২১. গল নামে এক জাতির দেশ

‘কাকে তুমি সবচেয়ে ভালোবাসো, হেঁয়ালি-মানুষ, আমায় বলো?
তোমার বাবা, মা, বোন, ভাইকে?
–আমার বাবা নেই, মা নেই, বোন নেই, ভাই নেই।
-তোমার বন্ধুদের?
-তুমি এমন একটা শব্দ ব্যবহার করেছ, যার অর্থ
আমি আজ পর্যন্ত বুঝিনি
-তোমার দেশ?
-কোন দ্রাঘিমায় তার অবস্থান আমি জানি না
-সৌন্দর্যকে?
-আমি আনন্দের সঙ্গেই তাকে ভালোবাসতাম, যদি হত সে
কোনও দেবী এবং অমর
-সোনা?
-আমি তা ঘৃণা করি, যেমন তুমি ঈশ্বরকে
-তবে, কী তুমি ভালোবাসো, অসাধারণ আগন্তুক?
-আমি ভালোবাসি মেঘ, যেসব মেঘেরা ভেসে যায়, ওই ওখানে…
ওই সেখানে…বিস্ময়ময় মেঘেরা!’
-–শার্ল বোদলেয়ার

ফরাসিদেশটা এককালে ছিল গল নামে এক জাতির দেশ। এই গল শব্দটা এখন বিশেষ ব্যবহৃত হয় না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সেনাপতি এবং পরবর্তী কালের রাষ্ট্রনায়ক দ্য গলের নামের মধ্যে রয়ে গেছে সেই স্মৃতি, এ দেশের এক জনপ্রিয় সিগারেটের ব্র্যান্ড হচ্ছে গলোয়াজ। এই গলদের ওপর রোমানরা বেশ কিছুকাল প্রভুত্ব করেছিল। অ্যাস্টারিকস-এর জনপ্রিয় কমিকসে জুলিয়াস সিজারের সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে গলদের একটু ক্ষুদ্র গ্রামের লড়াইয়ের অনেক কৌতুক কাহিনি পাওয়া যায়। রোমান সাম্রাজ্য যখন টুকরো-টুকরো হয়ে যায়, তখন বিভিন্ন রোমান সামন্ত অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যের রাজা হয়ে বসেছিল। ফ্রান্সের দক্ষিণ দিকে এই প্রভাঁস অঞ্চলও সেইরকম এক রোমান রাজার অধীনে ছিল কিছুকাল। তার কিছু ঐতিহাসিক চিহ্নও রয়ে গেছে।

এক্স শহরে আমাদের বেশিক্ষণ থাকা হল না। দেখা হল না এমিল জোলা কিংবা পল সেজান-এর বাড়ি, শুধু ঘুরে গেলাম রোমানদের গড়া এক অ্যামফিথিয়েটার, আজকাল যাকে আমরা বলি স্টেডিয়াম। চতুর্থ-পঞ্চম শতাব্দীর গড়া সেই বিশাল ব্যাপার, আজও অনেকটা অক্ষত। ওপরের দিকে গিয়ে দাঁড়ালে অনায়সে কল্পনা করা যায়, একদিকে বসে আছেন বিলাসী রোম সম্রাট, পাশে তাঁর ব্যভিচারিণী পত্নী, নেশাগ্রস্ত চোখে তারা উপভোগ করছেন আরিন্যার মধ্যে ক্ষুধার্ত সিংহদের সঙ্গে গ্ল্যাডিয়েটরদের প্রাণপণ লড়াই! একটা সিংহ একজন মানুষকে মেরে হামহুম করে খাচ্ছে, এই দৃশ্যও এককালে মানুষের কাছে উপভোগ্য ছিল!

এক্স শহর থেকে আমরা বেরিয়ে পড়লাম দুপুর-দুপুর। প্যারিস ছাড়ার পর আমরা তিন রাত কাটিয়েছি পথে, এবার কোথাও কয়েকদিনের জন্য থিতু হওয়া দরকার। অসীম একলা গাড়ি চালাচ্ছে, তাকে বিশ্রাম দেওয়া উচিত।

আমি ইংল্যান্ডের গ্রাম বিশেষ দেখিনি। লন্ডন থেকে কখনও গেছি অক্সফোর্ডে, কখনও ডোভারে, তাও বড় রাস্তা ধরে বিখ্যাত ব্রিটিশ কান্ট্রিসাইড আমার দেখা হয়নি আজও। কিছু গ্রাম দেখেছি বটে আমেরিকায়, কিন্তু সেগুলো কেমন যেন ছন্নছাড়া, ধূধূ করা মাঠ বা

ফসলের খেতের মধ্যে একটা-আধটা বাড়ি। তা ছাড়া, আমেরিকার অধিকাংশ গ্রামগুলিরই নামের সঙ্গে সিটি বা টাউন যোগ করা। মোট শ’দেড়েক পরিবারের বাস, এমন জায়গার নাম স্টোন সিটি। বড় রাস্তার ধারে ধারে যেসব জায়গা পড়ে, সেখানকার জনসংখ্যা বোর্ডে লেখা থাকে। যে-জায়গায় জনসংখ্যা মাত্র ছত্রিশ, সেটাও একটা টাউন। আমেরিকায় ভূতের গ্রামও আছে একাধিক। জনশূন্য কিংবা পরিত্যক্ত কোনও এলাকার নাম গোস্ট সিটি।

সোভিয়েত রাশিয়া কিংবা চিনের বড়-বড় শহরগুলিই শুধু আমি দেখেছি, গ্রাম দেখার সৌভাগ্য হয়নি। ভারতের বাইরে সত্যিকারের বহু গ্রাম আমি শুধু দেখেছি ফরাসিদেশেই। ভারী চোখ জুড়োনো সেই সব গ্রাম। গ্রাম্য ভাব একেবারে মুছে যায়নি, অথচ ঝকঝকে তকতকে, বাড়িগুলি মনে হয় চকোলেটের তৈরি। এমনকি কবরখানাগুলিও বড়ো সুন্দর। সৌন্দর্যবোধের সঙ্গে সবসময় যে দারিদ্র কিংবা প্রাচুর্যের কোনও সম্পর্ক আছে, তাও বলা যায় না। ফরাসিরা এমন কিছু বড়লোক নয়, কিন্তু রাস্তার পাশের একটা কবরখানাও যে সুন্দর করে সাজিয়ে রাখতে হয়, অন্য লোকের চক্ষুপীড়ার কারণ না ঘটে, সে বোধটুকু তাদের আছে।

এক-একটা গ্রামের মধ্য দিয়ে যেতে যেতে চোখে পড়ে কোনও স্তম্ভের ওপর একটা পাথরের মুরগি। প্রথম প্রথম দেখে মজা লাগে। ব্রিটেনের জাতীয় প্রতীক যেমন সিংহ, আমেরিকার ইগল, সেরকম ফ্রান্সের জাতীয় প্রতীক মুরগি, মুরগিরও মূর্তি বানিয়ে রেখেছে।

দু-একটা ছোট-ছোট শহরে বা গ্রামের নাম দেখলে চমকে চমকে উঠতে হয়। মনে পড়ে যায় অনেক ইতিহাস ও কাহিনি। যেমন একটা অপূর্ব মনোহর জায়গায় কফি খাওয়ার জন্য অসীম গাড়ি থামিয়েছিল। সেই জায়গাটার নাম বারজেরাক। নামটা চেনা চেনা লাগে। আমি অসীমকে জিগ্যেস করেছিলাম, এই জায়গাটার সঙ্গে সিরানো দ্য বারজেরাকের কি কোনও সম্পর্ক আছে?

অসীম বলল, ঠিক ধরেছ! এই জায়গাটিকেও কেন্দ্র করেই সিরানোর কাহিনি প্রচলিত।

সিরানো ছিল প্রেমিক, শিল্পী, কবি। কিন্তু দুঃখের বিষয় তার নাকটি ছিল বড় বেশি লম্বা। তার মুখে, নাকের বদলে যেন মনে হত, একটা কলা বসানো আছে। সেই লজ্জায় সে কোনও মেয়ের সামনে বেরুত না। অন্য এক অপদার্থ প্রেমিক, তার আর কোনও গুণই ছিল না, শুধু চেহারাটা ছিল কার্তিকের মতন, তার হয়ে তার প্রেমিকার কাছে সিরানো প্রেমপত্র লিখে দিত। এমনকি সেই প্রেমিকার বাড়ির ব্যালকনির নীচে লুকিয়ে থেকে সিরানো তার বন্ধুর বকলমে বলে যেত অপরূপ সব প্রণয়বাক্য, যা আসলে তার নিজেরই হাহাকার! আমাদের ছাত্র বয়েসে এই কাহিনি নিয়ে চমৎকার একটি ফিলম হয়েছিল, যাতে নাক-লম্বা সিরানোর ভূমিকায় ছিল জোসে ফেরার।

আর একটি শহরের নাম লোত্রেক। শুনলেই মনে পড়ে শিল্পী তুলুজ লোত্রেকের কথা। ধনীর সন্তান লোত্রেক অল্প বয়েসে একবার ঘোড়া থেকে পড়ে যায়, কোমরে ও পায়ে খুব চোট লাগে। সেই থেকে তার শরীর আর বাড়েনি, সে হয়ে গেল একটি বামন। কিন্তু সে অসাধারণ শিল্পী হয়ে উঠেছিল, মেয়েরা তার দিকে করুণার চক্ষে তাকালেও সে পানশালার নর্তকী ও বারবনিতাদের নিজের ছবিতে অমর করে রেখেছে। এই তুলুজ লোত্রেককে নিয়েও আমরা একটা ভালো ফিলম দেখেছি এক সময়, এবং কী আশ্চর্য ব্যাপার, সেখানেও ওই বামন শিল্পীর ভূমিকায় জোসে ফেরার অনবদ্য অভিনয় করেছিল।

নিম শহরটি দেখিয়ে অসীম বসেছিল, আজকাল যে জিনস-এর প্যান্ট পরার খুব ফ্যাশান হয়েছে সব দেশে, সেই জিনস কাপড়টার জন্ম এখানে।

ভাস্কর প্রতিবাদ করে বলল, যাঃ, জিনস তো চালু হয়েছে আমেরিকায়!

অসীম বলল, এইখান থেকে প্রথম কাপড়টা গেছে। এখনও দেখবে, জিনস-কে অনেকে বলে ডেনিম। ওই ডেনিম আসলে হচ্ছে দ্য নিম। ফরাসি দ্য মানে ইংরিজি অফ, বাংলায় ষষ্ঠী তৎপুরুষ! দ্য নিম, অফ নিম, অর্থাৎ নিম-এর জিনিস। একটু একটু ফরাসি শেখো, ভাস্কর।

ভাস্কর নাকের পাটা ফুলিয়ে বলল, কোন দুঃখে শিখতে যাব। না শিখেও জীবনের এতগুলো বচ্ছর কোনওই অসুবিধে হয়নি, বাকি জীবনটাও স্বচ্ছন্দে কেটে যাবে। ওই সব ফালতু জেনারেল নলেজের লেকচার তুমি সুনীলের ওপর যত ইচ্ছে ঝাড়ো না ভাই!

প্রায় বিকেলের দিকে আমরা এসে পৌঁছলাম সমুদ্রের কাছাকাছি। বাতাসে সমুদ্রের গন্ধ পাওয়া যায়, চোখে পড়ে সাদা ধপধপে পাখি। আমরা এসে গেছি ফ্রান্সের দক্ষিণ উপকূলে, বিশ্ববিখ্যাত ‘সাউথ অফ ফ্রান্স’। কোত দাজুর!

মার্সেই একটা বড় বন্দর এবং ভিড় ভাট্টার জায়গা বলে সেখানটা এড়িয়ে আমরা এগুতে লাগলাম তটরেখা ধরে। সামদের দিকে কান, আনতিব, নিস-এর মতন নাম করা সব শহর, এ ছাড়াও সমস্ত তটরেখা জুড়েই ছোট-বড় অজস্র শহর। পৃথিবীর বহু বিখ্যাত ধনী, ফিলমস্টার, শিল্পী, লেখকরা এখানে নিজস্ব বাড়ি করে রাখে। তা ছাড়াও পর্যটকদের জন্য কত রকমের যে হোটেল, গেস্ট হাউজ, লজ আর ইয়ত্তা নেই।

বিকেলের স্বর্ণাভ রোদে অসীম এক জায়গায় গাড়ি থামিয়ে বলল, এবার?

আমরা কেউ ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না।

অসীম বলল, এখানে প্রথম দৃশ্যটা কী দেখবে তা কি জানো? কোনও আন্দাজ আছে? আমি ইচ্ছে করেই আগে কিছু বলিনি।

অসীম কী যে রহস্য করছে, তা সত্যি ধরা গেল না। এখানে ভূমধ্যসাগরের নিবিড় নীল সৌন্দর্য দেখব, এটাই তো জানি।

গাড়ি থেকে নেমে প্রায় সেনাপতির ভঙ্গিতে অসীম আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে চলল। যেখানে গাড়ি পার্ক করা হয়েছে, সেখান থেকে সমুদ্র দেখা যায় না, একটা কাঁধ সমান উঁচু পাঁচিল। সেখানে এসে অসীম বলল, ওয়ান টু, থ্রি…।

সত্যিই এমন দৃশ্য কল্পনা করিনি। প্রথমে চক্ষু দুটি বিস্ফারিত হবেই।

আদিগন্ত নীল জলরাশির সামনের বেলাভূমিতে বালির ওপর শুয়ে-বসে আছে অন্তত হাজার খানেক নারী, পুরুষ, শিশু। কেউ শুয়ে আছে, কেউ পা ছড়িয়ে বসা, কেউ ছুটোছুটি করে নেমে যাচ্ছে জলে, খেলছে বাচ্চারা। সকলেই প্রায় উলঙ্গ। প্রায় বললাম এই কারণে যে, পুরুষ-নারী কারুরই উর্ধাঙ্গে একটা সুতোও নেই, নিম্নাঙ্গে এক চিলতে কটি-বস্ত্র আছে বটে, তাও প্রায় দেখাই যায় না।

পুরুষরা সুঠাম তরুণীদের নগ্ন বক্ষদেশে দেখে পুলকিত হবে, এ তো স্বাভাবিক। কিন্তু প্রথম দর্শনে আমার ঠিক কী অনুভূতি তাও অকপটে জানানো দরকার।

সেখানে কালো বা খয়েরি রঙের মানুষ একজনও চোখে পড়েনি। সবাই শ্বেতাঙ্গ, অনেকেরই সোনালি চুল, গায়ের রোমও সোনালি। সবাই কাছাকাছি শুয়ে-বসে আছে, এবং প্রায় নিঃশব্দ। হঠাৎ দেখেই আমার মনে হয়েছিল, এরা কেউ মানুষ নয়, মানুষের। পূর্বপুরুষ একদল বাঁদর। আমি আসামে, মানসের জঙ্গল একবার এক ঝাঁক গোল্ডেন লাঙ্গুর দেখেছিলাম, পুরুষ-স্ত্রী-শিশু মিলিয়ে চোদ্দো-পনেরো জনের একটা পরিবার, তাদের সারা গা সোনালি। অবিকল যেন সেই বাঁদরের ঝাঁকের মতন এই মানুষগুলি।

সেই গণ-নগ্নতা আমার তেমন পছন্দ হয়নি। প্রত্যেক মানুষের শরীরেই একটা রহস্য আছে, পোশাক তা ঢেকে রাখে। দু’জন মাত্র নারী-পুরুষ নিভৃতভাবে সেই রহস্য জানার চেষ্টা করে, ব্যাকুল হয়, অনেক ক্ষেত্রে সারা জীবনেও জানা হয় না।

আমরা চারজন পুরো পোশাক-পরিহিত মানুষ এতগুলি প্রায় নগ্ন নারী-পুরুষের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা বিসদৃশ, যদিও কেউ তা নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে না। তবু আমরা সেখান থেকে সরে এলাম। পরে কখনও আমরাও সমুদ্র-স্নানে আসব নিশ্চিত, তার আগে রাত্রিবাসের ব্যবস্থা করা দরকার।

এত রকম হোটেল থেকে বেছে নেওয়া সোজা কথা নয়। তা ছাড়া আমাদের সস্তার জায়গা খুঁজতে হবে। এখানে সব হোটেলের বাইরে স্পষ্টভাবে স্টার রেটিং দেওয়া থাকে। ফাইভ স্টার, ফোর স্টার, থ্রি স্টার হোটেলগুলের ধারেকাছেও আমরা ঘেঁষি না। টু স্টারই যথেষ্ট, এমনকি ওয়ান স্টারেও আপত্তি নেই। এখানে আমরা তিন চারদিন থাকব। সুতরাং পাকাঁপাকি একটা ভালো আস্তানা খোঁজা দরকার।

বেশ কিছু বছর আগে অসীম তার এক বন্ধুর সঙ্গে এই অঞ্চলে বেড়াতে এসে একটা লজে ছিল, জায়গাটা পরিচ্ছন্ন ও সস্তা, সুতরাং অসীম সেখানেই যেতে চায়। বেশ ভালো কথা। কিন্তু কোনওক্রমেই আমরা সেখানে পৌঁছতে পারি না। হয় পেরিয়ে যাই, আবার ফিরতে গেলে রাস্তা হারাই। অসীম প্রায় দু’যুগ ধরে ফ্রান্সে আছে, প্রতিদিন গাড়ি চালায়, তবু রাস্তা ভুল করতে সে খুব ওস্তাদ।

এক সময় অতি কষ্টে জুয়্যাঁ লে-প্যাঁ তে আসা গেল বটে, কিন্তু অসীমের সেই চেনা বাড়ি মিলল না কোনওক্রমেই। অসীমও জেদ ধরেছে, সে বাড়িটা আগে দেখবেই। এক একটা রাস্তা তার অস্পষ্টভাবে চেনা-চেনা মনে হয়, কিন্তু সেখানে কোনও লজ নেই। এদেশে অনবরত বাড়ি-ঘর ভেঙে নতুন নতুন বাড়ি হয়, এমনকি গোটা রাস্তাটাই বদলে যায়। আমেরিকার আয়ওয়া শহরে দ্বিতীয়বার গিয়ে আমি আগেরবার যে-বাড়িটাতে ছিলাম, সেটা কিছুতেই খুঁজে পাইনি। অথচ রাস্তার নাম, নম্বর সবই আমার মুখস্থ। কিন্তু মার্গারিটের মতন সেই বাড়িটাও শূন্যে মিলিয়ে গেছে, পুরো পাড়াটাই অন্যরকম!

এক সময় ভাস্কর্যের ধৈর্যচ্যুতি ঘটল।

তার নেতৃত্ববোধ মাথা চাড়া দিয়ে উঠল, সে এক ধমক দিয়ে বলল, যথেষ্ট হয়েছে, অসীম! তোমার ওই লে-প্যাঁ না মে-প্যাঁ ছাড়ো তো! এবার আমি সামনে যে টু-স্টার হোটেল দেখব, সেটাতেই উঠব!

ভাস্কর জোর করেই নেমে গেল গাড়ি থেকে। এতক্ষণ ধরে রাস্তা ভুল করে অসীমও খানিকটা চুপসে গেছে।

তিন-চারটে হোটেল ঘুরে এক জায়গায় ঘর ঠিক করে ফেলল ভাস্কর। এবং অবিশ্বাস্য রকমের সস্তা। চার জনের জন্য দুটি ঘরের বদলে পাওয়া গেল একটা স্যুইট, তাতে একটা বড় ঘর, একটা বসবার ঘর, এমনকি সংলগ্ন একটা রান্নাঘরও ব্যবহার করা যাবে। এখানে সারা বিশ্বের ভ্রমণার্থীরা আসে বলে সব হোটেল মালিকই কিছু কিছু ইংরিজি জানে, সুতরাং ইংরিজি বলার সুযোগ পেয়ে ভাস্কর হাসি-ঠাট্টা-মস্করায় এই হোটেল মালিকের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলল অবিলম্বে, সেই সুযোগে ভাড়াও কমিয়ে ফেলল অনেক।

হোটেলের মালিকটি তরুণ বয়স্ক, অতিশয় সুপুরুষ, মুখখানি হাস্যময়। কথায় কথায় সে জানাল যে তার নাম লুই এবং সে কর্সিকার লোক। নেপোলিয়ান বোনাপার্টের পর এই দ্বিতীয় একজন কর্সিকানের সঙ্গে আমার পরিচয় হল। সে শুধু হোটেলের মালিক নয়, সে

একজন কবি, শিগগিরই তার প্রথম কবিতার বই বেরুচ্ছে, তার প্রুফ দেখা চলছে।

তার এই পরিচয় পেয়ে ভাস্কর আরও হইচই করে উঠে বলল, তবে তো চমৎকার, আমরা সবাই কবিতা ভালোবাসি, আজ আমরা তোমার কবিতা শুনব। কাল এখানে একটা কবি সম্মেলন হবে। তুমি ফরাসি কবিদের মধ্যে কাকে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করো?

লুই বলল, বোদলেয়ার। আমার দেবতা হচ্ছে শার্ল বোদলেয়ার।

ভাস্কর অসীম ও আমার দিকে হাত দেখিয়ে বলল, ওরা দু’জনেও খুব বোদলেয়ারের ভক্ত। ওই কবি সম্পর্কে অনেক কিছু জানে, তোমার সঙ্গে জমে যাবে।

লুই বলল, আমার স্ত্রী ইংরেজ। সে এখন নেই। তোমাদের সঙ্গে আলাপ করিয়ে দেব। সে তোমাদের সঙ্গে ইংরিজিতে আরও ভালো করে কথা বলতে পারবে।

ভাস্কর ওর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বলল, তুমিও তো চমৎকার ইংরিজি বলছ। এই যথেষ্ট। এই তো যথেষ্ট! কাল তোমার বউ আর তুমি আমাদের সঙ্গে খাবে। তোমাদের ভারতীয় রান্না খাওয়াব। তোমরা কাল আমাদের অতিথি। তা হলে ওই কথাই রইল?

এরপর নিজেদের ঘরে এসে জুতো-মোজা খুলতে খুলতে অসীম জিগ্যেস করল, এই যে, ভাস্কর, তুমি তো দিব্যি ওই কর্সিকান ছেলেটিকে কাল রাত্তিরে খাওয়ার নেমন্তন্ন করে বসলে! রাঁধবে কে?

ভাস্কর ভুরু তুলে বিরাট বিস্ময়ের ভাব করে খাওয়াল, কেন, তুমি রাঁধবে? তুমি ব্যাচিলার, এত বছর একলা একলা এ দেশে রয়েছ, রান্নাবান্নায় তোমারই বেশি ইন্টারেস্ট থাকার কথা। আমি তো মনে মনে আগে থেকেই তোমাকে ওই ভার দিয়ে রেখেছি। মৃণাল বাজার করে দেবে, আর তুমি রাঁধবে। আমার বউ ভাই আমাকে বরাবর খাতির যত্ন করে, রান্না করে খাওয়ায়, আমি সেজন্য ও লাইনে নেই।

অসীম বলল, আমি রাঁধব? তোমার মাথা খারাপ? হোটেলে এসে নিজেরা রান্না করে খেতে যাব কেন? বাইরে খাব। কেন তুমি ঝামেলা করতে গেলে?

ভাস্কর বলল, এ হোটেলে একটা ফাঁকা রান্নাঘর পড়ে আছে কেন? নিশ্চয়ই অনেকে এখানে এসে নিজেদের পছন্দমতো রান্না করে খায়।

দুজনে বিতর্ক জমে উঠল।

এই সব হোটেলে সকালবেলা ব্রেকফাস্ট দেওয়ার ব্যবস্থা আছে, দুপুরে ও রাত্তিরে খাবারদাবারের কোনও পাট নেই। যারা ঘর ভাড়া দেয়, তারা বাইরের কোনও রেস্তোরাঁয় গিয়ে খেয়ে আসে।

ফ্রান্সের এই সব হোটেলের আর একটা ব্যাপার দেখে চমকে গেছি। এর আগে আমি যতগুলো দেশেই গেছি, সব জায়গাতেই কোনও হোটেলে এসে প্রথমেই কাউন্টারে মস্ত বড় খাতায় নাম-ধাম অনেক কিছু লিখতে হয়, পাসপোর্ট দেখাতে হয়, ফ্রান্সে এ পর্যন্ত কোনও হোটেলই সে-রকম কোনও ঝামেলাই নেই। খাতায় নাম লেখার বালাই নেই, কেউ পাসপোর্টও দেখতে চায় না। অফিসঘরে কোনও লোকই থাকে না। বেল বাজালে একজন কেউ ভেতর থেকে আসে, ঘর দেখিয়ে, ভাড়া ঠিক করে, চাবি দিয়ে চলে যায়। তারপর আর সেই হোটেলের মালিক বা ম্যানেজারের সঙ্গে দেখাই হয় না। কোনও অ্যাডভান্সও চায় না। আমাদের যখন হোটেল ছাড়ার ইচ্ছে হবে, তখন আবার অফিসঘরে গিয়ে বেল বাজালে সেই লোকটি আসবে, তার হাত ভাড়ার টাকা চুকিয়ে দিলেই হবে। ভাড়া না দিয়েও যদি কেউ চলে যেতে চায়, তাকে আটকাবার ব্যবস্থা নেই কোনও।

আমার মনে এই প্রশ্নটা খচখচর করে। এরা কি সব লোককেই বিশ্বাস করে এতখানি? সকলেই গাড়ি নিয়ে আসে, কেউ কোথাও নাম সই করে না, সুতরাং যে-কোনও সময় গাড়িতে মালপত্র চাপিয়ে চলে গেলে কেউ তো ধরতে পারবে না? পরে কখনও দেখা হয়ে গেলেও আইনত টাকা চাওয়ার কোনও অধিকার থাকে না।

অসীম এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছিল, কেউ কেউ ভাড়ার টাকা না দিয়েই চলে যায় হয়তো! এরা হিসেব করে দেখেছে, শতকরা তিন-চারজন খুব জোর টাকা মেরে দেয়। এরা সেটা গ্রাহ্য করে না। কারণ, কাউন্টারে একজন লোককে সারাক্ষণ রাখতে গেলে তাকে অনেক বেশি মাইনে দিতে হবে।

অদ্ভুত সহজ ব্যবস্থা। আমাদের দেশের হোটেলগুলোতে এই রকম ব্যবস্থা চালু করলে শতকরা ক’জন ভাড়া না দিয়ে পালাবে? কিংম্বা, প্রশ্নটা ঘুরিয়ে করা যায়, শতকরা ক’জন ফাঁকা অফিসঘরে বেল বাজিয়ে মালিককে ডেকে ভাড়ার টাকা বুঝিয়ে দেবে।

অসীম কিছুতেই রান্না করতে রাজি নয়, শেষ পর্যন্ত ভাস্কর সবর্গে বলল তা হলে ঠিক আছে, আমি নিজেই মাংস রাঁধবো কাল। দেখবে কেমন রাঁধি!

অসীম আর মৃণাল হেসে গড়াগড়ি যেতে লাগল। অসীম বলল, ভাস্কর, তুমি নর্থ ক্যালকাটার বনেদি বাড়ির ছেলে, জীবনে কখনও এক কাপ চা তৈরি করেছ?

ভাস্কর বলল, রণক্ষেত্রে হবে পরিচয়! কাল রাত্তিরে এমন রাঁধব, জীবনে সেরকম কখনও খাওনি।

অসীম বলল, সে মাংস খেয়ে জীবনটাই চলে যাবে না তো?

এরপর ওরা তিনজন চিঠি লিখতে বসল। অসীম লিখছে কাজের চিঠি, বাকি দু’জন তাদের স্ত্রীদের। আমি জানলার কাছে গিয়ে সমুদ্রের জলে অস্তরাশির আভা দেখতে লাগলাম।

মৃণাল আমাকে জিগ্যেস করল, আপনি বাড়িতে চিঠি পাঠাবেন না!

আমি বললাম, দু-একদিন যাক, জায়গাটা ভালো করে দেখি, তারপর তো লিখব, এখন লেখার মতন কী আছে?

ভাস্কর বলল, কবিরা চিঠি লেখে না। তারা সব কিছু ছাপার জন্য লেখে।

এই কথাটার মধ্যে একটা খোঁচা আছে। আমি ভাস্করকে সারা বছরে একটাও চিঠি লিখি কি না সন্দেহ!

মৃণাল বলল, কবিরা চিঠি লেখে না? রবীন্দ্রনাথ কত লিখেছেন, অন্তত কয়েক হাজার।

ভাস্কর বলল, রবীন্দ্রনাথ জানতেন, তাঁর সব চিঠিই ছাপা হবে। মৃত্যুর পরেও বহু বছর ধরে অপ্রকাশিত চিঠিপত্র বেরুবে।

অসীম বলল, রবীন্দ্রনাথ কী করে অত চিঠি লিখেছেন, ভাবলে সত্যি হাঁ হয়ে যেতে হয়। পৃথিবীর আর কোনও কবি বোধহয় এত চিঠি লেখেননি।

আমি বললাম, একই দিয়ে, একই ব্যক্তিকে সবচেয়ে বেশি চিঠি লেখার রেকর্ড কিন্তু রবীন্দ্রনাথের নয়। এক ফরাসি কবির। ওই কর্সিকান ছেলেটি যাঁর ভক্ত, সেই শার্ল বোদলেয়ারের। চিঠিগুলো একটা হোটেলে বসেই লেখা।

ভাস্কর বলল, প্রেমিকাকে চিঠি লিখেছিল? একদিনে ক’খানা!

আমি বললাম, প্রেমিকাকে নয়, নিজের মাকে। ক’খানা আন্দাজ করতে পারবি? সাতখানা। প্রত্যেক ঘণ্টায় একখানা করে।

ঘটনাটি এই রকম।

বোদলেয়ারের তখন পঁয়তিরিশ বছর বয়েস। কিছুদিন আগে অশ্লীলতার অভিযোগে তাঁর কবিতার বইটি নিষিদ্ধ হয়েছে। চরম অর্থাভাব। সেই সময়ই বোদলেয়ারের মা তাঁর দ্বিতীয় স্বামীর মৃত্যুর পর বিধবা হয়েছেন। উচ্ছঙ্খল ছেলের জন্য তিনি একটা মাসোহারার বন্দোবস্ত করেছেন বটে, কিন্তু ছেলের তাতে কুলোয় না। প্রচুর ধার দেনা করে ফেলে বোদলেয়ার মায়ের কাছে আরও টাকা চেয়ে কাকুতি-মিনতির চিঠি লেখেন।

ওঁদের এক পারিবারিক বন্ধু ছিলেন একজন আইনজীবী, তাঁর নাম আনসেল। একবার বোদলেয়ার এক হোটেল থেকে মাকে চিঠি লিখেছিলেন যে সেখানে তিনি সাংঘাতিক ঋণে আবদ্ধ। বোদলেয়ারের প্রকৃত অবস্থাটা কী, তা জানার জন্য আনসেল একদিন চলে এলেন সেই হোটেলে। তখন বোদলেয়ার ফেরার পর হোটেলের মালিক সাতকাহন করে লাগাল। একটা লোক এসেছিল স্পাইগিরি করতে, জিগ্যেস করছিল, ম্যসিউ বোদলেয়ার কত রাত করে বাড়ি ফেরেন, তাঁর ঘরে কোনও মেয়ে নিয়ে আসেন কি না, এই সব।

বোদলেয়ার তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন। আনসেলকে তিনি এমনিতেই দেখতে পারতেন না, আনসেলকে মধ্যস্থ রাখার শর্তটাও তাঁর অসহ্য ছিল। বোদলেয়ার ভাবলেন, এইভাবে গোয়েন্দাগিরি করতে এসে আনসেল তাঁকে অপমান করেছেন। বাল্যকাল থেকেই এই কবিটি বদরাগি, এখন এই ঘটনা শুনে রাতে হাত-পা ছুঁড়তে লাগলেন, চিৎকার করে বলতে লাগলেন, এক্ষুনি তিনি আনসেলের বাড়ি গিয়ে তাকে মারবেন, তার সঙ্গে ডুয়েল লড়বেন।

তারপর তিনি তাঁর মাকে চিঠি লিখতে বসলেন। বেলা দুটোর সময় প্রথম চিঠি : আমি এক্ষুনি যাচ্ছি আনসেলের বাড়িতে। ওই ইতরটার আমি কান মুলে দেব ওর বউ ও ছেলের সামনে। ও বাড়িতে না থাকলে আমি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করব। আজ সব কিছু হেস্তনেস্ত হয়ে যাবে।

বোদলেয়ার সেই রুদ্রমূর্তি দেখে বাড়িওয়ালিটি ভয় পেয়ে গেল। আসলে সে আনসেলের নামে অনেক কিছু বানিয়ে বসেছিল, আনসেল অপমানজনক কোনও প্রশ্ন বোদলেয়ার বিষয়ে করেননি।

বাড়িওয়ালা বোদলেয়ারকে আটকালেন। তখন বোদলেয়ার লিখলেন দ্বিতীয় চিঠি : আমি এক্ষুনি আনসেলের বাড়িতে যাচ্ছি না বটে, কিন্তু আনসেলকে ক্ষমা চাইতেই হবে। তাকে তুমি ধমকাবে।

তৃতীয় চিঠিতে লিখলেন, অপমানে আমার সারা শরীর জ্বলছে, আনসেল যদি ক্ষমা না চায়, প্রতিশোধ না নিলে আমি শান্ত হতে পারব না। আমি আনসেলকে থাপ্পড় মারব, ওর ছেলেকে থাপ্পড় মারব। তারপর গুণ্ডামির অভিযোগে পুলিশ আমাকে ধরে নিয়ে যায় তো যাক।

পরের চিঠি লেখার সময় বোদলেয়ারের স্ট্যাম্প কেনারও পয়সা ছিল না। বিয়ারিং চিঠি পাঠালেন তাকে। ততক্ষণে তাঁর কিছু বন্ধুবান্ধব জড়ো হয়েছে, তারা কবিকে ঠান্ডা করার চেষ্টা করতে লাগল।

সপ্তম চিঠিতে বোদলেয়ার লিখছেন, সবাই বলছে, ছেলেমেয়েদের সামনে একজন বৃদ্ধ লোককে চড় মারা একটা নোংরা কাজ। ঠিক আছে, তা আমি করব না, কিন্তু আমার অপমানের জ্বালা মিটবে কীসে? ও যদি ক্ষমা না চায়, আমি ওর বাড়িতে গিয়ে ওর

বউছেলেমেদের সামনে আমি আমার যা মনে আসে বলব। এর পরেও যদি লোকটা আমাকে অপমান করে? বাড়ি থেকে যার করে দেয়? মা, তুমি তোমার ছেলেকে এ কী সাংঘাতিক বিশ্রী অবস্থান ফেললে?

রাগে ফুসতে-ফুসতে এতগুলি চিঠি লেখার ফলে বোদলেয়ার অসুস্থ হয়ে পড়লেন খুব। বিছানায় শুয়ে রইলেন সাত দিন।