্যতলে আলোক প্রতিফলিত হইতেছে। বাতায়নের পাশে খট্বিকার উপর শুভ্র শয্যা। উপাধানের উপর মল্লিকা ফুলের স্থূল মালা শোভা পাইতেছে। ঘরের বাতাস কস্তূরী ও পুষ্পগন্ধে আমোদিত।

কুহু হাত ধরিয়া বজ্রকে খট্বিকার উপর বসাইয়া দিল; মুগ্ধবিধুর চক্ষে চাহিয়া তাহার পায়ের কাছে বসিয়া ধরা-ধরা গলায় বলিল— ‘ধুলোয় মাণিক কুড়িয়ে পেয়েছি তা কি আগে জানতাম! মহারাজ বজ্রদেব, যখন মাথায় রাজমুকুট ধারণ করবেন তখন এই পাপিষ্ঠা দাসীর কথা কি মনে থাকবে?’

বজ্র কুহুকে টানিয়া তুলিয়া পাশে বসাইল, বলিল— ‘কুহু, তুমি জানো না, তোমাকে পেয়ে আমি কী পেয়েছি। এই জনারণ্যে তুমিই আমার একমাত্র বন্ধু।’

কুহু আদরে গলিয়া গেল, বজ্রের কাঁধে মাথা রাখিয়া বলিল— ‘মনে থাকবে?’

‘থাকবে। তোমাকে চিরদিন মনে থাকবে।’

কুহু পরিপূর্ণ তৃপ্তির একটি নিশ্বাস ফেলিল, তারপর উঠিয়া মল্লিকা ফুলের মালাটি বজ্রের গলায় পরাইয়া দিল। মালাটি সে আজ বৈকালে রানীর আদেশে গাঁথিয়াছিল; সেই মালা আর একজনের গলায় উঠিবে তখন কে জানিত! তৃপ্তির মধ্যেও রানীর কথা কুহুর মনে পড়িয়া গেল। রাক্ষসীটার কাছে যাইতে হইবে; ছলে-ছুতায় আরও দুইটা দিন তাহাকে ভুলাইয়া রাখা দরকার—

ঈষৎ অন্যমনা হইয়া কুহু একটা কুলঙ্গির কাছে গেল। কুলঙ্গিতে নানাবিধ মিষ্টান্ন ছিল, একটি স্থালীতে তাহা লইয়া বজ্রের কাছে ফিরিয়া গেল।

বজ্র বলিল— ‘এ কী?’

কুহু বলিল— ‘একটু খাও।’

কুহু দুই হাতে থালি ধরিয়া রহিল, বজ্র মিষ্টান্ন তুলিয়া খাইতে লাগিল। খাইতে খাইতে বলিল— ‘কোদণ্ড মিশ্রের সঙ্গে তোমার কী সম্বন্ধ তা তো বললে না।’

কুহু বলিল— ‘আমার মা এই রাজপুরীর দাসী ছিল। কোদণ্ড ঠাকুর মাকে চিনতেন। মা মরবার সময় ঠাকুরকে বলে যায় তিনি যেন আমার দেখাশুনা করেন। তা ঠাকুর আর আমার কী দেখাশুনা করবেন, আমিই তাঁর দেখাশুনা করি। — ও কি, আর একটু খাও।’

‘আর না, অনেক খেয়েছি।’

‘এই ক্ষীরের পুলি খেতেই হবে।’— বলিয়া কুহু ক্ষীরের পুলি বজ্রের মুখে তুলিয়া দিল।

আহার শেষ হইলে বজ্র বলিল— ‘তুমি আর আমাকে মধুমথন বলবে না?’

‘বলতে ইচ্ছা করে। কিন্তু তোমার সত্যি নাম পরমভট্টারক শ্রীমন্ মহারাজা বজ্রদেব। মধুমথন তোমার মিথ্যে নাম।’

বজ্র একটু অন্যমনস্ক হইল; গুঞ্জার মুখখানি তাহার মনের মধ্যে ভাসিয়া উঠিল। সে বলিল— ‘মিথ্যে নয়, দুটো নামই সত্যি। তুমি আমাকে মধুমথন বলেই ডেকো।’

কুহু জিভ কাটিল— ‘রাজাকে কি অন্য নামে ডাকতে আছে?’

‘রাজা তো এখনও হইনি। হব কিনা তারই বা ঠিক কি?’

কুহুর মুখ দৃঢ় হইল; সে বলিল— ‘তুমি রাজা হবে।’

‘বেশ। যতদিন রাজা না হই ততদিন মধুমথন বলে ডেকো।’

‘সে ভাল। তিন রাত্রির জন্য তুমি আমার মধুমথন।’ কুহু বজ্রের খুব কাছে সরিয়া আসিল।

বজ্র উঠিবার উপক্রম করিয়া বলিল— ‘এবার কিন্তু আমি ফিরে যাব। কোদণ্ড মিশ্র বলেছেন—’

কুহু তাহার দুই কাঁধে হাত রাখিয়া তাহাকে উঠিতে দিল না। বলিল— ‘কোদণ্ড ঠাকুর কি বলেছেন আমি শুনেছি। কিন্তু এখন তোমার যাওয়া হবে না। ভোর হবার আগেই আমি তোমাকে ডিঙিতে করে পৌঁছে দেব।’

‘কিন্তু— এখন রাত কত?’

‘এখনও প্রথম প্রহর শেষ হয়নি।’

বজ্র হঠাৎ উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলিল— ‘না, আমি ফিরে যাই। তুমি যেতে না পারো আমি সাঁতরে ময়ূরাক্ষী পার হতে পারব।’

কুহু কিছুক্ষণ তাহার মুখের পানে চাহিয়া রহিল, তাহার অধরে একটি গুপ্ত হাসি খেলিয়া গেল। সে বজ্রের বুকের উপর হাত রাখিয়া বলিল— ‘আচ্ছা, একটু অপেক্ষা কর, আমার একটা কাজ আছে সেটা সেরে এসে আমি তোমাকে পৌঁছে দেব।’

‘কি কাজ?’

রানীর কাছে যাইতে হবে একথা কুহু বলিল না, বজ্রের কাছে রানীর নাম উচ্চারণ করিল না। বলিল— ‘কোদন্ড ঠাকুর চিঠি দিয়েছেন, রাজার অন্তরঙ্গ অর্জুনসেনকে দিতে হবে।’

‘কতক্ষণ সময় লাগবে?’

‘দু’ দণ্ড— বেশি নয়।’

‘দু’ দণ্ড বসে থাকব?’

কুহু কুহকভরা হাসিল— ‘বসে থাকবে কেন? আমার বিছানায় শুয়ে থাকো।’

বজ্র কোমল শয্যার প্রতি অপাঙ্গদৃষ্টি করিয়া বলিল— ‘যদি ঘুমিয়ে পড়ি?’

অধরের একটি ভঙ্গুর ভঙ্গি করিয়া কুহু বলিল— ‘যদি ঘুমিয়ে পড়, আমি এসে তোমাকে জাগিয়ে দেব।’

বজ্র শয়ন করিল। কুহু তাহার প্রতি ফিরিয়া চাহিতে চাহিতে ঘর হইতে বাহির হইল।

ঘরের বাহিরে আসিয়া কুহু সতর্কভাবে চারিদিকে চাহিল। কেহ কোথাও নাই, পুরীর এ অংশ নিশুতি হইয়া গিয়াছে। কুহু নিঃশব্দে দ্বারের শিকল তুলিয়া দিয়া দ্রুতপদে সিঁড়ির দিকে চলিল।

চতুস্তলে রানী শিখরিণীর শয়নকক্ষ। কুহু প্রবেশ করিলে রানী অর্ধোত্থিতা হইয়া প্রশ্নবিস্ফারিত চক্ষে চাহিলেন। ব্যজনরতা দাসী কুহুর ইঙ্গিতে সরিয়া গেল।

কুহু মনে মনে যে-কাহিনী গড়িয়া রাখিয়াছিল ম্রিয়মাণ কণ্ঠে তাহা বলিল। — আজও পানশালা বন্ধ, শৌণ্ডিক কোথায় চলিয়া গিয়াছে। সম্ভবত আগন্তুক যুবকও নিজের দেশে ফিরিয়া গিয়াছে, কিন্তু এ বিষয়ে নিঃসংশয়ে কিছু জানিবার উপায় নাই, পানশালা শূন্য। এদিকে কুহুর অবস্থা শোচনীয়; হাঁটিয়া হাঁটিয়া তাহার পা দুটার আর কিছু নাই। এখন দেবী আজ্ঞা করুন— সে কী করিবে।

দেবী প্রজ্বলিত চক্ষে বলিলেন— ‘তুই দূর হয়ে যা— দূর হয়ে যা— দূর হয়ে যা, তোর মুখ দেখতে চাই না।’

কুহু করুণ নতমুখে দাঁড়াইয়া রহিল, তারপর যুক্তকরে প্রণাম করিয়া ক্লান্তমন্থর পদে দ্বারের দিকে চলিল। দ্বারের বাহিরে গিয়া সে একবার চকিত-বঙ্কিম গ্রীবাভঙ্গি করিয়া চাহিল। তাহার চক্ষে প্রচ্ছন্ন বিদ্রূপ নিমেষে দেখা দিয়া নিমেষমধ্যে অন্তর্হিত হইল। তারপর সে দ্রুতপদে রাজার প্রমোদভবনের দিকে চলিল। অন্তরঙ্গ অর্জুনসেন রাজার কাছেই আছে, তাহাকে কোদণ্ড মিশ্রের লিপি দিয়া রানী শিখরিণীর সর্বনাশের ব্যবস্থা পাকা করিয়া তবে সে নিজের ঘরে ফিরিয়া যাইবে।

রানী শিখরিণী কিন্তু কুহুর ঐ চকিত কটাক্ষ দেখিয়াছিলেন। তিনি শয্যায় উঠিয়া বসিলেন। ব্যর্থতার ক্রোধ অপগত হইয়া তাঁহার ললাটে সংশয়ের ভ্রূকুটি দেখা দিল।

ব্যজনকারিণী দাসী ফিরিয়া আসিয়া আবার রানীকে বাতাস করিবার উদ্যোগ করিলে রানী জিজ্ঞাসা করিলেন— ‘বল্লী, কুহু কোন্‌দিকে গেল দেখলি?’

বল্লী চমকিয়া বলিল— ‘তা তো দেখিনি দেবি। নিজের ঘরে গিয়েছে বোধহয়। দেখবো?’

‘না— থাক।’

রানী শিখরিণী আরও কিছুক্ষণ অধর দংশন করিতে করিতে চিন্তা করিলেন। তারপর সহসা শয্যা হইতে নামিয়া বস্ত্রাঞ্চল সংবরণ করিতে করিতে বলিলেন— ‘বল্লী, আয় আমার সঙ্গে, কুহুর ঘরে আমাকে নিয়ে চল।’

বল্লী ভীতচক্ষে রানীর পানে চাহিল। রানীর মুখ দেখিয়া তাহার বুক শুকাইয়া গেল, মুখ দিয়া কথা বাহির হইল না। সে নীরবে অগ্রবর্তিনী হইয়া রানীকে পথ দেখাইয়া লইয়া চলিল।

কুহুর শয্যায় শয়ন করিয়া বজ্র ঘুমাইয়া পড়িয়াছিল। বাতায়ন দিয়া নদীর জল-ছোঁয়া বাতাস প্রবেশ করিয়া তাহার কপালে বুকে স্নিগ্ধ করাঙ্গুলি বুলাইয়া দিতেছিল। আজ দ্বিপ্রহরে বজ্র ঘুমাইয়াছিল বটে কিন্তু তাহার দেহের গ্লানি দূর হয় নাই। কুহুর কোমল শয্যায় শুইয়া মৃগমদ ও পুষ্পগন্ধে আচ্ছন্ন হইয়া সে গুঞ্জাকে স্বপ্ন দেখিতেছিল।

গুঞ্জা যেন তাহার পাশে বসিয়া তাহার মুখের পানে চাহিয়া হাসিতেছে, বুকে কপালে হাত বুলাইয়া দিতেছে। বলিতেছে— তোমার মাথায় ও কি? সোনার মুকুট। ছি ছি ফেলে দাও, আমি তোমাকে পলাশ ফুলের মালা পরিয়ে দেব—

গুঞ্জা! কুঁচবরণ কন্যা!…কিন্তু এ কে? এ তো গুঞ্জা নয়! এ কি কুহু!…না, কুহুর মুখ এত সুন্দর নয়, গুঞ্জার মুখও এত সুন্দর নয়। মুখখানা যেন চেনা চেনা…কী তপ্ত নিশ্বাস, বুকের উপর পড়িয়া বুক যেন পুড়াইয়া দিতেছে—

গুঞ্জা কোথায় গেল?…এই নারীর চোখের দৃষ্টি এত তীব্র কেন? না— না। … মনে পড়িয়াছে— রানী শিখরিণী! কিন্তু— না— না! গুঞ্জা কোথায়?

রানী শিখরিণী সরিয়া গেল… দ্বার খুলিয়া বাহিরে কাহার সহিত কথা কহিল, আবার দ্বার বন্ধ করিয়া ফিরিয়া আসিল— তাহার হাতে একগুচ্ছ ধূমনিঃস্যন্দী ধূপশলাকা…কিসের ধূপ! রানী শলাকাগুলি তাহার মুখের কাছে নাড়িতেছে…

ধূপের গন্ধে মাদকতা আছে। বজ্রের শরীর যেন বিবশ হইয়া আসিতেছে। শরীরে অনুভূতি আছে, চেষ্টা নাই— মন কিন্তু সজাগ; সে জাগিয়া আছে, তবু যেন ঘুমাইয়া স্বপ্ন দেখিতেছে…

তাহার চোখে রানী নিদালীর মন্ত্র পড়িয়া দিয়াছে। প্রাণপণ চেষ্টা করিয়াও সে চোখের পাতা খুলিতে পারিতেছে না…অথচ সে জাগিয়া আছে, সমস্তই অনুভব করিতেছে—

গুঞ্জা, তুমি কোথায়? সোনার মুকুট ভাল নয়, তুমি আমাকে পলাশ ফুলের মালা পরাইয়া দাও—

গুঞ্জা! তুমি কি রানীর ছদ্মবেশে আমার কাছে আসিয়াছ! তাই কি তোমাকে চিনিতে পারিতেছি না! কুঁচবরণ কন্যা—!

রাজার প্রমোদভবন অবরোধ হইতে অনেকখানি দূরে, প্রাসাদের অন্য প্রান্তে। কুহু অলিন্দ দিয়া সেই দিকে চলিল। কখনও এক প্রস্থ সোপান অবরোহণ করিয়া কখনও এক প্রস্থ আরোহণ করিয়া খদ্যোতের মত নিঃশব্দ সঞ্চারে চলিল। যতই প্রমোদভবনের কাছে আসিতে লাগিল ততই বাদ্যযন্ত্রের শব্দ স্পষ্টতর হইতে লাগিল— ঝনি ঝমকি ঝনি ঝমকি।

অবশেষে কুহু প্রমোদকক্ষের দ্বারে পৌঁছিল।

প্রমোদকক্ষটি আয়তনে বৃহৎ, কিন্তু সর্বত্র সমভাবে আলোকিত নয়। মধ্যস্থলে অনেকগুলি উচ্চ দীপদণ্ড চক্রাকারে সাজানো রহিয়াছে, ছাদ হইতেও শৃঙ্খল-লম্বিত দীপাধার ঝুলিতেছে। কিন্তু এই চক্রের বাহিরে অধিক আলো নাই, কোণে কোণে ছায়ান্ধকার; কক্ষে অনেকগুলি মানুষ ইতস্তত বিক্ষিপ্ত রহিয়াছে— তাহা সহসা ধরা যায় না।

মানুষগুলি কিন্তু সকলেই স্ত্রীজাতীয়। এমন কেহ নাই যে রূপসী ও নবীনা নয়; তাহাদের বেশভূষা সংক্ষিপ্ত, বুকে কাহারও কাঁচুলি আছে, কাহারও নাই। তাহারা গুচ্ছে গুচ্ছে হর্ম্যতলে বসিয়া আছে, কেহ বা আস্তরণের উপর অঙ্গ এলাইয়া দিয়াছে। যাহারা আলোকচক্র হইতে দূরে আছে তাহাদের অস্পষ্টভাবে দেখা যাইতেছে। আলোকচক্রের মাঝখানে এক বিরলবসনা সভানন্দিনী নৃত্য করিতেছে; আলোকবিভ্রান্ত প্রজাপতির ন্যায় তাহার নৃত্যের ভঙ্গি। তাহাকে ঘিরিয়া বসিয়া তিনটি যুবতী বীণা, মৃদঙ্গ ও মঞ্জীরা বাজাইতেছে— ঝনি ঝমকি ঝনি ঝমকি।

রাজা অগ্নিবর্মা যে এই কক্ষে আছেন তাহা সহসা লক্ষ্যগোচর হয় না। কেন্দ্রীয় দীপচক্র হইতে অল্প দূরে একটি স্তম্ভে পৃষ্ঠ অর্পণ করিয়া তিনি বসিয়া আছেন। অগ্নিবর্মার অস্থিসার মুখে শ্মশ্রু গুম্ফ নাই, বক্ষও কেশহীন; মাথার চুল নারীর মত দীর্ঘ। তিনি স্তিমিতচক্ষে নর্তকীর পানে চাহিয়া আছেন। ছাগ-চক্ষুর ন্যায় ভাবলেশহীন চক্ষুর্দ্বয়, কিন্তু তাহাদের অভ্যন্তরে প্রচ্ছন্ন উন্মাদনা।

কুহু উঁকি দিয়া দেখিল, কিন্তু ভিতরে প্রবেশ করিল না। অর্জুনসেন রাজার অন্তরঙ্গ, নিজস্ব বৈদ্য, সর্বদা রাজার সন্নিধানে থাকা তাহার কর্তব্য! কিন্তু কুহু প্রমোদকক্ষের ছায়াচ্ছন্ন কোণে কোণে দৃষ্টি প্রেরণ করিয়াও তাহাকে দেখিতে পাইল না।

ভিতরে নৃত্যের তাল ক্রমে দ্রুত হইতেছে। দ্বারের কাছে এক বিপুলকায়া প্রৌঢ়া রমণী হাতে খোলা তলোয়ার লইয়া বসিয়া আছে, সে এই প্রমোদকক্ষের দৌবারিকা। কিন্তু দ্বার রক্ষার দিকে তাহার দৃষ্টি নাই, নৃত্যলীলার দিকেও নাই। সে বসিয়া বসিয়া ঢুলিতেছে।

কুহু দ্বারের বাহিরে দাঁড়াইয়া দ্বিধায় পড়িল। অন্তরঙ্গ অর্জুনসেনকে সে কোথায় খুঁজিয়া বেড়াইবে? খুঁজিলেই কি পাওয়া যাইবে? কুহু ভাবিল, আজি থাক, কাল পত্র দিলেই হইবে। নিজের ঘরের দিকে কুহুর মন টানিতেছিল।

কুহু ফিরিবার জন্য পা বাড়াইয়াছে, দেখিল অলিন্দ দিয়া অর্জুনসেন আসিতেছে। তাহার পিছনে এক কিঙ্করী, কিঙ্করীর হস্তে পূর্ণ পানপাত্র।

অন্তরঙ্গ অর্জুনসেনের বয়স পঁয়ত্রিশ, নধর মসৃণ আকৃতি, মাথায় তৈলসিক্ত কুঞ্চিত কেশ, কুঞ্চিত গুম্ফ, চক্ষু দুটি উজ্জ্বল, যেন সর্বদাই বাষ্পোৎফুল্ল। কুহুকে দেখিয়া সে গতি শ্লথ করিল, কিঙ্করীকে বলিল— ‘তুমি মহারাজকে পানীয় দাও গিয়ে, আমি যাচ্ছি।’

কিঙ্করী প্রমোদকক্ষে প্রবেশ করিল। কুহু মৃদুস্বরে অর্জুনসেনকে কোদণ্ড মিশ্রের বার্তা জানাইল ও সঙ্কেতলিপি দিল।

অর্জুনসেনের বাষ্পোৎফুল্ল চোখে একটু কৌতুক দেখা দিল, সে স্নিগ্ধস্বরে বলিল— ‘অমাবস্যার রাত্রি? ভাল। নিবন্ত প্রদীপে ফুঁ দেওয়া বৈ তো নয়, তা দেব। আর্য কোদণ্ড মিশ্রকে আমার প্রণাম দিয়ে বোলো, শ্রীমন্মহারাজ একদিন আমাকে অম্বষ্ঠ বৈদ্য বলেছিলেন সে কথা আমার মনে আছে।’

কুহু একবার অর্জুনসেনের স্নিগ্ধ মুখের পানে চাহিল, একবার দ্বারের ভিতর দিয়া পানপাত্র হস্তে উপবিষ্ট মহারাজের দিকে দৃষ্টি প্রেরণ করিল, তারপর নিঃশব্দ ক্ষিপ্রচরণে ফিরিয়া চলিল।