[স্বাস্থ্যলাভের জন্য দার্জিলিঙ-এ দুই মাস অবস্থানের পর স্বামীজী নিমন্ত্রিত হইয়া হিমালয়ের আলমোড়া শহরে যান। স্থানীয় জনসাধারণের পক্ষ হইতে তাঁহাকে হিন্দীতে একটি অভিনন্দন প্রদত্ত হয়। উত্তরে স্বামীজী বলেনঃ]
আমাদের পূর্বপুরুষগণ শয়নে-স্বপনে যে-ভূমির বিষয় ধ্যান করিতেন, এই সেই ভূমি—ভারতজননী পার্বতী দেবীর জন্মভূমি। এই সেই পবিত্র ভূমি, যেখানে ভারতের প্রত্যেক যথার্থ সত্যপিপাসু ব্যক্তি জীবন-সন্ধায় আসিয়া ‘শেষ অধ্যায়’ সমাপ্ত করিতে অভিলাষী হয়। এই পবিত্র ভূমির গিরিশিখরে, গভীর গহ্বরে, দ্রুতগামিনী স্রোতস্বতীসমূহের তীরে সেই অপূর্ব তত্ত্বরাশি চিন্তিত হইয়াছিল—যে-তত্ত্বগুলির কণামাত্র বৈদেশিকগণের নিকট হইতেও গভীর শ্রদ্ধা আকর্ষণ করিয়াছে এবং যেগুলিকে যোগ্যতম বিচারকগণ অতুলনীয় বলিয়া নিজেদের মত প্রকাশ করিয়াছেন। এই সেই ভূমি—অতি বাল্যকাল হইতেই আমি যেখানে বাস করিবার কল্পনা করিতেছি এবং তোমরা সকলেই জান, আমি এখানে বাস করিবার জন্য কতবারই না চেষ্টা করিয়াছি; আর যদিও উপযুক্ত সময় না আসায় এবং আমার কর্ম থাকায় আমি এই পবিত্র ভূমি ত্যাগ করিতে বাধ্য হইয়াছি, তথাপি আমার প্রাণের বাসনা—ঋষিগণের প্রাচীন বাসভূমি, দর্শনশাস্ত্রের জন্মভূমি এই পর্বতরাজের ক্রোড়ে আমার জীবনের শেষ দিনগুলি কাটাইব। বন্ধুগণ, সম্ভবতঃ পূর্ব পূর্ব বারের ন্যায় এবারও বিফল-মনোরথ হইব, নির্জন নিস্তব্ধতার মধ্যে অজ্ঞাতভাবে থাকা হয়তো আমার ঘটিবে না, কিন্তু আমি অকপটভাবে প্রার্থনা ও আশা করি, শুধু তাহাই নহে, একরূপ বিশ্বাসও করি যে, জগতের অন্য কোথাও নয়, এইখানেই আমার জীবনের শেষ দিনগুলি কাটিবে।
এই পবিত্র ভূমির অধিবাসিগণ, পাশ্চাত্যদেশে আমার সামান্য কার্যের জন্য তোমরা কৃপা করিয়া আমার যে প্রশংসা করিয়াছ, সেই জন্য তোমাদের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করিতেছি। কিন্তু এখন আমার মন—কি পাশ্চাত্য, কি প্রাচ্য কোন দেশের কার্য-সম্বন্ধে কিছু বলিতে চাহিতেছে না। যতই এই শৈলরাজের শিখরগুলি পর পর নয়নগোচর হইতে লাগিল, ততই আমার কর্মপ্রবৃত্তি—বৎসরের পর বৎসর ধরিয়া আমার মাথায় যে আলোড়ন চলিতেছিল, তাহা যেন শান্ত হইয়া আসিল, এবং আমি কি কাজ করিয়াছি, ভবিষ্যতেই বা আমার কি কাজ করিবার সঙ্কল্প আছে, ঐ-সকল বিষয়ের আলোচনায় না গিয়া এখন আমার মন—হিমালয় অনন্তকাল ধরিয়া যে এক সনাতন সত্য শিক্ষা দিতেছে, যে এক সত্য এই স্থানের হাওয়াতে পর্যন্ত খেলিতেছে, ইহার নদীসমূহের বেগশীল আবর্তে আমি যে এক তত্ত্বের অস্ফুটধ্বনি শুনিতেছি—সেই ত্যাগের দিকে প্রধাবিত হইয়াছে। ‘সর্বং বস্তু ভয়ান্বিতং ভুবি নৃণাং বৈরাগ্যমেবাভয়ম্’—এই জগতে সকল জিনিষই ভয়-যুক্ত, কেবল বৈরাগ্যই ভয়শূন্য।
হ্যাঁ, সত্যই ইহা বৈরাগ্য-ভূমি। এখন আমার মনের ভাবসমূহ বিস্তারিতবাবে বলিবার সময় বা সুযোগ নাই। অতএব উপসংহারে বলিতেছি, এই হিমালয়পর্বত বৈরাগ্য ও ত্যাগের সাকার মূর্তিরূপে দণ্ডায়মান, আর মানবজাতিকে আমরা চিরদিন এই ত্যাগের মহৎ শিক্ষা দিতে থাকিব। যেমন আমাদের পূর্বপুরুষগণ তাঁহাদের জীবনের শেষভাগে এই হিমালয়ের প্রতি আকৃষ্ট হইতেন, সেইরূপ ভবিষ্যতে পৃথিবীর সর্বস্থান হইতে বীরহৃদয় ব্যক্তিগণ এই শৈলরাজের দিকে আকৃষ্ট হইবেন—যখন বিভিন্ন সম্প্রদায়ের বিরোধ ও মতপার্থক্য লোকের স্মৃতিপথ হইতে অন্তর্হিত হইবে, যখন তোমার ধর্মে ও আমার ধর্মে যে বিবাদ, তাহা একেবারে অন্তর্হিত হইবে, যখন মানুষ বুঝিবে, একটি সনাতন ধর্মই বিদ্যমান—সেটি অন্তরে ব্রহ্মানুভুতি, আর যাহা কিছু সব বৃথা। এইরূপ সত্যপিপাসু ব্যক্তিগণ ‘সংসার মায়ামাত্র এবং ঈশ্বর—শুধু ঈশ্বরের উপাসনা ব্যতীত আর সবই বৃথা’, ইহা জানিয়া এখানে আসিবেন।
বন্ধুগণ, তোমরা অনুগ্রহপূর্বক আমার একটি সঙ্কল্পের বিষয় উল্লেখ করিয়াছ। আমার মাথায় এখনও হিমালয়ে একটি কেন্দ্র স্থাপন করিবার সঙ্কল্প আছে; আর অন্যান্য স্থান অপেক্ষা এই স্থানটি এই সার্বভৌম ধর্মশিক্ষার একটি প্রধান কেন্দ্ররূপে কেন নির্বাচিত করিয়াছি, তাহাও সম্ভবতঃ তোমাদিগকে ভালরূপে বুঝাইতে সমর্থ হইয়াছি। এই হিমালয়ের সহিত আমাদের জাতির শ্রেষ্ঠ স্মৃতিসমূহ জড়িত। ভারতের ধর্মেতিহাস হইতে যদি হিমালয়কে বাদ দেওয়া যায়, তবে উহার অতি অল্পই অবশিষ্ট থাকিবে। অতএব এখানে একটি কেন্দ্র চাই-ই চাই, এই কেন্দ্র কর্মপ্রধান হইবে না—এখানে নিস্তব্ধতা শান্তি ও ধ্যানশীলতা অধিক মাত্রায় বিরাজ করিবে, আর আমি আশা করি, একদিন না একদিন আমি ইহা কার্যে পরিণত করিতে পারিব। আরও আশা করি, আমি অন্য সময়ে তোমাদের সহিত মিলিত হইয়া এ-সকল বিষয় আলোচনা করিবার অধিকতর অবকাশ পাইব। এখন তোমরা আমার প্রতি যে সহৃদয় ব্যবহার করিয়াছ, সেজন্য তোমাদিগকে আবার ধন্যবাদ দিতেছি, আর ইহা আমি কেবল আমার প্রতিই ব্যক্তিগত সদয় ব্যবহাররূপে গ্রহণ করিতে চাই না; আমি মনে করি, আমাদের ধর্মের প্রতিনিধি বলিয়াই তোমরা আমার প্রতি এরূপ সহৃদয় ব্যবহার করিয়াছ। প্রার্থনা করি, এই ধর্মভাব তোমাদিগকে যেন পরিত্যাগ না করে। প্রার্থনা করি, এখন আমরা যেরূপ ধর্মভাবে অনুপ্রাণিত, সর্বদা যেন সেই ভাবে থাকিতে পারি।
[স্বামীজী আলমোড়ায় আরও দুইটি বক্তৃতা দেন—একটি স্থানীয় জেলা স্কুলে, অন্যটি ইংলিশ ক্লাবে। জেলা স্কুলে ওজস্বিনী হিন্দী ভাষায় স্বামীজীর বক্তৃতা শুনিয়া শ্রোতৃবর্গ মুগ্ধ হন। ইংলিশ ক্লাবে বক্তৃতার বিষয় ছিলঃ বেদের উপদেশ—তাত্ত্বিক ও ব্যাবহারিক। এই প্রসঙ্গে তিনি উপজাতীয় দেবতা-উপাসনা, বেদ ও আত্মতত্ত্ব প্রভৃতি সম্বন্ধে আলোচনা করেন। স্থানীয় ইংরেজ অধিবাসীরা সভায় উপস্থিত ছিলেন।]