মিংমা ঠিক তিনটি ঘুষি মারে ভার্মাকে। চতুর্থ ঘুষিটা তোলার পর সে নিজেই হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল। তার শক্তি ফুরিয়ে আসছে। লোহার পাত তার কোমরের দু দিকে কেটে বসেছিল, সেখান থেকে অঝোরে রক্ত ঝরছে। অসম্ভব ব্যথায় সে আর জ্ঞান রাখতে পারছে না।
ঘোলাটে চোখে সে তাকাল এদিক-ওদিক। রিভলভারটা ভার্মার হাত থেকে ছিটকে খানিকটা দূরে পড়ে আছে। মিংমা সেটাকে নেবার জন্য টলতে-টলতে এগিয়ে গেল। কিন্তু কয়েক পা গিয়েই পড়ে গেল ধপাস করে।
প্রায় পাশাপাশি অজ্ঞান হয়ে পড়ে রইল ভার্মা আর মিংমা। একটু দূরে রিভলভারটা।
গম্বুজের মধ্যে বন্দী অবস্থায় রানা আর টমাস ত্ৰিভুবন কিছুই বুঝতে পারলেন না বাইরে কী হচ্ছে! ভার্মার ব্যবহারে রানা এতই অবাক হয়ে গেছেন যে, এখনও চোখ দুটি বিস্ফারিত করে আছেন।
টমাস ত্ৰিভুবন মৃদু গলায় জিজ্ঞেস করলেন, ঐ ভার্মা লোকটা কে?
রানা বললেন, ভারত সরকারের একজন প্রতিনিধি। মিঃ রায়চৌধুরীকে সাহায্য করবার জন্য ভারত সরকার ওকে পাঠিয়েছেন। এর আগেও ভারত সরকারের নানান কাজ নিয়ে ঐ ভাম। এদিকে এসেছে।
ওর পরিচয়পত্র সব ঠিকঠাক আছে কি না, আপনি নিজে দেখেছেন?
না, আমি নিজে দেখিনি। তবে কাঠমাণ্ডুতে আমাদের সরকারি অফিসে নিশ্চয়ই ওকে পরিচয়পত্র পেশ করতে হয়েছে।
সে পরিচয়পত্র জাল হতে পারে। যাই হোক, ও আমাদের এখানে আটকে রাখল কেন? ও বলল, আমরা বড় বেশি জেনে ফেলেছি। কী জেনেছি?
মাটির মধ্যে একটা লোহার দরজার কথা। মিংমার ঐ কথাটাতেই ভার্মা বারবার বাধা দিচ্ছিল।
টমাস ত্ৰিভুবন একটা কাঠের প্যাকিং বাক্সের ওপর গিয়ে বসলেন। তারপর রানাকে বললেন, আপনি একটা কাজ করবেন? গম্বুজের দরজাটা ভেতর থেকে ভাল করে বন্ধ করে দিন।–ভার্মা বাইরে থেকে দরজা আটকে দিয়েছে। ও যাতে হঠাৎ আবার ভেতরে ঢুকতে না পারে, সে-ব্যবস্থা করা দরকার।
রানা দরজাটা বন্ধ করতে গিয়ে আগে সেটাতে কান লাগিয়ে বাইরে কোনও শব্দ হচ্ছে কিনা শোনার চেষ্টা করলেন। কিছুই শুনতে পেলেন না। দরজা আটকে ফিরে এলেন।
টমাস ত্রিভুবন বললেন, এখানে বিঙ্কিট, মাখন, জ্যাম অনেক আছে। চা-কফি আছে। আমাদের না-খেয়ে মরতে হবে না। কিন্তু কথা হচ্ছে কতদিন থাকতে হবে?
রানা বললেন, কাঠমাণ্ডু থেকে আজই রেসকিউ পার্টি এসে পড়বার কথা। অবশ্য ভার্মা বলল, ওদিকে খুব ঝড়বৃষ্টি হচ্ছে বলে তিন-চারদিন প্লেন বা হেলিকপ্টার চলবে না।
সেটা সত্যি কথা না-ও হতে পারে। আবার এমনও হতে পারে, ও নিজেই কোনও মিথ্যে খবর পাঠিয়ে রেসকিউ পার্টি ক্যানসেল করে দিয়েছে। দাঁড়ান, আগে একটু চা খাওয়া যাক। শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করে লাভ নেই। চা খেলে মাথাটা পরিষ্কার হবে।
টমাস ত্ৰিভুবন স্পিরিট ল্যাম্প জ্বেলে জল চাপিয়ে দিলেন। রানা কিন্তু টমাস ত্ৰিভুবনের মতন শান্ত থাকতে পারছেন না। ছটফট করে ঘুরছেন ঐটুকু ছোট্ট জায়গার মধ্যে। নিজের মাথার চুল আকড়ে ধরে বললেন, এখান থেকে খবর পাঠাবারও কোনও উপায় নেই। কেউ জানতে পারবে না। আমাদের খবর। ওয়্যারলেস সেটটাকেও খারাপ করে দিয়েছে?
টমাস ত্ৰিভুবন বললেন, সেটটাকে আমি একটু নাড়াচাড়া করে দেখব। ও ব্যাপারে আমার কিছুটা জ্ঞান আছে, দেখি সরিয়ে ফেলতে পারি কি না। ব্যস্ত হচ্ছেন কেন? একটা জিনিস লক্ষ করেছেন? আমরা হেলিকপটারের কোনও আওয়াজ পাইনি! তার মানে, আমাদের বন্দী করে ও পালায়নি এখনও। রানা বললেন, পালাবে না। এখানেই ওরা দলবল আছে। মিঃ রায়চৌধুরী যখন অদৃশ্য হয়ে যান, তখনই আমার বোঝা উচিত ছিল যে এখানে মাটির তলায় কিছু ব্যাপার আছে। একটা লোক তো আর এমনি এমনি আকাশে উড়ে যেতে পারে না।
লোহার দরজা যখন আছে, তখন তার ভেতরে মানুষও আছে। তারা কুকুর পোষে, ভেতরে জ্যান্ত মুর্গি রাখে। কুকুরের পায়ের ছাপ আমি আগেরবার এসে দেখেছি। এবারে এসে দেখলুম মুর্গির পালক। তার মানে বেশ পাকাপাকি থাকবার ব্যবস্থা। এরা কারা?
নিশ্চয়ই কোনও গুপ্তচর-দল।
কিন্তু মাটির তলায় বসে কী গুপ্তচরগিরি করবে? আর এই বরফের দেশে গোপন কিছু দেখবার কী আছে?
আজকালকার গুপ্তচরবৃত্তির জন্য চোখে দেখার দরকার হয় না। নিশ্চয়ই ওরা মাটির তলায় কোনও শক্তিশালী যন্ত্র বসিয়েছে। কাছাকাছি তিনটে দেশের সীমানা। তিববত অথাৎ চীন, রাশিয়া, ভারত—
হুঁ। এই ভামটাও ওদের দলের লোক।
চা তৈরি হয়ে গেছে, কাগজের গেলাসে চা ঢেলে টমাস ত্ৰিভুবন একটা এগিয়ে দিলেন রানার দিকে। রানার মুখখানা দুশ্চিন্তায় মাখা, সেই তুলনায় টমাস ত্ৰিভুবন অনেকটা শান্ত।
আরাম করে চা-টা শেষ করার পর টমাস ত্ৰিভুবন বললেন, এই গম্বুজের সিঁড়ি দিয়ে ওপরে উঠে একটা বসবার জায়গা আছে আমি জানি। সেখান দিয়ে বাইরেটা দেখা যায়। দেখুন তো এখানে কোনও বাইনোকুলার পান কি না।
রানা বাইনোকুলার খুঁজতে লাগলেন আর টমাস ত্রিভুবন বসলেন রেডিও-টেলিফোন সেটটা নিয়ে। একটু নাড়াচাড়া করেই তিনি বলেন, ইশ, এটাকে একেবারে তছনছ করে দিয়েছে। ভার্মা কখন এটাকে ভাঙল বলুন তো।
রানা বললেন, কোন এক ফাঁকে ভেঙেছে, আমরা লক্ষই করিনি। আপনাকে শুধু শুধু এই বিপদের মধ্যে নিয়ে এলাম! আপনার আসবার কথাই ছিল না!
ত্ৰিভুবন বলেলেন, আমি এর আগেও তিনবার বিপদে পড়েছি জীবনে। একটা কথা ভেবে দেখুন তো, ভার্মা আমাদের দুজনকে গুলি করে মেরেই ফেলতে পারত। আমাদের কিছুই করার ছিল না। না-মেরে যে আমাদের এখানে আটকে রেখেছে, তার মানে আমাদের এখনও বাঁচার আশা আছে।
রানা আফশোসের সুরে বললেন, ইশ, কেন যে আমার লাইট মেশিনগানটা হেলিকপটারে ফেলে এলাম!
ত্ৰিভুবন বললেন, সেটা আনলেও কোনও লাভ হত না হয়তো। আপনি তো ভামাকে আগে সন্দেহ করেননি। সে হঠাৎ আপনার হাতে গুলিই চালিয়ে দিত। বাইনোকুলার পেলেন না?
না! মিঃ রায়চৌধুরীর গলাতেই একটা বাইনোকুলার ঝোলানো ছিল, যতদূর মনে পড়ছে। ওঃ হে! আমার নিজের পকেটেই তো একটা রয়েছে! একেবারে ভুলেই গিয়েছিলাম! আপনি বাইনোকুলার খুঁজতে বললেন, আর আমি অমনি খুঁজতে আরম্ভ করলাম।
এত বিপদের মধ্যেও ত্ৰিভুবন হেসে ফেললেন। তারপর বললেন, আপনার ওভারকেটের অন্য পকেটগুলোও খুঁজে দেখুন তো, রিভলভার-টিভলভার আছে কি না।
রানা কোটের সাব-কটা পকেট চাপড়ে দেখে নিয়ে বললেন, না, নেই। আমার নিজস্ব কোনও রিভলভারই নেই!
চলুন তাহলে গম্বুজের ওপরে উঠে দেখা যাক।
গম্বুজের ওপরে ছোট জানলাটা দিয়ে একজনের বেশি দেখা যায় না। বাইনোকুলারটা হাতে নিয়ে একবার রানা আর একবার ত্ৰিভুবন বাইরে দেখতে লাগলেন। বাইনোকুলার দিয়ে সাধারণত দূরের জিনিস দেখবার চেষ্টা করে। ওঁরাও দূরে দেখতে লাগলেন। গম্বুজের কাছেই যে ভার্মা ও মিংমা অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে, তা ওঁদের নজরে পড়ল না।
বাইরে আলো কমে এসেছে। এরপর একটু বাদেই হঠাৎ ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসবে। হেলিকপটারটা দূরে থেমে আছে। ছোট হেলিকপটারে বেশি লোক আঁটে না বলে এবার কোনও পাইলট আনা হয়নি, রানা নিজেই চালিয়ে নিয়ে এসেছেন। অবশ্য ভামাও হেলিকপটার চালাতে জানে, ইচ্ছে করলে সে পালাতে পারত।
একসময় বাইনোকুলারটা টমাস ত্ৰিভুবনের হাত ফসকে সিঁড়িতে পড়ে গেল। রানা বললেন, ঠিক আছে, আমি তুলে আনছি। তখন টমাস ত্ৰিভুবন খালি চোখে তাকালেন বাইরে। অমনি তিনি দেখতে পেলেন ভার্মা আর মিংমাকে। তাঁর বুকটা ধক করে উঠল। উত্তেজিতভাবে তিনি বললেন, রানা, রানা, এদিকে আসুন! শিগগির!
বাইনোকুলারটা কুড়িয়ে রানা দৌড়ে চলে এলেন ওপরে। ত্ৰিভুবন নিজে জানলার কাছ থেকে সরে গিয়ে রানাকে দেখতে দিলেন। রানা দেখেই বিস্ময়ের সঙ্গে বলে উঠলেন, মাই গড! ওরা দুজনেই মরে গেছে?
ত্ৰিভুবন বললেন, না, তা কী করে হয়! দুজনে কী করে একসঙ্গে মরবে? মিংমা তো অজ্ঞান হয়েই ছিল।
কিন্তু ঐ জায়গায় ছিল না। আরও কনেকটা বাঁ পাশে। কোনওক্রমে মিংমা উঠে এসেছিল। আমরা কোনও গুলির শব্দও পাইনি!
মনে হচ্ছে, কোনও কারণে দুজনেই অজ্ঞান হয়ে গেছে।
রিভলভারটা পড়ে আছে কাছেই।
কি সাঙ্ঘাতিক ব্যাপার। যদি ভার্মা ব্যাটা আগে জ্ঞান ফিরে পায়, তা হলে ও মিংমাকে এবার মেরে ফেলবে।
আর যদি মিংমা আগে জ্ঞান ফিরে পায়, তা হলে আমরা এক্ষুনি মুক্ত হতে পারি। মিংমা আমাদের দরজা খুলে দেবে।
মিংমাকে আগে জাগতেই হবে। ওকে কীভাবে জাগানো যায়? এখান থেকে চেঁচিয়ে ডাকলে-
না, তাতে লাভ নেই। তাতে ভামাই আগে জেগে যেতে পারে।
একটা কিছু করতেই হবে! মিংমাই আমাদের বেশি কাছে। যদি এখান থেকে ওর গায়ে জল ছুঁড়ে দেওয়া যায়?
অতটা দূরে কীভাবে জল ছুঁড়বেন?
অবশ্য সেরকম কিছুই করতে হল না। একবার দূরের দিকে চেয়ে ওঁরা দুজন আবার দারুণ চমকে উঠলেন।
আলো খুবই কমে গেছে। চতুর্দিকে হালকা অন্ধকার। তার মধ্যে দেখা গেল, মানুষের চেয়ে বড় আকারের দুটি প্রাণী এই গম্বুজের দিকে এগিয়ে আসছে।
অসম্ভব উত্তেজনায় রানা চেপে ধরলেন টমাস ত্ৰিভুবনকে। ফিস-ফিস করে বললেন, ইয়েটি! ইয়েটি
টমাস ত্ৰিভুবন ভাল করে দেখে বললেন, তাই তো মনে হচ্ছে!
ইয়েতির মতন প্রাণী দুটোর গায়ে ভালুকের মতন বড় বড় লোম, তারা দুলে-দুলে হাঁটে। মাঝে-মাঝে ঘাড় ফিরিয়ে চারদিক দেখে নেয়। তাদের মুখে কোনও শব্দ নেই।
বিস্ময়ে, রোমাঞ্চে এবং খানিকটা ভয়ে রানা একেবারে তোতলা হয়ে গেলেন। কাঁপতে কাঁপতে বললেন, তা-তা-তা-হলে আ-আ-ম-ম-র স-ত্যি ই-ই-য়ে-টি দে-দে-দে-খ-লা-মা!
টমাস ত্ৰিভুবন বললেন, চুপ! কোনও শব্দ করবেন না। ইশ, অন্ধকার হয়ে গেল, ওদের ছবি তোলা যাবে না?
ইয়েতির মতন প্রাণী দুটো ভার্মা আর মিংমার মাথার কাছে দাঁড়াল, গম্বুজের দিকে তারা একবারও দেখছে না। হঠাৎ ওরা এক অদ্ভুত খেলা শুরু করল, ওদের মধ্যে একজন মিংমাকে দুহাতে তুলে নিয়ে ছুঁড়ে দিল অন্যজনের দিকে। সে খুব কায়দা করে লুফে নিল মিংমাকে। তারপর আবার সে ছুঁড়ে দিল এদিকে। এইভাবে তারা মিংমাকে নিয়ে লোফালুফি খেলতে লাগল।
রানা ফিসফিস করে বললেন, মিংমা মরে যাবে। ওরা মিংমাকে মেরে ফেলবে! ইশ, যদি লাইট মেশিনগানটা থাকত ইয়েটি দুটোকে খতম করতে পারতাম। পৃথিবীতে যারা বিশ্বাস করে না, তারা দেখত সত্যিকারের ইয়েটির व्लाभ।
ত্ৰিভুবন রানাকে জোরে চিমটি কেটে বললেন, চুপ! চুপ! দেখুন, ওরা এবার কী করছে।
ইয়েতির মতন প্রাণী দুটো মিংমাকে একসময় নামিয়ে দিল মাটিতে। তারপর ওদের একজন ভামাকে তুলে নিল। কিন্তু ভামাকে নিয়ে ওরা লোফালুফি খেলল না। তাকে নিয়ে ওরা চলে গেল দূরের ঘন অন্ধকারের দিকে।